![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
I am the slave of my baptism. Parents, you have caused my misfortune, and you have caused your own... - Arthur Rimbaud
'মনসামঙ্গল'-এ বেহুলার কাহিনির সাথে গ্রিকদের অর্ফিয়ুসের কাহিনির একটা মিল আছে। সাপের কামড়ে বেহুলার স্বামী লখিন্দরের মৃত্যু হলে ইন্দ্রপুরীতে দেবতাদের নাচ দেখিয়ে তুষ্ট করার বিনিময়ে ফিরিয়ে দেয়া হয় লখিন্দরের জীবন, আর অর্ফিয়ুসের স্ত্রী ইউরিদিসের সাপের কামড়ে মৃত্যু হলে, মৃত্যুপুরীতে হেডিসের দরবারে সঙ্গীত পরিবেশনে দেবতাদের মুগ্ধ করে অর্ফিয়ুস ফিরে পায় তার স্ত্রীর জীবন। লখিন্দর এবং ইউরিদিস উভয়ের মৃত্যু হয় বিয়ের দিনেই। তবে মনসামঙ্গলের কাহিনিতে যেমন বেহুলার স্বামীর মৃত্যু, অর্ফিয়ুসের ক্ষেত্রে ঠিক তার বিপরীত। তবে মূল পার্থক্যটা অন্য জায়গায়, অর্ফিয়ুসের ক্ষেত্রে পরিণতিটা শেষ পর্যন্ত ট্র্যাজিক। শর্ত ছিল পাতালপুরী থেকে মর্ত্যে ফেরত আসবার সময় অর্ফিয়ুস থাকবে ইউরিদিসের সম্মুখে এবং উভয়েই মর্ত্যে পৌঁছাবার আগে অর্ফিয়ুসের পেছনে ফেরা নিষেধ। অর্ফিয়ুস যখন মর্ত্যে প্রবেশ করল, পেছন ফিরে যখন ইউরিদিসের দিকে তাকাল, ইউরিদিস তখনও মর্ত্যে প্রবেশ করে নি। ফলে দেবতার শর্তভঙ্গ হল আর ইউদিস চিরজীবনের জন্যে উধাও হয়ে গেল।
দুটো কাহিনি পাশাপাশি রাখলে আরেকটা পার্থক্য দেখা যায়, চাঁদসওদাগর অবশেষে মনসার পূঁজা শুরু করে এবং অভিজাত সম্প্রদায়ের মাঝে সেই থেকে মনসার আরাধনা শুরু হয়, এবং অর্ফিয়ুস শেষ জীবনে সূর্যদেবতা ছাড়া বাকি সব দেবতাদের অস্বীকার করা শুরু করে। এবং কালান্তরে ব্যর্থপ্রেমিকগণের একরকম উপাস্য হয়ে উঠে অর্ফিয়ুস। এখানে মনসামঙ্গলের কাহিনিতে যেমন দেবতার নিকট মানুষের নতি স্বীকার দেখানো হয়েছে অর্ফিয়ুসে ঠিক উল্টো। এ বিষয়ে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়ের একটা কবিতা আছে, 'বেহুলার প্রতি অর্ফিয়ুস' শেষ কয়েকটা পঙক্তির উদ্ধৃতি দেয়া যায়-
বেহুলা তোমার জয়, স্থূল সফলতার গৌরব
শিল্প নয়। তুমি
মানব চরিত্রে কালো কলঙ্ক এঁকেছো
দেবতাকে মহৎ করো নি।
চম্পকনগরে আজ সুখসিন্ধু, কেন সে সিন্ধুর জল
বিস্বাদ, অপেয়, তুমি জানো।
নাচনী, তোমার জন্য বীণাবাদকের দুঃখ হয়।
অবশ্য চাঁদসওদাগরকে বিবেচনায় রাখলে অর্ফিয়ুসের ঔদ্ধত্য আমরা তাঁর মাঝেও দেখতে পাই। শেষপর্যন্ত মনসার পূজা করলেও, সে পূজা নিবেদন করেছিল মনসার প্রতিমার দিকে উল্টো হয়ে ঘুরে। তবে তাতেই মনসা খুশি হয়। এক্ষেত্রে আর্নেস্ট হেমিংওয়ের old man and the sea উপন্যাসের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে উপন্যাসের সেই বিখ্যাত উক্তি, মানুষ ধ্বংস হতে পারে কিন্তু পরাজিত হয় না। অর্ফিয়ুস বা চাঁদসওদাগর অন্তত শেষ পর্যন্ত দেবতার কাছে পরাজয় স্বীকার করেনি। যেটা হয়তো করেছিল বেহুলা। বেহুলাকেই মূল চরিত্র হিসেবে ধরে নিলে মনসামঙ্গল সেই পরাজয়েরই আখ্যান।
এবার আরেকটি সাহিত্যকীর্তির কথা বিবেচনা করা যায়, যার জন্যেই আসলে বেহুলা-অর্ফিয়ুস নিয়ে এই আলোচনা। সেলিম আল দীন রচিত নাটক 'প্রাচ্য'। 'প্রাচ্য' নাটকেও মনসামঙ্গলের কাহিনির পুনঃনির্মাণ দেখা যায়। কিন্তু ঠিক মনসামঙ্গলের মতো নয় বরং অর্ফিয়ুসের মতো এই নাটকেরও ট্র্যাজিক পরিণতি। আবার ঠিক যেন অর্ফিয়ুসের মতোও নয়। সেলিম আল দীন নাটকের কাহিনিকে নামিয়ে এনেছেন নিম্নবিত্তের বাঙালি সমাজজীবনে। বাসার রাতে সাপের কামড়ে নববধুর মৃত্যুকে শেষ পর্যন্ত মেনে নিতে হয় নাটকের প্রোটাগনিস্টকে (নামটা ঠিক মনে আসছে না!)। এবং নববধুর হত্যার প্রতিশোধ নিতে ঘরের মেঝে খুড়ে সাপ বের আনলেও শেষ পর্যন্ত সাপকে তার ক্ষমা করে দিতেই হয়, এখানে এই ক্ষমা করে দেয়াটা যেন বাধ্যতামূলক এবং এর মাঝে নায়কোচিত গৌরব দেখি না বরং পরাজয় দেখা যায়। চরিত্রটি শেষ পর্যন্ত বিদ্রোহী হয়ে উঠতে পারে না, অর্ফিয়ুসের মতো মহানায়কও হয়ে উঠতে পারে না। এই যে ক্ষমা করে দেয়া, প্রতিশোধ নেয়া থেকে বিরত থাকা, এ তার মহানুভবতার পরিচয়তো নয় বরং কুরস্কারাচ্ছন্ন মননের প্রতিফলন। নাটকে শেষ পর্যন্ত কোনও মহাকাব্যিক বীরত্বও দেখা যায় না যেই কারণে। এখানেই মনে হয় সেলিম আল দীনের বিশেষত্ব দেখা যায়। পুরাণ কাহিনির যেই বিনির্মাণ আমরা নাটকে দেখি সেটা কেবল আঙ্গিকগত নয় বরং সেলিম আল দীন যেন আগাগোড়া মৌলিক হয়ে উঠেছেন, সেটা কিভাবে এক দুই কথায় ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। তবে এই নাটকের উৎস যদি খুঁজতে যাই সেটা বাঙালির প্রান্তিক সমাজজীবনেই খুঁজতে হবে। ইউরোপিয়ান অ্যারিসটোক্র্যাট সাহিত্যে তা পাওয়া সম্ভব নয়। মোটাদাগে এই বিষয়টা হয়তো চোখে পড়বে না, এখানে সাদৃশ্যটাই বৈসাদৃশ্য হিসেবে চলে আসছে, এবং এই বৈসাদৃশ্য কাহিনিতে নয় কাহিনির অন্তর্গত কোনও এক গোলকধাঁধায়, কিন্তু তিনটি ভিন্ন চরিত্রের জায়গায় দাঁড়িয়ে যদি একে অপরের দিকে তাকিয়ে দেখা যায়, তাহলে হয়তো কিছুটা আন্দাজ করা যায়, এক জায়গায় যেখানে বিজয়টাই পরাজয়, অন্য জায়গায় পরাজয়টাই গৌরব, আর অপরটিতে পরাজয়টা কেবল পরাজয়ই রয়ে যাচ্ছে....
( *বেহুলা, লখিন্দরের কাহিনির উৎস হয়তো, মহাভারতে উল্লেখিত সাবিত্রি-সত্যবানের উপাখ্যান। তবে সে অন্যত্র আলোচনার বিষয়। এখানে আর তার উল্লেখ করলাম না।)
* ছবি : Orpheus by James Barry, 1792
০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৭:৩৮
তানভীর আকন্দ বলেছেন: পৌরাণিক কাহিনির সাথে মিল-গড়মিলের ব্যাপারটা অামি অবশ্য নাটকের চরিত্রটা বুঝাবার জন্যে টেনেছি। তবে সেলিম আল দীন সচেতনভাবেই পৌরাণিক কাহিনি ভেঙে নিজস্ব আখ্যান দাঁড় করিয়েছেন, যেটাকে তিনি বলতেন উলট-পুরাণ। এই ব্যাপারটা আমরা আধুনিক ল্যাটিন-আমেরিকার সাহিত্যে খুব বেশি দেখতে পাই। সেলিম আল দীন চেয়েছিলেন, ইউরোপীয় প্রভাব মুক্ত হয়ে বাঙলা নাটকের নিজস্ব একটা ধারা তৈরি করতে, তিনি সেটা করে গেছেন, আমাদের পৌরাণিক কাহিনি নির্ভর মধ্যযুগীয় পালা ও যাত্রার থেকে নাটকের নিজস্ব ফর্ম গ্রহণ করে। এদিক থেকে বাঙলা নাটকের ধারাটাই পাল্টে গেছে সেলিম আল দীনের মাধ্যমে। অথচ তাঁকে নিয়ে যতোটা আলোচনা হওয়ার কথা ছিল ঠিক ততোটা হয় না কেন জানি। এটা আফসোসের বিষয়...
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা অক্টোবর, ২০১৬ সন্ধ্যা ৬:০০
চাঁদগাজী বলেছেন:
সেলিম ততকালীন সময়ের বাংগালী সমাজের ক্থক; আজ, সময়ের সাথে ভাবনা বদলাবে।
আপনি গ্রীক ও হিন্দু পৌরাণিকের সাথে মিল ও গরমিলের কথা তুলনা করেছেন, ভালো; সাহিত্য ভাবনার উপর সময়ের বিশাল প্রভাব আছে।