নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

মধু দুর্লভ হলে গুঁড় দিয়েই তার অভাব পূরণ করতে হয়।

বলার মতোন তেমন কেউ নই। বলার মতোন তেমন কিছু নেই।

সাঈদ অভি

সাঈদ অভি › বিস্তারিত পোস্টঃ

নিশ্চুপ

২২ শে মার্চ, ২০১৩ সকাল ১০:৪১

'বাইরে গিয়ে কান ধরে দাঁড়িয়ে থাক। কান ছেড়েছিস তো পাছায় দু ঘাঁ খাবি কিন্তু।'- হরেন স্যারের সাইরেনের মতো কর্কশ কন্ঠটা বেজে উঠে নীরবতা ভাঙ্গে ক্লাস সেভেনের। এলোমেলো চুলে ফর্সা ছেলেটি বেঞ্চ থেকে মাথা নিচু করে উঠে গিয়ে দরজার বাইরে কান ধরে 'মাদারল্যান্ড' মূর্তির মতো চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। 'গাধা হলেও এমন আশ্চর্যজনক গাধা হতে হয়?' -নিজে নিজেই ভাবে সে। স্কুলের শেষ পিরিয়ডের ঘন্টাটি বেজে ওঠে। হাপ ছাড়ে ছেলেটা, 'যাক, এবারের মতো বাঁচলাম!'



ঘষামাজা প্রকৃতির একটা নাম ছেলেটার; 'রতন'! আহামরি পরিবারের উত্তরাধিকারও নয়। বাপ ছোট্ট মফস্বলটির এক রঙের দোকানদার, মা গৃহিনী। কিন্তু তাদের ছোট্ট বুকে বিশাল আশা, ক্লান্ত চোখে অসীম স্বপ্ন - ছেলে বড় ডাক্তার হবে! কিন্তু ছেলের মাথা যে একটা আস্ত ঝুনা নারিকেল, Doctor বানান করতে যে ঠোটগুলো হাঁ-হুতাশ করতে করতে শুকিয়ে যায়, সেটা অবশ্য একটু দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছে বাবা-মা! তাই পড়া বিষয়ক যথা-অযথা অনেক প্রকৃতির নিত্তনৈমিত্তিক উপদেশ তাকে হজম করতে হয়।



কাঁধে বস্তাসদৃশ একটা স্কুলব্যাগ এবং হাতে ধরা তার কৃতিত্বপত্রে দুটি অসমবৃত্ত নিয়ে বাসার পথে যেতে যেতে তার কপালে অপরিসীম চিন্তার ভাঁজ পড়ে।



'আরে,এতো চিন্তা করিস ক্যান? আমি তো কোন টেনশন করতেছি না। তুই তো তাও একটা সাবজেক্টে পাস করেছিস!' রতনের বিমর্ষ মুখ দেখে পাশ থেকে তাকে সান্ত্বনা দেয় বন্ধু বারেক।



'ভাই রে, আজ বাসায় রোজ কেয়ামত আছে। তাই পেরেশান লাগতেছে!' নিরস কন্ঠে বলে সে।



বাসায় ফিরে চুপেচাপে গোসল-খাওয়া সেরে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় সে, পরীক্ষার খাতাগুলো মুচড়িয়ে এককোণে তোষকের নিচে রেখে দেয়। ছোট মাথাটায় বিরাট বিরাট ভাবনা ঘুরতে থাকে।

এইভাবে তো আর প্রতিবার খাতা দেওয়ার পর স্যারের কড়া অপমান সহ্য করা যায় না, বাসায় এসে ক্রমাগত কিছুদিন বাপের হাতের চড় আর মায়ের ধরাগলায় বকাঝকা সহ্য করা যায় না। প্রতিদিন না হয় দু-চার ঘাঁ বেত খাওয়া বা বেঞ্চের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা যায়। কিন্তু পরীক্ষার খাতায় লাল কালিতে বড় করে 'ফেল' লেখার নিচে যখন 'গাধা' লেখা থাকে আর সেই খাতা হাতে যখন কান ধরে বাইরে গিয়ে দাঁড়াতে হয়,তখন লজ্জায় মরে যেতে মন চায়। এই দুঃখ রতন ছাড়া আর বুঝবে কে? অপমানের চোটে চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে ওর।



পরদিন একইভাবে ঘন্টা বাজলে শেষ হয় স্কুলটাইম। কান ছেড়ে বেঞ্চের ওপর থেকে নেমে আসে রতন। এই নিরামিষ স্কুল, বাসার কড়া শাসন আর এই অভুক্ত- স্বাদহীন ছোট্ট জীবনের প্রতি বেশ আগে থেকেই বিতৃষ্ণা জমে গেছে তার। আজও তেমনিই কাটছে। বাসায় ফেরে ভর দুপুরে। দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকতেই খুন্তি হাতে মায়ের অগ্নিশর্মা চেহারাটা চোখে পড়ে। গায়ের রক্ত হিম হয়ে আসে তার। কে জানে আজো হয়তো স্কুল থেকে হরেন স্যারের নালিশ এসেছে।



'পরীক্ষায় কতো নাম্বার পেয়েছিস?'

চুপ করে থাকে রতন।

'কাল খাতা দেওয়ার পর দেখাসনি ক্যান? ক্যান লুকিয়ে রেখেছিলি?'

এবারও সে চুপ।

আচমকা হাতের হাতিয়ারটি দিয়ে মারতে শুরু করে তাকে। গা বাঁচাতে দৌড়ে তার ঘরে গিয়ে দুয়োর দেয় সে। ইতোমধ্যেই কিছু জায়গায় কেটে গেছে। দরজার ওপাশে শোনা যাচ্ছে মায়ের গর্জন। রাতে বাবা এলে যে কি হবে এই ভেবে মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকে সে।



রাতে খাবার টেবিলে মা এক এক করে ছেলের ফেলের ফিরিস্তি শোনাতে থাকে বাবার কাছে। এসব শুনতে শুনতে ক্লান্ত মুখটা ক্রমে কঠিন হতে থাকে। ভয়ে চুপসে যায় পাশে বসা রতন। একসময় হাতের প্লেটটি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে রতনের চুলের মুঠি ধরে পাশে থাকা একটা কাঠখন্ড দিয়ে পেটাতে থাকে সে। ব্যথায় আর্তনাদ করতে থাকে রতন। তবুও মার শেষ হয়না। মায়ের কাকুতি মিনতিও বাবার এ রাগ কমাতে পারে না। একসময় শান্ত হয় সে। রক্তাক্ত রতন মেঝেতে পড়ে থাকে। তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে মা।





২ সপ্তাহ পর



পাতলা কাথার নিচে জ্বরে কাতরাচ্ছে রতন। শিয়রে বসে চোখে জল গড়াচ্ছেন মা। আস্তে আস্তে নেতিয়ে পড়ছে রতনের দেহ।



'মা, একটু পানি দেবে?'

'একটু অপেক্ষা কর, আমি আসছি।' উঠে ঘরের বাইরে চলে যায় মা।



হঠাৎই একটা জোরে কাঁপুনি দিয়ে ওঠে রতনের সমস্ত দেহ। কি যেনো মনে হতেই একটা হালকা কষ্ট ও প্রশান্তির ছাপ এঁটে যায় তার মুখে। পাশে পড়ে থাকা প্যাডের একটা সাদা পৃষ্ঠা ছিড়ে কলম দিয়ে কাঁপা হাতে কিছু একটা লেখে বুকের উপর নিয়ে ধপ করে শুয়ে চোখ বন্ধ করে সে। মা পানির গ্লাস হাতে তার কাছে আসে, বুকের ওপর পড়ে থাকা কাগজটা উল্টিয়ে দেখে তাতে এবড়োথেবড়োভাবে কিছু শব্দ লেখা, 'মা, আমি নিশ্চুপ হয়ে গ্যালাম...'





উৎসর্গঃ জেএসসি পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয়ে আত্মহত্যা করা ছোট্ট বোনটিকে॥]

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.