![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
ফরিদপুর আদালতের সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) স্বপন পাল তথ্যপ্রযুক্তি আইনে প্রবীর সিকদারের বিরুদ্ধে রোববার কোতোয়ালি থানায় তথ্যপ্রযুক্তি আইন-২০০৬ সালের (সংশোধিত-২০১৩)-এর ৫৭ (১) ধারায় একটি মামলা করেন। ওই মামলায় প্রবীর সিকদারকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, প্রবীর সিকদারের দেয়া একটি ফেসবুক স্ট্যাটাসে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেনের সুনাম ক্ষুণ্ণ হওয়ায় তিনি (স্বপন পাল) সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছেন। ৫৭ (১) এ ধারাটি জামিন অযোগ্য ।
কিন্তু দুঃখজনক হলো শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাংবাদিক প্রবীর সিকদারকে কোর্টে হাজির করা হলে ফরিদপুরের একজন আইনজীবিও তার পক্ষে জামিনের জন্য দাঁড়ায়নি । ফরিদপুরে কি স্বাধীনতা স্বপক্ষের একজন আইনজীবিও নেই ? নাকি ক্ষমতার দম্ভের কাছে বিবেক বন্ধক দিয়েছেন ?
যে কোন আসামীর পক্ষে একজন আইনজীবি মামলায় লড়বেন এটা তার পেশাগত অবলিগেশন ।সেই আসামি একজন খুনী কিংবা রাস্ট্রদ্রোহী যেই হোক না কেন তার পক্ষে মামলায় অংশ নেয়া একজন আইনজীবির পেশাগত নৈতিক দায়িত্ব । তাহলে আজ কেন ফরিদপুরের আইনজীবি সমাজ প্রবীর সিকদারের পাশে এসে দাঁড়ালেন না ?
চারদলীয় জোটের সময় করে যাওয়া তথ্যপ্রযুক্তি আইন-২০০৬ সালের (সংশোধিত-২০১৩) আইনের অপব্যবহার বেড়ে গেছে । এই আইনের দ্বারা ইচ্ছে হলেই যাকে তাকে গ্রেফতার করে অন্তরীন করা সহজ ।ফলে আইসিটি এ্যাক্ট আজ রীতিমতন আতংকের কারন হয়ে দাঁড়িয়েছে । একটি গনতান্ত্রিক রাস্ট্রে সরকার ,বিরোধীদল বা অন্য যে কোন বিষয়ে আলোচনা ,সমালোচনাকে স্বাগতই জানায় । কোন সভ্য সমাজে , গনতান্ত্রিক রাস্ট্রে এই রকম দানবীয় আইন থাকতে পারে না। সময় এসেছে চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা এবং বাক,ব্যক্তি ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার পথ প্রশস্ত করার জন্য এই আইন পূনঃবিবেচনার ।
আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার জন্যই ২০১৫ সালের ২৯শে মার্চ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত যুগান্তকারী রায় দিয়েছে ।
রায়ে দেশটির তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬ (এ) ধারা বাতিল করে দিয়েছে। ওই ধারা অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আপত্তিকর মন্তব্য, ছবি বা ভিডিও পোস্ট করলে তাকে গ্রেফতার করা হত। শুধু তাই নয়, ওই পোস্টে কেউ লাইক দিলেও তিনি গ্রেপ্তারের শিকার হতেন। বিতর্কিত আইনটি বাতিলের আবেদন করেছিলেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের একজন শিক্ষার্থী শ্রেয়া সিঙ্ঘাল। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন আরও কয়েকজন ছাত্রছাত্রী এবং নাগরিক অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করছে এমন কিছু সংস্থা। আড়াই বছর লড়াই করে জয়ী হন শ্রেয়া।যুগান্তকারী রায়ে ইন্টারনেটে জনগণের মতপ্রকাশে বাধাদানকে ‘অসাংবিধানিক’ বলেছে।
২০১২ সালে মুম্বাইয়ে শিবসেনা প্রধান বাল ঠ্যাকারের মৃত্যুর পর পুরো শহরের কার্যক্রম বন্ধ করে দেওয়ার সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ায় এক নারীকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাতে লাইক দেওয়ায় কারান্তরীণ করা হয় আরেক নারীকেও। এরপরই শ্রেয়া উপলব্ধি করেন, কেউ যখন-তখন এ আইনের আওতায় গ্রেফতার হতে পারেন। এ চিন্তা থেকেই তিনি জনস্বার্থে মামলা ঠুকেছিলেন।
শ্রেয়ার এই লড়াই এবং আদালতের রায় বাংলাদেশের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হতে পারে। আমাদের দেশে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ওই রকম একটি ধারা মতপ্রকাশের অন্তরায় হয়ে কাজ করছে। মামুলি কিছু ঘটনায় নাগরিকদের হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে; কাউকে কাউকে বন্দীজীবন কাটাতে হচ্ছে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ (১) ধারা মতে, “কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েব সাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উস্কানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।”
এই অপরাধে ব্যক্তি অনধিক চৌদ্দ বছর এবং অন্যূন সাত বছর কারাদণ্ডে এবং অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন।
ভারতীয় আইনটির চেয়ে বাংলাদেশের আইনটিতে শাস্তি আরও কঠিন করে তোলা হয়েছে। ২০০৬ সালে যখন এটি করা হয় তখন শাস্তি ছিল সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড। ২০১৩ সালে সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে ১৪ বছর করা হয়। সেখানে সর্বনিম্ন কারাদণ্ড রাখা হয় ৭ বছর। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অপরাধ জামিনঅযোগ্য করা হয়। আগে মামলা করার জন্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। এখন সেটারও দরকার নেই। অপরাধ আমলে নিয়ে পুলিশ শুধু মামলাই নয়, অভিযুক্তকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তারও করতে পারছে।
প্রসঙ্গত, ভারতের তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা অনুযায়ী, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে আপত্তিকর কিছু পোস্ট করলে অভিযুক্তকে সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হত এবং দোষ প্রমাণ হলে সর্বোচ্চ ৩ বছর কারাদণ্ডের বিধান ছিল।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টে শুনানির সময় বিচারকদের বক্তব্য ছিল, একজনের কাছে যেটা আপত্তিকর, অন্যের কাছে সেটা আপত্তিকর নাও হতে পারে। কোনটি আপত্তিকর এবং কোনটি অতিমাত্রায় আপত্তিকর, তা কী করে নির্ধারণ করবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা? রাষ্ট্রপক্ষ বলার চেষ্টা করে যে, এই ধারার অপব্যবহার হবে না। বিচারপতিরা পাল্টা মন্তব্য করেন, সরকার আসে, সরকার যায়; কিন্তু ৬৬ (এ) ধারা থেকে যাবে। এরপরই ধারাটি বাতিলের ঘোষণা দেন সুপ্রিম কোর্ট। ভারতীয় বিচারপতিদের ওইসব মন্তব্য বাংলাদেশের জন্য অক্ষরে অক্ষরে প্রযোজ্য। বেশি কিছু ব্যাখা করার দরকার পড়ে না।
ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট অবশ্য এটাও বলেছে যে, এই ধারা বাতিলের অর্থ এই নয় যে, সোশ্যাল নেটয়ার্কিং সাইটে যে কোনো আপত্তিকর মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করা যাবে এবং সে জন্য শাস্তি হবে না। দেশ ও সমাজের পক্ষে ক্ষতিকর কিংবা অশালীন মন্তব্য বা ছবি পোস্ট করার ক্ষেত্রে এখনও নিষেধাজ্ঞা জারি থাকছে।
আমরাও মনে করি, কেউ যদি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা চর্চার নামে সীমা লঙ্ঘন করে তবে তার শাস্তি হতেই পারে। তবে এর জন্য কমপক্ষে ৭ বছর শাস্তি অবশ্যই হওয়া উচিত নয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, কোনো ব্যক্তি শুধু হাসি-ঠাট্টা বা মজা করার জন্য কিছু লিখে তথ্যপ্রযুক্তি আইনে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ওই ধারাটি দেশের নাগরিকদের হাসি-ঠাট্টা-মশকরা করার অধিকারও কেড়ে নিয়েছে। একে এমনভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যার কারণে ইন্টারনেটের যে কোনো কর্মকাণ্ড অপরাধ মনে করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।
কোনটি অপরাধ আর কোন অপরাধের মাত্রা কেমন এ বিষয়ে আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে কোনো নির্দেশনা কি দেওয়া হয়নি? রাষ্ট্র ওই আইন করে রক্ষণশীলতার পরিচয় দিয়েছে, উদার মনোভাব দেখাতে পারেনি। কারণ নাগরিকরা কোনো কিছু লেখার সময় যদি চিন্তা করে, এটা লিখলে বা বললে কত বছর জেলে থাকতে হবে, তাহলে লেখার গতি যে এগুবে না তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আইনটিতে মানহানির বিষয় এমনভাবে রাখা হয়েছে যাতে রাজনৈতিক উদ্দেশে ব্যবহার করার সুযোগ থেকে যায়। সে সুযোগের ব্যবহারও ঘটে চলেছে। রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নিয়ে নানা জন নানা রকম মন্তব্য করতেই পারেন। সেগুলো এত গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার দরকার পড়ল কেন? রাজনীতিবিদরা কি যুগ যুগ ধরে এসব কথাবার্তা হজম করে আসছেন না? তারা তো কোনোকালে এসব আমলে নেননি। কিছু ব্যক্তি আর অতিউৎসাহী পুলিশ মামুলি কিছু মন্তব্য আমলে নিয়ে নাগরিকদের কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছেন ,যা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজে কাম্য নয়।
মূলতঃ বাকস্বাধীনতা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে যারা কথা বলেন তাদের জন্য আইনটি খুবই বিপদজনক। যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তির ওপর এই আইন কার্যকর হয়ে যেতে পারে।
অথচ বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯(১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তাদান করা হইল।
৩৯(২)অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে 'রাস্ট্রের নিরাপত্তা,বিদেশী রাস্ট্রসমুহের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ,জনশৃঙ্খলা ,শালীনতা বা নৈতিকতার স্বার্থে কিংবা আদালত-অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ-সংঘটনে প্ররোচনা সম্পর্কে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসংগত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে (ক) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে যে , প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকারের এবং (খ) অনুচ্ছেদে , সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইলো ।"
যেখানে সংবিধানে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া আছে ঠিক তার উল্টো আইসিটি এ্যাক্ট দ্বারা তা নিয়ন্ত্রিত বা খর্ব করার চেস্টা হয়েছে । যা পবিত্র সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক ।
মুক্তচিন্তার স্বাধীনতা রক্ষার জন্যই আজ সময় এসেছে আইসিটি এ্যাক্ট পরিবর্তন ও সংশোধনের ।
©somewhere in net ltd.