নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আঁচলের ঘ্রাণে বিমোহিত হতে মনে প্রেম থাকা লাগে। চুলের গন্ধ নিতে দুহাত বাড়িয়ে দেয়া লাগে। হাহাকার থাকা লাগে। দুনিয়া ছারখার হওয়া লাগে। সবাই আত্মা স্পর্শ করতে পারে না।আমার সমস্ত হাহাকার ছারখারে তুমি মিশে আছো।

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার

এক জন নিভৃতচারী

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার › বিস্তারিত পোস্টঃ

১৯৭১ ও একটি অসমাপ্ত ভালবাসার গল্প

০৯ ই জুন, ২০১৬ রাত ১:০৫


পরীটাকে আজাদ প্রথম দেখেছিল করাচী ইউনিভার্সিটির বাঙ্গালী সমিতির অনুষ্ঠানে, শাড়ি আর নীল টিপের স্নিগ্ধ লাবণ্যে মনে হচ্ছিল সত্যিই বুঝি স্বর্গ থেকে কোন পরী নেমে এসেছে। কিন্নরি কণ্ঠে সে গাইছিল, “সাতটি রঙের মাঝে আমি মিল খুঁজে না পাই, জানি না তো কেমন করে কি দিয়ে সাজাই।“ চোখ সরাতে পারছিল না আজাদ, কি মায়াময় নিস্পাপ সৌন্দর্য…
ফাংশন শেষে আজাদ এগিয়ে যায়, দুরুদুরু বুকে হৃদপিণ্ডটা বাজে ড্রামের মত, যথাসম্ভব গলাটা পরিস্কার করে বলল,” আপনি গাইলেন, কেমন করে কি সাজাবেন, বুঝতে পারছেন না, অথচ আপনাকে কিন্তু অসাধারন লাগছে…
—ওমা, গাইলাম গান, প্রসংশা পেলাম সাজের, ব্যাপার কি? গান ভালো হয়নি বুঝি?
—আরে না না, গান ভালো হবে না কেন? কতদিন পর মায়ের ভাষার গান শুনলাম। গান-সাজ, সব মিলিয়েই আপনি অনন্য। ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছেন?
—হ্যাঁ ।আপনি?
—সেকেন্ড ইয়ার চলছে। কেমন লাগছে?
—উর্দু বুঝতে কষ্ট হয়। বিচ্ছিরি ভাষা।
—আমিও উর্দু তেমন বুঝি না। বিরক্তি লাগে। ইংলিশটাই বেটার। চা নেবেন না?
— হুম, ভিড়টা কি করেছে?
—বোধহয় কমেছে। চলুন। ঢাকায় কোথায় থাকা হয়?
—পুরানা পল্টন। আপনি কোথায়?
—(ইস্কাটন বলতে গিয়ে থেমে গেল আজাদ) আমি মগবাজারে থাকি।
—ওহো, আপনার তো নামটাই জানা হল না…
—আমি আজাদ। আপনি?
—আমি মিলি…
আজাদের সাথে মিলির পরিচয়টা এভাবেই। সেদিনের পর হুট করে কিভাবে যেন মিলি তার অস্তিত্বের সবটা দখল করে নিল। তাড়াহুড়োয় করাচীর ঠিকানাটা জানতে পারেনি, সেই আফসোসের মাঝেই তার মনে হতে থাকলো, আচ্ছা,সেদিনের মত হঠাৎ করে মিলির সাথে কি আরেকবার দেখা হয়ে যেতে পারে না? রাতের বেলা মনোযোগ দিয়ে পড়তে পড়তে হঠাৎ তার খেয়াল হল, সে আসলে এতক্ষণ মিলির কথা ভাবছিল। তারপর একদিন ক্লাস থেকে বেরিয়ে আজাদ তার চোখকে বিশ্বাস করতে পারল না। ওই তো করিডোরে মিলি দাড়িয়ে গল্প করছে। হাত-পা অসাড় হয়ে গেল, কাছে গিয়ে বহু কষ্টে পেছন থেকে জিজ্ঞেস করল, কেমন আছেন?
অবাক হয়ে ঘুরে দাঁড়ায় মিলি, এই পাণ্ডববর্জিত জায়গায় বাঙলায় কথা বলে কে?
—আরে, কি খবর? আছেন কেমন? একেবারে উধাও হয়ে গেলেন যে?
—আমি ভালো। উধাও হলাম কিভাবে? এই যে দেখুন দিব্যি আপনার সামনে দাড়িয়ে আছি।
—আমার অবশ্য বিশ্বাস হচ্ছে না।
—আর ক্লাস আছে আপনার?
—নাহ, বাসায় ফিরব এখন।
—বাসাটা যেন কোথায় আপনার?
— পিসিএইচ। খালার বাসা। ওখানেই থাকি।
—আরে আমিও তো ওদিকটায় যাব এখন। বোনের দেবর থাকেন, জরুরি কাজ আছে।
—চলেন তাহলে,বাস ধরতে হবে। এই সময় খালি বাস যাবে কিনা কে জানে…
— কুছ পরোয়া নেই ম্যাডাম। আমি আছি না…
কিভাবে যেন ভিড়ের ভেতর দুটো সিট ম্যানেজ করে ফেলল আজাদ। দুজন দুজনের কথা বলল, শুনল, গল্পে গল্পে সময়টুকু যেন দৌড়ে পালিয়ে গেল। বাস থেকে নেমে মিলি জিজ্ঞেস করল।
—আপনি যাবেন কোনদিকে?
—“এইতো এই রাস্তা ধরে সামনে দুটো লেন পরেই বাসাটা” তৎক্ষণাৎ কথাটা সাজিয়ে ফেলে আজাদ।
—আমি তো যাব উল্টো দিকে। চলুন না, এক কাপ চা খেয়ে যাবেন…
—(মনে মনে বলে আজাদ, অবশ্যই, একশবার) নাহ, আজ থাক, আরেকদিন… আসি।
—ভালো থাকবেন।আবার দেখা হবে…
উল্টো ঘুরে দু-তিন পা সামনে এগিয়ে চট করে একটা বাড়ির আড়ালে দাড়িয়ে যায় আজাদ, মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে দেখে মিলির চলে যাওয়া। প্রতিটা পদক্ষেপে চারপাশের সবকিছু ধন্য করে দিয়ে যাচ্ছে পরীটা,রাস্তার ধুলগুলো পর্যন্ত ধন্য হয়ে যাচ্ছে ওর পদস্পর্শ পেয়ে। এক অসামান্য আনন্দ নিয়ে ধীর পায়ে হাঁটতে হাঁটতে সে ফিরে আসে বাসস্ট্যান্ডে। কিসের বোন আর কিসের দেবর…
প্রচণ্ড উত্তেজনায় গত রাতে ঘুম হয়নি আজাদের। আজ সে মিলিকে বলবে তার ভালোবাসার কথা,জানাবে কি অসম্ভব ভালোবাসা সে জমিয়ে রেখেছে তার ছোট্ট হৃদয়ে, কেবল মিলির জন্য। অনেকক্ষন কলিংবেল বাজবার পর গেট খুলে যায়, মিলির খালা ড্রইংরুমে নিয়ে বসান আজাদকে। তারপর দাড়িয়ে থেকেই কাঁচুমাচু স্বরে বলেন, বাবা, তুমি এসেছ আমি খুব খুশি হয়েছি। কিন্তু তোমাকে তো একটা কথা জানানো হয় নাই। মিলির তো বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলে বাঙ্গালি,লাহোরে সেটেলড।
স্তব্ধ আজাদের গলাটা সামান্য কেঁপে যায়, “কিন্তু মিলি তো আমাকে কিছু জানালো না।“
—জানাবে কিভাবে? ও নিজেই জানতো নাকি? মেয়ে দেখতে এসে ছেলেপক্ষের পছন্দ হয়ে গেল,ব্যস বিয়ে করে নিয়ে চলে গেল। ভালো ছেলে কি সবসময় পাওয়া যায়? মিষ্টি খাও বাবা, মিলির বিয়ের মিষ্টি…
“চাচি, আল্লাহর কাছে শোকর করেন। আমি আছি বইলাই আজাদরে ছাইড়া দেওয়ার একটা সুযোগ আইছে। উনারে ক্যাপ্টেন সাব পাঠাইছে। কি কয় মন দিয়া শুনেন।“
সাদা শার্ট-কালো প্যান্ট পড়া আর্মি ছাটের চুলের মানুষটা সাফিয়া বেগমের দিকে ঠাণ্ডা দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল। তার গলার স্বরটা ততোধিক ঠাণ্ডা শোনায়,
–আজাদের সাথে দেখা করতে চান?
–জি।
–ছেলেকে ছাড়ায়ে আনতে চান?
–জি!
–আজকে রাতে আজাদকে রমনা থানায় নিয়ে আসবে। দেখা করায়া দিব ওর সাথে। বুঝলেন?
–জি।
–তার সাথে দেখা করবেন। দেখা করে বলবেন, সে যেন সবার নাম বলে দেয়। অস্ত্র কোথায় রেখেছে, তা বলে দেয়।
–জি?
–সে যদি সব বলে দেয়, তাকে রাজসাক্ষী বানানো হবে। ছেলেরে যদি ফিরে পাইতে চান, তারে সব বলতে বলবেন।
আজাদের মা লোকটার পাথুরে মুখের দিকে তাকান। তার চোখে নিঃস্পন্দ শুন্য দৃষ্টি…
গরাদের ওপারে দাড়িয়ে থাকা আজাদকে তার মা চিনতে পারেন না। প্রচণ্ড মারের চোটে চোখমুখ ফুলে গেছে, ঠোঁট কেটে ঝুলছে, ভুরুর কাছটা কেটে গভীর গর্ত হয়ে গেছে।
–“মা, কি করব? এরা তো খুব মারে। স্বীকার করতে বলে সব। সবার নাম বলতে বলে।“
–“বাবা, তুমি কারোর নাম বলোনি তো?
–না মা, বলি নাই। কিন্তু ভয় লাগে, যদি আরও মারে, যদি বলে দেই…
–বাবারে, যখন মারবে, তুমি শক্ত হয়ে থেকো। সহ্য করো। কারো নাম বলো না।
–আচ্ছা মা। ভাত খেতে ইচ্ছে করে। দুইদিন ভাত খাই না। কালকে ভাত দিয়েছিল, আমি ভাগে পাই নাই।
–আচ্ছা, কালকে যখন আসব, তোমার জন্য ভাত নিয়ে আসব।
সাফিয়া বেগমের ভেতরটা দুমড়ে-মুচড়ে যায়। হায়ে হাত তোলা তো দূরে থাক, ছেলের গায়ে একটা ফুলের টোকা লাগতে দেননি কোনোদিন। সেই ছেলেকে ওরা এভাবে মেরেছে… এভাবে…
মুরগির মাংস, ভাত, আলুভর্তা আর বেগুনভাজি টিফিন ক্যারিয়ারে ভরে পরদিন সারারাত রমনা থানায় দাড়িয়ে থাকেন সাফিয়া বেগম, কিন্তু আজাদকে আর দেখতে পাননি। তেজগাঁও থানা, এমপি হোস্টেল, ক্যান্টনমেন্ট-সব জায়গায় খুজলেন, হাতে তখন টিফিন ক্যারিয়ার ধরা, কিন্তু আজাদকে আর খুঁজে পেলেন না…
৭১রের ১৬ই ডিসেম্বর। জয় বাঙলা স্লোগান দিতে দিতে ঘরে ফিরছে বাঙলা মায়ের দামাল ছেলেরা,ফিরছে বিজয় নিয়ে, ফিরছে মুক্তির বারতা নিয়ে। বাঁধভাঙ্গা এ আনন্দের মুহূর্তে পুরানা পল্টনের একটি বাড়ির চিলেকোঠার কোনে বসে থাকা একটা মেয়ে কেবলই কেঁদে যাচ্ছে। নীরব অশ্রুর ফোঁটায় ফোঁটায় তার কাজলকালো চোখ দুটোতে ভর করেছে নীল বিষাদ। সে তাকিয়ে আছে দূরের রাজপথে, যেখানে ছেলে ফিরছে মায়ের কোলে, স্বামী ফিরছে স্ত্রীর কাছে, প্রিয়তম ফিরছে, প্রিয়তমার বাহুডোরে।
প্রচণ্ড ভালোবাসতো মেয়েটা ছেলেটাকে, ভালোবাসি কথাটা বলা হয়নি তবুও। বলবার সুযোগটাও পাওয়া গেল না। হুট করে একদিন জেনে গেলেন বাবা-মা,কোনভাবেই মানবেন না এ সম্পর্ক। ছেলের অপরাধ, তার পিতা ইউনুস সাহেব বহুগামী, চরিত্রহীন। মেয়েকে তারা আটকে রাখলেন ঘরে, কৌশলে ছেলেটাকে জানিয়ে দেওয়া হল, মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়ের ইস্পাতকঠিন দৃঢ় ভালোবাসার কাছে শেষতক হার মানতে হল মা-বাবাকে। কিন্তু ততদিনে বড্ড দেরী হয়ে গেছে। ছেলেটার ঠিকানা জানে না সে, অনেক খুঁজে খুঁজে জানতে পারল ছেলেটা মগবাজারের দিকে থাকে, কিন্তু একজ্যাক্ট ঠিকানাটা পাওয়া গেল না। এদিকে ছেলেটাকে তার বন্ধু জুয়েল একদিন বলল, “খবর শুনছস, মিলি তো এখন ঢাকায় থাকে। দেখা করবি নাকি?” কথাটা শুনে ছেলেটার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে গিয়েছিল, এক অনির্বচনীয় অভিমান দলা পাকিয়ে উঠেছিল তার ভেতরে। ছেলেটা কোন জবাব দেয়নি সেদিন, তারপর আর সুযোগ আসেনি জবাব দেবার। সেইরাতে মগবাজারের বাসায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী রেইড চালায়, ক্র্যাক প্লাটুনের সদস্য ছেলেটা তার বন্ধুদের সাথে ধরা পড়ে। তার দুদিন পর শেষপর্যন্ত মগবাজারের বাসার খোঁজ পায় মেয়েটা, কিন্তু ছেলেটাকে খুঁজে পায়নি। ছেলেটার নাম আজাদ, আজাদ আর কোনোদিন ফিরে আসেনি…
সময় বয়ে যায়, পাল্টে যায় পৃথিবী। কেবল মেয়েটা অধীর আগ্রহে অপলক তাকিয়ে থাকে কালো পিচঢাকা পথের দিকে। স্বাধীনতার লাল সূর্যটা সবুজ জমিনের পতাকায় জড়িয়ে বীরেরা ফিরে আসে, কেবল আজাদ ফেরে না। মেয়েটার চোখের নীরব অশ্রুর নীল বিষাদ হয়ে ঝরতে থাকে, অপেক্ষার পালা আর ফুরোয় না…
শুধু যুদ্ধ নয় ধর্ষন নয় ভালবাসাও ছিল ১৯৭১ এ
মা-আনিসুল হক
এই গল্পের প্রতিটা লাইন হৃদয় ছুঁয়ে যায়।কখনও আনমনে অদেখা প্রিয়তমাকে বলতে ইচ্ছে করে,মায়াবতী আমি তো সেই কবেই আজাদ হয়ে গেছি মনে প্রানে তুমি কি আমার মিলি হবে,শুধুই আমার?

মন্তব্য ২ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ০৯ ই জুন, ২০১৬ রাত ৩:৩৭

রূপক বিধৌত সাধু বলেছেন: কাহিনীটা জানাই ছিলো; আবার পড়লাম । বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠে ব্যথায়!

০৯ ই জুন, ২০১৬ বিকাল ৩:১৬

সানবীর খাঁন অরন্য রাইডার বলেছেন: প্রথম যখন পড়েছি,চোখের পানি আটকে রাখতে পারিনি

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.