![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্বাধীনতা মানুষের চিরন্তন আকুতি। পরাধীন জনগণ জীবনন্মৃত জনগোষ্ঠি ব্যতিত কিছুই নয় । স্বাধীনতা অর্জনের জন্য লড়াই করা এবং জীবন দেওয়া গৌরবজনক বলেই বিবেচিত। পলাশীর আমের বাগানে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ১৭৫৭ সালে অস্তমিত হয়। তখনও মোঘল বাদশাহর শাসন চলছিল উপমহাদেশে। হৃত স্বাধীনতা পূনরুদ্ধারের জন্য চলছিল লড়াই, কারণ বাণিজ্য করতে আসা ইংরেজরা একের পর এক রাজ্য দখল করে চলছিল। জনগণের মধ্যে অর্ন্তদ্বন্ধ ও বিরোধকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বাসঘাতকদের সহযোগিতায় তারা এগিয়ে যাচ্ছিল। বিশ্বাসঘাতকদের মুখোশ উন্মোচিত হবার সাথে সাথেই জনগণ এগিয়ে যেতে থাকে ভিনদেশী লুটেরাদের বিরুদ্ধে। এভাবেই বাংলার মঙ্গল পান্ডে , কানপুরের নানা সাহেব , ঝাঁসীর রাণী লক্ষ্মী বাঈ , বিধুরের তাঁতিয়া টোপী গর্জে উঠলো । বীর সিপাহসালার বখত খাঁর নেতৃত্বে শুরু হলো লড়াই। মোঘল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত ইংরেজরাই জয়ী হলো । সিপাহসালার বখত খাঁ নিরুদ্দেশ হলেন। প্রহসনের বিচারে প্রাণ দিলেন অন্যরা। দিল্লীর রাজ প্রাসাদেই হত্যা করা হলো বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফরের পুত্রদের। বাদশাহকে নির্বাসন দেওয়া হলো রেঙ্গুনে। তাতেও স্বাধীনতার লড়াইকে ইংরেজরা অবদমিত করতে পারে নাই। তীতুমীর , শরিয়ত উল্লাহ , মজনু শাহ , ক্ষুদিরাম , বাঘা যতিন , সূর্য সেন প্রমুখেরা জীবন দিয়েও লড়াই চালিয়ে যেতে থাকে। ইংরেজরা প্রমাদ গুনে। তারা কৌশলের আশ্রয় নেয়। আবহমানকাল ধরে চলমান সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিতে তারা ক’ট কৌশল প্রয়োগ করে ফাটল ধরানোর চেষ্টা করে। সাময়িকভাবে তারা সফলও হয়। সেই সাথে নিজেদের স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রণয়ন করে আইন। অবয়বে দেশীয় হলেও চিন্তা চেতনায় হবে ইংরেজ এই লক্ষ্য নিয়ে চালু করে শিক্ষা ব্যবস্থা।
নবাব স্যার সলিমুল্লাহ , নবাব নওয়াব আলি , নবাব আব্দুল লতিফ , শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক , দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ , নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু , হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী , শরৎ চন্দ্র বসু , কিরণ শংকর রায় , আবুল হাশিম প্রমুখের নেতৃত্বে পর্যায়ক্রমে এগিয়ে যেতে থাকে বাংলা ও বাঙালীর স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। তাদের সকলেরই লক্ষ্য ছিল এই অঞ্চলের মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতা অর্জন এবং ইংরেজ শাসনের অবসান। তবে এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তাদের সকলের মত ও পথ অভিন্ন ছিল না। ১৯৪৭ সালে ইংরেজরা প্রত্যক্ষ শাসন কার্য থেকে বিদায় নিলেও বাঙালী জনগণের প্রকৃত স্বাধীনতা ও মুক্তি তখনও অর্জিত হয় নাই। যদিও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তারা অনেক আশান্বিত হয়েছিল। একে একে সে আশা দূরাশায় পরিণত হতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা , স্বায়ত্বশাসন , কেন্দ্রীয় রাজধানী স্থাপন , নৌবাহিনীর সদর দফতর স্থাপন , সেনা বাহিনীসহ সরকারী চাকুরীতে বাঙালীদের অংশ গ্রহণ , পণ্য আমদানী রফতানির মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বন্টন , উন্নয়নমূলক কর্মকান্ড , শিক্ষা ক্ষেত্রে সুযোগ সুবিধা , ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঙালীদের সুযোগ প্রদান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই বৈষম্যমূলক আচরণের শিকার হয় বাংলার জনগণ। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র প্রণীত ও গৃহীত হলে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বললেন পূর্ব পাকিস্তানকে ৯৮% স্বায়ত্বশাসন দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে বিতর্ক উঠলেও পরীক্ষিত হবার আগেই উক্ত শাসনতন্ত্র সামরিক ফরমান বলে বাতিল করা হয়। দিনে দিনে এটা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হতে থাকে শোষণ বঞ্চনা থেকে বাঙালী জনগণের পরিপূর্ণ মুক্তি পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে সম্ভব নয়। এ জন্য বাংলার পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন অপরিহার্য। এই উপলব্ধি থেকেই ১৯৬২ সালে তৎকালীন ছাত্র নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ গোপন সংগঠন ‘নিউক্লিয়াস’ গঠন করেন। এই ‘নিউক্লিয়াস’ই কখনো ‘স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াস’ আবার কখনো ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। তবে তাদের কর্মকান্ড পরিচালিত হতো গোপনীয়তা রক্ষা করে। ‘নিউক্লিয়াসে’র সদস্য সংগ্রহ করা হতো মূলতঃ ছাত্র লীগ থেকে। সমর্থক ও শুভানুধ্যায়ী সংগ্রহ করা হতো বাইরে থেকে। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত সংঘটিত সকল আন্দোলনের কৌশল নির্ধারণ , পরিকল্পনা প্রণয়নসহ সব কিছুরই মূলে ছিল নিউক্লিয়াস। বাঙালী জনগণের স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে। নেপথ্যে মূল নিয়ন্ত্রণকারী ও পরিচালনাকারী হিসাবে কাজ করে ‘নিউক্লিয়াস’। স্বাধীন বাংলার পতাকা তৈরী করা সম্পর্কে আ স ম আবদুর রব তাঁর লিখিত ‘ আমি , ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাঙালীর স্বাধীনতা ’ শীর্ষক নিবন্ধে বলেন ,‘ ১৯৭০ সালের ১৪ই ফেব্রুয়ারী । এদিন তৈরী করা হয় বাঙালীর স্বাধীনতার পতাকা , নির্বাচন করা হয় জাতীয় সংগীত । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ( বর্তমান জহুরুল হক হল ) এর ১১৬ নং কক্ষে আমি থাকতাম। এই কক্ষে বসে স্বাধীন বাংলা নিউক্লিয়াসের পরিকল্পনায় আমি , শাজাহান সিরাজ , মরহুম কাজী আরেফ আহমেদ , মনিরুল ইসলাম ( মার্শাল মনি ) ও শরীফ নুরুল আম্বিয়া স্বাধীন বাংলার পতাকার কাঠামো তৈরী করি । পতাকার ভিতরের মানচিত্র অংকন সহজ নয় বলে তা অংকন করেন শিব নারায়ন দাস। সেদিন নিউক্লিয়াসের মতামত নিয়ে কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আমার সোনার বাংলা ’ গানটি জাতীয় সংগীত হিসাবে নির্বাচন করি । ১৫ই ফেব্রুয়ারী অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন শেষে বাহিনীর প্রধান হিসাবে আমি সামরিক কায়দায় ওই পতাকা তুলে দেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে। এর আগে এই পতাকা নিয়ে সারা ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে নিউক্লিয়াসপন্থী ছাত্র লীগের মিলিটেন্ট বাহিনী হিসেবে পরিচিত ‘জয় বাংলা বাহিনী ’ । ‘জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ছিলাম আমি ও উপ-প্রধান ছিলেন কামরুল আলম খান খসরু । জঙ্গী ছাত্রীদের নিয়ে ‘জয় বাংলা বাহিনী’র ‘প্রীতিলতা ছাত্রী বাহিনী ’ গড়ে তোলা হয় . এর প্রধান ছিলেন মরহুমা মমতাজ বেগম।’ { সূত্র ঃ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি , ঢাকা মহানগর ( দক্ষিণ ) এর সম্মেলন-২০১২ উপলক্ষ্যে ১৩ই ফেব্রুয়ারী ২০১২ তারিখে প্রকাশিত স্মরণিকা , পৃষ্ঠা ঃ ১১ ও ১২ }। কাজী আরেফ আহমেদ এ প্রসঙ্গে তাঁর অপ্রকাশিত পান্ডুলিপিতে লিখেছেন , “ ... রব ও মার্শাল মনি বললো পতাকার ‘বটল গ্রীন ’ জমিনের কথা এবং শাহজাহান সিরাজ অনুরোধ জানালো ‘রক্ত লাল একটা কিছু ’ যেন পতাকায় থাকে। আমি ওদের প্রস্তাব গ্রহন করে বটল গ্রীন জমিনের মাঝখানে গোলাকার রক্ত লাল রঙের উদিত সূর্য এঁকে সবাইকে দেখাই । ... আমি সবাইকে বললাম ঐ পতাকার মাঝখানে সোনালী রঙের ( বাংলার তৎকালীন অর্থকরী সম্পদ সোনালী আঁশ পাট ও পাকা ধান ক্ষেতের রং ) বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা থাকবে। পতাকায় ভ’খন্ডের মানচিত্র সুনির্দিষ্টভাবে থাকলে জনগণকে বিভ্রান্ত করা সম্ভব হবে না। সবাই একমত হলে আমি একটা চিঠি দিয়ে তিনজনকে নিউ মার্কেটের ‘এ্যাপোলো ’ নামের দোকানে পাঠালাম । গাঢ় সবুজ ও গাঢ় লাল রঙের তৎকালীন লেডি হ্যামিলটনের কাপড় নিয়ে ওরা বলাকা ভবনের ‘পাক ফ্যাশনে’র মালিকের কাছে যায়। মালিক ছিল অবাঙালী , ছাত্র লীগের ছেলেরা তাকে মামা বলে ডাকতো। সে বিষয়টি বুঝতে পেরে তার সকল কর্মচারীকে বিদায় দিয়ে নিজেই নকশা অনুযায়ী পতাকা তৈরী করে দিল। ... এরপর কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াসের অনুমোদনের জন্য আমরা তিনজন ( সিরাজুল আলম খান , আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমেদ ) বসে পতাকা অনুমোদন করি। বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন গ্রহণের দায়িত্ব পড়লো আবদুর রাজ্জাকের উপর । ঐ রাতেই আবদুর রাজ্জাক ৩২ নং ধানমন্ডিতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর অনুমোদন গ্রহণ করেন। ১৯৭০ সালের ৭ই জুন ভোরে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে ‘জয় বাংলা বাহিনী ’ অভিবাদন জানাতে কর্দমাক্ত পল্টন ময়দানে প্রবেশ করলো । মঞ্চে ছিলেন শেখ মুজিব , পাশে শেখ মনি , সিরাজুল আলম খান , আবদুর রাজ্জাক ও তোফায়েল আহমেদ। আমি মঞ্চের পাশে দাঁড়িয়ে হাতে পলিথিনে মোড়া স্ট্যান্ডসহ পতাকা। আবদুর রব ‘জয় বাংলা বাহিনী’র প্রধান হিসাবে মঞ্চের কাছে এসে সামরিক কায়দায় বঙ্গবন্ধুর সামনে হাঁটু গেড়ে বঙ্গবন্ধুর হাত থেকে ব্যাটালিয়ন ফ্লাগ গ্রহণ করেন। ” ( সূত্র ঃ পাক্ষিক আলোর মিছিল পত্রিকার ১৬-২৯ ফেব্রুয়ারী ২০১২ তারিখের সংখ্যায় কাজী আরেফ আহমেদ স্মরণে প্রকাশিত বিশেষ ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত কাজী আরেফ আহমেদ লিখিত শিরোনামহীন পান্ডৃলিপির অংশ বিশেষ , পৃষ্ঠা ঃ ৩ ) ।
এই পতাকাই হয়ে উঠে বাংলার জনগণের আশা আকাংখার প্রতীক ,মুক্তি পথের দিশারী। প্রত্যেক আন্দোলন সংগ্রামেই একটা রণধ্বনি থাকে । নিউক্লিয়াসের সাথে সম্পর্কিত প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল্লাহ সানি ছিলেন আহসান উল্লাহ হলের আবাসিক ছাত্র। তার কক্ষে সিরাজুল আলম খান , আ স ম আবদুর রব , আবুল কালাম আজাদ , আবদুল্লাহ সানি ও ইউসুফ সালাউদ্দিন মিলিত হয়ে সিদ্ধান্তে আসেন যে বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের রণধ্বনি হবে ‘ জয় বাংলা ’। ১৯৭০ সালের ১৯ শে জানুয়ারী তারিখে পল্টনের বিশাল জনসভায় সর্ব প্রথম সিরাজুল আলম খান ‘ জয় বাংলা ’ শ্লোগান দেন। সাথে সাথে নিউক্লিয়াসের অন্যান্য সদস্যগণ এই শ্লোগান দিয়ে মুখরিত করে তোলে গোটা পল্টন ময়দান। এর পর সারা দেশে এই শ্লোগান চালু হয়ে যায়।
সাহসিকতা সতর্কতা ও দৃঢ়তার সাথে ‘নিউক্লিয়াস’ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে স্বাধীনতা ও মুক্তির সংগ্রাম। মোক্ষম সময় আসে ১৯৭১ সালের পহেলা মার্চ। পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ঢাকায় ১৯৭১ সালের ৩রা মার্চ তারিখে। কিন্তু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান পহেলা মার্চ তারিখ দুপুরে জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দিয়ে জানিয়ে দিলেন ঐ তারিখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হবে না। এটা ছিল বাংলার জনগণের আশা আকাংখার প্রতি এক চরম আঘাত। সারা রাজ পথে নেমে আসে জনগণ। তারা শ্লোগন দেয় , ‘ ইয়াহিয়ার ঘোষণা , বাঙালী মানে না ’ ‘ ছয় দফা না এক দফা , এক দফ এক দফা ’ ‘ বীর বাঙালী অস্ত্র ধর , বাংলাদেশ স্বাধীন কর ’ ‘ মুক্ত কর , স্বাধীন কর , বাংলাদেশ বাংলাদেশ ’। ২রা মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে অনুষ্ঠিত স্বতঃস্ফ’র্ত ছাত্র জন সভায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংসদের সহ-সভাপতি আ স ম আবদুর রব উড়িয়ে দেন ‘রক্ত সূর্য মাঝে সোনালী চিত্র আঁকা ’ স্বাধীন বাংলার সবুজ পতাকা। এই পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমেই পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে যায় চিরতরে। জনতার জয়দ্বনি ও রণদ্ভণির ডামাডোলে মিলিয়ে যায় পাকিস্তানী রাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সর্বাধীক স্বায়ত্বশাসনের প্রবক্তাদের কন্ঠস্বর। এই পরিস্থিতিতে উত্তোলিত পতাকার জনপ্রিয়তার কাছে নেতাদের ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তা ম্লান হয়ে যায়। তাই এই পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামো বহাল রাখার সামর্থ্য কোন নেতা বা নেতৃবর্গের ছিল না। তবুও নেপথ্যে অনেক কিছুই ঘটতে থাকে। এ প্রসঙ্গে শাহজাহান সিরাজ বলেন , ‘ ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ রাত ১০টায় আমরা কয়েক জন ধানমন্ডির এক বাসায় বৈঠক করি এবং দীর্ঘ আলোচনার পর রাত ১টায় কোর আন শরীফ স্পর্শ করে শপথ নিই- কোনো অবস্থাতেই কোয়ালিশন সরকার গঠন করতে দেব না। যে স্বাধীন বাংলার পতাকা একবার তুলেছি , তা আর নামানো যাবে না। এ সিদ্ধান্ত নিয়ে রাত দেড়টায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে যাই এবং তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরাসরি বলি , আমাদের প্রস্তাব গ্রহণ না করলে আপনার সঙ্গেও আমাদের রাজনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটবে। এটা ঠিক যে , আওয়ামী লীগের এক বিরাট অংশ আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ছয় দফার সঙ্গে আপস করে পাকিস্তান রেখেই ক্ষমতায় যাবার পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এমন কি এক পর্যায়ে আমাদের অন্ধকারে রেখেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকেও এ প্রস্তাব মানতে বাধ্য করে। গোল টেবিলে আলোচনার মাধ্যমে পাকিস্তানের কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টির কোয়ালিশন সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয় । বিষয়টি গোপন থাকলেও জেনে ফেলি। ৩রা মার্চ ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টারী পার্টি নেতাদের এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তা প্রত্যাখ্যান করেন। এ দিনই বিকালে ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকীর সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে এক বিশাল ছাত্র-জনসভা হয়। সভায় আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইশতেহার পাঠ করি। ঘোষণা আকারে প্রস্তাবে ৫৪ হাজার ৫০৬ বর্গ মাইল বিস্তৃত ভৌগলিক এলাকার সাত কোটি মানুষের জন্য আবাসভ’মি হিসাবে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের নাম ‘ বাংলাদেশ ’ উল্লেখ করি। একই সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আমার সোনার বাংলা , আমি তোমায় ভালবাসি ’ গানটিকে জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয় । প্রচন্ড করতালির মধ্যে প্রস্তাব গৃহীত হলে ‘ জয় বাংলা ’ শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠে পল্টন ও পার্শ্ববর্তী এলাকা। বঙ্গবন্ধু তখনও এ ধরনের ঘোষনা থেকে বিরত ছিলেন। সভায় বঙ্গবন্ধু অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। তিনি অবিলম্বে সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে জনপ্রতিনিধিদেন হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান সরকারের প্রতি। অসহযোগের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করে দিতে আহ্বান জানান। বলেন , তাতেও পাকিস্তানী শাসক চক্রের মনোভাব পরিবর্তন না হলে ৭ই মার্চ রেসকোর্সের ( বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ) জনসভায় পরবর্তী কর্মসূচী দেওয়া হবে। মার্চের শুরুতে আমাদের অবস্থান নিয়েও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছিলেন অনেক আওয়ামী লীগ নেতা। ওই বিভ্রান্তি দূর করতেই আমরা কার্যত ৭ই মার্চের ভাষণের পর দিন তৎকালীন ছাত্রলীগ সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী ও সাধারন সম্পাদক হিসেবে আমি এবং ডাকসুর সহসভাপতি আ স ম আবদুর রব ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল কুদ্দুস মাখন এক যুক্ত বিবৃতি দেই। বিবৃতিতে বলা হয় , বাংলার বর্তমান মুক্তি আন্দোলনকে ‘স্বাধীনতার আন্দোলন’ ঘোষণা করে স্বাধীন বাংলার জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক জনসভায় যে কর্মসূচী ঘোষণা করেছেন , তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য বাংলার সংগ্রামী জনতার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি । এর পর থেকেই মূলত মুক্তিযুদ্ধ শুরু করে দেই। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পুরোটাই অবস্থান গোপন রেখে গেরিলা যুদ্ধ। ’ ( সূত্র ঃ দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন , শনিবার ৩রা মার্চ ২০১২ খ্রিঃ/ ২০শে ফাল্গুন ১৪১৮ বঙ্গাব্দ / ৯ই রবিউস সানি ১৪৩৩ হিজরি। দ্বিতীয় সংস্করণ। পৃষ্ঠা ঃ ১ ও ২ )।
দেশ ও জাতির এই ঐতিহাসিক ক্রান্তিলগ্নে সংগঠন হিসেবে ‘ নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ’ স্বাধীনতার পক্ষে কোন প্রস্তাব গ্রহণ করে নাই। আওয়ামী লীগ পার্লান্টোরী পার্টিও এরূপ কোন প্রস্তাব নেয় নাই। নিলে পাকিস্তানী শাসক চক্র এত হিং¯্র ভাবে জনগণের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার সাহস পেতো না। আর্ন্তজাতিক ক্ষেত্রেও জনগণের পক্ষে সমর্থন অনেক আগেই আসতো। আওয়ামী লীগের এই দোদুল্যমানতাই বাঙালী জনগণের মনোভাব সম্পর্কে পাকিস্তানী শাসকবর্গকে ভুল সংকেত দিয়েছিল। যার মাশুল দিতে হয়েছে জনগণকে। এই দলের এই আচরণের কারণেই আজ যখনই স্বাধীনতার বিষয়ে ঐতিহাসিকগণ আলোচনা পর্যালোচনা করতে যাচ্ছেন তখনই নানা ধরণের জটিল ক’ট তর্কের জটাজাল তাদের আচ্ছন্ন করে ফেলছে। ইতিহাস ঐতিহাসিকদের গবেষণার বিষয় , অন্য কারো চোখ রাঙিয়ে ছড়ি ঘুরানোর বিষয় নয়।
এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে আ স ম আবদুর রবের আবাািসক কক্ষে বসে এই পতাকা তৈরীর নকশা প্রস্তুত করা হয়। পতাকা প্রস্তুত করা হলে তা ১৯৭০ সালের ১৫ ই ফেব্রুয়ারী সাজেন্ট জহুর দিবসে জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজ পরিদর্শন শেষে বঙ্গবন্ধুর হাতে তুলে দেন আ স ম আবদুর রব। একই বৎসর ৭ই জুন ‘ ছয় দফা দিবস ’ ( মনু মিয়ার শাহাদাত বার্ষিকী ) এ পল্টন ময়দানে উক্ত বাহিনীর কুচকাওয়াজ শেষে পতাকাটি বঙ্গবন্ধু তুলে দেন আ স ম আবদুর রবের হাতে। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ তারিখে এই পতাকাই স্বাধীন বাংলার পতাকা হিসেবে আকাশে উড়িয়ে দেন আ স ম আবদুর রব। পতাকার দন্ডটি ছিল তারই হাতে। তাই এই পতাকার সাথে আ স ম আবদুর রবের সম্পৃক্ততা অত্যন্ত নিবিড়। এই ঐতিহাসিক সত্যকে অস্বীকার করতে এবং এড়িয়ে যেতে ঈর্ষাকাতর কাউকে কাউকে সক্রিয় দেখা যায়। মনে রাখা দরকার সাময়িক ক্ষমতা বা প্রতিপত্তির দাপটে কিছু দিনের জন্য ইতিহাসকে বিকৃত করা যায় বটে কিন্তু চিরদিনের জন্য তা করা যায় না। সত্য চির স্বয়ম প্রকাশ। আজ পাঠ্য বইয়ে এসব তথ্য নেই। আগামী প্রজন্মকে এ বিষয়ে অন্ধকারে রাখা কখনোই সম্ভব হবে না। তবুও এ প্রবণতা চলছেই।
ঐ পতাকা হাতে নিয়েই জাতি ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতা। ঐ পতাকায় জনগণের যে আশা আকাংখা প্রতিফলিত প্রতিধা¦নিত হয়েছিল তা আজও বাস্তবায়িত হয় নাই। স্বাধীনতার রূপকার সিরাজুল আলম খান রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে উপেক্ষিত। নিউক্লিয়াসের নেতা সংগঠক ও সদস্যরা আজ স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রীয় কর্মকান্ডে অপাংক্তেয়। তাদের অবদান শাসক মহল কর্তৃক অস্বীকৃত । তাই আজও বাংলার মানুষ ক্ষুধা বেকারত্ব রোগ ব্যধি অপুষ্টির অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারে নাই। শিক্ষা চিকিৎসা পাবার সুযোগ থেকে সর্বস্তরের জনগণ বঞ্চিত। এসব ক্ষেত্রে ১৯৭১ সালে দেশ যেমন ছিল , আজ সময়ের পরিবর্তন হলেও জনগণের ভাগ্য আগের মতোই আছে। আজো ধনী আরো ধনী হচ্ছে , গরিব হচ্ছে আরো গরিব। ২২টি ভাগ্যবান পরিবার পাকিস্তানের গোট অর্থনীতি ও শাসন কার্যের নিয়ন্তা হয়ে গিয়েছিল । তাই জনগণ এই শোষণ ও বঞ্চনা থেকে চেয়েছিল মুক্তি । তারা চেয়েছিল এমন একটি অর্থব্যবস্থা ও সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে শ্রমের মূল্যায়ন হবে, উৎপাদনের উৎসগুলিতে কৃষক-শ্রমিক কর্মচারীদেরও ( ক্ষেত্র মতো ) অংশীদারিত্ব থাকবে। শিক্ষা ব্যবস্থা হবে গণমুখি ও সার্বজনীন । শুধু রাজধানী শহর নয় , মফস্বল শহর ও গ্রামীন জনগণও লাভ করবে নাগরিক সুবিধা । এই আশা-আকাংখার প্রতীক হিসেবে উড়ানো হয়েছিল ঐ পতাকা। কিন্তু ৪০ বৎসরের পথ পরিক্রমায় দেখা যাচ্ছে শাসন ও বিচার ব্যবস্থা উপনিবেশিক আমলে যেরূপ ছিল আজও মৌলিকভাবে তা ঐরূপই আছে। রাষ্ট্রীয় কর্মক্ষেত্রে তথা অফিস আদালতে বাংলাভাষার ব্যবহার আজ সংকুচিত করা হচ্ছে। বাংলাভাষার জন্য সংগ্রামের স্মৃতি বিজড়িত দিনগুলো অর্থহীন , দিক নির্দেশনাহীন উৎসব অনুষ্ঠানের দিবসে পরিণত হয়েছে। এসব কিছুই বলে দিচ্ছে উত্তোলিত পতাকা হাতে সংগ্রামের দিন আজো শেষ হয় নাই। শাসন ও বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন দেশের উপযোগী করে ঢেলে সাজাতে হবে। সংসদ গঠন করতে হবে পেশা ভিত্তিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে। সংসদ হবে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। দেশকে নয়টি প্রদেশে বিভক্ত করে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা কার্যকর ও সক্রিয় করতে হবে। চালু করতে হবে অংশীদারিত্বের গণতন্ত্র। ১৯৭১ সালের ২রা মার্চ তারিখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে আ স ম আবদুর রব কর্তৃক উত্তোলিত পতাকাটি জনগণের যে মুক্তির বানী ঘোষণা করেছিল , তা অর্জনের জন্য এটাই মোক্ষম পথ। সে লক্ষ্য হাসিলের জন্যই জনতার সংগ্রাম এগিয়ে চলছে । যার কোন ক্লান্তি নাই , যাত্রা বিরতি নাই। অদম্য স্পৃহায় অমিত শক্তিতে এগিয়ে চলছে জনতার কাফেলা।
লেখক ঃ সাবেক জেলা ও দায়রা জজ। [email protected]
©somewhere in net ltd.