নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

অদৃশ্যমান মাধ্যমে দৃশ্যমান প্রতিবিম্ব খুঁজে বেড়ায় যে ...

রৌদবালক মামুন

সাক্ষী বাতায়ন ধারের বটবৃক্ষের পাতা / হিশেব করে ফেরত চাহি, আজকে মনের হালখাতা...

রৌদবালক মামুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

এক দেশে ছিলো এক \'এনাটমিস্ট\'

৩১ শে মার্চ, ২০১৬ রাত ১:২৫

শিশু যখন গল্পের সাথে পরিচিত হয় তখন সে যে শিরোনামের গল্প সবচাইতে বেশি শুনে তা হলো- এক দেশে ছিলো এক রাজা, তাঁর ছিলো ইয়া....

কোনো একদিন হয়তো মেডিকেল কলেজ এর প্রথম ক্লাসে শিক্ষক তাঁর ছাত্রদের পাঠদানের পূর্বে একটি গল্প শোনাবেন - এক দেশে ছিলো এক এনাটমিস্ট, তাঁর ছিলো ইয়া বিশাল এক উদার মন ...

১৯৬১ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ)-এ মাতা আছিয়া সুলতানার কোলে আসেন তিনি। পিতা ডা. মিরাজ আহমেদ ছিলেন সামরিক অফিসার, পরবর্তী সময়ে যিনি ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

দুই ভাই এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন মেঝ, বড় ভাই বর্তমানে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের এনাটমি বিভাগের প্রধান। বোন সবার ছোট।

ছোটবেলা থেকেই তিনি ছিলেন তুখোড় মেধার অধিকারী। বড় ভাই যখন প্রথম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত ছিলেন, তিনি নার্সারিতে আসাধারণ ফলাফলের পুরস্কার স্বরূপ ডাবল প্রমোশন পেয়ে বড় ভাইয়ের সহপাঠী হয়ে যান।
এরপর প্রথম শ্রেণিতে পুনরায় অতুলনীয় ফলাফলের কারণে তাঁকে উপরের ক্লাসে ডাবল প্রমোশন দেওয়া হয়। কিন্তু সেদিনের ছোট্ট সেই যাদুকর বড় ভাইয়ের সাথে থেকে যাবেন বলে আর ডাবল প্রমোশন নেননি।

১৯৭৬ সালে কুমিল্লা বোর্ডের অধীনে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুল থেকে এসএসসি পরীক্ষায় চার বিষয়ে লেটার মার্কস সহ প্রথম বিভাগ অর্জন করেন তিনি। অর্জিত মার্কস ছিল ৭৪%, আর সম্মিলিত মেধা তালিকায় তিনি অর্জন করেন ১৫তম স্থান।

১৯৭৮ সালে ঢাকা বোর্ডের অধীনে ময়মনসিংহের নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষায় ঠিক একই রেজাল্টের পুনরাবৃত্তি, চার বিষয়ে স্টার মার্কসহ প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ এবং ৮২.২% মার্কস পেয়ে সম্মিলিত মেধা তালিকায় ১৫তম স্থান।

এরপর মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার সিঁড়ি পার হয়ে মেধার স্বাক্ষর রেখে অধ্যয়নের সুযোগ পান ঢাকা মেডিকেল কলেজে। এতসব নাগরিক সুবিধা উপেক্ষা করে মাইগ্রেশন করে চলে আসেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ (মমেক)-এ। কারণ বড় ভাই সুযোগ পেয়েছেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে । নামের পাশে ঢাকা মেডিকেল কলেজ লেখার চাইতে ভাইয়ের পাশে থাকাকেই বেছে নিয়েছেন আগে। দু’ভাই মেডিকেল জীবন শুরু করেন মমেকের 'ম-১৬' ব্যাচে ।

মেডিকেলে এসেও সফলতা তাঁর হাতছাড়া হতে পারেনি । মেধার স্বাক্ষর রাখতে থাকেন অবিরাম ভাবে। অভূতপূর্ব কৃতকর্ম ও ফলাফলের জন্য পুরো ক্যাম্পাসে হয়ে ওঠেন সকলের পরিচিরত মুখ।

প্রথম পেশাগত পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রথম স্থান অধিকার করেন, দ্বিতীয় ও তৃতীয় পেশাগত পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান এবং চতুর্থ অর্থাৎ চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষায় প্রথম স্থান অর্জন করে তাঁর অসাধারণ, তীক্ষ্ণ মেধার পরিচয় বহাল রাখেন। মেডিকেলে যতগুলো বিষয় পাঠ্যভূক্ত ছিলো, তাতে শুধু কমিউনিটি মেডিসিন ও ফরেনসিক মেডিসিন ছাড়া বাকি সব বিষয়ে অনার্স মার্কস (৭৫%) অর্জন করে ১৯৮৪ সালে তিনি এমবিবিএস সম্পন্ন করেন।

অর্জন নামক গাড়ির চাকা এখানেই থেমে যায়নি। কেবল তো শুরু। ১৯৮৪-৮৫ সাল পর্যন্ত সহকারী সার্জন হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে । ১৯৮৬ সালে অষ্টম বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন এবং স্বাস্থ্য ক্যাডারে পুরো বাংলাদেশে প্রথম স্থান অর্জন করেন।

শরিয়তপুরের জাজিরা থানায় মেডিকেল অফিসার হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়তার সাথে দুই বছর (১৯৮৬-৮৮) দায়িত্ব পালন করেন । এরপর প্রভাষক হিসেবে দু’বছর (১৯৮৮-৯০) দায়িত্ব পালন করেন ঢাকা মেডিকেল কলেজে ।
এনাটমিতে স্নাতকোত্তর কোর্সের জন্য প্রেষণে যান ১৯৯০ সালে। তৎকালীন আইপিজিএমআরের অধীনে এমফিল এনাটমিতে পাস করেন ৭৫% মার্কসহ এবং ঠিক যেন গৎবাধা নিয়মে এখানেও প্রথম স্থান অর্জন করেন।
যদিও বাবা ডা. মিরাজ আহমেদের ইচ্ছে ছিল তাঁর তুখোড় মেধাবী ছেলেটি অনেক বড় সার্জন হবে। কিন্তু মূলত মেডিকেলে শিক্ষক হিসেবে ক্যারিয়ার গড়ার জন্যই বেসিক সাইন্সে (এনাটমি) এমফিল করেছেন তিনি।

এমফিল শেষে ১৯৯৩ সালে এনাটমি বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে। এনাটমিতেই পিএইচডি ডিগ্রি অর্জনের জন্য ১৯৯৪ সালে পাড়ি জমান জাপানে । ওসাকা ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৯৯ সালে। সেখানেও রেকর্ড সংখক মার্কস অর্জন করে স্পেশাল রিকমেন্ডেশন পান, তাঁকে গবেষণার কাজে জাপানে থেকে যেতে বলা হয়। বেশ উচ্চ পারিশ্রমিকেই। কিন্তু তিনি রাজি হননি। পয়সা আর আর সম্মানের লিপ্সা কখনো তাঁকে যে কখনও টানেনি। ফিরে আসেন নিজ দেশে।

১৯৯৯ সালে দেশে ফিরে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন নিজের পুরোনো কর্মস্থল ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে। ২০০১ সাল পর্যন্ত সেখানেই কর্মররত ছিলেন । জ্ঞান পিপাসা তখনও তাঁর পিছু ছাড়েনি । জন্ম দিয়ে যাচ্ছিলেন নতুন নতুন বিস্ময়ের। জ্ঞানের নেশা ছিল তাঁর। ২০০১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভেটেরিনারি এনাটমিতে কম্পেয়ারেটিভ এনাটমিতে এম এস কোর্সে প্রবেশ করেন। সাফল্যকে পৈত্রিক সম্পত্তি বানিয়ে এখানেও প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হন এবং তিনিই বাংলাদেশের একমাত্র এনাটমিস্ট যিনি মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণির মধ্যকার তুলনা নিয়ে অধ্যয়ন করেছেন।

এক কর্মস্থলে বেশিদিন মন টিকেনা তাঁর। বদলি হন। ২০০১-০২ সাল পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খুলনা মেডিকেল কলেজে।

এরপর নামের পাশের সহযোগী শব্দটি সরিয়ে যোগদান করেন সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজে । ২০০২-০৬ সাল পর্যন্ত অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সিওমেকে। এরই মাঝে ২০০৪ সালে সিলেট এম.এ.জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ থেকে ফরেনসিক মেডিসিনে ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করেন। এ অর্জন শুধুই অর্জন নয়। বরাবরের মতো প্রথম স্থান। ২০০৫ সালে অর্জন করেন ফরেনসিক মেডিসিনে এমসিপিএস ডিগ্রি। ২০০৬-০৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনস্থ সেন্টার ফর মেডিকেল এডুকেশন থেকে লাভ করেন MMed ডিগ্রি।

এরপর ২০০৯-১১ সাল পর্যন্ত অধ্যাপনা করেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে। ২০১১ সালে অধ্যাপক ও অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন নব্য শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজে। জীবনের শেষ সময়ে শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ, কিশোরগঞ্জ-কে পুরোপুরি দাঁড় করানোর পেছনে বলতে গেলে পুরো কৃতিত্ব তাঁরই। ভবন প্রতিষ্ঠা, লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা সব বিভাগে যথাযথ শিক্ষক নিয়োগে একাই দৌড়েছেন, প্রথম বর্ষের ছোট্ট ছেলেমেয়েগুলো যেন কোনোভাবেই বঞ্চিত না হয় সেই চিন্তাই তাঁর মাথায় ছিল সব সময়।

বাংলা ছাড়াও তাঁর দখল ছিল আরও সাতটি ভাষায়। ইংরেজি, আরবি, উর্দু, ফারসি, হিন্দি, জাপানি ও জার্মান। মেডিকেল সমাজে তাঁর নাম জানে না এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর । অথচ তিনি ক্লিনিশিয়ান ছিলেন না, জনসমাজে ক্লিনিশিয়ান চিকিৎসকগণ পরিচিতি পেলেও বেসিক সায়েন্সের তিনিই এমন একজন ব্যতিক্রম ব্যক্তি যাঁর নাম প্রায় সকলেরই জানা ।

এত মেধা সত্ত্বেও এত অর্জন সত্ত্বেও তিনি ছিলেন একেবারেই প্রচারবিমুখ , শিক্ষক হিসেবে তাঁর সব ধ্যান জ্ঞান ছিল মেডিকেলের শিক্ষার্থীদের নিয়ে। ক্লাস সময়সীমা শেষেও বিকেলে এবং রাতে শিক্ষার্থীদের পাঠদান করাতেন নিজ উদ্যোগে। নিঃস্বার্থ ভাবে। আর দুর্বল শিক্ষার্থীদের জন্য থাকত আলাদা যত্ন। প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ফোন নম্বর রাখতেন, নিয়মিত ফোনে পড়াশোনার খোঁজ নিতেন, একজন বাবার মতোই। নিজেই বলতেন- ‘এই মেডিকেল তোমাদের মা, আর আমি তোমাদের বাবা।’

এতক্ষণ মনে মনে যে নামটি উচ্চারণ করছিলেন সেটিই সঠিক । অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল। এনাটমির কিংবদন্তি শিক্ষক।

অনেকটা নিভৃতেই তিনি চলে গেলেন ২০১৫ সালের ২৪ ডিসেম্বরে। প্রিয় ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ত্যাগ করেছিলেন শেষ নিঃশ্বাস। দুটো শার্ট, দুটো প্যান্ট। এভাবেই যার বছরের পর বছর কেটে গেছে, যে কক্ষে থাকতেন সেথায় একটি চৌকি, একেবারেই সস্তা দরের একটি চেয়ার, একটি টেবিল অনুরূপ যেগুলো ছাত্রাবসে শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করে। টেবিলজুড়ে বই, বিছানার এক পাশজুড়েও বই, পাশে একটু ঘুমানোর জায়গা। এ রকম প্রচারবিমুখ, মিতচারী, অকৃতদার এবং নির্বিশেষে মেডিকেল শিক্ষার্থীদের একজন অভিভাবক ছিলেন অধ্যাপক ডাঃ মনছুর খলিল।

বড় ভাই অধ্যাপক ডাঃ মহসিন খলিল। দু'ভাইয়ের কেউই সংসার জীবনে জড়াননি। জীবন উৎসর্গ করে গেছেন জ্ঞান তপস্যায়।

একা একা থাকতেই বেশি পছন্দ করতেন প্রথিতযশা এই এনাটমিস্ট। সমাজ-সামাজিকতায় খুব একটা মানিয়ে ওঠার চেষ্টা করতেন না। ছাত্র-ছাত্রীরাই ছিল তাঁর সন্তান, তাদের ঘিরেই তাঁর সব চিন্তা ভাবনা। তারা কিভাবে আরো ভালোভাবে জ্ঞানার্জন করবে, কিভাবে পড়াশোনা সহজ করে নিতে পারবে। নতুন ভর্তি হওয়া ছাত্রদের জন্য নিজেই নীলক্ষেতে থেকে বই কিনে উপহার দিতেন। প্রত্যেক ছাত্রই তাঁকে বাবার মতো দেখত, বাবা বলেই সম্বোধন করত। মাসে যে বেতন পেতেন তার থেকে নিজের চলার জন্য যা লাগে তা রেখে মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিতেন। মা মারা যাওয়ার পর সেই টাকা দান করে দিতেন এতিমখানায়। মৃত্যুর পর ব্যাংক ব্যালেন্স ছিল মাত্র দুই হাজার টাকা।


চোখের জলে প্রিয় শিক্ষককে বিদায় দেবার পর তাঁকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে যে লেখাগুলো চোখের পাতাকে আরও সিক্ত করেছিলো -

• নাদিয়া আপুর থিসিস ডিফেন্ডের সময় স্যার বলছিলেন – ‘এমএমসি তোমার মা , এখান থেকে এমফিল ডিগ্রী নিয়ে যাচ্ছ, নিজের মা কে কখনও ভুলে যেও না।’
-যুবায়ের আহমেদ

• দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পরে ১ দিনের আল্টিমেটামে হেড-নেক কার্ড দিলাম । স্যার শুধু বলেছিলেন, ‘বাচ্চা, তুমি শুধু তোমার খেয়াল রাখবে। তুমি তো ডাক্তার হচ্ছো । এর চেয়েও বড় ব্যাপার আগে মানুষ হয়ে বেঁচে থাকো।’
তখন বুঝেছিলাম তিনি আসলে ভুল করে পৃথিবীতে চলে এসেছিলেন। পৃথিবী তো খারাপ মানুষের জায়গা ।
-ফাবলীনা নওশীন

• প্রফের আগে কার্ড হারিয়ে স্যারের কাছে গেছি।

তুমি কি রাজনীতি করো?
– না স্যার।

তোমার কী প্রেমিকা আছে ?
– না স্যার।

তাহলে কার্ড এখনো ইনকমপ্লিট কেনো? আমার সাথে বাটপারি করবে না ।
বলার পর স্যার গালে একটা চুমু দিয়ে বললেন যাও বাবা পড়াশুনা করো ভালো করে ।
মনে হলেই মন থেকে শ্রদ্ধা আসে। কী এক অদ্ভুত মানুষ…!!
-সোহান চৌধুরী

• আমরা দুই ঘণ্টা ক্লাস করলাম। আমরা নয়জন, যারা এনাটমিতে ডাব্বা মারছি। ভর দুপুরে একজন প্রফেসর একের পর এক ভিসেরা ধরিয়ে হাতে কলমে আমাদের শেখাচ্ছেন – দৃশ্যটা রেয়ার, খুবই রেয়ার।
-কাজী মুনতাসীর বিল্লাহ মিশু


• আরেকটা কারণে মনছুর খলিল হয়তো বিশ্বে অদ্বিতীয়। তিনি সমগ্র জীবন নিজের মায়ের হাতের সেলাই করা জামা-কাপড় পরেছেন।
-লিলি ফারুক

• অসংখ্যবার বুকে জড়িয়ে ধরেছেন তার অসংখ্য ছাত্রকে। বারবার একটা কথাই মুখে থাকত তার, ‘আমার বাচ্চারা পারবে’!
এই একটা কথাই যেন বুকে এক বিশাল শক্তি এনে দিত। কখনো তার শিক্ষার্থীর উপর বিশ্বাস হারাতেন না।
-মেজবাহ উদ্দিন আহমেদ

• পিতা মনছুর খলিল স্যার।
বাবা কখনো তাঁর ছবি উঠাতে দিতেন না আমাদের। বকা দিয়ে সরিয়ে দিতেন। অন্যদের ছবি উঠাতে বলতেন। তাহলে তারা খুশি হবে। অনেক হাত জোর করে এই ছবিটা তুলেছিলাম আমি সেদিন।
বাবার বহু ছবি আর স্মৃতি আমার কাছে আছে কিন্তু বাবা আর নেই আমাদের মাঝে।
আমরা শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল পরিবার পুরোপুরি এতিম হয়ে গেলাম।
এভাবে হারাতে চাইনি তোমাকে বাবা।
এভাবে হারাবো কখনো ভাবিনি।
ক্ষমা করে দিও আমাদের।
আমার বাবা, আমাদের বাবার জন্য সবাই দোয়া কইরেন।
আল্লাহ বাবাকে বেহেস্ত নাসিব করুন।
আমিন।
– মীর শওকত নেওয়াজ নীরব

• দুর্বল ছাত্রদের জন্য একই সাথে আতংক; একই সাথে তাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। তাই যে যত বড় সাবজেক্টেই পড়ুক না কেন, যত বড় পোস্টেই থাকুক না কেন, মনছুর স্যারের কথা শুনলে শ্রদ্ধায় মাথা নামিয়ে রাখতে বাধ্য এবং যে ছাত্র জীবনে একবার মহসিন স্যার অথবা মনছুর স্যারের সান্নিধ্যে এসেছে স্যার-কে আজীবন মনে রাখতে বাধ্য।
-মোস্তাফিজুর রহমান তপু


• ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ আপনার স্মৃতি সংরক্ষণ করবেই।। জীবনের শেষ মুহুর্তেও আপনি মমেক এর চিকিৎসার উপর আস্থা রেখেছিলেন। ভালো থাকবেন স্যার ।
-ডা. ইমতিয়াজ সিয়াম

• আমি জীবনে কোন ফেরেশতা দেখিনি। দেখার সাধও নাই। কারণ আমি মনছুর খলীল স্যারকে দেখেছি।
-মামুনুল হক


• সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে সিনিয়র ভাইয়াদের মুখে প্রফেসর ডা. মনসুর খলিল স্যারের নাম অনেক শুনেছি। উনাদের সময়কার অনেক স্যার-ম্যাডামকেই তো আমরা পাই নাই। তাদের নামও জানি না। জানার কথাও না। কিন্তু মনসুর খলিল স্যারের নাম জানে না। স্যারের গল্প শোনেনি এমন কেউ নেই।
স্যারের ইন্তেকালের খবর পাওয়ার পর সবাই স্যারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন। দোয়া করছেন। এখন মনে হচ্ছে বাংলাদেশের সব ডাক্তার সব মেডিকেল স্টুডেন্ট স্যারের সম্পর্কে জেনে ফেলেছেন।

আচ্ছা এত বড় মাপের একজন শিক্ষাবিদ, ছাত্র ছাত্রীদের কাছে এত প্রিয় একজন শিক্ষককে কেন জাতীয় অধ্যাপক বানানো হলো না?
প্রতিবছর কত তেলবাজ মানুষকে জাতীয় সম্মাননা দেয়া হয়। তার মতো ভালো মানুষকে কেন দেয়া হলো না? নিদেনপক্ষে কোন পত্রিকা বা টিভি চ্যানেল তো একটা নিউজ করতে পারতো। তাও তো চোখে পড়লো না।
যদি ডাক্তার নামের কোন দলবাজ ক্ষমতালিপ্সু অমানুষ মারা যেত, যদি শিক্ষক নামের কোন তেলবাজ অর্থলিপ্সু অমানুষ মারা যেত তাহলে ঠিকই আমরা কালো ব্যাজ ধারণ করতাম। টিভি চ্যানেলে স্মৃতিচারণ হতো। পত্রিকায় ক্রোড়পত্র বের হতো। সবাই চিনতো। সবাই জানতো। জাতীয় কোন সম্মাননা পাওয়া না থাকলে মরণোত্তর সম্মাননা দেয়া হতো।

আমাদেরই বা কী দোষ। আমরা ছোটবেলায় গরু রচনা শিখেছি তাই ঐসব গরুদের চিনি। গরুদের স্তুতি গাই। মানুষ রচনা শিখলে মনসুর খলিল স্যারের মতো মানুষদের চিনতাম। সম্মান দিতাম। তাদের মতো হওয়ার চেষ্টা করতাম।

আল্লাহ্ তাআলা যেন স্যারের কবরকে বেহেশতের বাগান বানিয়ে দেন। আমীন।
স্যারের মতো আরো ভালো মানুষদের যেন আমাদের কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষক হিসেবে পাঠিয়ে দেন। আমীন। আমীন।।
– নাজিরুম মুবিন

• স্যার এর হাতের ঘড়িটা তার প্রিয় শিক্ষকের দেয়া (আশির দশকে) যা তিনি মেরামত করে পরতেন ।
-ডাঃ অসূল আহমেদ চৌধুরী
(সাবেক প্রিন্সিপাল, সিওমেক)

• স্যারের সাথে শেষ দেখা ঈদে। সালামী চাইতেই পকেটে হাত দিয়ে দুই টাকার চকচকে একটা নোট যাদুকরের মতো বের করে নিয়ে এলেন।
স্যার মাত্র দুই টাকা!
সালামী সালামীই, কত সেটা বড় কথা না।
-মানিক চন্দ্র দাস

• হাসপাতাল কম্পাউন্ডে প্রতি শুক্রবার বিকেলে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গাড়ি আসতো। একদিন দেখলাম গাড়ি রাখার রাস্তাটায় পায়চারী করছে মনছুর খলীল স্যার। গাড়ী এসে থামলো। আশে পাশের কোয়ার্টার থেকে বাচ্চারা দৌড়ে আসছে। বই জমা দিয়ে বই নিবে। কিন্তু সবার আগে মনছুর খলীল স্যার। এই বইপড়ুয়া শিক্ষাবিদকে ভুলি ক্যামনে?
-সেলিম শাহেদ


• এনাটমির ভাইবা। এক্সটারনাল একটা মাসল এর অরিজিন জিজ্ঞেস করলেন বললাম। এরপর ইন্সারশান। আমি একটু থেমে গেলাম। মনে পড়ছে না, দেখি মনছুর স্যার ক্যাডাভার এর ক্ল্যাভিকলে হাত দিয়ে আছেন। আমি উত্তর দিলাম, স্যার ক্ল্যাভিকল! ভাবা যায়?

আমার এখনো হাসি পায়, ফরেনসিক এর মোয়াজ্জেম স্যারকে দেখলেই মনসুর স্যার জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মত আদর করতেন। কত জনকে যে রুমে ডেকে বই দিয়ে, উপদেশ দিয়ে সাহায্য করেছেন তার ইয়ত্তা নেই।

মনছুর স্যার সুপারিশ পছন্দ করতেন না। এক্সামে দেখাদেখি করলেই স্যার খাতা নিয়ে যেতেন আর ফেইল নিশ্চিত। আর অপছন্দ করতেন মিথ্যে বলা। কেউ স্বার্থপরের মতো ভালো রেজাল্ট করবে এটাও স্যার এর কাছে ১০০% ভালো না , ভালো স্টুডেন্ট খারাপদের টেনে তুললেই স্যার খুশী হতেন।

এখনো মনে আছে মনছুর স্যার অন্যান্য স্যারদেরকে পোষ্টকার্ডে চিঠি লিখে খবরাখবর জানতেন। একদিন দেখলাম এনাটমী ডিপার্টমেন্ট থেকেসার্জারীর আর এস সালেহীন স্যার এর কাছে পোষ্টকার্ডে চিঠি লিখেছেন।

স্যার এভাবেই সবার প্রিয় ছিলেন।

একজন পিতা, একজন সৎ মানুষ, একজন সফল শিক্ষক হতে এর বেশী আর কিছুই লাগে না।

আর লিখতে পারছি না, চোখ ভিজে আসে। বারবার ২৩ শে ডিসেম্বর রাতের কথাই মনে পড়ে।

এই সেই ডিসেম্বর।

স্যার ভালো থাকবেন।

– মৃণাল সাহা


(কৃতজ্ঞতা স্বীকারঃ যিনি বিভিন্ন তথ্য দিয়ে সাহায্য না করলে এই লেখা হয়তো লেখা হয়ে উঠতো না। ডাঃ যুবায়ের আহমেদ স্যার-ভাই।)

মন্তব্য ৫ টি রেটিং +৬/-০

মন্তব্য (৫) মন্তব্য লিখুন

১| ৩১ শে মার্চ, ২০১৬ সকাল ৯:০৮

বিজন রয় বলেছেন: অনেক কিছু জানলাম।
++++

০১ লা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১১:৪৪

রৌদবালক মামুন বলেছেন: ধন্যবাদ, কষ্ট করে পড়ার জন্য :)

২| ৩১ শে মার্চ, ২০১৬ বিকাল ৪:১১

বঙ্গভূমির রঙ্গমেলায় বলেছেন:
বিনম্র শদ্ধা জানাই।

৩| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ৮:৫৮

মায়াবী রূপকথা বলেছেন: খুব ভাল এবং খুব খারাপ দুটোই লাগছে। ভুল করে পৃথিবীতে এসেছিলেন। শ্রদ্ধ্যা রইল অনেক।

৪| ০১ লা এপ্রিল, ২০১৬ রাত ১০:৩৯

হন্টক হিমু বলেছেন: অসামান্য শ্রদ্ধা স্যারের প্রতি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.