![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মানুষ সে পুরুষ হোক নারী হোক সবাইকে ভালোবাসি। ভালোবাসা দিয়েই জয় করতে চাই সবার মন-প্রাণ।
তথ্য অধিকার আইন : সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
সুত্র:দৈনিক ইত্তেফাক(অক্টোবর ২৪, ২০১০)
তথ্য অধিকার নিশ্চিত করার জন্য বহু রাষ্ট্রে 'তথ্য অধিকার আইন' আছে। তথ্য অধিকার মানবাধিকারের অন্তর্ভুক্ত। জনগণের তথ্য অধিকার, সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি হ্রাস ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে সংবিধানে মৌলিক অধিকার রূপে স্বীকৃত চিন্তা, বিবেক ও বাক স্বাধীনতার অধিকারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে তথ্য প্রাপ্তির অধিকারকে সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৫ এপ্রিল, ২০০৯ সালের তথ্য অধিকার আইন বাংলাদেশ গেজেট প্রজ্ঞাপন আকারে জারী করা হয়। আইনে 'তথ্য কমিশন' নামে একটি সংবিধিবদ্ধ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করা হয়েছে। তথ্য কমিশনের একজন প্রধান তথ্য কমিশনারসহ দুইজন তথ্য কমিশনার রয়েছেন। তথ্য কমিশনের তথ্য কমিশনার হিসাবে জুলাই, ২০০৯-এ নিয়োগ পাবার পর কিছু অর্জিত অভিজ্ঞতার আলোকে এই নিবন্ধটিতে মূলত কমিশনের এ যাবৎকালীন তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে বিভিন্ন দিকসমূহ সীমিত পরিসরে আলোচনা করার প্রয়াস পেয়েছি। তথ্য কমিশনের কাজ তথ্য নিয়ন্ত্রণমূলক নয় বরং জনগণের নিকট তথ্য সহজলভ্য করার পরিবেশ সৃষ্টি। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯ জাতীয় সংসদে গৃহীত হয় এবং তার প্রেক্ষাপট বিশেস্নষণে অবশ্যই কয়েকটি বিষয় উলেস্নখ করা প্রয়োজন, যেমন- ১৯৮৩ সালে প্রেস কমিশনের সুপারিশ ও ২০০২ সালে আইন কমিশনের কার্যপত্রের সূত্র ধরে বাংলাদেশে সিভিল সোসাইটির পক্ষ থেকে তথ্য অধিকার আইনের দাবী জোরদার হতে থাকে। এরই ধারাবাহিকতায় আইন কমিশন বিভিন্ন দেশের আইন পর্যালোচনা করে ২০০৩ সালে তথ্য অধিকার আইনের একটি খসড়া সরকারের নিকট পেশ করে। নাগরিক সমাজ এই আইনটিকে বাস্তবায়নের জন্য সোচ্চার হয় এবং বিভিন্ন ডায়ালগ ও এ্যাডভোকেসি করে, ফলশ্রুতিতে ৪০টি বেসরকারী সংগঠন যেমন- মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন, অজঞওঈখঊ ১৯, নাগরিক উদ্যোগ, ঞওই, গজউও ইত্যাদির সমন্বয়ে জঞও ঋড়ৎঁস গঠিত হয়। পরবর্তীকালে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথ্য অধিকার অধ্যাদেশ-২০০৮ জারী করে এবং ২০০৯ সালে নির্বাচিত সরকার জাতীয় সংসদে এই তথ্য অধিকার সংক্রান্ত অধ্যাদেশকে তথ্য অধিকার আইন হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এই স্বীকৃতির মাধ্যমে উপলব্ধি করা যায় যে, বর্তমান নির্বাচিত সরকার বিশ্বাস করে জনগণের জন্য তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
তথ্য অধিকার আইন নাগরিকের ক্ষমতায়নের সাথে জড়িত এবং নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র এবং তার অঙ্গসংগঠন, রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্ব, প্রশাসন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করে। উক্ত আইনের (ধারা ৪)-এ উলেস্নখ আছে, 'প্রত্যেক নাগরিকের কর্তৃপক্ষের নিকট থেকে তথ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং কতর্ৃপক্ষ ও একজন নাগরিককে তথ্য প্রদানে বাধ্য থাকিবে'। সুতরাং এই আইন ক্ষমতাবানদের উপর তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। আবেদনকারীর আইনগত ভিত্তি (ধারা-৯) হচ্ছে তথ্য প্রদানের অনীহা, আইনের লংঘন এবং তথ্য প্রার্থী আইনি প্রতিকার নিতে পারে। এই বক্তব্য তুলে ধরে যে তথ্য জনগণের, সরকারের নয়। বাংলাদেশ একটি গণতান্ত্রিক দেশ। জনগণের রায়ে সরকার নির্বাচিত হয় এবং জনগণের প্রদত্ত করের টাকায় সরকার চলে। তাই জনগণের চাহিদাকৃত তথ্য দিতে সরকার বাধ্য।
এছাড়া গবেষণায় পরিলক্ষিত যে, তথ্যের অবাধ সরবরাহের সাথে দুনর্ীতি হ্রাসের সম্পর্ক রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ দুনর্ীতির ধারণা সূচকের ভিত্তিতে দেখা যায় যে সমস্ত দেশ (বিশেষ করে স্কেন্ডেনেভিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ফিনল্যান্ড) তথ্য অধিকার আইন গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছে তারাই সর্বনিম্ন দুনর্ীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে। যদিও সিঙ্গাপুর এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম যা তথ্য অধিকার আইন ছাড়াই কম দুনর্ীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় স্থান পেয়েছে যা দুনর্ীতির ধারণাসূচক এবং তথ্য অধিকারের মধ্যকার চূড়ান্ত সম্পর্ককে চ্যালেঞ্জ করে। বস্তুত দুর্নীতি এবং তথ্য অধিকারকে সুনির্দিষ্টভাবে সম্পর্কিত করা যায় না কারণ তা অন্যান্য আইনি, প্রাতিষ্ঠানিক এবং সর্বময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কিত।
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে বর্তমানে বেশ কিছুসংখ্যক বেসরকারী সংগঠন কাজ করছে। পাশাপাশি তথ্য কমিশন তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে উদ্যোগী হয়েছে। তথ্য কমিশন সীমিত জনবল নিয়ে তথ্য অধিকার আইন সম্পর্কিত সচেতনতায় বিভিন্ন ফোরামে ডায়ালগ, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের ডাটাবেজ তৈরি, ওয়েবপোর্টাল হালনাগাদকরণ এবং নিয়মিত প্রকাশনা সংক্রান্ত কাজ করছে। এ ব্যতীত তথ্য কমিশন প্রাপ্ত অভিযোগপত্রগুলো গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। ৬৪টি জেলার মধ্যে মোট ২৫টি জেলায় তথ্য কমিশন তথ্য অধিকার আইন জনঅবহিতকরণ করেছে। এর মধ্যে ২৩টি জেলায় তথ্য কমিশনের পক্ষ থেকে তথ্য কমিশনার হিসেবে আমি তথ্য আইন সম্পর্কে সভায় জনঅবহিতকরণ করেছি। এছাড়াও তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর বিধানাবলির উপর বিভিন্ন সরকারি, বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও এনজিওবিষয়ক প্রশিক্ষণ একাডেমিগুলোতে প্রশিক্ষণাথর্ীগণের সঙ্গে মতবিনিময় হচ্ছে। যেমন গণমাধ্যমের মধ্যে প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, সমকাল, যুগান্তর, জনকণ্ঠ, আমাদের সময়, ডেইলি স্টার, দি ইন্ডিপেনডেন্ট এবং বিটিভি, ইটিভি, আরটিভি, দেশ টিভি, এনটিভি, চ্যানেল আই প্রভৃতি। এছাড়াও বিপিটিসিএতে ফাউন্ডেশন কোর্স এবং এসিএডি কোর্স, ডিটেকটিভ ট্্েরনিং স্কুলে পুলিশ ইন্সপেক্টরদের ট্রেনিং কোর্স, এনডিসি, জাতীয় পর্যায়ে প্রতিবন্ধীদের জন্য ফোরামে আইন সম্পর্কে অবহিতকরণ করা হচ্ছে। প্রতিটি জনঅবহিতকরণ সভা ও প্রশিক্ষণে আমন্ত্রিত অংশগ্রহণকারীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আইনটি বাস্তবায়ন ও বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জসমূহ নিয়ে বিশদ আলোচনা করে। অংশগ্রহণকারীদের তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়ন সংক্রান্ত মতামত তথ্য কমিশনকে আইনের প্রায়োগিক ক্ষেত্রে সাহায্য করছে। অংশগ্রহণকারীদের সাথে আলোচনায় আইনটির সবল ও দুর্বল দিক বিশদভাবে আলোচিত হচ্ছে। অংশগ্রহণকারীগণ আইনের কিছু ধারার সংশোধন দাবি করেছেন। যেমন- বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এবং ইউনিয়ন পরিষদ কেন আইনে অন্তভর্ুক্ত হয়নি? কেন তথ্য অধিকার আইনে নারী ও শিশুদের তথ্য অধিকারকে সুনির্দিষ্ট করা হয়নি? তা জানতে চেয়েছেন। তথ্য আইন সংক্রান্ত সুচিন্তিত এই সুপারিশগুলো তথ্য কমিশন পযর্ায়ক্রমে গ্রহণ করে তথ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আইন মন্ত্রণালয়কে অবহিত করছে এবং আশা করা যায় বস্তুনিষ্ঠ প্রক্রিয়ায় উত্থাপিত পরামর্শগুলো পরবর্তীকালে আইনটির সংশোধনের সুযোগ আসলে সংশোধিত আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
এ-যাবৎকাল তথ্য অধিকার আইনটি উপস্থাপনকালে আইন সংক্রান্ত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন সবার কাছ থেকে উত্থাপিত হয়েছে। যেমন-তথ্য বলতে কি বুঝায়? যে কোন পর্যায়ে যে কোন উপাদান যেমন- নথি, দলিল, স্মারক, ই-মেইল, মতামত, উপদেশ, সংবাদপত্রের বিবৃতি, বিজ্ঞপ্তি, আদেশ, মূল্যায়ন বই, চুক্তি, প্রতিবেদন, কাগজ, নমুনা, নকশা, ইলেকট্রনিক তথ্য উপাদান ইত্যাদি এবং সরকারি কতর্ৃপক্ষ কতর্ৃক অন্য যে কোন আইনের ক্ষমতা বলে যে কোন ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানের তথ্য সংগ্রহ করা যেতে পারে [২ (৮) অনুচ্ছেদ]। এখানে উলেস্নখ্য যে দাপ্তরিক নোট শিট বা তার অনুলিপি তথ্য বলে গণ্য হবে না। এরপরে এসেছে তথ্য প্রদান ইউনিট, দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতর্ার দায়িত্বসমূহ কি? সরকারের কোন মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা কার্যালয়ের সাথে সংযুক্ত বা অধীনস্থ কোন অধিদপ্তর, পরিদপ্তর বা দপ্তরের প্রধান কাযর্ালয়, বিভাগীয় কাযর্ালয়, আঞ্চলিক কাযর্ালয়, জেলা কাযর্ালয় বা উপজেলা কাযর্ালয় তথ্য প্রদান ইউনিট হিসেবে কাজ করবে [ধারা- ২ (ক ও খ)]। উদাহরণস্বরূপ একজন কলেজ অধ্যক্ষ জানতে চেয়েছিলেন, কাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতর্া নিয়োগ দেয়া হবে? এক্ষেত্রে বলা হয় কলেজের অধ্যক্ষ যে কোন বিভাগের একজন শিক্ষক বা কর্মকর্তাকে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতর্া হিসেবে নিয়োগ প্রদান করতে পারেন। আর কলেজের অধ্যক্ষ হবেন আপীল কর্তৃপক্ষ। তথ্য অধিকার আইন অনুসারে তথ্য জানার জন্য লিখিত আবেদন করতে হবে। যাঁরা লেখাপড়া জানে না তারা কিভাবে আবেদন করবেন? এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সহযোগিতা প্রদান করবেন এবং আবেদনে টিপসহি নিয়ে দাখিল করতে পারবে। দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকতর্া নিধর্ারিত সময়সীমার মধ্যে তথ্য প্রদান না করলে ধারা- ২৪ অনুসারে তথ্য প্রদানের সময়সীমা অতিক্রান্ত হবার পরবতর্ী ৩০ (ত্রিশ) দিনের মধ্যে আপীল কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধকারী আপীল করতে পারবেন। আবেদনকারী আপীল কর্তৃপক্ষের নিকট আইন মোতাবেক সুবিচার না পেলে তথ্য কমিশনের নিকট অভিযোগ পাঠাতে পারবেন। এখানে উলেস্নখ্য যে, অনেকে এ ভুল ধারণা পোষণ করেন যে, তথ্য কমিশন হচ্ছে আপিল কর্তৃপক্ষ। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তথ্য কমিশনের কাজ হচ্ছে মূলত অভিযোগ গ্রহণ করা ও সে অনুসারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া (ধারা- ২৫ ও ২৬)। তথ্য অধিকার আইন, ২০০৯-এর ১৩ (ঙ) অনুসারে বিভ্রান্তমূলক তথ্য প্রদান করার জন্য সংশিস্নষ্ট কর্মকতর্াকে ধারা- ২৭ (ঘ) ও (ঙ) অনুযায়ী তথ্য কমিশন জরিমানা ছাড়াও ধারা ২৭ (৩) বলে অসদাচরণ গণ্য করে তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য সংশিস্নষ্ট কর্তৃপক্ষ বরাবর সুপারিশ প্রদান করতে পারবে। ধারা-৭ এ কিছু তথ্য প্রদান বা প্রদানে বাধ্যতামূলক নয় প্রসঙ্গে মূল যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে আলোচনায় আসে তা হচ্ছে বিচারাধীন মামলা সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশের জন্য পাওয়া যাবে কিনা? এই আইনের ধারা ৭ (ট) ও (ঠ) অনুযায়ী আদালতে বিচারাধীন কোন বিষয় যা প্রকাশে আদালত বা ট্রাইবু্যনালের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে অথবা যার প্রকাশ আদালত অবমাননার শামিল এবং তদন্তাধীন কোন বিষয় যার প্রকাশ তদন্ত কাজে বিঘ্ন ঘটাতে পারে এইরূপ তথ্য প্রকাশের জন্য প্রদান বাধ্যতামূলক নয়। রোগীর ব্যক্তিগত তথ্যাদি (যেমন, এইচআইভি, এইড্স প্রভৃতি) জানানো যাবে কিনা? এই আইনের ধারা ৭ (জ) ও (ঝ) অনুসারে ব্যক্তিগত তথ্যাদি প্রদান করা বাধ্যতামূলক নয়। পুলিশ এবং র্যাবের নিকট তথ্য চাওয়া যাবে কিনা? এ প্রসঙ্গে উলেস্নখ করা হয় যে, এই আইনের ধারা- ৩২-এর তফসিল অনুযায়ী ৮টি নিরাপত্তা সংস্থার (যা ভারতেও বিদ্যমান) ক্ষেত্রে তথ্য অধিকার আইন প্রযোজ্য হবে না। তবে উক্ত ৮টি নিরাপত্তা সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের কোন তথ্য দুনর্ীতি বা মানবাধিকার লংঘনের ঘটনার সাথে জড়িত থাকলে তথ্য কমিশনের অনুমোদন গ্রহণপূর্বক উক্ত তথ্য সরবরাহ করতে হবে। তবে এই সকল সংস্থা জনস্বার্থে প্রয়োজনবোধে স্বেচ্ছায় তথ্যের অবমুক্তকরণ করতে পারে। উলেস্নখ্য যে, দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে ভারতে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে সর্বোচ্চ তথ্য সরবরাহ করার জন্য বিভিন্ন নাগরিক সমাজ ও তথ্য অধিকার কর্মিগণ অব্যাহত চাপ সৃষ্টি করে যাচ্ছে।
তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ভূমিকা (ধারা- ৯) একটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ। তাঁকে তথ্যের সংরক্ষক/ভান্ডার হয়ে উঠতে হবে। তাঁর প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে আবেদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানানো, কতর্ৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য প্রাপ্তির সুবিধা সৃষ্টি, তথ্যের উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ, তথ্য সরবরাহে ব্যর্থতা নির্ধারণ। সরকারি দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ অজঞওঈখঊ ১৯ ও তথ্য কমিশনের যৌথ প্রশিক্ষণে তথ্য অধিকার আইনের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাদের মতামত প্রকাশ করেছেন। দাপ্তরিক বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা তাদেরকে তথ্য প্রদানে বিরত রাখছে। উপরন্তু তারা তাদের ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষকেও এ আইন সম্পর্কে অবহিত করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন। যেহেতু দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন। তাই ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষের ঢ়ৎড়-ধপঃরাব ফরংপষড়ংঁৎব সরহফংবঃ না থাকলে তথ্য সরবরাহে বিঘ্ন হবে। এ ব্যতীত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ প্রশিক্ষণ কর্মশালায় কতগুলো বাস্তবিক সমস্যার কথা উলেস্নখ করেছেন। যেমন- একজন সরকারি কর্মকর্তা যিনি ইতিমধ্যে কোন না কোন দায়িত্বে নিয়োজিত আছেন, তাঁর উপর বাড়তি দায়িত্ব হিসেবে তথ্য প্রদানের দায়িত্ব আরোপ করা হবে। তখন তিনি কেন তা গ্রহণ করতে উৎসাহবোধ করবেন? তাছাড়া তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মোবাইল ফোন প্রয়োজন। এছাড়া একজন বিকল্প কর্মকর্তা থাকা জরুরী যাতে একজনের অনুপস্থিতিতে অন্যজন কাজ চালিয়ে নিতে পারেন। কর্মশালায় অংশগ্রহণকারী দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণ সরকারি/বেসরকারি বিভাগ/অধিদপ্তরে তথ্য ইউনিট স্থাপনের প্রস্তাব দিয়েছেন যাতে করে অত্যন্ত সুশৃঙ্খলভাবে তথ্য ভান্ডার তৈরি হয় এবং জনগণ চাওয়া মাত্র প্রয়োজনীয় তথ্য সরবরাহ করা যায়। এ লক্ষ্যে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাগণই উপনিবেশিক প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিতে পরিবর্তন আনতে আগ্রহী এবং উলেস্নখ করেন যে সমস্ত সরকারি অফিস এবং সরকার কতর্ৃক নিবন্ধনপ্রাপ্ত বেসরকারী সংগঠন তথ্য অধিকার আইনের আওতায় পড়ে তাদের সম্পূর্ণ নতুন বাজেট এবং তথ্য সরবরাহের লক্ষ্যে নতুন একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। এই কাজগুলো অত্যন্ত সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। এ লক্ষ্যে তথ্য অধিকার আইন বিষয়ক গবেষক এসএম শামীম রেজা বলেন, "তথ্য অধিকার আইনের কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য দরকার প্রক্রিয়া এবং সক্ষমতার সঠিক প্রয়োগ, তথ্য প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত অবকাঠামো এবং সর্বোপরি সরকারি কর্মকর্তাদের মানস কাঠামোর পরিবর্তন"। এই দায়িত্বসমূহ পালনে তথ্য কমিশন সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে, কিন্তু সামগ্রিক বাস্তবায়ন সরকারের উপরই বর্তায়।
তথ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে কোন কোন ক্ষেত্রে দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইন সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। তথ্য কমিশনের কাছে অভিযোগ আসছে কিছু উপজেলায় কৃষি কর্মকর্তা বা খাদ্য কর্মকর্তা তথ্য সরবরাহে অপারগতা প্রকাশ করেন। এর মূল কারণ এ সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ দাপ্তরিক গোপনীয়তা আইনে দীক্ষিত এবং পরিচালিত। কিন্তু উলেস্নখ্য যে, প্রচলিত যে কোন সরকারি গোপনীয় আইনের বিধানাবলীকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা এই আইনে রয়েছে (ধারা-৩)। যেমন- অফিসিয়াল সিক্রেট্স এ্যাক্ট ১৯২৩-এর ৫ (১) অনুচ্ছেদটি সামরিক এবং কৌশলগত গোপনীয়তা রক্ষার নিমিত্তে তৈরি করা হয়েছে। তথ্য প্রদান না করার ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তাগণ এই অনুচ্ছেদটিই সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করেন। ৫ (১) অনুচ্ছেদে আরও উলেস্নখ আছে যে, যদি কোন ব্যক্তি তাঁর অধীন বা নিয়ন্ত্রণে কোন গোপন বিষয় (তথ্য) থাকা অবস্থায় (ক) স্বেচ্ছায় বিনিময় করে, (খ) তথ্য ব্যবহার করে (গ) তথ্য বিক্রি করে (ঘ) যৌক্তিক যত্ন নিতে ব্যর্থ হয়- তাহলে ঐ ব্যক্তি উক্ত ধারা মোতাবেক অপরাধী বলে গণ্য হবে। ১৩৮ বছরের পুরনো এভিডেন্স এ্যাক্টের ১২৩, ১২৪ ও ১২৫ উপধারা মতে কোন সরকারি অঙ্গসংগঠনের বিভাগীয় প্রধানই শুধুমাত্র তথ্য প্রকাশ করার ক্ষমতা রাখেন। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ ধারা ৯৯ অনুযায়ী তথ্য দেয়া যাবে না। রুলস অব বিজনেস (১৯৯৬) সংবাদকর্মীদের কাছে তথ্য প্রকাশে সরকারি কর্মকর্তাগণের উপর সুনির্দিষ্টভাবে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। এখন পর্যন্ত এটা নিশ্চিত যে, সরকারি কর্মচারীগণ তাদের শপথনামা এবং চাকরি বিধিমালা উভয়ের কারণেই তথ্য প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকেন। যাহোক, তথ্য অধিকার আইনের আশ্রয় নিয়ে কোন তথ্য চেয়ে আবেদন করলে ৩ উপধারা অনুযায়ী উপরোলেস্নখিত এ সকল নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না এবং এ সমস্ত সকল নিষেধাজ্ঞাকে অগ্রাহ্য করা হবে। নাগরিকগণ তথ্য চাওয়ার ক্ষেত্রে এভাবেই তথ্য অধিকার আইনের শক্তি দ্বারা ক্ষমতায়িত হবে এবং ঐ সমস্ত প্রাতিষ্ঠানিক বাধাঁসমূহ অপসারণ করতে সক্ষম হবে যা এখন পর্যন্ত সরকারি এবং বেসরকারি খাতকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তাই বলা যায় তথ্য অধিকার আইন রাষ্ট্রের কাছ থেকে জনগণের কাছে নিয়ন্ত্রণের চাবি পেঁৗছে দেয়।
তথ্য প্রাপ্তির ক্ষেত্র সুসংহত করার সাথে সাথে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে তথ্য অধিকার সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথ্য কমিশনের তথ্য বাতায়ন উদ্বোধনকালে বলেন যে, তথ্য অধিকার দরিদ্র, প্রান্তিক এবং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের উন্নয়ন নিশ্চিত করবে। তিনি বিশেষ করে এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে আইনটি সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এ লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য আ.আ.ম.স. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, "এখন সবকিছুই তথ্য প্রাপ্তির উপর নির্ভর করে, সুতরাং আমাদের প্রথমেই তথ্য অধিকার কি এবং কিভাবে তথ্য অধিকার জনগণের উপকারে আসবে তা তাদেরকে জানাতে হবে"। তিনি আরও উলেস্নখ করেন যে, ৭০% থেকে ৮০% লোক তাদের মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সচেতন নয় এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তারা নিঃসঙ্গ। সমাজের সর্বস্তরে তথ্য অধিকার এবং এর ব্যবহার সম্পর্কে ধারণা অবশ্যই পেঁৗছাতে হবে। বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে যেমন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কায় অধিকাংশ লোক দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে কিভাবে তাদের কাছে তথ্য পেঁৗছে দেয়া যায়। এখানে স্মরণ রাখতে হবে যে, বাংলাদেশে অধিকাংশ লোকের ইন্টারনেটে প্রবেশগম্যতা নেই। বাংলাদেশে আনুমানিক ৪% লোকের ইন্টারনেট সুবিধা আছে যেখানে ভারতে ১০% এবং পাকিস্তানে ৭%। এই বাস্তবতা এবং দক্ষিণ এশিয়ার স্বাক্ষরতার কথা বিবেচনায় তথ্য কমিশনকে বিভিন্ন মাধ্যম যেমন- রেডিও, টিভি, সংবাদপত্র প্রকাশনা, নাগরিক সনদ, বিলবোর্ড, জনপ্রিয় থিয়েটারের মাধ্যমে আরও বৃহৎ পরিসরে সচেতনতামূলক ভূমিকা নিতে হবে।
বাংলাদেশে তথ্য অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে গণমাধ্যম এখন পর্যন্ত আশানুরূপ ভূমিকা পালন করতে পারেনি। জনসাধারণ বিশেষ করে প্রান্তিক মানুষের জন্য বিদ্যমান তথ্য তৈরিতে এবং এই আইনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টিতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক গণমাধ্যম কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। কিছু বেসরকারী সংগঠন গণসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা রাখছে কিন্তু সেটাও সীমিত আকারে। সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে- জনগণকে তথ্য অধিকার আইনের উপযোগিতা সম্পর্কে অবহিতকরণ করা। এক্ষেত্রে তথ্য কমিশন সীমিত অবকাঠামো ও জনবল নিয়ে যথার্থ ভূমিকা পালন করার চেষ্টা করছে।
তথ্য অধিকার আইন-২০০৯ এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। ডিজিটাল এবং আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থিক এবং মৌল মানবিক চাহিদা পূরণে এই দুইটি আইন মূল অনুঘটক। আঞ্চলিক ই-উন্নয়নের মাধ্যমে ই-গভর্নেন্সের কাঠামো সৃষ্টির লক্ষ্যে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটের প্রেক্ষিতে এই দুইটি আইনের সমন্বয় সাধন জরুরী। তথ্য অধিকারের অনুশীলন এবং ব্যবহারসহ এই অঞ্চলের ই-গভর্নেন্স রাষ্ট্রীয় নীতিমালা প্রণয়নে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী ভিত্তি দান করতে পারে। তথ্য অধিকারকে একটি কৌশলগত এবং নির্দিষ্ট সময় ছকে বেঁধে দেয়া দরকার। জনগণের উপর তথ্য অধিকার আইনের বাস্তবায়ন এবং প্রভাব নিয়ে গবেষণা অতীব প্রয়োজনীয়।
তথ্য অধিকার আইন বাস্তবায়নে এ সমস্ত সমস্যা ও চ্যালেঞ্জসমূহের দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। সরকার এবং বেসরকারী সংগঠনসমূহকে ভিতর এবং বাইরে জবাবদিহি করার ক্ষেত্রে তথ্য কমিশন অন্যতম ভূমিকা পালন করতে পারে। তবে কিছু ক্ষেত্রে সকল নাগরিক সমাজ ও সংগঠন তাদের নিজেদের মধ্যকার অশোভনীয় প্রতিযোগিতা ও অনৈক্যের কারণে কার্যকর ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হতে পারে। তথ্য অধিকার আইনের উন্মুক্ততার কারণে সরকারি এবং ব্যক্তিমালিকানাধীন খাতে তথ্য অধিকারকে দমিয়ে রাখার ঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ক্ষমতার অযাচিত ব্যবহারের বিষয়টিও বিবেচনায় রাখতে হবে। তাই তথ্য অধিকার নিশ্চিতকরণে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিজস্ব নির্বাচনী এলাকায় আইনের ব্যবহারকে কার্যকর করতে হবে। চূড়ান্তভাবে আমরা বাংলাদেশে তথ্য কমিশনকে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এমন একটি শক্তিশালী এবং স্বাধীন তথ্য কমিশন হিসেবে দেখতে চাই যা সর্বাত্মক সমর্থন নিয়ে জনগণের তথ্যের অধিকার বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালনে সক্ষম হবে।
[ লেখক : অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
(বর্তমানে প্রেষণে তথ্য কমিশনার, তথ্য কমিশন)
©somewhere in net ltd.