নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
১৯৭২ সালে ‘বুঁড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ নাটকে অভিনয়ের মাধ্যমে মঞ্চে অভিষেক হয় অভিনেত্রী লাকি ইনামের। তারপর টানা ৪৩ বছর ধরে থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। অভিনয়ের পাশাপাশি নাট্যকার, নির্দেশক, সংগীতশিল্পী, নৃত্যশিল্পী এবং সর্বোপরি একজন সফল নাট্যশিক্ষক হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তারই হাত ধরে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি যাত্রা করে নাটকের দল ‘নাগরিক নাট্যাঙ্গন’। সম্প্রতি মানবকণ্ঠের পক্ষ থেকে গুণী এই মানুষটির সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রেজাউর রহমান রিজভী
প্রথমেই জানতে চাই মঞ্চের অবস্থা সম্পর্কে- কী দেখছেন, কেমন দেখছেন?
বাংলাদেশে মঞ্চের সামগ্রিক অবস্থাটা আমি কখনোই নেগেটিভ দেখিনি। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সাল থেকে মঞ্চনাটক নিজেকে ধীরে ধীরে তৈরি করেছে। এই যে অঙ্গনটা নিয়ে সাধারণ ভাবে হয়তো কেউ উক্তি করল, মঞ্চনাটকে দর্শক নেই বা মঞ্চনাটক ভালো হচ্ছে না- এটা খুব সাধারণ একটা কমেন্ট। তবে ওভারঅল আমাদের অগ্রগতি কতটা হয়েছে, আমাদের উত্তোরণ কতটা হয়েছে সেটা দেখতে হবে। আজকে ৪৩ বছরে মঞ্চনাটক কোন জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে সেটা জানা আমাদের প্রয়োজন। সেই এনালাইসিস যদি করতে চাই তবে সামগ্রিকভাবে আমার মন্তব্য, আমরা অনেক দূর এগিয়ে গেছি। আমরা ১৯৭২ সালে বেইলি রোড কেন্দ্রিক থিয়েটার করতাম। সে সময় ছিল মহিলা সমিতি, পরবর্তী সময়ে গাইড হাউস। এ দুটো মঞ্চে আমরা কাজ করেছি। গরমে ঘেঁমেছি। নিজেরা সেট লাগিয়েছি, সেট ভেঙেছি, নিজেরা সেট তুলে দিয়ে ঠেলা গাড়ি করে বাসায় গেছি। অনেক রকমের অনেক ইতিহাস আছে। অনেক কষ্ট আছে, দুঃখ আছে, অনেক পরিশ্রম আছে। আবার অনেক আনন্দও আছে। সেই যে একাগ্রভাবে মঞ্চের পেছনে কাজ করে যাওয়ার বিষয়টা- আমরা কিছু মানুষ করেছি। সেই অবদানে আজকে বাংলাদেশে থিয়েটার আন্তজার্তিক পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে। সকলেই জানেন যে, আইটিআই (ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইনস্টিটিউট)-এর সভাপতি দীর্ঘদিন ছিলেন আমাদের দেশের রামেন্দ্র মজুমদার। আমাদের এখানে ইন্টারন্যাশনাল প্রচুর থিয়েটার এসেছে, এখনো আসছে। এই আন্তর্জাতিকতা চলছেই থিয়েটারে। আমি যদি খুব ছোট করে কোনো কিছু বিচার করি তাহলে হবে না। আমি প্রথমেই যেটা বললাম যে, সামগ্রিকভাবে অগ্রগতিটা দেখতে হবে। সেক্ষেত্রে আমি মনে করি যে, খুব ভালো অবস্থানে আমরা আছি।
কলকাতার থিয়েটারগুলোর সঙ্গে যদি তুলনা করতে বলা হয়, তবে পেশাদারিত্বের মনোভাবটা কি ওদের বেশি, নাকি আমাদের বেশি?
কলকাতার কথা বলতে গেলে আমরা আগে একই দেশ ছিলাম। তারপরে দেশ ভেঙেছে। একটা দেশ থেকে তিনটা দেশ হয়েছে। সেই হিসেবে কলকাতায় যারা থিয়েটার শুরু করেছেন তাদের থিয়েটার কেন্দ্রিক বয়স আমাদের থেকে বেশি, অভিজ্ঞতা বেশি, চর্চা বেশি। আমাদের দেশে আগে আমরা থিয়েটারটাকে খুব সিরিয়াসলি নেইনি। স্বাধীনতা পূর্বকালে কমার্শিয়াল নাটক হতো, একটু বিনোদনমূলক নাটক হতো। থিয়েটারটা হলো একটা মিশ্র আর্ট, সেই মিশ্র আর্টের গুরুত্বটা আমরা পরে বুঝতে পেরেছি। ফলে ছেলে-মেয়েরা যারা গান জানে, নাচ জানে, সুন্দর করে কথা বলতে পারে, কোরিওগ্রাফি জানে, তারাই থিয়েটারের দিকে এসেছে। এই আকর্ষণটা থিয়েটারকে একটা ভালো জায়গায় নিয়ে গেছে। আর কলকাতায় যেটা হলো সেখানে চর্চা চলছেই তো চলছেই। কলকাতায় অনেক মঞ্চ। সে জায়গায় আমরা মঞ্চের সংখ্যার দিক থেকে অনেক পিছিয়ে। তার চেয়ে বড় কথা আমাদের মঞ্চগুলো সব সেন্ট্রালি একই জায়গায়। এতদিন বেইলি রোডে করেছি, এখন গেছি সেগুনবাগিচায়। কিন্তু কলকাতায় কত মঞ্চ। তাদের বিভিন্ন জোনেই মিলনায়তন আছে। আমরাও এবার দল নিয়ে গিয়ে একাধিক জোনে শো করেছি। ফলে সেই জোনে বসবাসকারী বাসিন্দারা নিয়মিত মঞ্চনাটক দেখছে। অথচ আমাদের এখানে অনেক দূর-দূরান্ত থেকে দর্শকরা নাটক দেখতে আসছে। এখন কোনো দর্শক যদি উত্তরা থেকে নাটক দেখতে আসতে চায় তবে তার কষ্ট হবে। এই কষ্টের জন্য দর্শকরা আসছে না। ফলে তারা থিয়েটার চিনবেও না, জানবেও না, বুঝবেও না। কিন্তু উত্তরায় যদি ২/৩টা মিলনায়তন থাকতো, তবে আমরাই গিয়ে সেখানে শো করতাম। তাহলে সেখানকার দর্শকরাও আমাদের নাটক দেখতে আসত।
আমাদের দেশে তো জেলা পর্যায়েও শিল্পকলা আছে। সেখানকার মঞ্চেও তো ইচ্ছা করলে স্থানীয় দলগুলো নাটক মঞ্চস্থ করতে পারে। সে ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
সেটা তো আসলে সরকারের উদ্যোগ নেয়ার বিষয়। একেবারে যে নিচ্ছে না, সেটাও না। তারা উদ্যোগ নিচ্ছেও। তবে স্থানীয় পর্যায়ের মঞ্চগুলোর অ্যাকটিভি খুব একটা নেই। তারা কাজ করছে, কিন্তু অনেক স্লো। তাদের উৎসাহ দিতে হবে। বিশেষ করে আর্থিকভাবে তাদের আরো বেশি সাহায্য করতে হবে। কারণ নাটক করা মানেই তো হল ভাড়া নিতে হয়, লাইট ভাড়া নিতে হয়, মেকআপম্যান নিতে হয়। এরপর নাটকটি দেখতে দর্শকরা যে টাকা দিয়ে টিকিট কাটে সেটা খুবই সামান্য। এই অর্থ দিয়ে তো একটা দলের চলাই কঠিন।
মঞ্চনাটকে আপনার সফলতার মূলমন্ত্র কি?
এখানে অনেক সেক্রিফাইস করতে হয়। আমি নিজেও টিভি মিডিয়া থেকে নিজেকে দূরে রাখি কেবল মঞ্চে অধিক সময় দেয়ার জন্য। আমি যদি টিভি নাটকে অভিনয় করি, তবে দিনে ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা আয় করতে পারব। আবার আমি যদি নাটক পরিচালনা করি, তবে সেখানেও আমি পরিচালনা বাবদ অর্থ আয় করতে পারব। কিন্তু সেখানে তো আমাকে সকাল থেকে রাত অবধি সময় দিতে হবে। ফলে মঞ্চনাটকে পরিপূর্ণভাবে কাজ করা যাবে না। একারণে নিজের লাভের বিষয়টাকেও ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা থাকতে হবে। আমার প্রথম থেকেই ছেড়ে দেয়ার মানসিকতা ছিল এবং এখনো আছে। থিয়েটারে পুরো সময় দিতে হবে। আমার তো পুরো বাসা জুড়েই থিয়েটারের জিনিসপত্র ছড়ানো। সারাক্ষণ থিয়েটারের সঙ্গেই বসবাস করি। আরেকটা কারণ সকলেই জানেন, আমার জীবন সঙ্গী ড. ইনামুল হক, যিনি ১৯৭২ সালে আমাদের বিয়ের পর থেকে আজ অবধি সর্বক্ষণই আমাকে থিয়েটারে কাজ করতে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছেন। এছাড়া আমার পরিবারের সকলেই মঞ্চের সঙ্গে জড়িত। আমার মেয়ে হৃদি হক নাটক পরিচালনা করে। আমি তার পরিচালনাতেও কাজ করেছি।
বলা হয়ে থাকে, এখন তরুণরা মঞ্চবিমুখ। এ সম্পর্কে আপনি কী ভাবছেন?
এটা আসলেই একটু চিন্তার বিষয়। এখনকার তরুণদের মঞ্চে কাজের চেয়ে টেলিভিশন মিডিয়ায় কাজের আগ্রহটা বেশি। আমার থিয়েটার শেখার স্কুলেও যে সব তরুণরা আসে তারাও আমাকে জিজ্ঞেস করে এখানে কোর্স করে তারা মিডিয়ায় কাজ করতে পারবে কী না। আমি বলি, থিয়েটার স্কুলে আমরা যা শেখাই তার পুরোটাই তো মিডিয়াতে কাজ করতে গেলে প্রয়োজন হবে। সুন্দর বাচন ভঙ্গি, অভিনয়, জড়তাহীনভাবে নিজেকে উপস্থাপন করা- এসবই তো যে কোনো মিডিয়াতে কাজের ক্ষেত্রেই জরুরি। সুতরাং টিভি নাটকেও যে কেউ ইচ্ছা করলে কাজ করতে পারে। আমি তাদের বাধা দেই না। বরং, টিভি নাটকেও কাজের জন্য স্কুলিংটা জরুরি।
আমাদের দেশের টিভি নাটক সম্পর্কে বলুন।
ইদানীং অনেক টিভি নাটকেই যাদের অভিনয় করতে দেখি তাদের বাচন ভঙ্গি ভালো না। উচ্চারণ শুদ্ধ না। আবার অনেক নাটকে তো দেদার আঞ্চলিকতার প্রয়োগ করা হচ্ছে। ভালো নাটকের মানদণ্ডে এগুলো কেমন সেটি দেখা ছাড়াও আগে দেখতে হবে আমাদের দর্শকরা সে সব নাটক গ্রহণ করছে কী না। অনেকেই বলে কলকাতার নাটক দেখা যাবে না। কিন্তু সন্ধ্যার পর প্রায় সব বাড়িতেই তো কলকাতার সিরিয়াল চলে। সেগুলো তো চাইলেই আর বন্ধ করা যাবে না। কলকাতার অনেক আর্টিস্টদের চেয়ে আমাদের আর্টিস্টদের কোয়ালিটি অনেক ভালো। সুতরাং ভালো নাটক তৈরির বিষয়টি নিয়ে যত্মবান হয়া উচিত।
আমাদের দেশের মঞ্চনাটকগুলো হয়ে গেছে উৎসব কেন্দ্রিক। উৎসব ছাড়া মঞ্চনাটক দেখার জন্য তেমন একটা দর্শক পাওয়া যায় না। এ বিষয়ের উত্তোরণে আপনার মন্তব্য কী?
সবার আগে দলগুলোকে স্ট্রং হতে হবে। দল যদি কনফিডেন্টি নাটকের শো করতে পারে তবে দর্শক আসবে। রাষ্ট্রীয়ভাবে মঞ্চ নাটকের পৃষ্টপোষকতাও জরুরি। দলগুলো যদি শিল্পকলার অনুদান পায়, যেমন- হলগুলোর ভাড়া যদি কমিয়ে দেয়া হয়, থিয়েটারের ছেলে-মেয়েগুলোকে যদি ন্যূনতম যাতায়াত ভাড়া দেয়া সম্ভব হয়, তবে আমার মনে হয় দলগুলো নিয়মিত থিয়েটারে কাজ করতে আগ্রহী ও উৎসাহিত বোধ করবে। এছাড়া আগেই যেটা বলেছি, বিভিন্ন এলাকাভিত্তিক মিলনায়তন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ- ধানমণ্ডি বা গুলশানে যদি কোনো মিলনায়তন থাকত তবে তাতে যদি কোন দল নাটক পরিবেশন করে তবে সেখানকার মানুষরা টিকিটের মূল্য বেশি হলেও দেখতে আসত।
নতুন মিলনায়তন তৈরি করতে বেসরকারি পর্যায়ে কেউ এগিয়ে আসছেন না কেন?
আমার মনে হয় বেসরকারি পর্যায়ে কেউ এগিয়ে না আসার কারণ হলো তাদের জানা ও বোঝার অভাব। কিছুদিন আগে আমি উত্তরায় একটি বড় কন্ট্রাকশনের মালিকের সঙ্গে কথা বলেছিলাম। তাকে বললাম, আপনার এত বড় বড় ফ্লোর। আপনি তো ইচ্ছা করলেই একটি হলো করতে পারেন। এখানকার বাসিন্দারা সেখানে মঞ্চনাটকও দেখতে পারবে আবার ইচ্ছা করলে আপনি সিনেমাও চালাতে পারবেন। তিনি তখন চিন্তিত মুখে বলেন, চলবে তো? আমি তাকে বলি বসুন্ধরার সিনেপ্লেক্স কি কখনো খালি যেতে দেখেছেন নাকি? আমি চেষ্টা করলাম তাকে কনভিন্স করলাম। কিন্তু তিনি মানলেন না। রাজধানীতে এত বড় বড় মার্কেট হচ্ছে, কিন্তু কোনো মার্কেটেই কোনো প্রকার হলো বা সিনেপ্লেক্স তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয় না। আসলে ব্যক্তি নিজে যতক্ষণ না উদ্যোগী হবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তাকে দিয়ে কেউ কিছু করাতে পারবে না। আবার বেসরকারি বড় বড় ব্যাংক বা প্রতিষ্ঠানগুলোও কিন্তু সেভাবে মঞ্চের প্রতি আগ্রহী হচ্ছেন না। তারা ভিজ্যুয়াল মিডিয়াতেই স্পন্সর করতে বেশি আগ্রহ। এরা যদি মঞ্চের প্রতি এর খানিকটা আগ্রহী হতো তবে মঞ্চের অবস্থা আরো অনেক ভালো হতো।
[মানবকণ্ঠের ঈদ সংখ্যা-২০১৫ তে প্রকাশিত]
©somewhere in net ltd.