![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
স্থপতি/শিক্ষক
চোখে আলো পড়তেই ঘুমটা ভেঙে গেল। আগের রাতে ঘুমানোর আগে বিছানা বরাবর যে জানালা তার পর্দা টেনে দিতে খেয়াল ছিল না। তাই ভোরের প্রথম স্নিগ্ধ আলোটা তার উপস্থিতি জানান দিতেই যেন কুম্ভকর্ণ আমাকে প্রবল বিক্রমে জাগিয়ে তুলল। তবে ঘুমটা জম্পেশ হয়েছে। ডিনারে হোটেল ওলাথাং এর দক্ষ শেফের হাতের গরম স্যুপ আর ওনটুন খেয়ে পাহাড়ের উপর পাইন বনে চন্দ্রস্নান শেষে বাথটাবে হট শাওয়ার নিয়েছিলাম, আর সারাদিন পারো শহরে টো টো করে ঘোরার ক্লান্তি তো ছিলই। তাই হ্যাগার্ডের বই হাতে যখন বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছি দু পৃষ্ঠা পড়তেই কখন যেন গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছি টের পাইনি। পর্দা যে টেনে দিতে ভুলে গেছি এটা হয়তো সে কারনেই। তবে ভালোই হল, ভুটানের স্নিগ্ধ ভোর যে এত সুন্দর হতে পারে ঘুমটা না ভাঙলে হয়ত সেটা অজানাই থেকে যেত। কম্বলের নিচ থেকে তাই বের হয়ে পর্দাটা আরও সরিয়ে দিলাম। তারপর আবার চিৎপটাং। তবে ঘুম ঘুম ভাব থাকলেও চোখ বোজা দায়, জানালার বাইরে আপেলের বাগান, তার পেছনে সবুজ পাইনে ঘেরা পাহাড়ের দেয়াল, আর তাতে ভোরের সূর্য আর দূরন্ত মেঘের খেলা, একে অপরকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতা, এ এক অদ্ভুত অপার্থিব দৃশ্য, কী অকল্পনীয় সুন্দর, কী অসাধারন, কী প্রেমময়। এ দৃশ্য না দেখে চোখ বন্ধ করাটা অসম্ভব। সুন্দরের আর প্রেমের এই আছন্নতায় হঠাৎ ছেদ পড়ল মোবাইলের টুং আওয়াজে। ছিকির মেসেজ।
‘কি... ঘুম ভাঙলো? তোমাকে নিতে আসব কখন? টাকসাং না যাবে আজ?’
ও হো আজ তো টাকসাং এ যাওয়ার কথা, টাকসাং মানে ভুটানের বিখ্যাত এক বৌদ্ধআশ্রম, ষোল শতাব্দীতে ভুটানের বৌদ্ধ ধর্মের প্রচারক পদ্মসম্ভবা পর্বতের চূড়ায় যা তৈরি করেছিলেন, বহির্বিশ্বে যা টাইগারস নেস্ট নামেই অধিক পরিচিত। শুনেছি সেখানে পৌঁছুতে তিন ঘন্টার মত পাহাড়ি পথে হাইকিং করতে হয়, দমে যাওয়ার মতই তথ্য, তবে ছবিতেই সেটা এত সুন্দর না জানি সামনা সামনি কতটা সুন্দর। সেই সৌন্দর্য উপভোগ না করে গেলে পুরো ভুটান ভ্রমনটাই যে বৃথা।
ছিকি দম্পতির সাথে এই পারোর রাস্তাতেই পরিচয়, অতঃপর বন্ধুত্ব। ভুটান হেলিকপ্টার সার্ভিসে চাকরি করে ও, আর ওর স্ত্রী কৃষি বিভাগে। অসম্ভব কিউট দম্পতি, দুজনকেই মানিয়েছে বেশ, চোখ জুড়িয়ে যায়, মানুষ হিসাবেও ওরা অসাধারণ। আজ ভুটানে সরকারি ছুটি। আগের সন্ধ্যাতে আড্ডায় ঠিক হয়েছে ও ওর গাড়ীতে করে টাকসাং পৌঁছে দেবে, ছুটিটা তাতে বেশ ভালই কাটবে ওদের।
‘এইতো এখনও বিছানায়, ভোর দেখি, তোমাদের ভোর খুব সুন্দর’, রিপ্লাই দিলাম।
‘হা হা হা, তা বটে, আমিও এখনো বিছানায়, রেডি হয়ে জানিয়ো, আসতে পনের মিনিট লাগবে আমার’ ছিকির উত্তর।
‘ওকে’
হুম...রেডি হতে হবে, পাশের বিছানায় আমার সফরসঙ্গী এখনও বিভোর ঘুমাচ্ছে। ডাকা দরকার, না থাক আর কিছুক্ষণ ঘুমাক। ডেস্কে রাখা চায়ের ইলেক্ট্রিক কেটলীটা অন করে দিয়ে ফ্রেশ হতে রেস্টরুমে ঢুকলাম। যখন বের হলাম ততক্ষণে পানি গরম হয়ে গেছে, কাপে গরম পানিতে একটা খাটি ভুটানি টি ব্যাগ ছেড়ে দিতেই সুন্দর মোহনীয় গন্ধ বের হল, চায়ের কাপ হাতে জানালার সিলে পা মেলে বসে পড়লাম। এই স্যুইটটাতে বারান্দা নেই, আসলে ভুটানের স্থাপত্য রীতিতে বারান্দা ব্যাপারটা খুব বেশি দেখা যায় না, ওদের কন্টেক্সের কারনেই। তাই জানালার সিলটা চওড়া করে তৈরি করা, যাতে পা মেলে বসা যায় আর প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। হাতে এককাপ চা, পাশে সবুজ প্রকৃতির অসাধারণ দৃশ্যপট, গুনগুনানি গান তাই চলেই এল, এ কি লাবণ্যে পূর্ণ প্রাণ প্রাণেশ হে...
সাড়ে সাতটা বেজে গেছে, সফরসঙ্গীকে ডাকা দরকার, নয়টার মধ্যে টাকসাঙের বেজক্যাম্পে পৌঁছানোর পরিকল্পনা নয়তো ভেস্তে যাবে। তবে সফরসঙ্গীকে বিছানা থেকে টেনে তুলতে বেশ বেগ পেতে হল, টাকসাঙের ক্লান্তিকর হাইকিং এর চেয়ে ওলাথাং হোটেলের নরম বিছানা যে অধিক সুখকর!
আটটার দিকে ছিকিকে ফোন দিলাম, ও জানাল সাড়ে আটটার আগেই ওলাথাং এ পৌছে যাবে। ছিকিই খোঁজ দিয়েছিল এই হোটেল ওলাথাং এর। পাহাড়ের চূড়ায় পাইন বনের মধ্যে অনেকটা শ্রীলঙ্কান স্থপতি জিওফ্রি বাওয়ার স্থাপত্য স্টাইলে তৈরি তিন তারা মানের অসম্ভব সুন্দর এই হোটেল। রেডি হয়ে হোটেলের রিসিপশনে অপেক্ষা করছি ছিকির জন্য, হোটেলের রুপবতী এটেন্ডেন্ট এসে জিজ্ঞাসা করল ব্রেকফাস্ট করেছি কীনা। ওকে হেসে বললাম, টাকসাং এ হাইকিং এ যাবো, তোমাদের বুফে ব্রেকফাস্ট করলে পেট ভারি হয়ে যাবে, টাকসাং পর্যন্ত আর যাওয়া হবে না। মেয়েটা হেসে ফেলল, ‘বেস্ট অব লাক’ বলে বলল, গাড়ী লাগলে জানিয়ো। সেটা বোধহয় দরকার হবে না, পিক করার জন্য বন্ধু আসছে.. বললাম আমি। মেয়েটা ‘ওকে’ বলে হাসিমুখে হালকা মাথা ঝাকিয়ে চলে গেল। এই বুঝি ছিকির গাড়ী এল, রিসিপশন লবি থেকে বাইরের পার্কিং লটটা দেখা যায়।
হালকা ব্রেকফ্রাস্ট অথচ প্রচুর এনার্জি দরকার। কী করা যায়? চকোলেট কেকের কথাই মনে পড়ল সবার আগে। গাড়ীতে চেপে তাই প্রথমেই চলে গেলাম ক্যাফে মাউন্টেনে, আগের সন্ধ্যাটা এখানেই কেটেছে। ক্যাফেতে ঢুকতেই কাউন্টারে বসে থাকা মেয়েটা চিনতে পারল, হাসিমুখে অভিবাদনও জানাল। অর্ডার দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে এল ব্লাক ফরেস্ট কেক, সেটা খেয়ে আর পরিমাণমত চকোলেট কিনে গাড়ীতে চেপে বসলাম, এবার উদ্দেশ্য টাকসাঙের বেজক্যাম্প।
পাহাড়ী আঁকাবাঁকা পথে এগিয়ে চলেছে গাড়ী। রাস্তার পাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা ঝর্ণা, পাহাড়ী নদী আর আপেলের ক্ষেত দেখতে দেখতে বেজক্যাম্পে পৌঁছে গেলাম। বেজক্যাম্প থেকেই পাহাড়ে হেটে হেটে টাকসাঙে যেতে হবে, এখান থেকে টাকসাঙকে দেখার চেস্টা করলাম, নাহ মেঘে ঢেকে আছে, দেখা যায় না কিছু। পথে আসতেই বৃষ্টি শুরু হয়েছে, বেজক্যাম্পেও সেই বৃষ্টি! চিন্তার ব্যাপার! টিকেট কাটতে হবে, টিকেট কাউন্টারের তরুণ ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল ভারতীয় কীনা। আমি সগৌরবে বললাম বাংলাদেশী। ও বাংলাদেশী! বলে ছেলেটা বেশ ভালবাসা মেশানো দৃষ্টিতে তাকাল। এই ব্যাপারটা ভুটানে এসে পর্যন্ত উপলদ্ধি করছি, ওরা ভারতীয়দের থেকে বাংলাদেশীদের বেশি পছন্দ করে, ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করেছিল আমাদের পুনাখা ভ্রমণে ট্যাক্সি ড্রাইভার ডুবজং। ভারতীয়দের অতিরিক্ত দাদাগিরি আর আভ্যন্তরীন বিষয়ে অযাযিত হস্তক্ষেপ এর কারনে সাধারন ভুটানিরা ভারতীয়দের পছন্দ করে না, অনেকটা আমরা যে কারনে করি না সেই একই কারণ। শুধু অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল বলে সমঝে চলে, এই যা। আর ভারতীয় পর্যটকদের আচরণও ওদের পছন্দ না। সে যাই হোক, কাউন্টারের ছেলেটা ভাল ইংরেজি বলে, তাই কথা এগুলো। ছেলেটা জিজ্ঞাসা করল থিম্পু পুনাখা ঘুরেছি কীনা। ওকে বললাম ওগুলো ঘোরা শেষ, টাকসাং ই শেষ যাত্রা, এখান থেকে সোজা বাংলাদেশ। ছেলেটা হেসে বলল, খুব ভাল সিদ্ধান্ত নিয়েছ, টাকসাঙ থেকে নেমে আসার পর সবাই এত ক্লান্ত হয়ে যায় যে আর কোথাও যাওয়ার শক্তি থাকে না। তবে বোধহয় ভুলদিনে চলে এসেছ। এ্যা বল কি? কেন? হতভম্ব আমি জানতে চাইলাম। ছেলেটা মুখে বিষন্নতা নিয়ে বলল গত দুইদিন ধরেই বৃষ্টি হচ্ছে, গতকাল রাতেও ঝুম বৃষ্টি হয়েছে, পাহাড়ি পথ পিচ্ছিল হয়ে আছে, ওঠা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।
‘তাহলে কি ফিরে যাব?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘ওঠার চেষ্টা করে দেখতে পারো, গতকালও অনেকে উঠেছিল, নেমেও এসেছে। তবে আজকের কথা বলতে পারছি না, উঠতে না পারলে নেমে এসো, ঝুকি নিয়ো না, বেস্ট অব লাক।’ বলল ছেলেটা।
এই গত ক’দিনে যাকেই বলেছি টাকসাঙে যাব সেই বলেছে ‘বেস্ট অব লাক’, তাই এই বাক্যটা অনেকটা বিদ্রুপের মত শোনাচ্ছে এখন। আচ্ছা আমার মোটা সাস্থ্য দেখে কি সবাই এমন বলছে? যেন মনে মনে বলছে তোর মত মটু উঠবে টাকসাঙে? হা হা হা । আর তারপর মুখে বলছে ‘বেস্ট অব লাক’! যেন টাকসাঙে ওঠার কোন সামর্থ্যই নেই আমার, ভাগ্য যদি সহায় হয় তবেই যদি উঠতে পারি! হাহ!
কাউন্টার থেকে টিকেট কেটে বেরিয়ে আসতেই দেখি ছিকি ততক্ষণে এক ঘোড়াওয়ালা ঠিক করে ফেলেছে। ঘোড়াতে কিছুটা পথ যাওয়া যায়, বলা বাহুল্য এই অংশটুকু কম খাড়া, হেটে উঠতেও খুব বেশি বেগ পাওয়ার কথা না। তবে ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা সাথে কিছুটা পথ এগুনোও গেল, মন্দ কি! খুশিমনে ঘোড়ায় চেপে বসলাম তাই। ঘোড়ায় চেপে বসার আগে ছিকি একটা শক্ত-সমর্থ দেখে লাঠি কিনে দিল, বলল কাজে দেবে। (সত্যিই খুব কাজে দিয়েছিল লাঠিটা) । তবে ছিকি উঠবে না, এর আগে উঠেছে সে, এর থেকে বউ এর সাথে পাহাড়ের কোলে বসে প্রেম করাটাকেই বেশি ভাল ওর কাছে, বিয়ে যে হয়েছে এই সেদিন!
ঘোড়াটার গায়ের রঙ গাঢ় বাদামী, বেশ শক্তিশালী। ঘোড়াটাকে পছন্দ হল বেশ। পাইন বনের মধ্য দিয়ে শুরু হল পথচলা। তবে গতি ধীর, পথ যে কাদায় প্যাঁচপ্যাঁচে হয়ে আছে! ঘোড়ায় চড়িয়া মদ্দ হাটিয়া চলিল- ব্যাপারটা অনেকটা এমনই দাড়াল। পাহাড়ী ঢালু পথে ওঠার সময় ঘোড়া পিচ্ছিল খেতে লাগল, সে এক বিভীষীকাময় পরিস্থিতি। আর ওদিকে ঘোড়াওয়ালা হিন্দিতে সমানে চেঁচাতে লাগল ‘জোরে আকড়ে ধরুন, নয়ত হাত ফসকে সোজা খাঁদে পড়বেন, খুঁজেও পাওয়া যাবে না’। প্রাণভয়ে প্রাণপনে তাই ঘোড়ার জিন আকড়ে ধরে থাকলাম, তাই ঘোড়ায় চড়াটা যতটা সুখের হবে বলে ভেবেছিলাম তা আর হল না, তবে রোমাঞ্চকর হল তো বটেই। অবশেষে একঘন্টার সেই রোমাঞ্চকর ঘোড়যাত্রা শেষ হল, এসে পৌঁছুলাম এক পাহাড়ের চূড়ায়, ঘোড়া থেকে নেমে আস্তাবল থেকে একটু সামনে এগিয়ে যেতে দেখা মিলল এক রেস্তোরার, পাহাড়ের ঢালে ভূটানের প্রচলিত স্থাপত্যরীতিতে তৈরি রেস্তোরা, ক্লান্ত হাইকারদের জলখাবারের ব্যবস্থা আছে এখানে, রেস্টরুম সুবিধাও মিলবে। তবে এই রেস্তোরার সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপারটা হল এখান থেকে দূরে পর্বতের মাথায় টাকসাংকে দেখা যায়। তাই বেশিরভাগ পর্যটকই এ পর্যন্ত এসে কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে দূর থেকে টাকসাঙের সৌন্দর্য উপভোগ করে দুধের সাধ ঘোলে মিটিয়ে চলে যান।
রেস্তোরার গোল উন্মুক্ত এক ছাওনীর নিচে বসলাম আমরা। ওই যে...ওই যে টাকসাংকে দেখা যাচ্ছে, মেঘের মাঝে লাল সাদার এক অনন্য স্থাপত্য। ওহ কী অপূর্ব, যেন হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকছে, কী অসাধারণ । যেতে তো হবেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলাম আমি। যে ছাওনীতে বসে আছি সেখানে পরিচয় হল কলকাতার এক বাঙালী পরিবারের সাথে, পুজোর ছুটিতে ওঁরা বেড়াতে এসেছে ভুটানে। নানান কথার ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, উপরে যাবেন না? প্রশ্ন শুনেই যেন আৎকে উঠলেন কত্রী মহিলাটি। খাটি কলকাতার নাকি বাংলায় বললেন, ‘না বাবা, পাগলে কামড়েছে নাকি? এখান থেকে যা দেখা যাচ্ছে তাই সই, আর পারবনা, এটুক আসতেই যা অবস্থাটা হল।’ কথা শুনে না হেসে পারলাম না। অবশ্য ওরা এ অব্দি হেটেই উঠেছে, ঘোড়ার পেছনে ‘খামোকা’ ব্যয়টা করেনি আর। কিন্তু আমরা কী করব? উঠব? টাকসাঙের তীব্র সৌন্দর্য যে প্রবল ভাবে ডাকছে, ভয়ংকর সুন্দর পিপাসু আমার মত মানুষের সে ডাক উপেক্ষা করার ক্ষমতা কই?
জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম সফরসঙ্গীর দিকে, সঙ্গী অসহায় দৃষ্টিতে তার কেডস এর দিকে তাকাল। একেবারেই গ্রিপ করছে না ওটা, সুতরাং ঝুকি নিয়ে উঠবে না সে, তার থেকে এখানে বসে থাকাটাই অনেক ভাল। মাথা ঘুরে তাকালাম অন্যজনের দিকে, এই জন সম্পর্কে এখনো বলা হয়ে ওঠেনি।
ফারদিন ফাত্তাহ, ছেলেটার সাথে এই ভুটান সফরেই পরিচয়। নেশায় পরিব্রাজক, শখের ইউটিউবার, এই সেদিন হল এম বি এ শেষ করেছে। যদিও তার টাকসাঙে আসার কোন পরিকল্পনা ছিল না, কিন্তু আমাদের সাথে জুটে যাওয়ায় আর অনেক কিছু বলে রাজি করাতে পারায় সে এখন টাকসাঙের মধ্যপথে। কি? যাবে নাকি? জিজ্ঞাসা করলাম ওকে। ভেবেছিলাম বলবে ‘না’। কিন্তু গভীর প্রত্যয়ে জানাল, সে যাবে। টাকসাঙের এত কাছে এসে তাকে না ছুঁয়ে চলে যাওয়াটা নাকি অপরাধের সামিল। যাক পাওয়া গেল একজনকে, নইলে তো মনে মনে ভেবেই রেখেছিলাম ‘যদি তোর ডাক শুনে কেও না আসে তবে একলা চল রে’। সফরসঙ্গী আমাদের ফিরে আসার অপেক্ষায় রেস্তোরাতেই অপেক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিল। (পরে শুনেছিলাম দুই অস্ট্রেলিয়ানের সাথে স্থাপত্য নিয়ে জ্ঞানগর্ভ বয়ানবাজি করে চারঘন্টা ভালই কেটেছিল তার!) । অতঃপর শুরু হল পথচলা।
খাড়া পাহাড়ী পথ। পাঁচ মিনিট হাটলেই দম ফুরিয়ে যায়। তবে মনের দম তো ফুরাবার না। এর আগে টানা ষাট কিলোমিটার সাইকেল চালানোর অভিজ্ঞতা থেকে জানি প্রথম প্রথম আয়েশী শরীর কষ্ট মেনে নিতে না চাইলেও একসময় ঠিকই মানিয়ে নেয়। সুতরাং সিদ্ধান্ত নিলাম থেমে থেমে ধীরে ধীরে উঠব। শরীর মানিয়ে নিলে গতি বাড়ানো যাবে। কিন্তু বৃষ্টিটা বেশ বাধা হয়ে দাড়াল, এমনিতেই পর্বতের উপরে বেশ ঠান্ডা আবহাওয়া, তার উপর বৃষ্টি, পরনের জ্যাকেট কিছুক্ষণের মধ্যেই ভিজে চুপচুপ হয়ে গেল। ঠান্ডা লাগছে বেশ। চলার রাস্তাটাও কাদাকাদা, পিছলে পড়তে পারি যখন তখন, তবে আশার কথা হল, অদ্ভুত হলেও সত্য আমার এপেক্স স্প্রিন্ট এর কেডসটা একদমই পিছলাচ্ছে না, বাহ..চমৎকার! নিজ দেশের পন্য বলেই গর্বে বুকটা ফুলে গেল, অথচ আমার সামনেই সাদা চামড়াদের নাইকি এডিডাস হরহামেশাই পিচ্ছিল খাচ্ছে। কীসের ব্র্যান্ড! যদি সেটা কাজের সময় কোন কাজে না লাগে? হুহ...।জুতাটার উপর ভরসা বেড়ে গেছে, তাই পিছলে পড়ার টেনশন বাদ দিয়ে নির্বিঘ্নেই হেটে চলেছি। এই হেটে চলাটা কষ্টকর তবে একঘেয়ে নয় মোটেই, কেননা কিছুসময় পরপরই পথের দৃশ্যপট পালটে যাচ্ছে, কখনও পাইনের ঘন বন, কখনও পাথুরে দেয়ালের পাশ দিয়ে হেটে যাওয়া, কখনও পাথরের সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠা, বৈচিত্রময় বটে।
হেটে চলেছি, হঠাৎ লক্ষ্য করলাম মাঝবয়েসি এক ভদ্রলোক পথের পাশে এক পাথরের চাইয়ে বসে ভয়ানক হাপাচ্ছে, নিশ্বাস নিতে যেন ভীষন কষ্ট হচ্ছে তার, মনে হচ্ছে মারা পড়বে। চেহারা আর গায়ের রঙেই বুঝে নিলাম লোকটা ভারতীয়।
ঠিক আছেন? কোন সমস্যা? কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম।
ঠিক হে...ঠিক হে... বহু কষ্টে হাত নেড়ে উত্তর দিল লোকটা। সব ঠিক হে...
বুঝলাম অনেকক্ষণ বিশ্রাম দরকার তার। শুভবাদ জানিয়ে আবার হাটা শুরু করলাম। ভেবেছিলাম পথে সাপ, বিছে কিংবা নিদেনপক্ষে জোকের দেখা পাব, কিন্তু সেরকম কারও সাথে দেখা হল না। এসব পাহাড়ে নাকি এনাদের তেমন একটা দেখা যায় না। তবে প্রায়শই চলার পথে সারি সারি প্রার্থনা পতাকা ঝুলতে দেখা গেল, অনেকটা আমাদের দেশে নির্বাচনের সময় দড়িতে যেভাবে পোস্টার ঝোলায়, অনেকটা সেরকম। ভুটানীদের বিশ্বাস এই পতাকায় লেখা প্রার্থনাগুলোকে বাতাস ছুঁয়ে যতদূর যাবে ততদূর পর্যন্ত সে প্রার্থনা ছড়িয়ে যাবে।
হাটার মাঝে প্রায়শই থামতে হল, কখনও জিরিয়ে নিতে, কখনও পানি খেতে আবার কখনও অসাধারণ কোন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে থমকে গিয়ে। যাই হোক এভাবেই হাটতে হাটতে প্রায় দেড় ঘন্টা পর পৌঁছে গেলাম এক পর্বতের চূড়ায়, এখান থেকে টাকসাঙকে স্পষ্ট দেখা যায়, অসাধারণ এক ব্যাপার। এই স্মৃতি ধরে রাখতে হবে, শুরু হল ফটোসেশন। টাকসাঙের খুব কাছে চলে এসেছি মনে হচ্ছে। টাকসাং দর্শন শেষ করে ফিরতি পথ ধরেছেন এক স্প্যানিশ তরুনী, তাকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম ওখানে যেতে আর কতক্ষণ লাগতে পারে ? সে জানাল আর আধঘন্টার মত। আর মাত্র আধাঘন্টা! চমৎকার! ছবি তোলা শেষ করে শুরু হল নতুন যাত্রা, এবং সম্ভবত সবচেয়ে ঝুকিপূর্ণ ও কষ্টকর যাত্রা।
বৃষ্টি পড়ছে সাথে পাল্লাদিয়ে মেঘও এসে ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঠান্ডায় থরকম্প অবস্থা, বুদ্ধিকরে হোটেলের রেস্টরুম থেকে শাওয়ার ক্যাপটা সঙ্গে এনেছিলাম বলে যা একটু রক্ষা, মাথাটা অন্ততপক্ষে ভিজছে না। পর্বতের গা বেয়ে পাথরের চাই দিয়ে তৈরি করা সিড়িঁ, এই সিড়িঁ বেয়েই যেতে হবে টাকসাং পর্যন্ত। সিড়িঁর বা দিকে তাকালে পর্বতের শরীর, আর ডান দিকে তাকালে শূন্যতা, নিচ পর্যন্ত দেখা যায় না, যাদের হাইটফোবিয়া নামক ব্যামো আছে তাদের জন্য ভয়ংকর বটে। আবার সেই সিড়িঁও একরকম নয়, ধাপগুলোর উচ্চতা একটার থেকে আরেকটা আলাদা। উপরন্তু বৃষ্টির পানিতে ধাপগুলো ভিজে আছে, প্রতিবছরই নাকি এখানে দূর্ঘটনায় মানুষ মারা যায়! যা আছে কপালে, সেই ভেজা সিড়িঁতে শুরু হল কষ্টকর পথচলা, খুব ধীরে সন্তপর্নে পার হতে হচ্ছে একেকটা ধাপ। সিড়িঁর ফ্লাইট কখনও উর্দ্ধমুখী কখনওবা নিন্মগামী। এই পাঁচ ফিট উপরে উঠছি তো আবার দশফিট নিচে নামছি, আবার পাঁচ ফিট নিচে নামছি তো পনের ফিট উপরে উঠছি। এলাহি কারবার। স্থাপত্যের ভাষায় একেই বলে ‘সাইট রেসপেক্ট’ করে নকশা। যারা সিড়ি বানিয়েছেন তারা পাথরের পর্বতকে ‘রেসপেক্ট’ করতে যে বাধ্য হয়েছেন তা বলা বাহুল্য। যা হোক চল্লিশ মিনিট পর অবশেষে শেষ হল সেই যাত্রা, পৌঁছে গেলাম একটা ছোট্ট পুলে, এবং সম্ভবত সবচেয়ে অবাক করা জিনিসটার দেখা পেলাম। অসম্ভব সুন্দর এক ঝর্ণা। পাথুরে পর্বতের গা বেয়ে আলোড়ন তুলে প্রবল বিক্রমে নেমে আসছে, পাথরের তটে সেই পানি বাড়ি খেয়ে ছোট নদী তৈরি করে নেমে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে ঢাকা পড়া উপত্যকায়, আর এই সরু নদীর উপর তৈরি পুলে দাড়িয়েই উপভোগ করছি এই নৈসর্গীকতা। আহা এ অব্দি না এলে তো একে দেখতেই পেতাম না। রেস্তোরা কিংবা পাশের পর্বতের চূড়া থেকে যে একে দেখাই যায় না!
শব্দ আর সৌন্দর্যে সম্মোহিত হয়ে রইলাম যেন, ঠিক কতক্ষণ মনে নেই, সম্মোহন কাটল ফারদিনের ডাকে। দ্রুত টাকসাঙের ভেতরে ঢুকতে হবে, নইলে মুল ফটক বন্ধ হয়ে যাবে দুপুরের খাবারের বিরতিতে, ঢুকতে হলে আবার একঘন্টার অপেক্ষা। ওহ টাকসাঙ, একদম আমার সামনে সমহিমায় দাড়িয়ে। যেন আমারই অপেক্ষায়। টিকেট দেখিয়ে ঢুকে পড়লাম ভেতরে, অবশ্য তার আগে হাতের ব্যাগ, ফোন, ক্যামেরা, লাঠি সবই জমা দিতে হল ক্লোকরুমে। বেশ ক’বছর আগে টাকসাঙে আগুন লেগেছিল, তাই এই বাড়তি নিরাপত্তা ব্যবস্থা। তাও ভাল, বেল্ট খুলে নেয় নি। এর আগে দিল্লিতে স্বামীনারায়ণ অক্ষরধাম কমপ্লেক্সে ঢুকতে গেছিলাম, ওরা তো কোমর থেকে বেল্টও খুলে নিয়েছিল! মহারাস্ট্রের অওরঙ্গবাদের ঘ্রিনেশ্বর শিবমন্দিরে ঢোকার সময় শার্টটাও খুলে নিয়েছিল, প্যান্ট যে খোলেনি এটা যেন ওদের দয়া! সে তুলনায় টাকসাং ভাল। শুধু হাতের জিনিসপত্র রেখে দিল, আর দরজার উপরে ঝোলানো বিজ্ঞপ্তিটাও নজর এড়াল না- ‘মার্জিত পোশাকে ঢুকুন’। ঢুকে পড়লাম টাকসাঙে, টাকসাঙকে বর্ণনা করা কঠিন। টাকসাঙ কোন পুরনো পরিত্যক্ত স্থাপনা নয়, পবিত্র স্থান। দেখতে পেলাম বিভিন্ন স্থানে তপস্যারত ভিক্ষুদের। টাকসাঙ একক কোন স্থাপনাও নয়, কম্প্লেক্স বলা যেতে পারে, কারণ ভেতরে বেশ কয়েকটি মণ্দির, বৌদ্ধভিক্ষুদের থাকার ঘর, প্রক্ষালন কক্ষ, আর রান্নাঘর রয়েছে। ঘি পোড়ানো ধোয়ার গন্ধে ম ম চারদিক। প্রতিটি মন্দিরেই বুদ্ধ ও বিভিন্ন নামী বৌদ্ধগুরুদের প্রতিমা নানা ঘটনাপ্রবাহের সাথে মিলিয়ে উপস্থাপিত আছে অসাধারণ শিল্পমণ্ডিত উপায়ে। নিচের সব মন্দিরে ঢুকে সেখানে থাকা এইসব অতি উচুমানের শিল্পকর্ম উপভোগ করতে করতে একসময় টাকসাংয়ের সবচেয়ে উচু স্থাপনায় উঠে পড়লাম, ঢুকলাম অপেক্ষাকৃত ছোট এক মন্দিরে। মন্দিরের ভেতর তপস্যারত এক ভিক্ষুকে দেখতে পেলাম। তাকে প্রণাম জানাতেই হাসিমুখে স্বাগত জানাল। ভেতরে ঢুকে জানালার পাশে গিয়ে দাড়ালাম, খুলে দিলাম জানালাটা। আর যে দৃশ্যটা দেখলাম তার জন্যই হয়ত এত কষ্ট সয়ে এতদূর আসা। চারপাশে মেঘের ভেলা, তার মধ্যে, সেই অসীম এর মধ্যে আমি যেন ভেসে বেড়াচ্ছি, পাথরের গায়ে ঝর্ণার পানি পড়ার আওয়াজ এক অভাবনীয় আধ্যাত্বিক জগৎ তৈরি করেছে এখানে। জীবনের সমস্ত না পাওয়ার ব্যাথা ভুলে এই অসীমের মাঝে নিজের ক্ষুদ্রতাকে আরেকবার উপলদ্ধি করে সুন্দরের তপস্যা করার সুন্দরতম পরিসর বোধহয় এটাই। নেতিচিন্তার জগত এখানে ছোট হয়ে আসে, সেখানে বুকের খাঁচার ভেতর যে হৃদয় সেখানে ভর করে বিশালতা, ব্রম্মান্ডের বিশালতা, সৃষ্টির বিশালতা, সৃষ্টিকর্তার বিশালতা। বন্ধচোখে বুকভরে নিঃশ্বাস নিলাম, শান্তি বর্ষিত হোক জগতের সকল সৃষ্টির প্রতি, শান্তি বর্ষিত হোক তোমার প্রতি, আমার প্রতি, আমাদিগের প্রতি।
ফিরতে হবে, ভাবনার জগতে ছেদ ঘটিয়ে বেয়াড়া মস্তিস্কের বাস্তব অংশটা ডাক দিল। হুম, ফিরতে হবে, বহুপথ পাহাড় বেয়ে নামতে হবে । বাস্তবতা আমায় ডাকছে।
ক্লোকরুম থেকে জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে হাটা শুরু করলাম, কিছুদূর হেটে এসে দাড়ালাম সেই পুলের উপর, সেই ঝর্ণার কাছে। অসাধারণ শব্দ লহরী। বৌদ্ধমন্দিরগুলো এ কারনেই ঝর্ণার কাছাকাছি তৈরি করা হয় বোধকরি, জল পড়ার শব্দকে আধ্যাত্বিকতায় ভেসে যাওয়ার উপাদান ধরে। ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছি ভারতের অজন্তার রককাট বৌদ্ধমন্দিরের ক্ষেত্রেও। পাহাড়ী ঝর্ণার পাশ ঘেষে যে পাহাড়ের পাথুরে শরীর তার গা কেটে তৈরি করা অসম্ভব সুন্দর একেকটি গুহামন্দির। প্রত্যেক গুহার ভেতরে ঢুকলেই জলের শব্দ আর নির্জনতার মিশেলে এক অদ্ভুত আধ্যাত্বিকতার জগৎ সৃষ্টি হয়। যাকগে, সে কথা না হয় আরেকদিন বলা যাবে। টাকসাঙে ফিরে আসি।
পাহাড়ে ওঠা কঠিন, নামা সহজ। কারণ ওঠার সময় উঠতে হয় পৃথিবীর মধ্যাকর্ষণ শক্তির বিপরীতে, নামার সময় মধ্যাকর্ষণ শক্তির দিকে। কিন্তু এই সহজ তত্ত্ব আমাদের জন্য খাটল না। কারণ বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়া পথ। নামাটা আরও কঠিন হয়ে গেল, সাবধান না থাকলে পা হড়কে দূর্ঘটনা ঘটা সময়ের ব্যাপার মাত্র। চোখের সামনেই দূর্ঘটনা ঘটেও গেল একটা। এক আমেরিকান পা হড়কালো, সোজা গিয়ে বাড়ি খেল পাথর খন্ডে। মুখের বামদিকটা পুরো থেতলে গেছে। ছুটে গিয়ে তার স্থানীয় ভুটানী এজেন্ট ধরল বটে তবে ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে, বেচারা পথের ধারে বসে পড়েছে, রক্ত বেরোচ্ছে মুখের বামপাশটা দিয়ে। নাহ, এ অবস্থায় আর যাই হোক তার পক্ষে বাকি পথ হেটে পাড়ি দেয়া সম্ভব না। এজেন্ট এর মুখ শুকিয়ে আছে, হাটা ছাড়া একে নিয়ে নামার যে আর কোন উপায়ই নেই। ততক্ষণে তার সাথে থাকা সফরসঙ্গীরা চলে এসেছে, টিস্যু পেপার রুমাল দিয়ে রক্ত বন্ধের টেষ্টা করছে। আমরা আর তাই বেশিক্ষণ ভিড় করলাম না। আরও সন্তপর্ণে শুরু করলাম পথচলা। পথে দেখা মিলল সেই ভদ্রলোকের, যে হাপিয়ে মরতে বসেছিল। অনেকদূর চলে এসেছে সে। আমাকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘অর কিতনা টাইম লাগেগা ভাই?’। তাকে আশ্বস্ত করলাম এইতো আর পঞ্চাশ মিনিট। লোকটা মলিন মুখে তাকাল আমার দিকে। লোকটাকে উৎসাহ দিয়ে এগিয়ে যেতে লাগলাম আর ভাবতে লাগলাম মানুষ কী অদ্ভুত অনুভূতিশীল প্রানী, সুন্দরের প্রতি কি প্রবল টান! শরীরে কুলোচ্ছে না, তবুও উঠে চলেছে, কী তীব্র সংকল্প সুন্দরকে ছুঁয়ে দেখার। শ্রদ্ধা জাগল লোকটার জন্য। অবশেষে আর কোন ঘটনা-দূর্ঘটনা ছাড়াই নিরাপদেই পৌঁছে গেলাম সেই রেস্তোরায়, যেখানে আমার জন্য গত চারঘন্টা ধরে অপেক্ষা করছে আমার সফরসঙ্গী।
কিছুটা বিশ্রাম নিয়ে, ব্যাগে থাকা চকোলেট বারগুলো মুখে পুরে আবার শুরু করলাম যাত্রা। এখন আর ঘোড়ায় ফেরার উপায় নেই। হেটেই নামতে হবে, কারণ পিচ্ছিল পথে সওয়ারী নিয়ে ঘোড়া উঠতে পারলেও নামতে পারে না। নামার সময় উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটল না, শুধু মাঝপথে এক বাংলাদেশী পরিবারের সাথে দেখা হল। বৃদ্ধ মা-বাবা আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে এ অব্দি ঘোড়ায় করে উঠেছে, কিন্তু এখন নামতে গিয়ে বিপদে পড়ে গেছে। নামতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে ওঁদের। যাই হোক অবশেষে টাকসাঙ থেকে দীর্ঘ সাড়ে তিনঘন্টার হন্টন শেষে ক্লান্ত বিধ্বস্ত অবস্থায় বেজক্যাম্পে পৌঁছুলাম। বেজক্যাম্পে পাইনের বনটা পার হয়ে পেছনে উর্দ্ধমুখে তাকালাম, বৃষ্টি থেমে গেছে, সরে গেছে মেঘও, দূরে পর্বতের মাথায় টাকসাঙকে দেখা যাচ্ছে। হায় হায় অতদূর উঠেছিলাম আমি! হাইকিং করার কোন অভিজ্ঞতাই যার নেই! মনের শক্তির কী ভীষণ জোর! অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি জাগল বিশাল হয়ে আসা হৃদয়ের গভীরে। পেরেছি আমি...মুখে বিজয়ের হাসি ফুটিয়ে সামনে তাকালাম, দেখি ছিকি ও তার স্ত্রী আমাদের অপেক্ষায় দাড়িয়ে আছে। হাসিমুখে আমাদের অভিনন্দন জানাল ওরা। ওকে বললাম ভীষণ খিদে পেয়েছে, কোন একটা ইন্ডিয়ান রেস্তোরায় নিয়ে চল যেখানে ভাত, ডাল আর ডিম ওমলেট পাওয়া যাবে, গলা ডুবিয়ে খাব। হাসল ও, বলল চল আমার পরিচিত এক রেস্তোরা আছে যেখানে এগুলো পাওয়া যেতে পারে। গাড়ীতে উঠে বসলাম, এবারের উদ্দেশ্য বাংলাভোজন...ভাত, ডাল আর ডিম।
পুনশ্চঃ পরদিন সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর বিছানা থেকে নামার সময় আবিষ্কার করলাম পা নাড়াতে পারছি না! ভয়ংকর ব্যাথায় কুকড়ে ছিলাম পরবর্তী সাতদিন। দুইবেলা প্যারসিটামল! যারা নিয়মিত হাইকিং করেন তাদের জন্য টাকসাং ডালভাত বা মুড়ি মুড়কী হবে, কিন্তু আমার মত যারা তাদের জন্য-‘সাধু সাবধান’।
২২ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১২:৩৯
সাব্বির হুসাইন শাওন বলেছেন: ধন্যবাদ ফারদিন। দিনটি স্মরণীয় বলেই এতলম্বা গল্প লিখে ফেললাম।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে অক্টোবর, ২০১৭ রাত ১১:১০
ফারদিন ২৮৮ বলেছেন: দুর্দান্ত ! অসাধারণ একটা দিন ছিল, যা মনে থাকবে আজিবন। আপনাকে ধন্যবাদ, আপনি না চাপ দিলে হয়তো টাইগার্স নেস্টে যাওয়া হতো না।
একা একাই ঘুরি, কিন্তু আপনাদের সাথে পেয়ে অনেক দিন পর গ্রুপ ঘুরার স্বাদ ও পেলাম।