নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

রোমেল রহমান এর ব্লগ

রোমেল রহমান

রোমেল রহমান › বিস্তারিত পোস্টঃ

সেকালের স্মৃতিকথা----আমাদের ঐতিহ্য

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৫১

পদ্মা-যমুনা বিধৌত পাবনা জেলা । এই জেলা শহরের বুক চিরে বয়ে চলেছে ইছমতি নদী। দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হতে হতে আটুয়া পাড় হয়ে সাধু পাড়ার কাছে এসে পূর্ব দিকে বাঁক নিয়েছে। নদীর দক্ষিণে সাধু পাড়া এবং পূর্ব ও উত্তর পাড়ে কাচারী পাড়া মহল্লা। এই বাঁকে কাচারী পাড়া মহল্লায় বিশাল এলাকা নিয়ে সুদর্শন দোতালা বাড়ি। নাম ‘ রিভার ভিউ’। এই বাড়িতেই বাস করেন শিক্ষাবিদ সদর উদ্দিন আহমেদ। সারা শহরে সর্বস্তরের মানুষের কাছে তিনি ‘হেড মাষ্টার সাহেব’ নামেই পরিচিত। তিনি ছিলেন আমার নানী উমদাতুন নেছার ফুফা। সেই সূত্রে আমাদের ‘বড় আব্বা’। তিনি আমাদের কাছে ‘মাষ্টার বড় আব্বা’ বলেই সমধিক পরিচিত ছিলেন। আমাদের কৈশরে তিনি ছিলেন বৃদ্ধ , কিন্তু সুঠাম দেহের অধিকারী। তাঁর কন্ঠস্বর, পদচারণা , চিন্তা চেতনায় কখনো বার্ধক্যের ছোঁয়া আমরা অনুভব করিনি। পরাধীন দেশে জন্মগ্রহণকারী এই স্বাধীনচেতা মানুষ প্রাণভরে ভালবাসতেন দেশের মানুষকে। চিন্তা করতেন দেশের মানুষের কল্যাণের বিষয় নিয়ে, তাদের সেবায় আত্মনিয়োগ করার বিষয়ে। তিনি চেয়েছেন তাঁর পরবতী প্রজন্মও এইভাবে কাজ করে যাবে। তাঁর জীবন কথায় তাঁর এই চিন্তা-চেতনার কথাই ফুটে উঠেছে। তাঁর কাছ থেকে শুনে তা লিখে নিয়েছেন তাঁর পুত্র ডাঃ সাঈদ হায়দার। তার সাথে নিজের কথায় ব্যাখ্যা করেছেন ডাঃ হায়দার (আমাদের ‘নান্নু নানা)। এই শ্রুতি লিখনের উদ্দেশ্য ছিল জীবনকথা লিপিবদ্ধ করে তা বই আকারে প্রকাশ করা। সময় মতো না হলেও সম্প্রতি বইটি প্রকাশিত হয়েছে। ‘শিক্ষাবিদ সদরউদ্দিন আহমেদের জীবনকথা তাঁর কথায় , আমার কথায়’ বইয়ে ‘মাস্টার বড় আব্বা’র চিন্তা চেতনা এবং এদেশের ইতিহাসের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা প্রকাশিত হয়েছে। বইটিতে তাঁর জীবনের নানা বিচিত্র ঘটনার ইতিবৃত্তসহ ‘সমসাময়িক রাজনীতি , শিক্ষা, সমাজ ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ঘটনাবলী’ সাবলীলভাবে অকপটে বর্ণিত হয়েছে। তিনি ‘সিপাহী বিদ্রোহ’এর একুশ বৎসর পর অর্থাৎ ১৮৭৮ (এক হাজার আট শত আটাত্তর) সালে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ইংরেজদের তখন জয়জয়াকার। তাঁর নিজের পূর্বপুরুষেরাও বিভিন্নভাবে বিদেশী শাসকদের দ্বারা নিগৃহিত হয়েছেন, তাদেরকে একাধিকবার এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায় বসতি স্থাপন করতে হয়েছে। এইরূপ পরিবেশে এই মেধাবী সন্তান বড় হয়েছেন। তিনি দেশ ও রাজনীতি সচেতন ছিলেন, তবে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ গ্রহণ করেন নাই। দেশের জনগণের প্রতি ছিল তাঁর অদম্য মমত্ববোধ। তাঁর এই চেতনার প্রকাশ ঘটেছে তাঁর পুত্র ডাঃ সাঈদ হায়দারের তাঁর কথোপকথনের মধ্যে। তিনি তাঁর আত্মকথা বলতে গিয়ে পুত্রকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘ ভেবেছিলাম ডাক্তার হয়ে তুই গ্রামে না হোক পাবনা শহরে প্র্যাকটিস করবি, আমি তোকে বললাম পাবনা শহরে একটা জমি কিনে ডিসপেনসারি কর, আমি থাকতে থাকতে Ñ যাতে আমি সহায়তাও করতে পারব, তুই শুনলি না । ঢুকে পড়লি চাকুরীতে । ...... আমি যে আশা নিয়ে তোকে ডাক্তারি পড়বার জন্য উৎসাহ দিতাম তা সফল হলো না ------- তুই যদি গ্রামে প্র্যাকটিস করতিস তবে গ্রামের দুঃখী মানুষরা উপকৃত হতো। তোকে ভক্তি করতো, ভালবাসতো....।.... নিজের জন্মস্থানের , নিজের গ্রামের , নিজের শহরের মানুষ যে যে কত আপনার হয় তা তুই ততটা বুঝবি না।.... সে দিনের কথা তোর মনে আছে Ñ যেদিন আমি মেডিকেল কলেজে তোর ভর্তির জন্য নির্বচিত হওয়ার চিঠিটা নিয়ে কলকাতায় ছুটে গিয়েছিলাম ? সেদিন কিন্তু একটা দূরবর্তী সম্ভাব্য আশাপূরণের ভবিষ্যৎ ছবি দেখতে পেয়েছিলাম। সে ছবি কেবল ছবিই থেকে গেছে ------’।

এই কথার সূত্র খুজতে গিয়ে দেখা যায় যে ডাঃ সাঈদ হায়দার পাবনা এডওয়ার্ড মহাবিদ্যালয় থেকে আইএসসি পাশ করে কলকাতায় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়নবিদ্যায় সম্মান শ্রেণীতে ভর্তি হন। সে ১৯৪৪ সালের কথা। কলকাতা মেডিকেল কলেজেও তিনি ভর্তির আবেদন করেন। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ শেষে মানুষের মধ্যে শান্তি ফিরে আসে। এইরূপ এক সকালে শিক্ষাবিদ সদরউদ্দীন আহমেদ কলকাতায় বানু ম্যানসনে বসবাসকারী তাঁর শ্যালক মেজর ডাঃ মোফাজ্জল হোসেনের বাসায় হাজির হন। ডাঃ সাঈদ হায়দার তার মামার এই বাসাতেই থাকতেন। সাতসকালে শিক্ষাবিদ পিতাকে দেখে ডাঃ সাঈদ একাধারে বিস্মিত ও উৎকন্ঠিত হন। বাড়ির সবাই সদরউদ্দিন আহমেদকে ঘিরে ধরে কুশল জানতে চাইলো। খুশি মনে শিক্ষাবিদ বললেন,“ খবর সব ভালো, মেডিকেল কলেজে ‘ নাননু’ ভর্তির জন্য নির্বাচিত হয়েছে; চিঠিটা মেডিকেল কলেজ থেকে পাবনার স্থায়ী ঠিকানায় পাঠানো হয়েছে। সময় কম ছিল বলে আমি নিজেই নিয়ে এলাম।” ভর্তিচ্ছু অপেক্ষমান ছাত্রদের নামের তালিকা থেকে কর্তৃপক্ষ ডাঃ সাঈদ হায়দারকে ভর্তির জন্য মনোনীত করায় তাঁর ছাত্রজীবনের মোড় ঘুরে যায়। পুত্রের স্বাবলম্বী পেশায় ঢোকার পথ নিষ্কন্টক হওয়াতে শিক্ষাবিদ পিতা আনন্দিত হয়েছিলেন। সেই সাথে তাঁর সুপ্ত বাসনা ছিলো পুত্র চিকিৎসক হয়ে নিজ জেলার সাধারণ মানুষের সেবা করবে। তাঁর সে বাসনা পূরণ না হওয়াবে জীবনকথা বলার সময় খেদ ও আক্ষেপ প্রকাশ করেছিলেন। এটাই ছিল এদেশের শিক্ষিত মেধাবী সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। তা পূরণ হওয়া দূরের কথা বাংলাদেশের নাগরিকেরা একে একে দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ডাঃ সাঈদ হায়দারের মতে ‘বেকারত্ব অবসান, নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ , পরবর্তী প্রজন্মের উচ্চতর ও শ্রেষ্ঠতর শিক্ষায় শিক্ষিত করার সুযোগ লাভ Ñ এ সবই বিদেশে অভিবাসন করার কারণ।’ শিক্ষাবিদ আহমেদের সাত ছেলে মেয়ের অধিকাংশের পরবর্তী প্রজন্ম দেশ ছেড়ে বিদেশে অভিবাসী হয়েছেন। যদিও ‘ এদের সবারই ঢাকায় নিজেদের ছোট-বড় বাড়ি আছে : জীবনে আরও স্বচ্ছলতা আনতে , নিজেদের জ্ঞানকে ভালোভাবে কাজে লাগানোর অভিপ্রায়ে এবং অধিকতর নিরাপত্তার মাঝে নিরুপদ্রব জীবন যাপনের আশাতেই তারা প্রিয় মাতৃভ’মি ছেড়ে বিদেশে চলে গেছে। এদের পরবর্তী প্রজন্ম আর কোন দিনই এদেশে বাস করতে ফিরবে না। এটাই বাস্তব ।’ ডাঃ সাঈদ হায়দার আক্ষেপের সাথে তাঁর ভাগিনার প্রসঙ্গ টেনে বলেন,“ ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের কালিনারায়ণ স্কলার বুবুর ছেলে পরমাণু বিজ্ঞানী ডা. ফরহাদ এইচ ফয়সল খোকন ৭ বছর ‘নাসা’তে কাজ করে দেশে কাজ করার কোন কোন পরিবেশ বা প্রতিষ্ঠান না পেয়ে পুনরায় দেশ ত্যাগ করে জার্মানীতে অভিবাসী হতে বাধ্য হয়েছে।” শুধু মেধাবী ও সদবংশীয়রাই নয়, দারিদ্রপীড়িত সাধারণ মানুষেরাও আজ দেশ ত্যাগ করছে। মহাসাগরে, অভিবাসী শিবিরে , বিদেশের গহীন জংগলের গণ-কবরে তাদের দেখা/সন্ধান মিলছে। দেশ স্বাধীন করে জনগণের বসবাসের উপযোগী পরিবেশ আমরা তৈরী করতে ব্যর্থ হয়েছি। ১৯৭২ সালের ১১ ই জানুয়ারীতে দলীয় শাসন ব্যবস্থা কায়েম করার কুফল আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করতে পারছি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ‘জাতীয় ঐক্য’ কে কাজে লাগিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও শক্তির সমন্বয়ে ‘জাতীয় বিপ্লবী সরকার’ গঠনের মাধ্যমে দেশ গড়ার উদ্যোগ না নেবার কারণেই আজ এই বিভেদমূলক পরিবেশ গড়ে উঠেছে। সেই পুরাতন কথা আবার বলতে হয় ‘ একজন ডাক্তার ভুল করলে একজন রোগী মারা যায় কিন্তু জাতীয় নেতা ভুল করলে গোটা জাতিকে তার খেসারত দিতে হয়।’ আজ জনগণকে সে খেসারতই দিতে হচ্ছে। এর মধ্যে এটাও প্রমাণিত হয়েছে সেদিন যাদেরকে ‘দুধের বাচ্চা’, ‘নাক টিপলে দুধ বের হয়’ বলে ব্যঙ্গ করা হয়েছিল ; তারা আসলে দেশ গড়ার জন্য সঠিক দিক-নির্দেশনা ও কর্মসূচী দিয়েছিলেন। কিন্তু শাসকদের রোষানলে পড়ে তারা চরমভাবে নির্যাতিত হয়েছে।

কোন কোন ঐতিহাসিক বলে থাকেন যে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর বাংলায় নতুন সূর্য উদীত হয়েছিল যা বাংলার মানুষকে আধুনিক জগতে প্রবেশের পথ দেখিয়েছিল। নবাবের পতনের দ্বারা কৃষক সমাজ কোন ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় নাই। এই সব উক্তি যে উদ্দেশ্য প্রণোদীত তা আমরা আমরা মহান শিক্ষাবিদের স্মৃতিকথা থেকে বুঝতে পারি। তিনি বলেন, “ ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধে শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের সাথে সাথেই তো ইংরেজরা এই বাংলাদেশে তাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা কায়েম করতে পারে নি, বেশ কিছুদিন দ্বৈতশাসন চলেছিল। তারপরও নতুন শাসককে জনগণ স্বতঃস্ফ’র্ত সমর্থন দেয় নি, এর প্রধান কারণ তারা এ দেশ শাসনকালে চিরাচরিত রীতিকে উপেক্ষা করেছিল, এ দেশের গ্রামীণ রীতিনীতি ও ঐতিহ্যেও প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে নি। তাছাড়া কোম্পানি ও নবাবের মধ্যে ক্ষমতা ভাগাভাগির প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্থা , আইন ও জনগণের মতকে কোম্পানির লোকজন যখন উপেক্ষা করতে শুরু করে ÑÑ তখন জনগণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। এর প্রতিক্রিয়ায় পূর্বের জমিদার , সাধারণ ভ’মালিক, উপজাতি সমাজ , কৃষকরা সবাই তাদের বিরোধীতা নানা ভাবে ব্যক্ত করে। এর ফলে নানা আন্দোলন ও বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল।

......রাজনৈতিক প্রতিরোধের কথা বলতে গেলে প্রথমেই যে নামটি মনে পড়ে তা হলো মির্জা আগা মোহাম্মদ রেজা বেগের নাম। সিলেটের রাজা বেগ ছিলেন একজন স্বনির্বাসিত মুঘল। তিনি এবং ঢাকার নবাব শামসুদ্দৌলা ১৭৯৯ সালে ‘ফিরিঙ্গি হুকুমত’ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং সকলকে ব্রিটিশ বিরোধী জেহাদে তাঁদের সাথে যোগ দেবার আহ্বান জানান। এর আগে বলতে হতো প্রাক-ব্রিটিশ সময়কালের জমিদারদের বিদ্রোহ । মুঘলদের কাছ থেকে দিউয়ানি পেয়ে কোম্পানী এই জেলাগুলির বড় বড় জমিদারী বিলোপ করে জমিদারদের পেনশনভোগী শ্রেণিভুক্ত করলে এই বিদ্রোহ দেখা দেয় (১৭৭২)। উপজাতি খাসিয়াদের বিদ্রোহ (১৭৮১ --- ৮৩) এবং সাঁওতাল বিদ্রোহ (১৮৮৫) এর নাম অবশ্যই করতে হয়, তবে চাকমারাও ১৭৭৬ সালে বিদ্রোহ করে এবং গেরিলা কৌশলে কোম্পানি প্রশাসনকে আক্রমণ করতে থাকে। পাহাড়িদের নিজেদের রাজার শাসন , সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র রক্ষার জন্যই ছিল তাদের প্রতিরোধক আন্দোলন ও যুদ্ধ। মুঘল রাষ্ট্রব্যবস্থায় কৃষকদের অর্থাৎ রায়তদের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা বিনষ্ট করায় , সরকারের নতুন ভ’মিনীতিতে পঞ্চায়েত প্রথা বাতিল , জমিদার, তালুকদার, ইজারাদার এবং আমলাদের যথেচ্ছা কর আরোপ, করবৃদ্ধি ও শোষণের বিরুদ্ধে বাংলার নানা স্থানে কৃষক বিদ্রোহ হয় ------ ১৭৮৩ সালের রাজস্ব ইজারাদার দেবি সিংহের বিরুদ্ধে রংপুর বিদ্রোহ হয় এবং ১৮৭৩ সালে পাবনা কৃষক বিদ্রোহ সবচেয়ে প্রচন্ড বিদ্রোহ ছিল। এই শেষোক্ত বিদ্রোহ সবচেয়ে প্রচন্ড কিন্তু ব্যাপকভাবে অহিংস এবং সুসংগঠিত ছিল। এতে নেতৃত্ব দেন দৌলতপুরের ক্ষুদে ভ’স্বামী ঈশ^র চন্দ্র রায় এবং জগতুলার খুদি মোল্লা। প্রাসঙ্গিকভাবে সেকালের আরেকজন কৃষক নেতার নাম মনে পড়ছে, ষোলঘরের চন্দ্রনাথ মজুমদার। ” এ থেকে এটা স্পষ্টভাবে জানা যায় যে বাংলার মানুষ সহজে ‘ফিরিঙ্গি হুকুমত’ মেনে নেয় নাই। গেরিলা যুদ্ধ তারা জানতো এবং পাবনার কৃষক নেতারাই অহিংস পথে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। তাই বলতে পারি অহিংস আন্দোলনের পুরোধা পাবনার সেকালের কৃষক নেতাগণ, অন্য কেউ নন।

ইংরেজ শাসকেরা এদেশে নীলচাষীদের উপর নানা রকম অত্যাচার করতো। চাষীরা বিদ্রোহ করেছে। এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ বলেন ,“ আমার পূর্বপুরুষ মোজাহার (১৭৫২--১৮০০) এবং তার পুত্র জামাল (১৭৭৭---১৮৪৫) পোড়াখালির বাসিন্দা ছিলেন। তারা কৃষক ছিলেন এবং তাদের নিজস্ব জমিজমা ছিল। ..... ইংরেজ নীলকর নিজেদের বাগান বা এস্টেট বানিয়েছিল, তাতে কৃষকদের দিনমজুর খাটিয়ে ,নিজেদের খরচে ও তত্ত্বাবধানে চাষ করতো। পুরুষরা পেতো নগদ তিন টাকা আর মহিলা ও শিশু মজুররা পেতো দুই টাকা। আর একটি ছিল ‘বারতী’ প্রথা, এই নিয়মে নীলকরদের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়ে চাষী নিজের জমিতে নীলচাষ করতো। চুক্তি অনুযায়ী চাষী কিছু অর্থ অগ্রীম হিসেবে পেতো। মোজাহার বেঁচে থাকতে এবং তারপর তার ছেলে জামাল এই বারতী প্রথায় নীলচাষ করতো। চুক্তির সব শর্তগুলি ছিল নীলকর সাহেবদের অনুক’লে। নীলের চাষ না করে অন্য ফসল লাগালে বাজারদর অনুযায়ী চাষীদের লাভ হতো। কিন্তু তাতো হবার উপায় ছিল না। নীলচাষ বাদে অনেকের মত জামালের যে খরচ হতো , নীলকর সাহেব তাদের কেনার দর তার চেয়েও কম বেঁধে দিয়েছিল। দাদনের উপরে প্রায়শ তারা আর কিছু পেত না। ১৮২৫ সালে জামালের মধ্য বয়স পেরিয়ে গেছে। তখন বাড়ির বড় ছেলে কিশোর বাউলের বয়স তেরো চৌদ্দ বছর। সে এবং তার কিশোর ভাই মহুরি , জহুরি--- কেউই নীলের আবাদ না করে ধান ও রবিশস্যের আবাদ করলো। নীলকরদের পাইক বরকন্দাজরা এসে তাদের শাসিয়ে গেল যে নীলচাষ বন্ধ করা যাবে না। তারা বাউলকে কুঠিতে ডেকে এনে বলল , ‘আগাম টাকা তিন বছরের বাকী পড়েছে , সে টাকা দাও , আর নীলচাষ বন্ধ করতে পারবে না। তাতে অন্যথা না হয় বলে দিচ্ছি।’ জামাল মনে মনে স্থির করলো সে যে শস্য আবাদ করেছে , তার চারা গাছগুলি সুন্দরভাবে বেড়ে উঠছে। মাঠের মাঝে কুয়ো খনন করে , অনেক পরিশ্রম করে পানি সেচের ব্যবস্থা করলে। সবুজ চারাগুলি আশার সঞ্চার করেছিল যে এবারে আবাদি শস্য বিক্রি করে নীলকর সাহেবদের পাওনা টাকা শোধ করে দেবে, আর কখনো নীলচাষ করবে না। কিন্তু তার সুখস্বপ্ন কোন কাজে আসলো না। একদিন নীলকর সাহেবদের এক দঙ্গল মানুষ, তাদের ঘাড়ে লাঙ্গল, সঙ্গে বলদ আর সশস্ত্র পাইক বরকন্দাজ, তারা এসে ফসলের মাঠে লাঙ্গল চালিয়ে নষ্ট করে দিল শস্য , নষ্ট হলো তার স্বপ্ন। বাধা দিয়ে কোন লাভ হলো না। জোর যার মুল্লুক তার, এই বুনো কথাটাই যেন আইন হয়ে পড়েছিল। জামাল এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আদালতে বিচার চেয়েছিল কিন্তু ন্যায়বিচার পায়নি। সে চুক্তির বরখেলাপ করেছে --- এই কথা বলে তার আরজি খারিজ হয়ে যায়। সেদিনই ছেলে বাউলের সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নেয় পোড়াখালিতে তারা আর থাকবে না। এ হলো ১৮৩৫ সালের কথা। ...... নীলকরদের অত্যাচারের সীমা ছাড়িয়ে গেল, নীলকরদের নিপীড়ন যখন অসহ্য হয়ে উঠল, তখন পুঞ্জীভ’ত ক্ষোভ বিরোধের রূপ নিল। ১৮৫৯ সালে যশোর জেলার চৌগাছা গ্রামের চাষীরা প্রথমে সংঘবদ্ধ হয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা কেউ আর নীলচাষ করবে না। নীলকরের অনুগত পাইক লাঠিয়াল বাহিনী রাতের অন্ধকারে চৌগাছা আক্রমণ করে , লুটপাট করে ঘরবাড়ি জ¦ালিয়ে দেয়। কত কৃষক যে তাদের বাড়িঘর সহায়সম্পত্তি হারায় তার সঠিক হিসাব নেই। একজন চাষী নিহত হয়। কিন্তু এতেও তাদের দমন করা যায় নি। বিদ্রোহ আশে পাশের জেলাগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৬০ সালের মাঝামাঝি যশোর, পাবনা, নদীয়া, রাজশাহী , বারাসাত ও ফরিদপুরে বিদ্রোহের আগুন জ¦লে উঠে। এতে অংশ নেয় হিন্দু-মুসলমান সব সম্প্রদায়ের চাষীরা।

সরকার বিষয়টি তদন্ত করার জন্য ১৮৬০ সালের শেষের দিকে একটা কমিশন নিযুক্ত করে।কমিশন স্বীকার করেছিল যে নীলকররা চাষীদের উপর মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার ও নিপীড়ন করেছিল। তবে নীল চাষ বন্ধ করার কোন সুপারিশ কমিশন করে নি। বিশ^বাজারে এরপর ধীরে ধীরে নীলের দাম কমে আসছিল । আর ১৮৮০ সালে সিনথেটিক কৃত্রিম নীল আবিষ্কার হওয়ার পর নীল চাষ কম হতে থাকে এবং পরবর্তীতে প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। ”

শিক্ষাবিদের বর্নিত এই ঘটনাগুলি তাঁর জন্মের আগের। পারিবারিক এবং মুরুব্বীদের সূত্রে তিনি এসব জেনেছিলেন। এর ভিতরে রয়েছে সেকালের জনগণের সামাজিক অর্থনেতিক অবস্থার চিত্র। এ থেকে সেকালের বিচারব্যবস্থা এবং রাজনীতি সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যায়। বাংলার জনগণের শৌর্য বীরত্ব ও প্রতিবাদমূখর হবার কথাও এখানে প্রকাশিত হয়েছে। এই স্মৃতিকথাগুলো কালের গতি প্রবাহে বিস্মৃতির অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতো। শিক্ষাবিদ সদরউদ্দীন আহমেদ তাঁর জীবনকথা লিপিবদ্ধ করার মাধ্যমে একে ইতিহাসের বিষয়ে পরিণত করেছেন। আমাদের দেশে বিদেশীরা অতীতে আমাদের শ্রমজীবী মানুষের সাথে কখনো ভালো আচরণ করে নাই । বাংলার জনগণও কখনো অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে পিছুপা হয় নাই। এই ইতিহাস আমাদেরকে আত্মসচেতন করে স্বাধীনভাবে সামনে চলার দিকনির্দেশনা দিয়েছে এবং আমাদের আত্মানুসন্ধানী চেতনাকে শাণিত করেছে। বাংলার জনগণ এই ঐতিহ্য নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছে সামনে।

লেখকঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ । বর্তমানে সদস্য বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট আইনজীবী সমিতি, ঢাকা
এবং বে-সরকারী সংস্থার কর্মকর্তা, রাজশাহী।

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৬ রাত ৮:১৮

শাহাদাত হোসেন বলেছেন: জাতীয় নেতা
ভুল করলে গোটা
জাতিকে তার খেসারত
দিতে হয়। কথাটির বাস্তবতা চরমভাবে উপলিদ্ধ করতে হচ্ছে ।

২| ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৬ সকাল ৯:৫৪

কাল্পনিক_ভালোবাসা বলেছেন: এটা কি আপনার লেখা??

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.