![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সাল ২০০২। প্রতিটি মেলার মত সেই মেলাতেও গিয়েছিলাম। আমার বয়স তখন ১৫। মা বাবা স্বল্প শিক্ষিত হলেও বই যে একটা ভালো জিনিস, আমাকে বুঝতে শিখিয়েছিল। আমিও ভালবাসতাম।সায়েন্স ফিকশান আর হিমুর খুব ই ভক্ত ছিলাম। সবাই কে বই পরতে উৎসাহিত করতাম। তখন হাতে গোনা কিছু লেখকের নাম জানতাম। এই যেমন, হুমায়ুন আহমেদ, ইমদাদুল হক মিলন, জাফর ইকবাল ইত্যাদি। তখন শুধু আমি অবুঝ পাঠক।
আমার একজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন নারী। লেখক তখনও অখ্যাত (আমার কাছে)। নাম হুমায়ুন আযাদ। বইয়ের মলাট খুব একটা পছন্দ হলনা। খুব ই অনাগ্রহ নিয়ে পরতে শুরু করলাম। যতই গভীরে যাচ্ছিলাম, ততই হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হচ্ছিলাম। যাবতীয় বিশ্বাস ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাচ্ছিলো! ছোট্ট মস্তিষ্কটা কেমন যেন নিষ্প্রভ হয়ে উঠছিল। বুঝতে পারছিলামনা এই লেখা আমি বিশ্বাস করবো কি না। অবশেষে সিদ্ধান্ত নিলাম এইসব লেখা ভুয়া, এবং মানুশ কে বিপথে নেবার জন্যই এই সমস্ত লেখা হয়। হুমায়ূন আযাদ কে চরম গালি গালাজ করলাম। আমার বন্ধুরাও একমত হল।
এরপর একটু দেরিতে হলেও তসলিমা নাসরিন এর সাথে পরিচয় হল। এবং যথারীতি তাকেও আমি দুশ্চরিত্রা, বেহায়া এবং অধার্মিক পাষণ্ড মনে করে আস্তাকুরে ফেললাম।
এরপর ধীরে ধীরে পরিচিত হলাম আহমেদ ছফা, শিরশেন্দু মুখপাদ্ধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, বুদ্ধ দেব গুহ প্রভৃতি লেখকের লেখার সাথে। আসলে ভাবতে শিখলাম কিছু কিছু। যখন সাহস করে শরৎচন্দ্র পড়লাম, আমার ভাষার দক্ষতা ত বাড়লই, সেই সাথে ভাবনার গভীরতাও বাড়ল।
আবার নতুন করে পুরনো চিন্তাগুলো মাথা চাড়া দিতে শুরু করলো। কেমন যেন অসহায় মনে হতে লাগলো নিজেকে। এই সমস্ত সত্য গুলো ক্রমেই পাশ কাটিয়ে যাবার অযোগ্য হয়ে উঠলো। তখন ২০০৪ সাল, সেদিন ছিল ২৭ শে ফেব্রুয়ারী। বই মেলা শেষের এক দিন বাকি। মা কে পটিয়ে, বাবা কে জ্বালিয়ে তিনশ টাকা ম্যানেজ করে বই মেলায় যাবার জন্য প্রস্তুত হলাম। গেলাম বই নিয়ে ফিরে এলাম। রাতে খবর দেখতে গিয়ে দেখলাম হুমায়ূন আযাদ নামের একজনকে বই মেলায় কুপিয়ে চাপা আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। আমি অবাক হলাম। কেন শুধু শুধু একজন কে মারা হবে!!!! পরে জানলাম যে তিনি নাকি ধর্মের বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। যাক নোংরা লোক মরাই ভালো! কিন্তু একটা খটকা লাগলো। যখন বাবড়ি মসজিদ ভাঙ্গা হল, তখন শুধু শুধু বাংলাদেশের হিন্দু গুলকে চরম লাঞ্ছিত করা হোল। স্লোগান তৈরি হল “দুই একটা হিন্দু ধর, সকাল বিকাল নাস্তা কর”। এই লোকটা সেই অমানবিক ঘটনারও তীব্র প্রতিবাদ করেছিলো। কিন্তু সেটা ত খারাপ কাজ হতে পারেনা! আবার ফিলিস্তিনের নির্যাতনের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সদা সোচ্চার। একই লোক দুই ধর্মের জন্য সমব্যাথী হয় কি করে? সমস্যা কোথায়? এটা কেমন কথা। আমিতো ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি যে, যে যেই ধর্মের লোক সে সেই ধর্মকে রক্ষা করে। কিন্তু এই লোক দেখি সব ধর্মকেই ধুয়ে দেয়!!! কি ব্যাপার!!!!!!!!! আমার প্রশ্ন শুনে লোক হাসত। বলত ওগুলা নাস্তিক। সেই প্রথম নাস্তিকতার সাথে আমার পরিচয়। ওহ, আরেকটা কথা, আমি হুমায়ূন আযাদ কে আর অসম্মান করতে পারছিলাম না। এর মধ্যেই শামসুর রহমান কেও মেরে ফেলার চেষ্টা করা হল। আমার বিশ্বাস তীব্র হতে লাগলো।
অনেক দিন ধরে আবার সেই পুরনো বই গুলো পড়লাম। বুঝতে শিখলাম, যে মানবতা নামের আরেকটা ধর্ম আছে। সেই ধর্মের মুল কথা হল সেই চণ্ডীদাসের সেই অমর উক্তি। “সবার উপর মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই”। পড়লাম আরজ আলী মাতুব্বর। যিনি কিনা প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা নেননি। কিন্তু কি তার বিশ্লেষণী ক্ষমতা!!! যে কোন চরম শিক্ষিত লোক কেই ঘোল খাইয়ে দিতে পারে। বুঝলাম যে এই ধরনের মানুষ হতে চরম শিক্ষিত হবার প্রয়োজন নাই। শুধু নিরপেক্ষ ভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা আর সাহস থাকতে হয়। তাহলেই সত্য মিথ্যার ফারাক স্পষ্ট হয়ে যায়।
ক্রমেই ব্লগ নামক মরন ব্যাধির (!!!!!) সাথে পরিচয়। হ্যাঁ, ঠিক ই বলছি। মরন ব্যাধি। না হলে ব্লগ এ লিখলেই মৃত্যু কেন হয়? ব্লগে এসেই পরিচিত হলাম অভিজিৎ, সুব্রত, আসিফ মহিউদ্দিন, মান্নান, বন্যা, সাদিয়া, রাজীব ইত্যাদি লোকের সাথে। দেখলাম (অবাক হয়ে) আমি যা ভাবছি, এরাও তাই ভাবে। তবে কেউ কেউ একটু বেশীই উদ্ধত। এতটা না হলেই আসলে ভালো। তবুও বলতে হয় তারা যুক্তি ছাড়া কিছুই লিখতেন না। আমার মনে হতো সব যুক্তির বিপরীতেও নিশ্চয়ই যুক্তি আছে। কিন্তু সেই সব যুক্তি যারা দিতেন, তারা যে কতখানি জানেন বা বোঝেন, আমার বোধগম্য হতোনা। কমেডি মনে হতো। একদিন দেখলাম গনজাগরন মঞ্চ!!! বুঝলাম ব্লগ কতটা ক্ষমতা রাখে!! দেখলাম একে একে আসিফ, রাজীব, আরও একজন (নাম মনে নেই) এর উপর হামলা হল। একজন ত মরেই গেল। আমরা অনেক চিল্লা ফাল্লা করলাম। কিন্তু নাস্তিক হবার দোষে মানবিক বিচার পেলামনা। অবশ্য আমাদের অতি গুরুত্বপূর্ণ কিছু সাধারন মানুষ ও তাদের প্রান ভরে গালি দিতেন। আমি নিজেই শুনেছি কতবার!!! ফল কি? আমাদের সরকার আমাদের ব্যবহার করে দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় থেকে গেলো। কৌশল এ আসল গণজাগরণ হয়ে গেলো কার্যত সরকারের লোকদের আড্ডাখানা। কষ্ট পেলাম। নির্যাতিত হলাম। হত্যাকারীদের কিছু হলনা বরং কিছু ব্লগার কে ধরে আচ্ছা করে মেরামত করে দেওয়া হোল। হায়রে আমার দেশ। আমাদের বাবা, ভাইরা এই দেশ দেখার জন্য রক্ত দিয়েছিলেন!!! এই দেশে একটা মেধাবী, মুক্তচিন্তার লোকও থাকবেনা। সব বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। আসলে এই দেশের মানুশেরা তাদের কি ই বা দিতে পারে!!! অপমান, আর মৃত্যু ছাড়া? এই মানুষ গুলো কি সেই মানুষ, যারা পাকিস্তানীদের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছিলো!!!!
না বোধয়। আজ সেই সব লোক বিলুপ্ত হয়েছে। মানবতা গেছে জাদুঘর এ। নইলে লাখো মানুষের মধ্যে একটা মানুষ কে মেরে ফেললো, কেউ ঠেকাল না!!!! আমরা কি মানুষ!!!!! সে নাস্তিক না আস্তিক, তার গায়ে ত লেখা ছিলোনা!!!! তবুও কেন কেউ তাঁকে বাঁচাতে গেলনা? অমানুষের দেশ হচ্ছে কি বাংলাদেশ!!!! মনে হচ্ছে তাই।
অভিজিৎ এর মৃত্যুর পর দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ব্লগ এ এক চরম শিক্ষিত ভদ্রলোক যা লিখেছেন, তা সংক্ষেপ করলে যা দাড়ায়, অভিজিৎ ছিল ঘর অমানুষ। সে মুসলিম কে আসলে বিয়ে না করে লিভ টুগেদার করছিলো যা কোন শাস্ত্র সম্মত নয় এবং এই জাতীয় লোক দের এভাবেই নাকি মরা শ্রেয়।
পাঠক, আমি খুব ই সাধারন মানুষ। খুব বেশী জানিও না। শুধু জানি, কার ব্যক্তিগত জীবন একান্তই তার। শুধু সমাজে তার কর্মটাই মুখ্য। কর্মের দিক হিসেব করলে এই মানুষ গুলো দেশ, সমাজের জন্য অনেক কিছুই করেছেন। যেমন বিদেশি অর্থ দেশে এনে সরাসরি সুবিধা বঞ্চিত মানুষের কাজে লাগানো, নিজেদের উপার্জিত অর্থ দেশে পাঠিয়ে রেমিটেন্স বাড়ানো ইত্যাদি। আমি এইগুলকে মোটামুটি ভালো অবদান ই বলতে চাই। কিন্তু এই যে জঙ্গি গুলো, যাদের অনেক শিক্ষিত (তথাকথিত) লোকের সমর্থন রয়েছে, তারা কি অবদান রাখছেন দেশের প্রতি? হ্যাঁ তারাও বিদেশি অর্থ দেশে আনে। এনে বোম বানানোর কাজে লাগায়। চোরাচালান, আদম ব্যবসা ইত্যাদি তারা সবার ছখের সামনেই করে। তারপরও তাদের কি জয়গান আমাদের সমাজে!!!! হ্যাঁ, এই কাজ অনেক ভালো বড় বড় লোকেরাও করেন। কিন্তু তারা কখনও কখনও ধরাও পরে। কিন্তু এরা ধরা পরেনা। কেন পরেনা সে এক বিরাট রহস্য। নাহলে এত হত্যার বিচার হয়না। নিজ দেশে, নিজ ভাষায় নিজের মত প্রকাশ করা যাবেনা। করলেই নির্ঘাত মৃত্যু!!!
ইংল্যান্ড এ পশু অধিকার আইন আছে। প্রতিটি পশু (পোষা) যাতে সঠিক পরিচর্যা পায়, অবহেলায় মৃত্যু না হয়, তার মনিটর করা হয়। সমস্যা পেলে নগদ ব্যবস্থা। আর আমাদের দেশে মানুষ মেরে ফেলে অমানুষেরা, আর উলটো মরা মানুষ ই বিচারের মুখোমুখি হয়।
আমাদের ইতিহাস এর দিকে তাকিয়ে, নিজের প্রতি ঘেন্না হয় পাঠক। সেটাই কি স্বাভাবিক নয়?
©somewhere in net ltd.