![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
হাসতে ভালবাসি। হাসাতে ভালবাসি। আর ভালবাসি এদেশকে......।
রাত তখন ১ টা। হৃদি ফেসবুকে চ্যাট করছে। চ্যাট করতে করতে আনমনে হেসে উঠছে সে। ওপাশের মানুষটার ছবি বারবার মনের মণিকোঠায় উঁকি দিচ্ছে। তাসিন, হৃদির বয়ফ্রেন্ড। এক বছর আগে ফেসবুকের দৌলতে হৃদির সাথে পরিচয়। তাসিন লন্ডন প্রবাসী। পেশায় অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার। হৃদি পড়ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে। একসময় বেশ নামকরা ছাত্রী ছিল। যদিও এখন লেখাপড়ার চেয়ে তাসিনের দিকেই তার মনোযোগ। হৃদির বাবা নেই। ওর বয়স যখন এক বছর, তখনই এক সড়ক দূর্ঘটনা ওর কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে বাবাকে। মামণি গুলশান আরা তখন তাঁর ব্যবসায়ী স্বামীর ব্যবসার হাল ধরেন। যদিও তাঁর ভাই আইনজীবী আবেদ হোসেন আর ভাবি ফেরদৌসী তাঁকে একা ছাড়েন নি। আবেদ হৃদির কথা চিন্তা করেই গুলশান আর হৃদিকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন। নিঃসন্তান দম্পত্তি নিজ সন্তানের মত মানুষ করেছেন হৃদিকে।
-হাই জান, হাউ আর ইউ? হৃদি জানতে চাইল।
-ফাইন, এন্ড ইউ? তাসিন রিপ্লাই করল।
-এক্সেলেন্ট। হৃদি জবাব দিল।
- ইউ হ্যাভ আ সারপ্রাইজ। তাসিনের মেসেজ হৃদির মনে এক আলোড়ন সৃষ্টি করল।
-হোয়াট?
-আই এম ইন ঢাকা।
-সে কী? কবে আসলে?
-বিশ্বাস হচ্ছে না? মোবাইলটা হাতে নাও।
হৃদি মোবাইলটা হাতে নিতেই তা বেজে ওঠে। অচেনা নাম্বার। কানে লাগাতেই ওপাশ থেকে শোনা গেল, “কেমন আছ জান?” আরে! এতো সত্যিই তাসিন; স্কাইপে শোনা সেই কন্ঠ, যা তাকে মোহিত করছে গত এক বছর ধরে।
-সত্যিই তুমি? হৃদির আনন্দ যেন আর ধরে না।
-ইয়েস। কাল সকালে দেখা করো রমনায়। আরও সারপ্রাইজ আছে। বাই।
-বাই জান।
মোবাইলটা রেখে হৃদির মনে হল, আজ সে পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। যে লোকটা তার নিঃসঙ্গতার চিরসঙ্গী, তার দেখা সে কাল পেতে চলেছে। মাকে ব্যবসার কাজে বাইরে থাকতে হয়, মামা থাকেন কোর্টে, মামী সারাদিন পড়ে থাকেন হিন্দি চ্যানেলের বস্তাপঁচা সিরিয়াল নিয়ে। ছোটবেলার মত আর কারোই সঙ্গ পায় না হৃদি। তাই ফেসবুকে পরিচিত এই মানুষটাই হতে থাকে তার প্রাণের সাথী। এক বছরে কী হয় নি? তাসিনের ভালবাসার প্রস্তাব; হৃদির সম্মতি। একজন আরেকজনের সম্পর্কে জানা।
তাসিনের পুরো পরিবার লন্ডন থাকে। ও ওর বাবা-মা আর বৃদ্ধ দাদার সাথে থাকে। এই বছরখানেক সময়ের মধ্যে সে সবার সাথেই কথা বলেছে স্কাইপে। তাঁরাও ওকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু হৃদির পরিবারকেই জানানো হয় নি।
পরদিন সকালে নাস্তা না খেয়েই হৃদি বেড়িয়ে যায় রমনার উদ্দেশ্যে। মা-মামা আগেই বেড়িয়ে গেছেন। মামী ফেরদৌসী বলেছিলেন, হৃদি, ব্রেকফাস্ট করে বের হ।
-না মামী, আমার ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
উঁহ, এই মেয়েটাকে নিয়ে আর পারি না। দিনকে দিন কেমন যেন বেয়াদপ হয়ে যাচ্ছে। আগে তো এমন করত না। চিন্তা করেন ফেরদৌসী। না ওর মা আর মামার সাথে কথা বলতেই হবে। ওদের আদর পেয়েই বাদঁর হচ্ছে ও। যাক এখন গিয়ে টিভি সিরিয়াল দেখাই ভাল। না জানি কি হয়ে গেছে এতক্ষণে!
রিকশায় করে রমনার গেটে পৌঁছাতেই দেখল, তাসিন দৌঁড়ে আসছে। ও নামতেই উবু হয়ে বসে হাতে ফুলের গোঁছা তুলে দিয়েই বলে, উইল ইউ মেরি মি? ওর বাঁ হাতে একটা রিং।
-ইয়েস আই উইল। ফুল হাতে নিয়ে বলে হৃদি। তাসিন তাকে আংটি পরিয়ে দেয়।
এরপর রমনায় ঘুরতে থাকে তারা। এত দিনের নানা মান-অভিমান আরও কতকিছু, আলোচনা চলে ওদের মাঝে।
একসময় তাসিন জানায়, ওর মাও এসেছেন। দাদা অসুস্থ, তাই বাবা আসেননি। উনি এসেছেন ছেলেকে বিয়ে পরিয়ে পুত্রবধুকে সাথে করে নিয়ে যেতে। তাসিনের দাদা নাকি ওকে দেখে মরতে চান। এখন হৃদির উচিত নিজের পরিবারকে সবকথা জানিয়ে বিয়ের প্রস্তুতি শুরু করা। ঠিক হল কাল সন্ধ্যায় তাসিনের মা জান্নাত যাবেন ওদের বাড়ি। গিয়ে কথা একদম পাকা করে আসবেন।
যেই কথা সেই কাজ। হৃদি সব জানায় তার মা আর মামা-মামীকে। তাঁরা সকলেই ওকে বোঝাতে চেষ্টা করে বিদেশ-বিঁভুই এ থাকা ছেলে; ইন্টারনেটে পরিচয়, বংশ-পরিচয় ভাল করে জানিস না, কোন বিশ্বাস নেই। ওর সম্পর্কে বেশি কিছুই তুই জানিসনা। তোর এখনো গ্র্যাজুয়েশন শেষ করা বাকি, এসব করার বয়স তোর হয় নি ইত্যাদি। কিন্তু হৃদি কিছুই মানবে না। একাকিত্ব যখন তাকে কুঁড়ে-কুঁড়ে খাচ্ছিল, তখন একে সঙ্গ দিয়েছে এই ছেলে। আর ও অটোমোবাইল ইঞ্জিনিয়ার, ভালো মাইনে, প্রয়োজনে হৃদিও চাকরি করবে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির প্রধান পুরুষ ওর মামা জানালেন, আচ্ছা তাসিনের মাকে কাল আসতে বল। আর ওর ছবি দেখা তো, দেখি। আমার মামণির প্রিয়তমকে কেমন দেখায়? হৃদি ল্যাপটপ এনে সবাইকে ওর ছবি দেখায়।
পরদিন যথারীতি জান্নাত আরা বেগম তাসিনের সাথে এসে হৃদিকে এসে আশীর্বাদ করে যান। বিয়ের কথা পাকা করে যান। ঠিক হয় তিনদিন পরেই শুক্রবারে বিয়ে হবে, একেবারেই পারিবারিকভাবে। কোন বাইরের মেহমান আসবে না, স্বাক্ষী থাকবে দুই পরিবারের ড্রাইভারেরা। মোহরানা ঠিক হয় দশ লাখ এক টাকা। বিয়ের তিন দিন পরেই ফ্লাইটে হৃদিকে নিয়ে লন্ডন চলে যাবেন তাঁরা। তাসিনের বৃদ্ধ দাদা নাতবউ দেখতে অধীর আগ্রহে বসে আছেন। এরপর হৃদি আর তাসিনকে বারান্দায় পাঠিয়ে তিনি আসল কথাটা পাড়েন, ‘বেয়াই সাহেব। দেখুন আমার একমাত্র ছেলের বিয়ে নিয়ে আমার অনেক আশা ছিল। কিন্তু সময়ের অভাবে তা হচ্ছে না। কিছু মনে না করলে বিয়ের আর বউ ভাতের একটাই অনুষ্ঠান করবো পরে লন্ডনে। খরচ আমরা আধাআধি ভাগ করে নেব। আপনাদের ভাগে মোটামুটি এক কোটি টাকার মত পড়বে’। এই দাবি শুনে হৃদির মা, মামা-মামী খুশি হতে না পারলেও মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে রাজি হন।
এর মাঝে আসে শুক্রবার। কনের সাজে হৃদি। দারুণ আনন্দে বরের সাজে বসে থাকা তাসিনের পাশে বসে আছে সে। আজ তার আশা পূরণ হতে যাচ্ছে। তাসিনকে যা হ্যান্ডসাম লাগছে আজ। জান্নাত জিজ্ঞেস করলেন, বেয়াই সাহেব, টাকাটা তৈরি তো? আবেদ হোসেন জানান, অবশ্যই, আমার একমাত্র মেয়ের বিয়ে, এ কী আর যে সে রকমভাবে হতে পারে?
এদিকে হৃদির মা গুলশান জিজ্ঞেস করলেন, কি রে আবেদ? কাজী সাহেব এখনো এলেন না?
-এই তো আপা এল বলে। বেয়াইন সাহেব আপনি বরং ততক্ষণ মিষ্টি খান।
কিছুক্ষণের মধ্যেই কলিংবেল। দরজা খুলতেই প্রবেশ করেন পুলিশের ওসি হারুন হায়দার। সাথে কয়েকজন কনস্টেবল।
আসুন, আসুন বলে তাদের এগিয়ে নিয়ে আসেন আবেদ সাহেদ। জান্নাত বেগম রেগে গিয়ে বলেন, এরা এখানে কেন?
-এখনই বুঝতে পারবেন। জবাব দেন আবেদ।
ওসি সাহেব নির্দেশ দেন জান্নাত বেগম আর তাসিনকে গ্রেপ্তারের। শুনে রেগে যায় হৃদি। কেন কি করেছে ওরা? মামা, ওরা এখানে কেন?
জবাবটা ওসি সাহেবই দেন। জান্নাত আর তাসিন নারী পাচারকারী ও প্রতারকদলের সদস্য। এর আগে একই কৌশলে তারা আরো দুই পরিবারকে ঠকিয়েছে। টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, মেয়েদের মিডল-ইস্টে পাচার করেছে। এডভোকেট আবেদ সাহেবের সন্দেহ হওয়ায় তিনি পুলিশের কাছে তাসিনের ছবিসহ যোগাযোগ করেন। পরে তদন্তে সব জানা যায়। সেন্ট্রি, ওদের নিয়ে চল।
সব শুনে হৃদি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। এ কোন বাস্তবতার মুখোমুখি সে আজ? মা তার কাঁধে হাত রেখে বলেন, কাঁদিস না। সময়মত সব জানা গেছে। আসলে দোষ তো আমাদেরই, তোকে সময় দিতে পারিনা আমরা।
-একদম ঠিক বলেছো আপা। আবেদ হোসেন বললেন। আসলেই আমরা আমাদের মামণিকে সময় দিতে পারিনি। তার উপর আজকাল ইন্টারনেটের মাধ্যমে এত বেশি ফ্রড হচ্ছে!! যাই হোক, আজ থেকে আমরা যেভাবে পারি তোকে সময় দেব। আর তুইও ভালোভাবে পড়ালেখা করে ভাল রেজাল্ট করে চাকরি করবি। আর আমরা তোর জন্য যোগ্য বর জোগাড় করব।
-ঠিক কথা। হৃদির মামী ফেরদৌসী বললেন। চুলোই যাক টিভির বস্তাপঁচা সব সিরিয়াল। এগুলোর জন্যেই আমি মামণিকে সময় দিতে পারিনি। আজ থেকে আমার সময় কাটবে শুধুই ওকে নিয়ে।
হৃদির মুখে হাসি ফোটে। আর জীবনে এমন বাস্তবতার মুখোমুখি হতে সে চায় না। এই পরিবারকে নিয়ে সে দারুণ খুশি, গর্বিত।
©somewhere in net ltd.