নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

আসুন সত্যকে চিনি

সত্যের পক্ষ আসুন

সত্যের পক্ষ আসুন › বিস্তারিত পোস্টঃ

ঘুনে খাওয়া সমাজ আর একজন রোকেয়ার উপখ্যান !

০৬ ই মার্চ, ২০১৭ সকাল ৯:৩৪

আমাদের দেশে আসলে কি কিছুই বদলাবে না,,,,

রোকেয়া বেগম। একেবারে ছা-পোষা নিরীহ টাইপের নারী। স্বামীহারা। তার বয়স ত্রিশের কোঠায় হলেও শরীরে ভর করেছে আটপৌরে ভাব। অবয়ব জুড়ে দারিদ্র্যের বিষণ্ন ছাপ। চোখের নিচে লেপটে থাকে কালচে দাগ। সুখের সংসার ছিল তার। চট্টগ্রাম শহরে সিএনজি চালিয়ে তার স্বামী ভালোভাবেই সংসার টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ একদিন সড়ক দুর্ঘটনায় তার স্বামী মারা যাওয়ার পর সংসারের কঠিনতম হাল ধরতে হয়েছে তাকে। গার্মেন্টসের চাকরি করে টেনেটুনে কোনোমতে সংসার চালিয়ে নিচ্ছিল।
গ্রামের এক সৌদিপ্রবাসী দূরসম্পর্কের এক চাচার সহযোগিতায় আয়ার চাকরি নিয়ে সৌদি আরব যাওয়ার সুযোগ পেয়েছে সে। কাকডাকা ভোরে পাসপোর্ট তৈরির জন্য পাসপোর্ট অফিসে ফরম জমা দিতে সে যখন বাসা থেকে বের হয়েছিল বন্দর নগরী চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততা তখনো শুরু হয়নি। পাসপোর্ট অফিসে পৌঁছানোর আগ পর্যন্ত রোকেয়া মনে মনে ভেবেছিল আজকে ফরম জমা দেওয়ার লাইনে সেই সবার আগে থাকবে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখে সম্পূর্ণ বিপরীত। পা ফেলার এতটুকুন জায়গা বাকি নেই। আগে থেকে আসা মানুষে গিজগিজ করছে। বেলা বাড়ার সঙ্গে মানুষও বাড়তে থাকে। পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে সূর্যের তাপ।
কালো রঙের বোরকা পরা রোকেয়া লাইনে দাঁড়িয়ে। লাইনটা অনেক লম্বা। কড়া রোদ মাথায় নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে রোকেয়া। লাইন যেন শেষ হতে চায় না। কচ্ছপ গতিতে এগোচ্ছে। কাউন্টারের ভেতরের কর্মচারীদের গলা বাড়িয়ে দেখার চেষ্টা করছে সে। কোটটাই পরা একজন মোবাইল কানে চেপে আয়েশ করে কথা বলছেন। কিছুক্ষণ আগে তিনি সামনে দাঁড়ানো পাসপোর্ট প্রার্থী একজনকে বিশ্রী ভাষায় বকাঝকা করেছেন। রোকেয়ার কিছুটা ঘোর লাগে। কোটটাই পরা ভদ্রলোকও এভাবে খিস্তিখেউড় করতে পারেন তা ঘুণাক্ষরেও জানা ছিল না তার। রোকেয়া কিছুটা হতচকিত।

অফিসের পাশে একটা গাছ। সেই গাছে একটি ময়না পাখির বাসা। ওখানে কোথা থেকে একটা দাঁড়কাক উড়ে এসে বসেছে। ভয়ে জড়সড় ময়নাটা বাসা ছেড়ে বের হয়ে কিছুটা দূরে বসে তারস্বরে ডেকে যাচ্ছে সমানতালে।
রোকেয়া ঘেমে-নেয়ে যা–তা অবস্থা। চারদিকে মানুষের চেঁচামেচি। যত্রতত্র দালালদের দৌরাত্ম্য। আরও কয়েকজন নারী লাইনে দাঁড়িয়ে। নারী-পুরুষ সবাই নিয়ম মেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে আছে ফরম জমা দেওয়ার জন্য। তাদের দিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। অথচ দালালেরা খুব স্বাভাবিকভাবে তাদের সামনে দিয়ে কাজ করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আবার কেউ কেউ চোখের সামনে হোমরাচোমরা কারও মাধ্যমে কত সহজেই কাজ হাসিল করে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের লাইনে দাঁড়াবার প্রয়োজন নেই। দেশের সকল নিয়ম কানুনই যেন রোকেয়াদের মতো প্রান্তিক মানুষদের জন্য তৈরি।
প্রায় চার ঘণ্টা যাবৎ লাইনে দাঁড়িয়ে আছে রোকেয়া। পাগুলো আর দাঁড়িয়ে থাকতে চাচ্ছে না। পানি খেতে পারলে ভালো হতো। শরীরটা আরেকটু বল পেত। কিন্তু পানি খেতে গেলেই লাইনের জায়গা হারিয়ে বসবে। সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা একজন আনসারকে সে একবার পানির কথা বলেছিল। পানি খাওয়ানো তো দূরের কথা সাধারণ মানুষের কোনো প্রশ্নেরই সে জবাব দেয় না। এমন একটা ভাব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে যেন সে কেউকেটা একজন। কিন্তু দালালদের সঙ্গে তার খুব খাতির। দাঁত বের করে দালালের সঙ্গে হাসি-মশকরা করছে। মাঝে মধ্যে দালালটা রোকেয়ার দিকে কেমন চোখে তাকাচ্ছে। রোকেয়া অস্বস্তি অনুভব করে।
ওদিকে গাছে দাঁড়কাক এক–দুই পা করে ময়নার বাসার দিকে এগোয়। কাকের তিরন্দাজ চোখ দুটো ময়না পাখির বাসাটার দিকে স্থির। ময়নাটা আবারও আহাজারি করে ওঠে। কাক ইতস্তত করে থমকে দাঁড়ায়। কাকটা এদিক-ওদিক করে। আর সামনে এগোয় না। একটু পর পাখা মেলে উড়াল দেয়। তখন ময়না পাখিটার চোখ কিছুটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। আনন্দে লেজ নাড়াতে নাড়াতে বাসার দিকে এগোয়। চনমনে ভঙ্গিতে বাসায় গিয়ে বসে। একটু ডেকে ওঠে। এই ডাকার মধ্যে সুর আছে। আছে ছন্দ। নিজের বাসা নিরাপদে ফিরে পাওয়ার ছন্দ।
তাতিয়ে ওঠা সূর্যটা ঠিক মাথার ওপরে। রোকেয়ার সামনে এখনো তিনজন বাকি। এই সময় ছোট এক ভুলের জন্য লাইনের সামনে থাকা নারীর কাছে ১০০ টাকা দাবি করে কাউন্টারে থাকা এক কর্মচারী। টাকা না দেওয়ায় স্বল্পশিক্ষিত ওই নারীকে সমস্যাটি সঠিকভাবে না বুঝিয়ে নামের অক্ষর বড় হাতের হয়নি, এই ফরম বাতিল, নতুন ফরম পূরণ করে নিয়ে আস, ইত্যাদি বলে।
মানুষই সম্ভবত একমাত্র প্রজাতি, যে অন্য প্রজাতিকে শুধু নয়, নিজ প্রজাতিকেও নির্যাতন করে। সবল মানুষের কাছে দুর্বল মানুষ, ধনী মানুষের কাছে গরিব মানুষ, পুরুষ মানুষের কাছে মেয়ে মানুষ। নানা কায়দায় মানুষ মানুষকে নির্যাতন করে। প্রতিদিন নির্যাতন করছে। কেবল রক্ত বেরোলেই আর শ্বাসপ্রশ্বাস বন্ধ হলেই কি মৃত্যু ঘটে? অনেকে মার খেতে খেতে মৃত্যু পর্যন্ত বেঁচে থাকে। গোটা জগৎ জুড়ে এ রকম চলছে।
একটু পর রোকেয়ার পালা। মিনিট দু-এক পর তার ডাক পড়বে। নিজেকে খুব অসহায় লাগছে। মনে মনে ভাবে না, তার অসহায় হলে চলবে না। অসহায় হলে যে তার স্বপ্ন ভেস্তে যাবে। অনেক দিন ধরে লালিত স্বপ্ন সে ভেস্তে দিতে পারে না। সে সাহস নিয়ে দাঁড়ায়। অবশেষে সবকিছু ঠিকঠাকভাবে হয়ে যায়। কোনো সমস্যা হয় না। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জ্ঞাপন করে সে। ময়না পাখিটার মতোই আনন্দে তারও নাচতে ইচ্ছে করে।
তারপর আরও কিছু চড়াই-উতরাই পার হয়ে তার পাসপোর্টটা হাতে পেয়েছে। পাসপোর্ট অফিস, ব্যাংক, কমিশনার অফিস আর কত জায়গায় না তাকে এ জন্য ধরনা দিতে হয়েছে। দুনিয়াটা এখন টাকার ওপরে চলে। চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট নেওয়ার জন্য টাকা দাও। জন্ম নিবন্ধন কার্ডের জন্য টাকা দাও। আবার ওটা অনলাইন করার জন্য টাকা দাও। পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য টাকা দাও। টাকা আছে তো সব আছে। পাসপোর্ট পাওয়ার জন্য এ রকম পদে পদে হয়রানি। সময় ক্ষেপণ। লাঞ্ছনা-বঞ্চনার মতো অনেক কষ্ট আছে। অবশেষে ছিল স্বস্তি। পাসপোর্ট পাওয়ার রুদ্ধশ্বাস স্বস্তি!
পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য থানায় গিয়ে রোকেয়াকে শিকার হতে হয়েছিল আরেক প্রহসনের। তিন ঘণ্টা থানার বাইরে বসে থাকার পর ডাক আসে তার।
-এই তোমার কি চাই, কেন আসছ?
ছার সৌদিতে যাওয়ার লাইগা পাসপোর্ট বানামু, এর লাইগা কাগজ চাই।
-সৌদিতে তোমাদের মেয়েদের কাজ কি?
ছার মেয়ে ছাওয়াল হলে কি কাম করন যাইব না?
-চুপ কর। কথা বলা বেশ শিখেছ। মুখ কম চালাও।
ধমক দিয়ে এসআই তাকে এমনভাবে কথা বলেছে, যেন এইমাত্র কাউকে খুন করে এসেছে। তারপর শুধুমাত্র নামধাম জিজ্ঞেস করে চেয়ে বসে চার হাজার টাকা। টাকা চাওয়ার সময় রোকেয়া খেয়াল করে দেখেছে এসআইয়ের চোখে কোনো জড়তা নেই, আছে সাবলীলতা। যেন পাওনাদার টাকা ফেরত চাচ্ছে। বরং সরাসরিই বলে দেয়, টাকা না দিলে পুলিশ ভেরিফিকেশনের কোনো কাগজ মিলবে না।
অথচ মানুষকে তারাই ছবক দেয় স্বভাবচরিত্র বদলানোর, ভালো হওয়ার। এ অনেকটা নিজেরা সাপ হয়ে ছোবল না দেওয়ার পরামর্শের মতো। শেষে অনেক অন্যূনয় বিনয় করে তিন হাজার টাকায় পুলিশ ভেরিফিকেশন পায়।
জগতের বেশির ভাগ মানুষই তার বুকের ভেতর নিজস্ব কিছু কষ্ট বয়ে বেড়ায়। ভয়াবহ কষ্ট। দালালটা কীভাবে বুঝবে বিধবা নারীর বেঁচে থাকার কষ্ট। আনসার সদস্যটা কীভাবে শুনবে দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত তার বৃদ্ধ মায়ের হৃদয় নিংড়ানো দীর্ঘশ্বাস। হয়তো কোথাও এ রকম শুনেছে, কিন্তু একটু বুক পেতে শোনা হয়নি। সরকারি বেতনধারী অফিসারই বা কীভাবে বুঝবে রোকেয়ার ভেতরের কষ্ট। সে তো আর রোকেয়ার মেয়েটার মতো বাবাহারা মেয়ে দেখেনি, হয়তো বা দেখেছে। নতুবা বাইরের চোখে শুধু চেয়ে দেখেছে, মনের চোখ দিয়ে কখনো দেখতে চেষ্টা করেনি! রোকেয়াই জানে সেই মেয়েটিকে কতটা কষ্টে লালন পালন করে আসছে এই সবুজ তৃণভূমিতে।

দুই.
রোকেয়া আজ বাসায় গরুর মাংস রান্না করছে। আদা বাটা, রসুন বাটা, পেঁয়াজ বাটা, গুঁড়া মরিচ, হলুদের গুঁড়া, জিরা বাটা, এলাচ, দারুচিনি সব রকমের মসলা দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে উনুনে কষানো হচ্ছে। ঝালটা একটু বেশিই দেওয়া হয়েছে। গত কোরবানির ঈদের পর এই প্রথম গরুর মাংস রান্না হচ্ছে ঘরে। তার ছোট মেয়েটার খুব শখ গরুর মাংস খাওয়ার। গত আট মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে কতবার যে গরুর মাংস খাওয়ার কথা বলেছে তার কোনো ইয়ত্তা নেই। ভুলিয়ে ভালিয়ে মেয়েটাকে আর কত দিন রাখা যায়। মাঝে মধ্যে কাঁদে।
নুন আনতে পান্তা ফুরায় এ রকম টানাপোড়েনের সংসারে সাড়ে চার শ টাকা কেজিতে গরুর মাংস খাওয়াটা যে ভয়াবহ রকমের বিলাসিতা। তা এই অবুঝ মেয়েটাকে কীভাবে বোঝায়। উপরি রোকেয়ার বৃদ্ধা মায়ের ওষুধের খরচ।
সৌদি আরব যাওয়া উপলক্ষে বাসায় গরুর মাংসের আয়োজন। মাংসের সুগন্ধে সারা বাড়ি মৌ মৌ করছে। মা সৌদিতে চলে যাবে শুনে গত কয়েক দিন ধরে মুখ বেজার করে থাকলেও আজ তার মেয়েটার মন খুব ভালো। নিজে নিজেই ঘর ঝাড়ু দিয়ে মাদুর পেতে বসে গেছে খাওয়ার জন্য। গরম ধোঁয়া ওঠা ভাতের থালায় যখন রোকেয়া চামচ ভরে মাংস তুলে দিল তখন তার মেয়েটার চিকচিক করে ওঠা চোখগুলোতে ঠিকরে বেরোচ্ছিল রাজ্যের আনন্দ!
মেয়েটা গোগ্রাসে খাচ্ছে আর আদুরে অভিমানী কণ্ঠে বলছে—আম্মু গরুর গরুর মাংসে এত সুগন্ধ কেন? আমাক প্রতি মাসে এ রকম মাংস রান্না করে খাওয়াবা কিন্তু।
এটাই রোকেয়ার কাছে দুনিয়ার সেরা দৃশ্য। এই সেই তীব্র সুখকর অনুভূতি যার কোনো তুলনা নেই। এই দৃশ্যটাই বারবার দেখার জন্য সে আজ সন্ধ্যায় সৌদির উদ্দেশে বিমানে চেপে বসবে। সুদীর্ঘ অন্ধকার রজনীর শেষে তার জীবনে আবারও ভোরের সূর্য উদিত হবে। অপার্থিব সেই সূর্যের আলো ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। খুশিতে তার চোখ ঠেলে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে নোনতা জলের বন্যা। রোকেয়া কাঁদছে, আজ সে কাঁদছে আলোর স্পর্শে...।

*লেখক বশির আহমেদ রাকিব নামে পরিচিত।
সুত্র: প্রথম আলো

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.