![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্কর্ম ও খোদাভীতিতে একে অন্যের সাহায্য কর। পাপ ও সীমালঙ্ঘনের ব্যাপারে একে অন্যের সহায়তা করো না। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা কঠোর শাস্তিদাতা। (আল ময়েদা:২)তার কথা অপেক্ষা উত্তম কথা আর কার, যে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দেয়, সত্কর্ম করে এবং বলে, আমি একজন আজ্ঞাবহ (মুসলিম)। (আল কুরআন ৪১:৩৩)কেউ হেদায়েতের দিকে আহবান করলে যতজন তার অনুসরণ করবে প্রত্যেকের সমান সওয়াবের অধিকারী সে হবে, তবে যারা অনুসরণ করেছে তাদের সওয়াবে কোন কমতি হবেনা (সহীহ্ মুসলিম: ২৬৭৪)
তর্কের খাতিরে আমি আবার বলছি যে, মনে করুন আপনার জীবনের আয়ুষ্কাল ৫৭ বছর যা আসলে ২,৯৯,৫৯,২০০ মিনিটের সমষ্টি। ধরুন, আপনার সারা জীবনের জীবিকার জন্য মিনিটে ১ টাকা হিসেবে আপনার হাতে ১০০ টাকার নোটে, মোট ২,৯৯,৫৯,২০০ টাকা একত্রে তুলে দেয়া হয়েছিল। আপনি একটা চুলার পাশে বসে, একের পর এক ১০০ টাকার নোট চুলায় পুড়িয়ে ফেললেন ২ দিনের ভিতরই। তারপর আপনার জীবনের নির্ধারিত টাকা শেষ হয়ে গেলে, জীবনযাত্রার ব্যয়ভার বহনের জন্য আপনার হাতে আর কোন অর্থ রইলো না। বাকী জীবন আপনাকে ভিক্ষার উপর এবং অন্যের করুণার উপর বাঁচতে হবে – এমন নির্বুদ্ধিতার কাজ কি কোন উন্মাদ ব্যক্তির কাছেও আশা করা যায়? না, কারণ আজকালকার পাগলেরা – এমনকি শিশুরাও বুঝি “অর্থ” সম্বন্ধে অত্যন্ত সচেতন। যা হোক, এখন দেখুন আখেরাতের সীমাহীন জীবনের provision বা ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা করার জন্য, আপনার হাতে ২,৯৯,৫৯,২০০ মিনিট সময় তুলে দেয়া হয়েছিল – আপনি কি পৃথিবীর চুলার পাশে বসে সেসব পুড়িয়ে শেষ করতে পারেন? সামান্য বুদ্ধি থাকলে প্রথম বর্ণনার ব্যক্তি যেমন ঐ টাকা দিয়ে কিছু কিনতো, কোন সম্পদ, বা তা কোন ব্যবসায় খাটাতো বা অন্তত তার ৫৭ বছরের জীবনকে সামনে রেখে কি করে সে জীবন যাপন করবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতো – ঠিক তেমনি আমাদের সবার হাতে আখেরাতের সীমাহীন জীবনের ব্যবস্থাপত্র করে নেয়ার জন্য যে নির্দিষ্ট পরিমাণ “সময়” তুলে দিয়েছেন আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তা’লা, সামান্য বুদ্ধি থাকলে আমরা চেষ্টা করবো তা দিয়ে provision কেনার। তা না করে, যেন তেন ভাবে সময় কাটিয়ে আমরা যদি কবরে যাই, তবে আমাদের একমাত্র ভরসা হবে করুণাবশত কেউ যদি(যেমন সন্তান-সন্ততি) আমাদের জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে এবং সেজন্য আল্লাহ্ যদি আমাদের শাস্তির ভার লাঘব করেন। এমন সন্তান, যারা পিতা-মাতার জন্য আল্লাহর কাছে করুণা ভিক্ষা করবে – তাদের নিশ্চয়ই সুসন্তান হতে হবে! বলা বাহুল্য যে, তেমন সুসন্তান পৃথিবীতে রেখে যাবেন যে পিতা, তিনি নিজেও ভালো মুসলিম হবেন, এটাই স্বাভাবিক (অন্যথা হচ্ছে ব্যতিক্রম) – সুতরাং, যিনি নিজের জীবন অপব্যয় করে যাবেন, তার সন্তানেরা যে তার জন্য দোয়া করতে গিয়ে TV-তে Bay watch বা জেনিফার লোপেজের চটকদার waiting for tonight-এর মত একটা গানের ভিডিও দেখার “অপরিহার্য মহৎ কাজ” থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে, বাবার জন্য দোয়া করে তাদের ‘সময়’ ব্যয় করবে – তা আশা করা উচিত নয়। তবে হ্যাঁ, পিতা যদি তাদের ‘মানুষ’ করে যান – প্রচলিত অর্থে যার সারমর্ম হচ্ছে চুরি করে হোক বা অসৎ পথে উপার্জন করেই হোক, সন্তানদের বিত্ত বৈভবের অধিকারী হবার যোগ্য করে তোলা – তবে তারা হয়তো ‘শবে বরাতের’ রাতে দশ পদ হালুয়ার সাথে রুটি বিতরণ করে, অথবা, পিতার আত্মার শান্তি কামনায় একসাথে ১০ জন মোল্লা ডেকে, জন প্রতি ৩ সিপারা হিসেবে মাত্র দু’ঘণ্টায় ৩ x ১০ বা ৩০ সিপারা, অর্থাৎ গোটা কুর’আন ‘খতম’ করার ব্যবস্থা করবে – অবশ্য যদি ঐ রাতের সাথে once in a life time মার্কা কোন অনুষ্ঠান coincide না করে যায়। ‘শবে বরাতের’ সময় যেহেতু পরিবর্তন হতে থাকে – তা কখনো কোন অপরিহার্য বিশেষ অনুষ্ঠান, যেমন ধরুন ‘অস্কার পুরস্কার’ বিতরণ অনুষ্ঠানের সাথে মিলে গেলে, মৃত পিতার কপাল খারাপ বলতে হবে। একসাথে এত বিশাল সংখ্যক দেহ ও রূপ ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বকে একনজর দেখার এমন বিরল সুযোগ হাতছাড়া করে, কি করে ঐ সব আয়োজন করা যায় – তার চেয়ে না হয় পরের দিন ‘দোয়া-দরূদের’ ব্যবস্থা করলে হয় – শবে বরাতের পরের দিনটাও তো ‘ফজিলতপূর্ণ’ – ইসলামী নিয়মে তো সন্ধ্যা থেকে দিন শুরু হয়ে পরের সন্ধ্যা পর্যন্ত একই দিন থাকে নাকি!
আবারো একটা প্রাসঙ্গিক গল্প মনে হলো। যুক্তরাজ্যের পটভূমিতে ঘটা একটা ঘটনাকে কেন্দ্র করে এই গল্প। জনৈক ইয়েমেনী ভদ্রলোক – খুব সম্ভব রেঁস্তোরার ব্যবসায়ী। যখনই তাকে কোন দ্বীনী মজলিসে ডাকা হতো – তিনি বলতেন যে তার ‘সময়’ নেই – বৌ-বাচ্চার জন্য উপার্জন করাও তার জন্য সমধিক জরুরী বলে তিনি মত প্রকাশ করতেন। বলা আবশ্যক যে, জীবনে তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত উপার্জন করেন এবং সেই সুবাদে মৃত্যুর সময় পরিবারের জন্য অনেক সম্পদ রেখে যান। যে মজলিসে তিনি “সময়ের অভাবে” আসতে পারতেন না, সেই মজলিসের দ্বীনী ভাইরাই তার জানাযা ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন। যুক্তরাজ্যের আইন অনুযায়ী, লাশ সমাহিত করার জন্য, কিছু নিয়ম কানুন ও আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হবার অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। সেসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হওয়া পর্যন্ত মরদেহ মর্গে বরফ-বাক্সে সংরক্ষিত থাকে। ঐ ভদ্রলোকের মরদেহ বরফ-বাক্সে রাখার পরে, ভদ্রলোকের স্ত্রী-পুত্র হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে উক্ত মজলিসের দ্বীনী ভাইদের জিজ্ঞেস করেন যে, ঐ ভদ্রলোকের হাতে অত্যন্ত দামী একটা আংটি ছিল সেটার কি হয়েছে? দ্বীনী ভাইয়েরা বললেন যে, স্বাভাবিকভাবে তারা আংটিখানা বের করতে পারেন নি বলে, তা রয়ে গেছে ওভাবেই – মৃতদেহকে আর ‘কষ্ট’ দিতে চাননি তারা। মৃত ভদ্রলোকের স্ত্রী-পুত্র অসন্তুষ্ট চিত্তে ছুটলেন ‘মিস্ত্রী’ আনতে – দ্বীনী ভাইদের অনুরোধ অগ্রাহ্য করে। মজলিসের ভাইরা তাদের অনুরোধ করছিলেন মৃতদেহের আঙ্গুল কেটে আংটি না বের করার জন্য, কারণ আল্লাহর রহমতে তিনি প্রচুর সহায় সম্পত্তি রেখে গিয়েছেন তাদের জন্য। কিন্তু তারা তা শুনলেন না – উত্তরাধিকারের দাবীতে ভদ্রলোকের নিস্প্রাণ দেহের আঙ্গুল কেটে সম্পদ আহরণ করলেন ভদ্রলোকের স্ত্রী ও পুত্র। হায়, এদের জন্য উপার্জন করতে গিয়েই তিনি কখনো দ্বীনের দু’টো কথা শোনার ‘সময়’ পাননি!
আমার গল্প এখানেই শেষ। মাননীয় পাঠক, আমি বলছি না যে আপনি আপনার পরিবারের ভরণ পোষণের দায়-দায়িত্ব পরিহার করে বৈরাগী হয়ে যাবেন! না মোটেই না। পরিবারের জন্য, পরিবারের প্রয়োজনীয় ভরণ-পোষণের জন্য আপনার ব্যয়, ধর্মযুদ্ধে ব্যয়কৃত অর্থের চেয়ে শ্রেয়। কিন্তু আপনাকে বুঝতে হবে যে, প্রয়োজনীয় মৌলিক দাবীগুলো পূরণের পর আপনি যখন সম্পদ-আহরণের-জন্য ‘সম্পদ আহরণে’ আত্মনিয়োগ করবেন, অথবা, আপনি স্ত্রী পুত্রের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়তে গিয়ে আল্লাহ্ যে আপনাকে কেবল তাঁর ইবাদতের উদ্দেশ্যে সৃষ্টি করেছেন, তা ভুলে রইলেন, তখন আপনি আপনার জীবনের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হলেন।
আপনি যখন ঢাকা থেকে সিলেট যাবার জন্য ট্রেনে চাপেন, তখন যদি শুরুতে আপনাকে কেউ জিজ্ঞেস করে যে, আপনি ট্রেনে কেন উঠেছেন – আপনার সহজ উত্তর হবে যে আপনি সিলেট যাবার জন্য ট্রেনে উঠেছেন। এখন সিলেট যাবার পথে আপনার গাড়ি আখাউড়া (অল্প কিছুদিন আগেও ঢাকা থেকে ট্রেন আখাউড়া হয়ে সিলেট যেত) , শ্রীমঙ্গল ইত্যাদি নানা স্টেশনে থামলো। আপনি কোথাও প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে হয়তো একটা ডাব খেয়েছেন – কোথাও বা বাড়িতে আপনার পথ চেয়ে বসে থাকা মায়ের জন্য ফল কিনলেন – এগুলো আনুষঙ্গিক ঘটনা। সিলেট যাবার মূল লক্ষ্য অর্জন করতে গিয়ে পথে ঘটা আনুষঙ্গিক ঘটনা। আপনি কেন ট্রেনে ভ্রমণ করছেন এর উত্তরে আপনি নিশ্চয়ই কাউকে বলবেন না যে, আখাউড়া স্টেশনে একটা ডাব খাবার জন্য আপনি ট্রেনে উঠেছেন। পথে ঘটে যাওয়া নানা ঘটনা সত্ত্বেও আপনি আপনার মুখ্য উদ্দেশ্যের কথাই বলবেন। ঠিক তেমনি আপনাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহর ইবাদত করা ‘উদ্দেশ্যে’। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে পথ চলতে গিয়ে আপনার জীবনে অনেক আনুষঙ্গিক ব্যাপার স্বাভাবিকভাবেই আসবে। কিন্তু কখনো এসব আনুষঙ্গিক ব্যাপার যদি মুখ্য হয়ে যায়, তবে আপনি আপনার জীবনের উদ্দেশ্য থেকে বিচ্যুত হয়েছেন বলে বলতে হবে এবং তা আপনার জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক বলতে হবে – অনেকটা আখাউড়া স্টেশনে ডাব খেতে গিয়ে আপনি ভুলে গেলেন যে আপনি আসলে সিলেট যাবার জন্য ট্রেনে উঠেছিলেন এবং আপনার ট্রেনখানা আপনার অজান্তেই আখাউড়া ছেড়ে চলে গেল – এমন একটা ঘটনার মতই হাস্যকর এবং দুঃখজনক হবে আপনার জীবনের সেই ভ্রান্ত-দশা।
মুসলিম জীবন গাধার মত কেবল উপার্জনের পেছনে খাটাখাটুনি করবার জন্য সৃষ্ট নয়। বরং মুসলিম জীবনে সবকিছুর জন্য সঠিক পরিমাপের ‘সময়ের’ ব্যয়বরাদ্দ থাকবে। আমরা গল্প করবো, সামাজিকতায় সময় ব্যয় করবো, স্ত্রীকে সঙ্গ দেব – গল্প করার জন্য, ভ্রমণের জন্য বা স্রেফ মনোরঞ্জনের জন্য। কিন্তু এসব কিছুর ঝামেলায় কিছুতেই আমাদের জীবনের মুখ্য উদ্দেশ্যটা হারিয়ে যাবে না।
ইসলামী পরিভাষার ভুল ব্যয়ের বা অপব্যয়ের দু’টো ধারণা রয়েছে – একটা হচ্ছে ভুল পথে ব্যয় করা – অপরটি হচ্ছে সঠিক পথে হলেও, অতিরিক্ত ব্যয় করা। উদাহরণ স্বরূপ, আপনি মদ কিনতে আপনার অর্থ ব্যয় করলেন – এখানে মদ কেনার উদ্দেশ্যে অর্থ ব্যয় করাটাই নিষিদ্ধ বা হারাম, তার পরিমাণ যাই হোক না কেন – ঐ পথে সামান্যতম অর্থ বা সম্পদ ব্যয় করাটাই ‘হারাম’। এই ধারণাকে ইসলামী পরিভাষায় বলা হয় ‘তাবজীর’। আরেকটি অপব্যয়ের ধারণাকে বলা হয় ‘ইস্রাফ’ – যেখানে কোন নির্দিষ্ট পথে ব্যয় করাটা মূলত ‘হারাম’ নয়। কিন্তু ঐ পথে অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ করা হয়েছে বলে তা অপব্যয়। উদাহরণস্বরূপ, খাবার কিনতে অর্থ ব্যয় করাটা এমনিতে হারাম নয় – কিন্তু আপনি যেখানে ২/৩ পদ দিয়ে তৃপ্তি সহকারে আপনার আহার সম্পন্ন করতে পারেন, সেখানে আপনার সঙ্গতি আছে বলে ১০/১৫ পদের আয়োজন করলেন – কিছুটা খেলেন, বাকীটুকু ছড়িয়ে ছিটিয়ে নষ্ট করলেন। এখানে ব্যাপারটা over allocation-এর পর্যায়ে পড়লো – এটাও অপব্যয় এবং জুলুম।
পবিত্র কুর’আনে এই দুটো অপব্যয়ের concept-ই উল্লেখিত আছে। ‘তাবজীর’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ১৭ : ২৬-২৭ আয়াতে আর ‘ইস্রাফ’ সম্বন্ধে বলা হয়েছে ২০ : ১২৪-১২৭ আয়াতে। সময়কে ইসলামে মহা-মূল্যবান সম্পদ বলে গণ্য করা হয় বলে, অপব্যয়ের ব্যাপারে তিরস্কারসমূহ, সময়ের অপব্যয়ের ব্যাপারেও প্রযোজ্য। অন্য সম্পদের মতই সময়ের অপব্যয়ও এই দুই শ্রেণীভুক্ত হবে। যেমন ধরুন মালাইকা অরোরার নৃত্য বা পামেলা এন্ডারসনের দেহ সৌন্দর্য্যরে দৃশ্য TV-তে উপভোগ করতে গিয়ে আপনি সময় ব্যয় করলেন – এটা প্রথম শ্রেণীতে পড়বে অর্থাৎ ‘হারাম’ পথে সময় ব্যয় করা হলো বলে তা ‘তাবজীরের’ পর্যায়ে পড়বে। আবার ধরুন আপনি একটা দোকান সাজিয়ে ‘হালাল’ সামগ্রীর ব্যবসায় করেন। কিন্তু বিকিকিনি খুব ভালো হচ্ছে বলে আপনি আপনার সব সময় সেখানেই ব্যয় করলেন – দ্বীনের কাজ-কর্ম ভুলে রইলেন – এই পথে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করাটা ‘ইস্রাফ’ বলে গণ্য হবে, যদিও আদতে ব্যবসায়টা ‘হারাম’ ছিল না।
সুতরাং সময়ের ব্যাপারে আমাদের অত্যন্ত সাবধান হতে হবে – প্রথমত আমরা যেন ‘হারাম’ কাজে সময় ব্যয় না করি। আর দ্বিতীয়ত জীবন ধারণের জন্য – ‘কেবল আল্লাহর ইবাদতের জন্য’ সৃষ্ট আমাদের এই জীবন ধারণ ও সে জীবন যাপনের জন্য – স্বাভাবিকভাবেই কিছু আনুষঙ্গিক ব্যাপার বা incidental ব্যাপার থাকবে, যেগুলোর জন্য কিছু সময়ের বরাদ্দও অনুমোদিত। কিন্তু আখাউড়ার প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ডাব খেতে গিয়ে ট্রেন মিস্ করার মত করে, সেসব আনুষঙ্গিক ব্যাপারকে মুখ্য মর্যাদা দিয়ে, সেদিকে সব ‘সময়’ ব্যয় করে যদি আমরা আমাদের কাছে প্রত্যাশিত ইবাদত-কার্য পালনে ব্যর্থ হই, তবে আমাদের অবস্থা হবে ২০ : ১২৪-২৭ বর্ণিত দুর্ভাগা ব্যক্তির মত।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, প্রতিটি মুহূর্ত কেটে যাবার সাথে সাথেই ঐ মুহূর্তে আমরা কি করলাম তা ‘রেকর্ড’ হয়ে রইলো – হয় তা আমাদের পক্ষে যাবে, নয় তা আমাদের বিপক্ষে যাবে। এই ‘রেকর্ড’ কিছুতেই মোছা যাবে না – এই ‘রেকর্ড’ reversible নয়। ‘ঘুষ’ দিয়ে বা দারোগা সাহেবের হাতে-পায়ে ধরে আসামীর তালিকা থেকে নাম বাদ দেওয়ানোর কোন system নেই এক্ষেত্রে।
যারা চতুষ্পদ জন্তুর মত ভোগ-সুখের প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিতে নারাজ এবং যাদের চিন্তাশক্তি কাফির-মুশরিকদের দেহ তথা রূপ ব্যবসায় ভিত্তিক মায়াজালে আবদ্ধ নয়, তারা হয়তো ভাবনায় পড়তে পারেন যে, জীবনের সময়কে তাহলে কি করে সর্বোত্তম ও সর্বাপেক্ষা কাজে লাগানো যায়। এ ব্যাপারেও আল্লাহ্ স্পষ্ট দিক নির্দেশনা দিয়েছেন পবিত্র কুর’আনের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অথচ সবচেয়ে ছোট্ট সূরাসমূহের একটিতে ।
সূরা আল্ আসরের সর্বমোট তিনটি আয়াতের প্রথম আয়াতটি হচ্ছে, “আসরের শপথ” – অধিকাংশ তফসীরকার বা অনুবাদকের মতে একথার অর্থ হচ্ছে “সময়ের শপথ”। দ্বিতীয় আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন, “নিশ্চিতই মানুষ ক্ষতির মাঝে রয়েছে।” তৃতীয় আয়াতে আল্লাহ্ বলছেন “কেবল তারা ছাড়া যারা ঈমান এনেছে, যারা সৎকাজ করে, যারা একে অপরকে সত্য সম্বন্ধে শিক্ষা দেয় এবং যারা একে অপরকে ধৈর্যের পরামর্শ দেয়।” – ব্যাস্ কি Precise এবং Concise দিক নির্দেশনা – এক পৃথিবী বক্তব্য মাত্র তিনটি বাক্যের ভিতর সন্নিবেশিত হয়েছে। ‘সময়ের শপথ’ দিয়ে শুরু করাটা এখানে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। মানুষের সকল চিন্তা-ভাবনা, অর্থ, সম্পদ, জ্ঞান, বিত্ত, বৈভব সবকিছুকে নিষ্ফল প্রতীয়মান করে বলা হয়েছে, ”মানুষ মাত্রই ক্ষতির ভিতর পতিত” – যদি সে এই চারটি শ্রেণীভুক্ত না হয়ে অন্য কিছু হয়। এই চারটি শ্রেণীভুক্ত হতে গিয়ে সে যেটুকু সময় ব্যয় করবে জীবনের, সেটুকুই তার লাভ — বাকী সকল প্রয়াস ও সময়ক্ষেপণ তাকে কেবল ক্ষতির দিকেই টেনে নিয়ে যাবে।
মুসলিম বিশ্বাস মতে প্রথম শ্রেণীভুক্ত না হতে পারলে জীবনের “ষোল আনাই মিছে” – ঈমান না আনলে গোটা জীবনের সমীকরণের দুপাশেই শূন্য লেখা থাকবে। দ্বিতীয় শ্রেণী হচ্ছে যারা সৎকাজ করে। বলা বাহুল্য প্রথম শ্রেণীতে দাখিল হবার পরেই কেবল, দ্বিতীয় শ্রেণীভুক্ত হওয়াটা অর্থবহ হবে – ঈমানবিহীন কোন কাজই ইসলামের দৃষ্টিতে ‘সৎকাজ’ বলে পরিগণিত হতে পারে না – ঈমান সমেত ‘সৎকাজ’ও আবার হবে সেই কাজ, যেটাকে আল্লাহ্ বা আল্লাহর রাসূল(সা.) ‘সৎকাজ’ বলে চিহ্নিত করেছেন। আপনি মানবতাবাদী বলে যদি মনে করেন যে, প্রতিটি মানুষের নিজের জীবনের সুখ-দুঃখ সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার রয়েছে – আর তাই সমকামী মেয়েরা যদি নিজেদের মাঝে সমকামী বিবাহের মাধ্যমে জীবনে সুখী হতে চায়, তবে তা সমর্থনযোগ্য – তবে আপনি আপনার এহেন ‘মানবিক’ গুণাগুণের জন্য ‘পুলিটজার’ পুরস্কার পেলেও, আপনার নিশ্চিত গন্তব্য জাহান্নাম হবার কথা এবং আপনার এই ‘মহৎ’ কাজ ইসলামের দৃষ্টিতে কখনোই ‘সৎকাজ’ বলে গণ্য হবে না। সুতরাং, আল্লাহ্ ও আল্লাহর রাসূল(সা.) যে সবকে ‘সৎকাজ’ বলেছেন, সে সব সৎকাজে নিয়োজিত হতে হবে। ‘চোলি কে পিছে কেয়া হ্যায়’ মার্কা কাফির-শিল্প উপভোগ করার মহৎ কাজে আত্মনিয়োগ করে নিজের আত্মীয়ের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখা ‘সৎকাজ’ নয় বরং ঘরে কোন মেহমান আসলে তার বাস্তবতাকে, TV-র স্বপ্নরাজ্যের উপরে স্থান দিয়ে, তাকে ‘সময়’ দেয়াটা ‘সৎকাজ’ বলে গণ্য হতে পারে। যাহোক, তৃতীয় শ্রেণীটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ – বুঝতে হবে দান-খয়রাত করা, মসজিদে বানানো, তসবীহ জপা, অতিথি আপ্যায়ন, মিস্কীন খাওয়ানো – এসব সৎকাজ হলেও, এগুলোকে আল্লাহ্ নাম ধরে উল্লেখ করেন নি – সবকিছু সৎকাজের ভিতর এসে যাচ্ছে – অথচ ”একে অপরের সাথে সত্য নিয়ে আলোচনা করা বা সত্য সম্বন্ধে জ্ঞানদানকে” এই আলাপ আলোচনার ব্যাপারকে – কত গুরুত্ব দেয়া হয়েছে যে, মানব জীবনের সারমর্মকে যে চারটি শ্রেণীভুক্তির ভিতর Narrowed down করা হয়েছে, তার ভিতর একটি হচ্ছে এই সত্য সংক্রান্ত আলাপ-আলোচনা, শিক্ষাদান বা পরামর্শ করা মানবশ্রেণী। তাহলে দেখুন TV দেখে সময়ক্ষেপণ করে দ্বীনের দুটো কথার ‘সময়’ নেই বলাটা কত আত্মঘাতী একটা ব্যাপার এবং কত বড় গর্হিত একটা অপরাধ। চতুর্থ শ্রেণী হচ্ছে “যারা একে অপরকে ধৈর্যের পরামর্শ দেয়” – ধৈর্যের অর্থও ব্যাপক – আপনি রেগে যাচ্ছেন, আমি আপনাকে ধৈর্য ধারণ করতে বলতে পারি, আপনার সন্তানগুলো একের পর এক মৃত্যুবরণ করে চলেছে জন্মের পর পরই – সেজন্য আপনার কাছে জীবন অর্থহীন মনে হয়, আমি আপনাকে আপনার দ্বীনী ভাই হিসেবে ধৈর্যধারণ করতে অনুরোধ করতে পারি – আপনাকে সান্ত্বনা দিতে পারি – এভাবে মুসলিম সামাজিক জীবনে ধৈর্য ও ধৈর্যের উপদেশের তাৎপর্য অপরিসীম।
তাহলে দেখুন আল্লাহর স্পষ্ট শ্রেণী চিহ্নিতকরণে, আপনি যদি এই চার শ্রেণীভুক্ত বলে নিজেকে গণ্য করতে পারেন, তবেই আপনার জীবনের একটা অর্থ রয়েছে, তা না হলে আপনার জীবন অর্থহীন এবং আপনি ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন। এই চার দলভুক্ত হবার প্রয়াসে আপনি যে ‘সময়’ ব্যয় করবেন সেটাই সার্থক – বাকী কাজে যে ‘সময়’ ব্যয় করলেন, তা যেন অনেকটা চুলার পাশে বসে আপনার গোটা জীবনের পাথেয় স্বরূপ পাওয়া টাকার সমষ্টি থেকে একটার পর একটা নোট আগুনে ছুঁড়ে দেয়ার মতই অর্বাচীনের কাজ।
মাননীয় পাঠক! আমি মনে করি, আমাকে সৃষ্টিই করা হয়েছে কেবল আল্লাহর ইবাদত করার জন্য! আপনি? আপনি কি মনে করেন?
[শায়খ এনামুল হকের মুসলিম জীবনে সময় প্রবন্ধের শেষ পর্ব থেকে সংকলিত]
[এই সিরিজের প্রথম লেখা ৩ টি রয়েছে এখানে: http://www.peaceinislam.com/muslim55/5793/
http://www.peaceinislam.com/muslim55/5822/
http://www.peaceinislam.com/muslim55/5919/ ]
২| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৫ দুপুর ১২:৫৪
সাইফুল্লাহ্ বলেছেন: আপনাকে ধন্যবাদ
৩| ৩০ শে আগস্ট, ২০১৫ বিকাল ৪:০১
বিজন শররমা বলেছেন: "দূরের বাদ্য শুনিতে মধূ" । এটি ওমর খাইয়ামের একটি কবিতার অংশ । আমরা "নদীর অপর পাড়ের ঘাস সবুজ দেখায়" অথবা "শোনা কথা দু'না (দুই গুন) হয়" বলে যা বুঝিয়ে থাকি তিনিও তাই বোঝাতে চেয়েছেন । আমাদের সবারই অভিজ্ঞতা আছে যে শোনা কথা অধিকাংশ সময় অসত্য বা বিকৃত হয়ে থাকে । আমাদের দেশে যে সব ধর্ম প্রচলিত আছে তার সবগুলিরই বেলায়ই একথা কম বেশী সত্য ।
বিদেশ থেকে আমাদের দেশে যে সব প্রধান ধর্ম এসেছে সেগুলি প্রধানতঃ ইংরেজী, আরবী, হিব্রু ইত্যাদি ভাষায় প্রচারিত হয়েছে । এর মধ্যে ইংরেজী ভাষা আমাদের কিছু কিছু জানা থাকলেও অন্য ভাষাগুলি কিন্তু সাধারনভাবে জানা নেই । কোন কোন ধর্মে আবার বিধান থাকে যে কেবলমাত্র মূল ভাষায়ই সেগুলির চর্চা করতে হবে । তাই সেই ধরনের ধর্ম যখন আমাদের দেশে প্রচলিত হয় তখন সেই ধর্মের অর্থ বুঝতে আমাদেরকে সম্পুর্ন রূপে নির্ভর করতে হয় সে ভাষা জানা মানুষের উপর । বলা বাহুল্য এক্ষেত্রে অনুবাদে "তারা তাদের যেমন খুশী বলে দিয়েছেন" এমনটা হবার সম্ভাবনা ছিল শতকরা একশত ভাগ । আর যদি তা হয়েই থাকে তাহলে কিন্তু আজকের যুগে আমরা সহজেই তা ধরে ফেলতে পারবো । কারন এখন ইন্টারনেটের কল্যানে যে কোন গ্রন্থের বিশ্বাসযোগ্য অনুবাদ সহজেই পাওয়া সম্ভব । এই কারনে ঈদানীং কালে কোন কোন ধর্ম বেশ ধাক্কা খেয়েছে ।
শোনা কথা পরিবর্তিত হবার একটি উদাহরণ দেয়া যাক । নীচের গলপটি আমরা সবাই কম বেশি জানি । "এক বুড়ী তাঁহাকে পছন্দ করিত না । বুড়ি তাঁহার চলের পথে কাঁটা বিছাইয়া রাখিত । পথ চলার সময় তাঁহার পায়ে কাঁটা বিধিত। তিনি কষ্ট পাইতেন, আর বুড়ী দূর হইতে তাহা দেখিয়া হাসিতো । একদিন তিনি দেখিলেন, পথে কোন কাঁটা নাই । তিনি ভাবিলেন, নিশচয়ই বুড়ীর কোন সমস্যা হইয়াছে । তিনি বুড়ীর বাড়ী গেলেন এবং দেখিলেন, বুড়ীর বড় অসুখ । বুড়ী তাঁহাকে দেখিয়া বড় ভয় পাইয়াছিল । কিন্তু তিনি সেবা করিয়া বুড়ীকে ভালো করিয়া তুলিলেন । ভালো হইয়া বুড়ী তাহার ধর্ম গ্রহন করিল ।"
উপরের গল্পটি আসলে মারমাদুকে পিকথল অনুদিত ধর্মগ্রন্থের ১১১ - আল মাসাদ সুরা, (মাসাদ অর্থ হলো, তাল গাছের রশি) ইংরেজী অনুবাদ । তিনি অনুবাদটি করেছেন এই ভাবে -
111. Al-Masad: Palm Fiber
111:1-5 The power of Abu Lahab will perish, and he will perish. His wealth and gains will not exempt him. He will be plunged in flaming Fire, and his wife, the wood carrier; she will have upon her neck a halter of palm fiber.
এই সুরাটির পটভূমি হিসেবে অন্যত্র যা বলা হয়েছে তাহলো, "আবু লাহাবের স্ত্রী তাঁহার পথে কাঁটা বিছিইয়ে রাখত। আবু লাহাবও নানাভাবে তার ক্ষতি করতো । সেই কারনে স্বর্গের পিতা তার দুতের মাধ্যমে জানাচ্ছেন যে, (উপরের ইংরেজীর অনুবাদ) আবু লাহাবের ক্ষমতা শেষ হয়ে যাবে, সেও শেষ হয়ে যাবে । তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, আর তার স্ত্রী, যে কাঠ কেটে জীবিকা নির্বাহ করে তার গলায় তালের রশি জড়ানো হবে ।"
অনুবাদে মূল অর্থ সবসময় বোঝানো না গেলেও এর অর্থ মোটামুটি এরকমই । একজন লোক বা তার স্ত্রী আমাদের ক্ষতি করলে আমরা তাকে আমাদের স্বভাবসুলভঃ ভাবে গালাগালি করি, কোন কোন ক্ষেত্রে মার দিই, এমনকি চরম ক্ষেত্রে মেরেও ফেলতে পারি । এখানে পরম পিতা একজন মানুষ ও তার স্ত্রীকে শাস্তি দিতে চান, কারন এরা তার প্রিয় ব্যাক্তিকে কষ্ট দিয়েছে । তিনিও নিশ্চয়ই তার পক্ষে যা স্বাভাবিক সেই ভাবে শাস্তি দিতে চাইবেন। যেমন, দূতের মাধ্যমে তিনি জানাচ্ছেন - ঐ লোকের ক্ষমতা শেষ হবে, তাকে আগুনে নিক্ষেপ করা হবে, আর তার স্ত্রীর গলায় তালের রশি জড়ানো হবে ।- এতে অবাক হবার কিছু নেই । কিন্তু দেখুন, এটিই যখন আমরা আগে ধর্মীয় লোকদের বাচনে শুনেছি তখন তাতে কত খানি মধূ মেশানো হয়েছিল, এবং যার অনেক কিছুই সত্য ছিল না ।
আসলে আগে শোনা অনেক কিছুই এখন আমরা একেবারে মূল সূত্র থেকে জানার সুযোগ পাচ্ছি । বলাবাহুল্য এই সুযোগই আমাদেরকে অনেক ধর্ম একেবারে নতুনভাবে জানার সুযোগ করে দিচ্ছে । আর এই নতুন ভাবে জানাটা অনেককেই অবাক করে দিচ্ছে । লতিফ সিদ্দিকী বা গাফফার চৌধুরীরা এসব কথা জানার পর তা এদেশে না বললেও আটলান্টিকের অপর পাড়ে গিয়ে অকপটে বলে ফেলেছেন । ইন্টারনেটের কল্যানে আমরা জানি একদল লোক তাদেরকে একটি বিশেষ ধর্মের প্রাক্তন সদস্য হিসেবে ঘোষনা করে একই নাম এবং পদবী রেখে এই ধর্ম সম্বন্ধে তাদের যা মনের কথা অকপটে বলে চলেছে । আর ইন্টারনেটের কল্যানে সারা বিশ্বে যে কেউ তা জানতে পারছে ।
©somewhere in net ltd.
১|
৩০ শে আগস্ট, ২০১৫ সকাল ৭:৫৭
অমল ধবল বলেছেন: হৃদয় ছোঁয়া লেখা, শেয়ার করলাম।