![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
"স্যার কেমন আছেন, আপনাকে দেখতে এসেছি..."
আমি একটু অবাক হলাম। চেম্বারে সিরিয়াল নিয়ে অপেক্ষা করে এভাবে কেউ ডাক্তারের খবর নিতে আসে? একালে অবাক হওয়ারই বিষয়! সে সময় আবার মায়ের আচল ধরে পিছনে দাঁড়িয়ে উকি ঝুকি দিচ্ছিলো ছোট্ট একটি মেয়ে। আমার মেয়ের বয়সী। এবার হাতটি ধরে মা তাকে আমার টেবিলের সামনে এনে বললেন স্যার,
"সব সময় বায়না ধরে, আমার ব্রেইন সেলাই যে করেছিলেন যেই ডাক্তার মামা সেই ডাক্তার মামাকে একবার একটু দেখাওনা মা......, তাই আজ স্কুল শেষ করেই ওকে নিয়ে রওয়ানা দিলাম, স্যার দ্যাখেনতো চিনতে পারেন কিনা..?
আমি চিনতে পারলাম না। আমি আবার কবে ব্রেইন সেলাই করলাম! আমিতো আর নিউরোসার্জন না।
মেয়েটাকে ডেকে কাছে টেনে নিলাম।
"কিরে মা তোর ব্রেইন আমি সেলাই করেছি নাকি, হা হা হা....,কই কিছু দেখছিনাতো..?
মেয়েটি টা মাথার চুল এক পাশে সরিয়ে দেখালেন বেশ বড় লম্বা একটা কাটার দাগ। অনেক পুরাতন একটা স্কার মার্ক।
"মামা আমি যখন ছোট তিন দিনের ছিলাম তখন আমার মাথা কেটে যায়, মরেই নাকি গিয়েছিলাম। আপনি বাঁচিয়েছেন..."
"তাই নাকি মা'মনি। দেখি দেখি আয়তো বলে আমি মেয়েটির কাটা দাগটিতে হাত বুলালাম। এখনো মুছে যায়নি। চিকন লম্বা একটা স্কার মার্ক।
ফ্ল্যাশ বেকে মনে পড়লো সেই বারো বছর আগের ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা....!!!!!
বেশ ঘঠা করেই আয়োজন। চারিদিকে হই হই রই রই..। তিন দিন বয়েসী রীতার আজ প্রথম চুল কাটা। মা'ই তার আদরের কন্যার চুল অত্যন্ত যত্নের সাথে ধীরে ধীরে নতুন ধারালো ব্লেড দিয়ে ছেচে দিচ্ছিলেন। কিন্ত কে জানে কি ভয়ংকর বিপদ অপেক্ষা করছে। পাশে খেলছিলো তার ভাই রবি। হঠাৎ করে বেখেয়ালে রীতার আড়াই বছর বয়সী ভাইটা এসে ছিটকে পড়ে যায় মায়ের হাতের উপর। কচি মাথার চামড়া ধারালো ব্লেডে এফোড় ওফোড়। ফিনকি দিয়ে মুহূর্তেই রক্তে ছেয়ে যায় সব।
আমি তখন মনু উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র, কুলাউড়া সাব সেন্টারে কর্মরত একেবারেই নবীন মেডিকেল অফিসার। ২৪ তম বি সি এস এর আমার প্রথম পদায়ন। একেবারে গহীন গ্রামের মধ্যিখানে এই সাব সেন্টার। পাশ দিয়ে বহমান আঁকা বাকা নদী, সারি সারি গাছ অপার সৌন্দর্য, প্রেমে পড়ে যাই তার।
যাহোক, রক্তে ভিজে টকটকে লাল হয়ে যাওয়া সদ্য নবজাতক কে নিয়ে সাত গ্রাম পেরিয়ে দৌড়ে দৌড়ে মা, বাবা আত্মীয় স্বজন,গ্রাম বাসী, মেম্বার মাতবর সব এসে হাজির আমার সাব সেন্টারে। চারিদিকে কান্না আহাজারি। ততক্ষনে অতিরিক্ত রক্ত ক্ষরণে বাচ্চা ও একেবারে নিস্তেজ, যায় যায়...।
আমি কি করব বুঝতে পারছিনা। সারা গা রক্তে লাল হয়ে যাওয়া তিন দিনের বাচ্চাটিকে দেখে কিছুটা ভয় ও পেয়ে যাই। রেফার করব যে তাতেও মন সায় দিলো না। সদর হাসপাতাল সেতো প্রায় তিরিশ কিলো, যেতে যেতে দু তিন ঘন্টা । ততক্ষনে হয়ত বাচ্চাটি মরেই যাবে। রোগী দের সিরিয়েল মেইন্টেইন করার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে রাখা এতিম ছেলেটা রন্টু মালাকার ভয়ে কাঁচুমাচু হয়ে আমার পিছনে এসে দাড়িয়েছে। রন্টু সারাক্ষণ ছায়ার মতো আমার পাশে থাকতো। ও ভেবেছিল বাচ্চাটি বোধহয় বেঁচে নেই আর।
সাব সেন্টারের ফার্মাসিস্ট প্রয়াত ইসমাঈল সাহেব কে ডাকলাম, প্রবীন ও বিজ্ঞ আমার মেডিকেল এসিস্টেন্ট সেকমো হোসেন সাহেব কেও আসতে বললাম। সিদ্ধান্ত নিলাম, কপালে যাই হোক চিকিৎসা শুরু করবো, সিলাই দিব।
হোসেন সাহেব কিছুতেই মত দিলেন না। ফিস ফিস করে বললেন,
"স্যার বাচ্চা খারাপ, সিলাই দিতে দিতে যদি মারা যায় তবে পুরো গ্রাম বাসী আপনাকে ধরে বসবে। বলবে আপনিই সেলাই দিতে যেয়ে মেরে ফেলেছেন। বেটার স্যার রেফার ইট "
কথাটা যৌক্তিক তবুও আমি বললাম
"নো, যেহেতু ব্রেইন মেটার ইন্টেক্ট, নো প্রব্লেম, ভয় পাবেন না"। সদর হাসপাতালে যেতে যেতে তিন ঘন্টায় কিনা কি হয়। জেনে শুনে আমি এটা করতে পারিনা"
ইসমাইল সাহেবকে বললাম, রেডি হন, ওয়াস নেন।
হোসেন সাহেব কে বললাম, বাচ্চার বাবা আর মেম্বার কে রেখে সবাইকে বের করে দেন। আর বাহিরে একটু কাউন্সেলিং করে আসেন।
বাচ্চার মা'কে সান্তনা দিলাম। বললাম,
"ভয় পাবেন না। বাচ্চাকে দুধ পান করিয়ে নেন। মাথার চার পাশের মোড়ানো রক্তে ভেজা গামছা আর কাপড় যে ভাবে আছে অভাবেই থাক, আমি দেখবো.."
আমি এর ভিতর যতটা সম্ভব সাবান টাবান আর হেক্সিসল দিয়ে ওয়াশ নিলাম। ইসমাইল সাহেব কে বাচ্চা কোলে নিয়ে মাকে বের করে দিতে বললাম। এরি মধ্যে কিছু সরকারী লোক (রোগীর সাথে অযথা আসা ভি ভি আই পি ও সি আই পি আগন্তুক) সেলাইর কথা শুনে ভয়ে লাপাত্তা।
আমার ফার্স্ট এইড বক্স থেকে লিগনোকেইন স্প্রে আর কেটগাট নিলাম। আল্লাহ কে স্মরণ করে শুরু করে দিলাম। একটা , দুইটা, তিনটা করে টপাটপ ১৫ /২০টা সেলাই। কচি চামড়া তেমন সময় লাগেনি। কানে শুধু বাজতেছিলো ঢাকা মেডিকেলে ইন্টার্নী করার সময় এক স্যারের কথা...
"ডক্টর'স হেভ ওমেন্স হেন্ড, ইগলস আই এন্ড লায়ন্স হার্ট"।
সেলাইয়ে বাচ্চাটা কিছুটা কাহিল। আমি মা কে ডেকে এনে আবার দুধ পান করিয়ে দিতে বললাম।
শুরু করলাম শেষ পর্ব। এন্টিবায়োটিক ইঞ্জেকশন, পেইন কিলার যতটা পারলাম দিয়ে পুরো মাথা ব্যান্ডেজ করে মার হাতে বাচ্চা কে তুলে দিয়ে বললাম,
"দুধ পান করাতে থাকেন। আর আল্লাহ কে ডাকেন কিচ্ছু হবেনা...."। আমার সামনেই বাচ্চাটা চো চো করে দুধ টেনে এক সময় শান্ত হয়ে কোলেই ঘুমিয়ে পড়লো।
আমার জীবনের ভয়ংকর এক অভিজ্ঞতা। এর মাঝে ততক্ষনে আমার সাব সেন্টারের আশে পাশে শত শত লোকের সমাগম।
গুজব রটেছে, গুঞ্জন উঠেছে.... "সাব সেন্টারের নতুন ডাক্তার সাব বাচ্চার ব্রেইন সেলাই করে বাচ্চারে বাচায়ে ফেলেছে..."।
হা হা হা...আজব গুজব। তবে মন্দ না। সেই থেকে ঐ এলাকায় আমার ভালোই নাম ডাক ছড়িয়ে পড়ে।
অফিস এর পর বিকালে ফিরতি পথে গ্রামের কয়েকটা বাজারে প্রাইভেট চেম্বার খুলতে হলো। একেক দিন একেক টা তে বসতাম। সপ্তাহে তিন দিন শনি সোম বুধ। রবি মংগল বৃহস্পতি চেম্বার করতাম না। পোস্ট গ্রাজুয়েশন এর জন্য পড়তাম।
প্রায় শো খানেক রোগী হতো প্রতিদিন। গভীর রাতঅব্দি রোগী দেখতাম। সবাই ভিজিট দিতো পারতোনা, খুব মায়া হতো। অসম্ভব শ্রদ্ধা করতো সহজ সরল আবাল বৃদ্ধবনীতা। গরীব এলাকা ভিজিট বা নগদ নারায়ন কম হলেও তাদেত ফলানো সবজি, লাউ, পেপে, ডিম, কলা, গাছের কাটাল, পিঠা পায়েশ এ রোজ ই ব্যাগ ভরতো।কিছু আনতাম বাসায় কিছু দিয়েও আসতাম একে ওকে।
দুই.
রীতা এখন ক্লাস ফোরে পড়ে। ওর মা বাবা কে বললাম, মাঝে মধ্যে নিয়ে আসবেন। আরেকবার তার মাথার চুলের নীচের চামড়ার কাটা সাদা দাগ টুকুতে হাত বুলালাম। বললাম,
"রিতা তুই ভালো থাকিস রে মা। মন দিয়ে লেখা পড়া করিস.."
লেখকঃ ডা. মো. সাঈদ এনাম
সাইকিয়াট্রিস্ট
ইউ এইচ এফ পি ও
দক্ষিণ সুরমা
সিলেট।
©somewhere in net ltd.