নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

Our sweetest songs are those that tell of saddest thought (Shelly).

রূপক বিধৌত সাধু

মন রে, কৃষিকাজ জানো না; এমন মানবজমিন রইল পতিত আবাদ করলে ফলত সোনা! রামপ্রসাদ সেন ([email protected])

রূপক বিধৌত সাধু › বিস্তারিত পোস্টঃ

আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (শেষ পর্ব)

২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ১:১৫


আত্মস্মৃতি: কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় (ষষ্ঠাংশ)
তখনও পর্যন্ত সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন; এমন কেউ ছিলেন না আমাদের নারাঙ্গী গ্রামে। উচ্চশিক্ষিত যারা ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই পড়েছেন ময়মনসিংহের আনন্দমোহন কলেজে। কেউ কেউ পড়েছেন গাজীপুরের ‘ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ’ থেকে। আমার ইচ্ছে ছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার, সেখানে না হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে।

গ্রামে বা ভালুকা সদরে থেকে পড়ালেখায় সুবিধে করে উঠার সুযোগ ছিল না। তাই আমাদের পার্শ্ববর্তী গ্রাম মেনজেনার এক বড়ো ভাই হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে ময়মনসিংহ শহরে চলে এলাম। উঠলাম কলেজ রোডের ওখানকার এক ছাত্রাবাসে। ভর্তি হলাম বিদ্যাময়ী স্কুলের বিপরীতে অবস্থিত ‘ইউনিএইড’ নামক বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং সেন্টারে।

ময়মনসিংহ শহরে এই প্রথমবারের মতো থাকতে শুরু করেছি। কারও সাথে তেমন মেলামেশা করার সুযোগ নেই। পথঘাট কোনোকিছু ঠিকমতো চিনিও না। প্রথম প্রথম চলতে-ফিরতে বেশ কষ্টই হলো। যদিও একসময় সব চেনাজানা হয়ে গেল। সিলভার ক্যাসেল, ব্রহ্মপুত্র সংলগ্ন জয়নুল আবেদীন পার্ক, বিপিন পার্ক, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আমার আপন হয়ে ওঠে। ওসব জায়গায় না গেলে কেমন জানি শূন্য শূন্য লাগত।

কিছু বন্ধু-বান্ধবও জুটে গেল। ফয়সাল নামের একজন ছিল জামালপুরের, মোতালিব নামের একজন ছিল ত্রিশালের বালিপাড়ার। তার সঙ্গেই আমার বোঝাপড়াটা বেশি ভালো ছিল। দুইজন একসঙ্গে রেললাইন ধরে হেঁটে হেঁটে কোচিংয়ে যেতাম। পড়ালেখার বিষয়ে আলোচনা হতো। অবসরে দুইজন ব্রহ্মপুত্রের পাড় ধরে হাঁটতাম।

কোচিং চলল মোটামুটি ছয় মাস। পড়ালেখা অতটা খারাপ হলো না। খালিদ নামের এক বড়ো ভাই আমাদের বাংলায় দক্ষ করে তুললেন, ইভান নামের একজন ব্যবস্থাপনার সব ভয় দূর করে দিলেন। ইংলিশ-হিসাববিজ্ঞান নিয়ে ভয়ও কেটে গেল। এরপর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার ফর্ম তুলে পরীক্ষা দিতে লাগলাম। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়; এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়। সময়মতো পরীক্ষাকেন্দ্রে পৌঁছতে না পারার কারণে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষাটাশ অংশগ্রহণ করতে পারিনি।

আমি ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্র। মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক দুটোই ব্যবসায় শিক্ষা। একে আসন কম, এছাড়া প্রস্তুতিও একেবারে আহামরি ছিল না। মোটামুটি চলে। তখনও পর্যন্ত জানতাম না অন্য ইউনিটেও পরীক্ষা দেওয়া যায়। এ ছিল আমার বহির্জগত সম্পর্কে জানার দৌড়!

যাহোক, পরীক্ষা তো দিচ্ছিলাম কিন্তু কোথাও সুযোগ হচ্ছিল না আমার। হতাশায় একেবারে মুষড়ে পড়েছিলাম। এ ফোন দিচ্ছে, ও ফোন দিচ্ছে; জানতে চাচ্ছে কোথাও সুযোগ হলো কি না। লজ্জায় মোবাইলও বন্ধ রাখার সুযোগ নেই। হঠাৎ যদি কোনো সুখবর আসে!

শেষ পর্যন্ত টিকলাম কেবল ত্রিশালের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। পার্শ্ববর্তী উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান বলে ভর্তি হওয়ার আগ্রহ ছিল না। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো, তাই ত্রিশালে পরীক্ষা দেওয়া!

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এ এবং সি দুই ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম। দুটোতেই চান্স হলো। এ ইউনিটে ছিল বাংলা এবং ইংরেজি। মৌখিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বাংলা পেলাম। তবে কয়েকজনের প্ররোচনায় ভর্তি হলাম সি ইউনিটে, মানে ব্যবসায় প্রশাসনে। বিষয় হিসেবে পেলাম এইচআরএম। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ভুলগুলো একটি করলাম।

মোতালিব আরও কয়েকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিল। আমার টাকায় কুলাচ্ছিল না। তাই আর কোথাও পরীক্ষা দেইনি। তবে আমার কয়েকজন সহপাঠী ‘ভাওয়াল বদরে আলম সরকারি কলেজ’ থেকে আমার হয়ে ফর্ম পূরণ করেছিল। আমি পরীক্ষায় একটু সহযোগিতা করলে ওদের উপকার হয়। তাই এই পরীক্ষাটা দিয়েছিলাম। পরীক্ষায় ৪৯তম হয়েছিলাম। সহপাঠীরাও ভাওয়ালে পড়ার সুযোগ পায়।

ত্রিশালের চরপাড়া এলাকায় ‘খাদিজা’ নামে এক ছাত্রাবাসে উঠলাম। পরিচিত এক ভাই ধ্রুব এখানে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। এখান থেকে বিশ্ববিদ্যালয় ৫-৬ মিনিটের পথ। এখানে ছয় মাস রইলাম। এরপর ‘চন্দ্রবিন্দু’ নামে নতুন আরেকটা ছাত্রাবাসে উঠি। এটার অবস্থান চরপাড়াতেই। এই ছাত্রাবাসটা একেবারেই নতুন। নামকরণটাও আমারই করা।

বিশ্ববিদ্যালয়টা ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। যখন ভর্তি হলাম, প্রতিষ্ঠার মোটে চার বছর চলছে। অ্যাকাডেমিক ভবন দুটো। কলা ভবন এবং বিজ্ঞান ভবন। আর ছিল প্রশাসনিক ভবন। আমরা বিজ্ঞান ভবনে ক্লাস করি। আমাদের বিজনেস অনুষদ মাত্র তিনটে বিষয় (অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, এইচআরএম) নিয়ে শুরু করেছে। একেবারে নিচতলায় অ্যাকাউন্টিং, পঞ্চমতলায় ফিন্যান্স। আমরা, মানে এইচআরএমের শিক্ষার্থীরা কখনও নিচতলায়, কখনও পঞ্চমতলায় উদ্বাস্তুর মতো ক্লাস করতে লাগলাম। মাস্টার্সের প্রথম সেমিস্টার পর্যন্ত এমনই চলল। আমাদের নিজস্ব ভবন পাঠদানের উপযোগী হয়ে উঠে একেবারে শেষ সেমিস্টারে। আমরা ছিলাম এইচআরএমের প্রথম ব্যাচ। প্রথম হলে জ্বালা যে কত, আমরা হাড়ে হাড়ে টের পেলাম।

বাড়ি থেকে পড়ালেখার খরচ চালানো কঠিন। কিছু একটা করার চেষ্টা করছিলাম। এরমধ্যে আমাদের উপজেলার নুরুল আমিন নামের একজনের খপ্পরে পড়ে ডেস্টিনিতে পনেরো হাজার টাকা ধরা খেলাম! লোকটার সাথে বাবার পরিচয় হয়েছিল রাস্তায়। লোকটা আমাদের বাড়িতে আসেন। আমার কিছু করা দরকার ছিল। উনি ডেস্টিনির গল্প করেন। আমি প্ররোচিত হয়ে ফাঁদে ধরা দেই।

প্রথমে ‘খাদিজা’ নামে যে ছাত্রাবাসটায় উঠেছিলাম, র্যাগিংয়ে অতিষ্ঠ হয়ে উঠলাম। অর্থনীতি বিভাগের তৌহিদ, সুমন, জনি, ইমরান, অপু, আমিনুল নামের কিছু বড়ো ভাই নামক বর্বর এখানে থাকার পরিবেশ রাখলেন না, তাই আমার এক সহপাঠী আলফাজকে নিয়ে ‘চন্দ্রবিন্দু’তে উঠে যাই।

‘চন্দ্রবিন্দু’তে একে একে আরও অনেকেই আসে। দুই ঘরের ছাত্রাবাস একসময় ছয় ঘর হয়ে যায়। সবাই মোটামুটি টিউশনি বা স্কুল-কোচিংয়ে জড়িতে হতে থাকে। আমি কোথাও কিছু করার সুযোগ পাই না। সঙ্কোচে কাউকে বলতেও পারি না একটা টিউশনি জোগাড় করে দিতে। ভেতর থেকে ভেঙে পড়তে থাকি।

এভাবেই ঠেকে ঠেকে ত্রিশালে দুই বছর কাটল। তেমন কিছু করতে পারলাম না। আড়াই-তিন হাজার টাকা হলে ত্রিশালে থাকা-খাওয়া সব হয়ে যেত। অথচ অভাগা আমি সেটারও সংস্থান করতে পারলাম না। যখন কিছুই করতে পারলাম না, শুয়ে-বসে মা-বাবার অন্ন ধ্বংস করছি; তখন ময়মনসিংহ শহরে চলে এলাম। যদিও সহপাঠীরা ত্রিশালে থেকে যেতে বলল। কিন্তু তারা তো আমার মর্মবেদনা বুঝতে চেষ্টা করেনি।

ময়মনসিংহ শহরে নিশ্চয়ই কিছু একটা হবে। সম্ভাবনাও দেখা দিল। এক কাকাত বোন একটা টিউশনির ব্যবস্থা করল। সমস্যার কারণে যাওয়ার তারিখ একদিন পেছানোয় টিউশনিটা হাতছাড়া হয়ে গেল। কিন্ডারগার্টেনে পড়ানোর একটা প্রস্তাব পেলাম। হাজার টাকা একটা টিউশনি। রুমমেট বলল, প্রচুর খাটায়। টাকা কম। পড়ালেখার ক্ষতি হবে। কী করব বুঝতে না পারায় এই সুযোগটাও হাড়ছাড়া হলো।

লোকের কথায় তো হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেললাম, এখন তো আর প্রস্তাব আসে না। রুমমেট কিছু করে দেওয়ার চেষ্টা করল বটে কিন্তু সেও সফল হলো না। সিভি দিতে লাগলাম বিভিন্ন স্কুলে, কোচিংয়ে। কিন্তু কেউ আমাকে ডাকল না। নওমহল এলাকায় এক কোচিংয়ে গেলে জানাল, ছাত্রছাত্রী জোগাড় করতে হবে। চিনি না, জানি না ছাত্রছাত্রী পাব কোথায়? শেষ আশা ছিল একটা বিশ্ববিদ্যালয় কোচিং, যেটা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিয়েই পরিচালিত হতো। সেখান থেকেও ডাকল না।

কূলহারা আমি ময়মনসিংহ শহর ঘুরেবেড়াই। একটা কাজ জোগাড় করতে পারি না। সুযোগ মিস করায় আফসোসের আগুনে পুড়তে থাকি। একসময় আমার পড়ালেখা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হয়ে দাঁড়াল ‘বসন্ত’। গুটিতে গুটিতে সারা শরীর ভরে গেল। শেষে বাড়িতে চলে এলাম।

সুস্থ হয়ে উঠার পর কয়েকমাস বাড়ি থেকে ত্রিশালে গিয়েই ক্লাস করলাম। এটা খুব কষ্টদায়ক ছিল আমার জন্য। সব জেনে ছোটোখাটো একটা কাজের বিনিময়ে এক মামা আমার পড়ালেখার দায়িত্ব নিলেন। বেশ কিছুদিন টাকা-পয়সা দিয়ে সহযোগিতা করলেন।

অনার্সের শেষদিকে মামা টাকা-পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দিলেন। উনার ব্যবসা ভালো যাচ্ছিল না। তখন ময়মনসিংহ শহর ছেড়ে দিয়ে আবার নিজের গ্রামে চলে এলাম। সোনালী ব্যাংকে ইন্টার্নশিপ ছিল তিন মাস। এ তিন মাস বাড়িতে থেকে, কিছুদিন সহপাঠী লুৎফরের সাথে আনন্দমোহন কলেজের তরুণ হলে থেকে শেষ করলাম। এরপর সিদ্ধান্ত নিলাম মাস্টার্স করব না। এত পড়ালেখার দরকার নেই। ছোটোখাটো একটা চাকরি যেকোনোভাবেই হোক আমাকে জুটাতে হবেই।

ছবি: প্রতীকি

বিশেষ দ্রষ্টব্য: আমার আত্মস্মৃতি কাঁটালতা উঠবে ঘরের দ্বারগুলায় এ পর্যন্তই শেষ হলো। এক থেকে সাত পর্বে আমার শিশুকাল থেকে অনার্স পর্যন্ত জীবনী স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করার চেষ্টা করলাম। এর পরের কাহিনীগুলো (গাজীপুর আসা, চাকরি না পেয়ে ময়মনসিংহে চলে যাওয়া, ভালুকায় কোচিং-টিউশন-স্কুলে পড়ানো, আবার গাজীপুর আসা, পদে পদে ধাক্কা খাওয়া, একটু গোছানো, করোনার থাবায় বাড়ি চলে আসা, ব্যবসা করে ধরা খাওয়া, ঢাকায় চলে আসা, টিকে থাকার চেষ্টা) অগোছালোভাবে ব্লগে পোস্ট করা হয়েছে। কিছু পোস্ট করা হয়নি। বই আকারে প্রকাশ করার সুযোগ পেলে ধারাবাহিকভাবে যোগ করে নেব। যারা ধৈর্য ধরে পড়েছেন, সাথে থাকার জন্য তাদের প্রতি অশেষ কৃতজ্ঞতা রইল।

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:০৩

শায়মা বলেছেন: এই লেখা তাড়াহুড়া করে লিখেছো ভাইয়া। বুঝাই যাচ্ছে। পরে আবার বাকীটুকুও লিখলে আবার পড়বো।

২৬ শে জুলাই, ২০২৪ দুপুর ২:১৭

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: আরও কিছু যোগ-বিয়োগ করে নিচ্ছি।

২| ২৬ শে জুলাই, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৪

কামাল১৮ বলেছেন: আন্দোলনে মানুষের মনের অবস্থা ভালো না।আন্দোলন এখনো শেষ হয় নাই।শুক্রবারের গোলাগুলি হয়েছে।

২৬ শে জুলাই, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৭

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: ছোট্ট একটা ইস্যু এত বড়ো ঘটনায় রূপ নেবে, শুরু থেকেই আঁচ করা উচিত ছিল। এই ক্ষত সেরে উঠতে সময় লাগবে।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.