নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালনঃ আইন ও জীবন

২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ দুপুর ১:৫৮

আমাদের দেহে বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ রয়েছে । সেই সাথে আছে অসংখ্য শিরা-উপশিরা বা রক্তবহা-নাড়ি (Blood-vessel )। এই রক্তবহা-নাড়িগুলি বিভিন্ন আকৃতি ও ব্যাস বিশিষ্ট , এর অনেকগুলো সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম। এই রক্তবহা-নাড়িগুলি ধমনীর সাথে সংশ্লিষ্ট অঙ্গের সংযোগ সাধন করেছে। এই রক্তবহা-নাড়ি দিয়ে প্রবাহিত তরল পদার্থই হচ্ছে রক্ত। রক্তে রয়েছে প্লাজমা এবং শ্বেত-কণিকা , লোহিত-কণিকা ও অনুচক্রিকা বা প্লাটিলেট । শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে আমরা বাতাস থেকে অক্সিজেন গ্রহণ করি। শ্বাস-প্রশ্বাসের কারণেই আমাদের হৃদ-যন্ত্র প্রতিনিয়ত সংকুচিত ও প্রসারিত হয়। এরই মাধ্যমে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত হৃদযন্ত্র থেকে উক্ত রক্তবহা-নাড়ি দিয়ে চলাচল করে এবং অন্যত্র প্রবাহিত হয়। এই প্রক্রিয়ার এতটুকু হের ফের হলে আমাদের জীবন হয়ে পড়ে বিপন্ন। কোন কারণে রক্ত দুষিত হলে অথবা দেহে প্রয়োজনীয় রক্ত কমে গেলে অথবা দেহ রক্তশূণ্য হয়ে গেলে আমরা অসুস্থ হয়ে পড়ি ; যথাযথ চিকিৎসা না হলে মানুষ ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। তাই এরূপ পরিস্থিতিতে এইরূপ অসুস্থ রোগীর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালনের প্রয়োজন হয়। আমাদের দেশে চিকিৎসা প্রার্থী রোগীকে নানাভাবে প্রতারিত ও অহেতুক খরচান্ত করা হয়। রোগীর চিকিৎসা প্রার্থনাকে গণ্য করা হয় পণ্যরূপে। যেখানে এই রোগী জীবন মরণ সংকটাপন্ন অবস্থায় উপনীত হয় , সেখানে এহেন ব্যবসা জমজমাট। এর একটি বড় ক্ষেত্র রক্ত পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা। তাই চিকিৎসার প্রয়োজনে নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ , সংরক্ষণ এবং রোগীর দেহে পরিসঞ্চালন ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণকল্পে ‘নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন আইন,২০০২’ প্রবর্তিত হয়। এই আইন ২০০২ সনের ১০ই এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।

এই আইন অনুসারে অনুমোদিত ব্যক্তি অনুমোদিত পদ্ধতিতে নিরীক্ষিত রক্ত অনুমোদিত পদ্ধতিতে সংগ্রহ ও পরিসঞ্চালন করতে পারবেন। রক্ত বলতে এক্ষেত্রে পরিপূর্ন মানব রক্ত বুঝতে হবে। ডাক্তার কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন চিকিৎসা প্রদানকালে প্রদেয় রোগীর বা রক্ত গ্রহীতার রক্তের সঠিক চাহিদা , রক্তের উপাদানের প্রকৃতি , রোগী বা রক্ত গ্রহীতার বিদ্যমান শারীরিক অবস্থা এবং রক্ত পরিসঞ্চালনের ধরণ বা পদ্ধতি ব্যবস্থাপত্রে সুস্পষ্ট ও সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করতে হবে।

এমবিবিএস বা সমমানের ডিগ্রিধারী এবং রক্ত পরিসঞ্চালন মেডিসিন বিষয়ে ডিপ্লোমা ডিবিএসএন্ডটি, এমটিএম, এমডি, পিএইচডি ডিগ্রীপ্রাপ্ত ডাক্তারগণ ‘রক্ত পরিসঞ্চালন বিশেষঞ্জ’ বলে বিবেচিত হবেন। এই বিশেষঞ্জদের নিয়ে সরকার এক বা একাধিক বিশেষঞ্জ কমিটি গঠন করবেন এবং তাদের দায়িত্ব ও ক্ষমতা নির্দিষ্ট করে দেবেন।

স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রীর সভাপতিত্বে একুশ সদস্য বিশিষ্ট ‘জাতীয় নিরাপদ রক্ত পরিসঞ্চালন কাউন্সিল’ রয়েছে। এতদ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রণয়ন ও উদ্ভূত আনুষঙ্গিক বিষয়ে সরকারকে পরামর্শ প্রদান এই কাউন্সিলের দায়িত্ব ও কর্তব্য। সভাপতি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ও স্থানে কাউন্সিলের সভা অনুষ্ঠিত হবে।

রক্তদান হবে সেবা মূলক। ‘হিউম্যান ইমিউনো ডিফিসিয়েন্সি ভাইরাস অর্থাৎ এইচ আই ভি ’ , ‘হেপাটাইটিস বি ভাইরাস’, ‘হেপাটাইটিস সি ভাইরাস’, ম্যালেরিয়া ও সিফিলিসসহ সর্বপ্রকার রক্ত বাহিত রোগ থেকে মানব দেহকে রক্ষার জন্য ; নিরাপদ রক্ত সংগ্রহ , সংরক্ষণ ও পরিসঞ্চালনের পদ্ধতি নির্ধারণ ; রক্তদাতাদেরকে স্বেচ্ছায় রক্তদান , স্বজনকে রক্তদান এবং রক্তের বিনিময়ে রক্তদানকে উৎসাহিত করা ; পেশাদার রক্তদাতাদেরকে রক্তদানে পর্যায়ক্রমে নিরুৎসাহিত করার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের দায়িত্ব উক্ত কাউন্সিলের। এই কাউন্সিল কর্তৃক প্রণীত নীতিমালার ভিত্তিতে বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র নিয়ন্ত্রিত ; রক্তদাতাদের পরিসংখ্যান সংরক্ষিত ও সরকারী হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র পরিচালিত হয়ে থাকে।

লাইসেন্স ব্যতীত বেসরকারী রক্ত পরিসঞ্চালন কেন্দ্র স্থাপন ও পরিচালনা ; ভুল ব্যবস্থাপত্র প্রদান ; অননুমোদিত পদ্ধতিতে রক্ত পরিসঞ্চালন ; বিনষ্টযোগ্য উপকরণ বিনষ্ট না করা এবং তা পুনরায় ব্যবহার করা ; অনিরীক্ষিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা ; অননুামোদিত উপায়ে রক্ত , রক্তের উপাদান ও রক্তজাত সামগ্রী সংগ্রহ , উৎপাদন ও বিতরণ করা ; অননুমোদিত ব্যক্তি কর্তৃক রক্ত পরিসঞ্চালন করা ; রক্তদাতার ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করা এবং অতিরিক্ত সেবা ফিস আদায় করা এই আইন অনুসারে দন্ডনীয় অপরাধ। উল্লিখিত অপরাধ সমূহের যে কোন একটি বা একাধিক অপরাধ সংঘটনের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচার অন্তে দোষী সাব্যস্ত হলে সশ্রম করাদন্ড অথবা জরিমানা অথবা ঊভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। এই আইনের অধীনে সংঘটিত সকল অপরাধ অআমলযোগ্য (Non-cognizable ) , জামিনযোগ্য , আপোষযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। মামলা দায়ের করতে হবে বিচারিক ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে। এই আইন অনুসারে কৃত অপরাধের বিচারের জন্য মামলা করতে পারবেন ক) স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক এবং তার অবর্তমানে মহা-পরিচালকের দায়িত্ব পালনরত কোন কর্মকর্তা অথবা তার কাছ থেকে ক্ষমতাপ্রাপ্ত কোন কর্মকর্তা এবং খ) ক্ষতিগ্রস্থ কোন ব্যক্তি বা তার প্রতিনিধি। এরা ছাড়া আর কেউ এসব বিষয়ে মামলা দায়ের করতে পারবে না। অভিযোগ দায়ের করতে হবে লিখিতভাবে।

প্রতিনিয়তই আমরা দেখতে পাই হাসপাতালগুলোতে পেশাজীবী রক্ত দাতাদের ভিড়। এদের অনেকেই নেশাগ্রস্থ অথবা অত্যন্ত দরিদ্র। অনেকে বিশ্বাস করেন যে নেশার অর্থ সংগ্রহের জন্যই এরা রক্ত বিক্রয় করে। দরিদ্র লোকেরা রক্ত বিক্রয় করে ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য। এটা আমাদের সমাজের এক করুন বাস্তব চিত্র। শল্য চিকিৎসার সময় , প্রসুতির প্রসব কালীন সময় , দুর্ঘটনায় পতিত ব্যক্তির চিকিৎসার সময় , রক্ত শূণ্য রোগীর চিকিৎসার সময় সহ বহুবিধ চিকিৎসায় রোগীর দেহে রক্ত পরিসঞ্চালন করার প্রয়োজন হয়ে পড়ে। অনেক সময় জরুরী ভিত্তিতে রক্তের দরকার হয় , এরূপ অবস্থায় রোগীর স্বজনেরা হয়ে পড়ে অসহায় ও দিশেহারা। এরূপ পরিস্থিতির সুযোগ অনেকে নিয়ে থাকে। ফলে রোগীর স্বজনেরা প্রতারিত হয় , রোগীর জীবন হয় বিপন্ন। এরূপ অভিযোগ প্রায়ই শোনা যায়। আইনগতভাবে প্রতিকারের বিধান থাকলেও অনেক সময়ই এর যথার্থ প্রয়োগ হয় না। তাই আইনের যথার্থ প্রয়োগের জন্য আন্তরিকতা , দৃঢ়তা ও মানবতার বিষয়ে আপোষহীন মনোভাব সম্পন্ন চৌকশ বিশেষঞ্জ ও কর্মকর্তার প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য। নতুবা চিকিৎসার এই ক্ষেত্রে রোগী ও তাদের স্বজনদের ক্ষোভ ও হাহাকার চলতেই থাকবে , যা শান্তিপূর্ণ জীবনের জন্য কখনোই কাম্য নয়।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে এ্যাডভোকেট , বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট , হাইকোর্ট বিভাগ, ঢাকা এবং বে-সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক। [email protected]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.