![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শেষ দুবারের প্রথমবার যখন দেখেছিলাম তাকে, তার চোখ গুলো বড্ড লাল ছিল। চুলের রং ও কেমন যেন লালচে হয়ে গিয়েছিল। দূর থেকে তাকে দেখেই চিনতে পারলাম, সামনে গেলাম। দেখলাম একটা নেভানো সিগারেট সে বারবার করে খাওয়ার মতন করে ভান করছে। দৃষ্টি উদাস ছিল, দেখে মনে হচ্ছিল মন খারাপ। জিজ্ঞেস করলাম,"কিহে বন্ধু সিগারেট এমন নেভানো কেন?আর মন খারাপ বুঝি?" মনে হল প্রথমবার শুনতে পায়নি, তার গায়ে আলতো করে ধাক্কা দিয়ে আবার বললাম। তার উত্তর ছিল কিছুটা আনমনা, "টাকা নেইতো তাই, আর মন খারাপ তো নয়"। বুঝলাম মন খারাপ,"প্রেয়সীর সাথে ঝগড়া বুঝি?" সে বলল-হুঁ। কেন জিজ্ঞেস করলে সে বলতে পারলনা। সে আমতা আমতা করে কি যেন বলল বিড়াল নিয়ে একটা কাহিনী বলল, তার কাহিনী বানানোর ক্ষমতা ভাল হলেও বুঝলাম সে মিথ্যে বলছে,তবুও ঘাটালাম না।বলবার হলে বলে দিত, অন্তত আমাকে তো বলতই।
কদিন পর জানতে পেরেছিলাম তার বাবার নাকি কি একটা কঠিন অসুখ হয়েছিল, এখন পুরোপুরি বিছানায়। তাই বোধহয় তার ওমন পাগল দশা হয়েছিল!
ছেলেটা বড় প্রতিভাবান ছিল। ছোট ক্লাসগুলোতে বড়াবড়ই ফার্স্ট সেকণ্ড হত, বড় ক্লাসেও ভাল করত। মেট্রিক ইন্টারে নাকি বৃত্তিও পেল। হাতের লেখার মত লেখার হাতও ছিল চমৎকার! অনেক সুন্দর করে গোটা গোটা অক্ষরে মনের কথা গুলো লিখতে পারত। আমাদের কত বন্ধু যে তার কাছে প্রেমপত্র লিখে নিয়ে গেল! প্রেমে সাফল্যও পেয়েছিল বৈকি! তবে সুতোটা কেমন যেন কেঁটে গেল ভার্সিটিতে এসে। জানিনা সেটা কি ছিল, যৌবনের নতুন প্রেমের ফল, নাকি তার কবি মনের জাগরণ, মাঝে মাঝেই সে বলত পড়ালেখা বাদ দিয়ে লেখালেখি শুরু করবে সে, নাকি পারিবারিক সমস্যা। শুনেছিলাম তাদের পরিবারে যেন কি এক সমস্যা আছে, সে কাউকে তা কখনও বলেনি। ভার্সিটিতে এসে তার বিপথে যাবার কথা বুঝেছিলাম এভাবে- স্কুল কলেজে থাকতে সবসময়ই তার নোটখাতা থেকে পড়তাম আমি। তার লেখা ছিল সুন্দর আবার লিখতও সহজ ভাষায়। এই লেখার গুণটি মনে হয় ওর জন্মগত। ও যে খুব বেশি বই পড়ত তাও কিন্তু নয়। সে যাই হোক, ভার্সিটি প্রথম বর্ষের বার্ষিকের সময় তার খাতা আনলাম, এনে দেখি সেখানে গণিত, পদার্থ তো লেখা নেইই, বরং কি সব কবিতা লেখা, তাও খাপছাড়া। বুঝেছিলাম কোন সমস্যাতো আছেই। এবং বার্ষিকে তার অকৃতকার্য হওয়াও আমার জন্যে অবাক করা ছিলনা।
ও সেদিন সে আমার কাছে একটা জিনিস চেয়েছিল প্রথমবারের মত। তার কাছে বসে থেকে কোন প্রশ্নেরই সদুত্তর না পেয়ে উঠে আসছিলাম, সে বলল -আমাকে একটা জিনিস দেবে? -বল কি জিনিস -এক পাল হতাশ মানুষ দেবে আমাকে? ভাবলাম সে কবি মানুষ হয়ত হতাশদের জাগিয়ে তুলতে দু একখানা কবিতা টবিতা লিখবে তাই জিজ্ঞেস করলাম,"কি করবে?কবিতা লিখবে নাকি?" তার উত্তরটা ছিল এমন-"নাহ! বরং কবিতা হয়ে তাদের সাথে মিশে যাব"। এ কথা শুনে চলে আসছিলাম। সে বললা, "দিতে পারবেনা তো?যাবার আগে একটা সিগারেট কিনে দিতে পারবে?তখন ফিরে আসবার আগে অবশ্য একটা গোল্ডলিফ কিনে দিয়ে আসলাম। এরপর দেখা হয়নি বহুদিন। শুনেছিলাম তার নাকি কি মাথার ব্যামো!উলট পালট কথা বলে! কাউকে চিনতে পারেনা।
এরপর হঠাৎ একদিন রাস্তায় দেখা। এতদিন যা শুনেছিলাম তা এবার নিজ চোখে দেখলাম, সে রাস্তায় দৌড়াদৌড়ি-লাফালাফি করছে। আমাকে দেখে অবশ্য চিনতে পারল। আমাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল-"বন্ধু আমাকে একটি জিনিস দেবে?" কি জিনিস বলার আগেই সে বলল, "এক পাল হতাশ মানুষ ও একটি সিগারেট"। এরপর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই দৌড়ে চলে গেল।
এরপর একদিন শুনি তার নাকি কোন খোঁজ খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। ভাবলাম আগে তার বাসায় তো অনেকবার গিয়েছি এখন গিয়ে একবার খালাম্মার(তার মাকে খালাম্মা ডাকতাম) সাথে কথা বলে আসি। গেলাম, তারা বাসার অবস্থা আসলেই অনেক খারাপ, এরই মাঝে আবার স্বামী বিছানায় আবার ছেলে নিখোজ, মহিলা বড় কষ্টে আছেন বোঝা যাচ্ছিল। তিনি আমাকে শুধু তার রেখে যাওয়া একটা ময়লা ডায়েরী আমাকে দিলেন। তিনি জানতেন তার সমস্ত গুপ্ত জিনিস জানবার অধিকার আমার ছিল। দেখলাম ডায়েরীতে একটা উপন্যাস লেখা, পুরো শেষ করা না, সে মনে হয় এক জায়গায় এসে আটকে গিয়েছিল। দেখলাম পরপর অনেকগুলো পৃষ্ঠা কাঁটা, অনেকগুলো আবার গোড়া থেকে ছিড়ে ফেলা।পৃষ্ঠায় সিগারেটের ছাইও দেখা যাচ্ছিল কিছু। উপন্যাসটি ছিল তার আশেপাশের দেখা হতাশ মানুষদের নিয়ে। সে শেষ করতে পারেনি অবশ্য। অনেকগুলো পৃষ্ঠা পর এক পৃষ্ঠায় লেখা দেখলাম, "আমি কিছুতেই উপন্যাসের পরের লাইনে যেতে পারছিনা, নিরুদ্দেশ হচ্ছি, যেদিন পরের লাইনে যেতে পারব সেদিন ফিরে আসব। ও যাবার সময় তোমার দেওয়া একটা সিগারেট নিয়ে যাচ্ছি"। সে হয়ত আগে থেকেই জানত তার ডায়েরীটা আমার হাতে এসেই পড়বে। তার উপন্যাস শেষ হয়নি কে বলল? এর চেয়ে মর্মস্পর্শী সমাপ্তি আমি কোন উপন্যাসে দেখিনি। কোনদিন মনে হয়না দেখব। আমি তার উপন্যাসের একটা নাম দিয়ে দিলাম। নামটি ছিল- "একপাল হতাশ মানুষ ও একটি সিগারেট"।
©somewhere in net ltd.