![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাক্ষী বাতায়ন ধারের বটবৃক্ষের পাতা / হিশেব করে ফেরত চাহি, আজকে মনের হালখাতা...
খৃস্টীয় ১৯৬৫ সাল ; নিউজিল্যান্ড এর ডুনিডেন শহরের ওটাগো মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন এক তরুণ । নামের আগে যুক্ত হয় 'ডাক্তার' পদবী। ডাঃ এড্রিক এস বেকার।
পরে ওয়েলিংটনে ইন্টার্নি শেষে নিউজিল্যান্ড সরকারের সার্জিক্যাল টিমে যোগ দিয়ে চলে যান যুদ্ধবিধ্বস্থ ভিয়েতনামে। সেখানে কাজ করেন ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত। মাঝে অষ্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডে পোস্টগ্রাজুয়েশন কোর্স করেন ট্রপিক্যাল মেডিসিন, গাইনী, শিশু স্বাস্থ্য বিষয়ে। ১৯৭৬ সালে পাপুয়া নিউগিনি ও জাম্বিয়ায় যান। কিন্তু কোথাও মন টেকেনি। এরই মধ্যে জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে চলে যান যুক্তরাজ্যে। এক বছর পর সুস্থ হয়ে ১৯৭৯ সালে চলে আসেন বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এসে এড্রিক বেকার প্রথমে মেহেরপুর মিশন হাসপাতালে প্রায় দু’বছর ও পরে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কুমুদিনী হাসপাতালে আটমাস কাজ করেন। তার কোনো বড় হাসপাতালে কাজ করার ইচ্ছে ছিলো না। ইচ্ছে ছিলো প্রত্যন্ত গ্রামে কাজ করার। অন্যরকম কিছু করার। সে চিন্তা থেকেই চলে আসেন মধুপুর গড় এলাকায়।
১৯৭১ সালে কাজ করছিলেন ভিয়েতনামের একটি মেডিকেল টিমে। তখন বাংলাদেশে চলছে মুক্তিযুদ্ধ। পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের মানুষের উপর বর্বরতা, ভারতগামী শরণার্থীদের ছবি দেখে এদেশের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন তিনি ।
ডিসেম্বরে বিজয়ের খবর শুনে খুবই উল্লাসিত হন। তখন থেকেই তার খুব ইচ্ছে একবার বাংলাদেশ ঘুরে যাবেন। আসলেনও ১৯৭৯ সালে। কিন্তু আর ফিরে যেতে পারলেন না। বাংলাদেশের টানে এদেশের মানুষের টানে রয়ে গেলেন। দীর্ঘদিন যাবৎ মধুপুর গড় এলাকায় অবস্থান করে দরিদ্র মানুষের চিকিৎসা সেবা করে গেছেন।
সাধারণ মানুষের মনের কথা পড়তে মধুপুরের জলছত্র খ্রীষ্টান মিশনে এক বছরে বাংলা ভাষা শিখে নেন। তারপর যোগ দেন গড় এলাকার থানারবাইদ গ্রামে ‘চার্চ অফ বাংলাদেশে’র একটি ক্লিনিকে। সেই থেকে প্রত্যন্ত পাহাড়ী এলাকায় অবস্থান করে মানুষের স্বাস্থ্য সেবা দিতে শুরু করেন ডাঃ বেকার।
১৯৮৩ সালে দু’জন খন্ডকালীন এবং তিনজন সার্বক্ষণিক কর্মী নিয়ে বেকারের যাত্রা শুরু হয়। দিনদিন বাড়তে থাকে রোগীর সংখ্যা। তখন পাশের গ্রাম কাইলাকুড়িতে ১৯৯৬ সালে উপকেন্দ্র খুলে চিকিৎসা সেবা দেয়া শুরু করেন। ২০০২ সালে একটি পূর্ণাাঙ্গ স্বাস্থ্য কেন্দ্র হিসেবে কাইলাকুড়িতে কাজ শুরু হয়। এখন সেখানে শতাধিক গ্রাামীন যুবক-যুবতীকে প্রশিক্ষিত করে চলছে বেকারের স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম।
মধুপুর উপজেলা সদর থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার উত্তরে প্রত্যন্ত পাহাড়ি এলাকায় কাইলাকুড়ি গ্রামের অবস্থান। এলাকার আদিবাসী-বাঙালী প্রায় সবাই দরিদ্র। এরকম একটি প্রত্যন্ত এলাকায় চার একর জায়গার উপর ডাঃ বেকারের স্বাস্থ্য কেন্দ্র। ছোট ছোট মাটির ঘরে হাসপাতালের ডায়াবেটিস বিভাগ, যক্ষা বিভাগ, মা ও শিশু বিভাগসহ আলাদা আলাদা বিভিন্ন বিভাগে চল্লিশ জন রোগী ভর্তির ব্যবস্থা রয়েছে। আগত রোগীদের সবাই দরিদ্র।
ঐ এলাকাবাসীদের ভাষ্য মতে ডাক্তার ভাই আসার পর কেউ বিনা চিকিৎসায় মারা যাননি।
ভোগ বিলাস পরিহার করে পাহাড়িয়া এলাকার প্রত্যন্ত অঞ্চলে মানুষের চিকিৎসা সেবা দিয়ে কাটিয়ে গেছেন সারাজীবন।
গরীব দুঃখী মানুষের সেবায় নিবেদতি থাকায় ‘ডাক্তার ভাই’ বলে পরিচিত হয়ে যান ডাঃ এড্রিক। দীর্ঘ ৩৫ বছর টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ে দরিদ্র ও অসহায় মানুষদের বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা বিলিয়ে গেছেন তিনি। মানবতার প্রতীক হয়ে উঠা ডাঃ বেকারকে ২০১৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়।
এড্রিক বেকারের জন্ম ১৯৪১ সালে নিউজিল্যান্ডের রাজধানী ওয়েলিংটনে। বাবা জন বেকার সরকারের পরিসংখ্যানবিদ ছিলেন। মা বেট্রি বেকার ছিলেন শিক্ষক। চারভাই দু’বোনের মধ্যে দ্বিতীয় এড্রিক।
শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা আনতে চাইলে তিনি অপরাগতা প্রকাশ করে বলেন, এই এলাকার মানুষদের সাধ্য নেই যেখানে যাবার, সেখানে আমিও যাবোনা। ইচ্ছে ছিলো তাঁর তৈরি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উঠানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করবেন। তাই হয়েছে।
সারাজীবন মানুষের কল্যাণে কাজ করাই ছিল যার ব্রত। টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করে গেছেন ডাক্তার বেকার। লোভ লালসার উর্ধ্বে উঠে মানবিক মূল্যবোধ সম্পন্ন এমন মানুষ সাধারণত পাওয়া যায় না। গত মঙ্গলবার দুপুরে ৭৪ বছর বয়সে তিনি পরলোকগমন করেন।
আর আমরা একটু জোরে বাতাস ছাড়লেই সিঙ্গাপুর দৌঁড় দেই। আমাদের এখনও অনেক কিছু শেখার বাকি। দেশপ্রেম, দেশের প্রতি দায়িত্ববোধ, শ্রদ্ধাবোধ সহ আরও অনেক কিছু শেখা বাকি।
'ডাক্তার ভাই' এর মতো ডাক্তার তৈরি হোক, তার সাথে তৈরি হোক কাইলাকুড়ি এলাকার মতো আদিবাসী, জনগণ। যাঁরা শ্রদ্ধা করতে শিখেছিলো ।
যাঁরা কখনও কলার চেপে বলেনি, আমাকে মামলায় জিততে হবে। এই এই জিনিস লিখে দেন...
©somewhere in net ltd.