নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সায়েমা খাতুনঃ নৃবিজ্ঞানী, গবেষক ও লেখক
উপন্যাসিক হিসেবে ইদানীং আমার একটু নাম-ডাক শুরু হয়েছে। প্রতিবছর ঈদ সংখ্যায় আমার উপন্যাস ছাপার জন্যে কয়েকটি পত্রিকা থেকে অনুরোধ আসে। ইদানীং তরুণদের মধ্যে আমি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছি, আমার বইয়ের কাটতিও ভালো। লেখা থেকে একটু ছুটি নেবার জন্যে আমি যশোরে আমার মামার বাড়ি পূর্বাচলে চলে এলাম। মামার বয়েস হয়ে গেলেও লেখক ভাগ্নির জন্যে আদরের কমতি নেই। তাদের বিরাট বড় বাংলো বাড়ীতে আমি এক মাসের অবকাশ কাটাচ্ছি। মামাতো ভাই- বোনেরা আশেপাশেই থাকে। বইপত্র পড়ে, ভাইবোনের বাচ্চাদের সাথে এখানে ওখানে বেড়িয়ে আমার সময় কাটে। রূপা আমার সমবয়েসী, ছোটবেলায় খেলাধুলা করে বড় হয়েছি। সে একদিন তার কলেজের লাইব্রেরী থেকে একটা পুরনো ডায়রি উদ্ধার করে নিয়ে আসে। কেউ কিছু কাগজপত্র, দলিল- দস্তাবেজের সাথে দান করেছিল। বল্ল,
- তুই তো লেখালিখি করিস। এখানে একজন নড়াইলের ইতিহাসের অনেক কিছু লিখে রেখেছে। সব পড়া যাচ্ছে না। কিছু কিছু পাতা হারিয়ে গেছে। দ্যাখ কোন কাজে লাগাতে পারিস কিনা। না হয়, তোর পরিচিত পত্রিকায় দিয়ে দিস। ওরা ছাপলে ছাপতে পারে।
বল্লাম,
- এখানকার পত্রিকায় যোগাযোগ করেছিস?
- এসব লেখালেখির জগতের সাথে অনেক দিন যোগাযোগ নেই।
- সেকি! তুই আর কবিতা লিখিস না?
- আরে বাদ দে। সংসারের ঘানি টেনে কুলাই না, আবার কবিতা!
রাতে পাঙ্গাশ মাছ দিয়ে ভাত খেয়ে ডায়রিটা হাতে নিয়ে বসলাম। হাতের লেখা অনেক জায়গায় অস্পষ্ট। কিছু জায়গা ছিঁড়ে গেছে। পড়তে পড়তে যেন একশ বছর আগের একটা অধ্যায় থেকে গল্প শুরু করলাম। পড়তে পড়তে রাত দুটা-তিনটা বেজে গেল। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ঠিক করলাম এটাই আমার পরবর্তী উপন্যাস।
এক।
যশোর জেলায় নড়াইল মহকুমার ডুমুরতলা গ্রামে ১৯০৬ সালে আমার জন্ম। সাত ভাই- বোনের মধ্যে আমি ছিলাম ষষ্ঠ। আমাদের পরিবার ছিল গাঁতিদার। যখন রাস্তায় বেরুতাম, সবাই ছোট বাবু বইলে ডাকত। আমাদের তিনশো ঘর প্রজা ছিল। মাইনে করা নায়েব ছিল আমাদের। বাড়ি বাড়ি প্রজাদের কাছ থেকে খাজনা আদায় করতো। নায়েবের বাড়ি ছিল মাগুরায় কালুখালি। আমার পিতা কবিরাজি করে ঐ অঞ্চলে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। মাতা ছিলেন আরবি-হিন্দি- উর্দু- মারাঠি ভাষায় অভিজ্ঞ এবং কোরআনে হাফিজা। সাত বছর বয়েসে আমি মাতৃহারা হই। মায়ের মৃত্যুর বছর কিছুদিন পরেই পিতা দ্বিতীয় বিবাহ করেন। আমার বিমাতার ছিল তিন সন্তান।আমি নড়াইল হাই স্কুলে যখন ষষ্ঠ শ্রেণীতে উঠি সে সময় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রথম কাব্য গ্রন্থ “অগ্নিবীণা” প্রকাশিত হয়েছিলো। একদিন বাংলার শিক্ষক গোপালচন্দ্র কবিকুসুম একটা বই হাতে করে ক্লাসে ঢুকেই বললেন,
- বাংলায় এক অচিন্তনীয় প্রতিভাবান কবির আবির্ভাব হয়েছে। তাঁর কাব্য গ্রন্থের প্রথম কবিতার কিছু অংশ তোমাদের পড়ে শোনাই ।
বলেই তিনি আবৃত্তি শুরু করলেন ঃ
“বল বীর
বল চির উন্নত মম শির
শির নেহারি, আমারই নত শির, ঐ শিখর হিমাদ্রির ... ।”
আবৃত্তি করতে করতে যেন তিনি এক উচ্চতর লোকে উন্নীত হলেন। তাঁর চেহারা, মুখের রঙ, চোখ এমন পাল্টে যেতে থাকলো যা আমি আজও ভুলিনি। কবিতাটি আমার মধ্যেও আলোড়ন সৃষ্টি করে। সেই সময়ে ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের ঢেউ এসে পরে আমাদের ছোট্ট মহকুমা শহরেও। ১৯২১ সালের দিকে আমি ছিলাম স্কুলের উঁচু শ্রেণীর ছাত্র। স্কুলের সামনে দিয়ে দেখতাম মিছিল যাচ্ছে, স্লোগান দিচ্ছে
–ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হউক!
- মহাত্মা গান্ধী কি জয়!
- আলী ভাই কি জয়!
স্লোগানের ধ্বনির টানে স্কুলের ছাত্ররা বসে থাকতে পারতো না। সবাই মিছিলে নেমে যেতাম।কিভাবে মিছিলে ঢুকে পড়েছি আমি নিজেও জানিনা। কলেজের পরে আমার লেখাপড়া নানা কারণে আর এগোল না। কিন্তু তখন নানা রকম বইপত্র হাতে আসতো। পড়তাম ধীরাজ ভট্টাচার্যের বিখ্যাত উপন্যাস মাথিনের কূপ, যখন পুলিশ ছিলাম, যখন নায়ক ছিলাম। যশোরের কেশবপুর উপজেলার পাঁজিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন সাহিত্যিক ধীরাজ ভট্টাচার্য। তিনি একসময় ভারতীয় থিয়েটার ও সিনেমার অভিনেতা ছিলেন। পাঁজিয়াতে থিয়েটারও হতো। ধীরাজ ভট্টাচার্যের অভিনয়ও দেখেছি।
১৯৩৬ সালে সর্বপ্রথম সারা বাংলায় আইনসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সময়েই ফজলুল হকের নেতৃত্বে ‘কৃষক-প্রজা পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল আত্মপ্রকাশ করে। এই দলের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে যোগদান করে আমি মাগুরা মহকুমার নির্বাচনী দায়িত্ব পালন করি। আমাদের বৃহত্তর যশোর জেলায় কৃষক- প্রজা পার্টি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে বিপুল ভোটে জয়লাভ করে ফজলুল হকের মুখ্য মন্ত্রীত্বে মন্ত্রী সভা গঠিত হয়। যশোর থেকে সৈয়দ নওশের আলী স্বায়ত্তশাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন।যশোর জেলার যে কোন স্থানে তাঁর বক্তৃতায় দূর দূরান্ত থেকে সাধারণ মানুষের বড় বড় জমায়েত হত। আমার বড় ভাই নুরুল হুদা ছিলেন তাঁর সমর্থক। কিন্তু মাত্র দু বছরের মধ্যেই এই পার্টি ক্ষমতা হারায়। ঠিক এই সময়েই ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে ‘ভারতীয় কিষান সভা’ গঠিত হয় এবং এরই অধীনে বাংলায় গঠিত হয় ‘বঙ্গীয় কৃষক সমিতি’। যশোর জেলার বিশিষ্ট আইনজীবী কৃষ্ণ বিনোদ রায় ছিলেন এর প্রধান সংগঠক। দুর্গাপুর ইউনিয়ন কৃষক সমিতি গঠিত হলে সম্পাদক হিসেবে আমি সরাসরি রাজনীতির মাঠে নেমে যাই। সর্বাধিক সদস্য সংগ্রহ করে আমি যশোর জেলা কমিটিতেও অন্তর্ভুক্ত হই। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪১ সালে আমি ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ লাভ করি। তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন পিসি (পূরণ চাঁদ) যোশী। ইংরেজ বিতাড়ান ও ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে কিভাবে কৃষকদের আনা যায় এই চিন্তা থেকে ১৯৪৬ সালে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি ভাগচাষিদের ফসলের তেভাগা দাবীর পক্ষে আন্দোলনে গড়ে তুলবার কথা ভাবা হয়। যশোরের পাঁজিয়াতেই সে বছর সর্বভারতের কৃষকসভার সম্মেলন হয়েছিল। এই সর্বভারতীয় কৃষক সমিতির সম্মেলনের স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন নারায়ণ বসু। খুব মিষ্টির ভক্ত ছিলেন। তিনি স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে পাঁজিয়ার উপেন চন্দ্র দে বা টুনে ময়রার বিখ্যাত লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের রসগোল্লা ডেলিগেটদের জন্যে ফরমায়েশ করেছিলেন। পাঁজিয়া বাজারের কালিমন্দিরের দক্ষিণ পাশে উপেন বাবুর দোকান ছিল। তিনি ছিলেন পাঁজিয়ার আদি ময়রা। এই দোকানের রসগোল্লা খেতে দূর থেকে মানুষ আসতো।
বাংলার প্রতিটি জেলা ও মহকুমা কমিটির কাছে এই সিদ্ধান্ত পৌঁছে গেলে সে বছরেরই পরবর্তী আমন ফসলের মৌসুম থেকে তেভাগার লড়াই শুরুর সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। রূপগঞ্জের বটু দত্তের বাড়ীতে এ বিষয়ে সভা শেষ করতে করতে সন্ধ্যা পার হয়ে গেল। মোদাচ্ছের মুন্সীর সাথে বাড়ী ফিরছিলাম। তওরিয়ার পুলের কাছে আমরা একটু জিরিয়ে নিলাম। মোদাচ্ছের মুন্সীর চৌদ্দ বিঘা জমি বর্গা দেয়া। আমরা সিন্ধান্ত নিলাম আমাদের নিজেদের থেকেই এই নজীর সৃষ্টি করতে হবে। দুদিন পরেই মুন্সী বর্গাইতদের ডেকে বলে দিলেন আগামী আউশ ফসল থেকেই দু’ ভাগ চাষিদের, এক ভাগ তাঁর। আমিও ভাইদের সাথে নিয়ে একই কাজ করলাম। সবাই বিস্মিত হয়ে বলতে থাকলো,
- এই কাজ করলেন কেন? আপনাদের দুজনের কি মাথা খারাপ হয়েছে? দেশের কোথাও এই নিয়ম নেই! এরা তো আমাদের সর্বনাশ করবে!
জমির মালিকেরা আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। আমাদের দুজনের তেভাগা দেয়ার কথা দ্রুত চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সারা বাংলায়, সারা ভারতে এই হল তেভাগা আন্দোলনের শুরু। আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে তেভাগা প্রথায় জমি বর্গা দেয়ার আগেই আমি আমাদের স্থাবর- অস্থাবর সব সম্পত্তি আইন অনুযায়ী ভাগ করে পৃথক হয়ে গেলাম। এজমালি থাকলে সম্পত্তি তেভাগার পদ্ধতিতে বর্গা দিলে ছোট দুই ভাইয়ের আপত্তি থাকতে পারে। এমনকি অনেক পার্টি কর্মীও তাদের জমি তেভাগা দেয় নি। আমার ভাইয়েরা কেউ আমার অনুসারী হল, কেউ বিপক্ষে গেল।ছোট ভাই নুরুল আকবর আর নুরুজ্জামান তেভাগা আন্দোলনে যোগ দেয়, বড় ভাই নুরুল হুদা বিপক্ষে থাকে। নুরুল আকবর প্রথম প্রথম তেভাগা করবার বিপক্ষে ছিল ছিল। কমরেড মোজাফফর আহমেদ তখন আমাদের বাড়ী আসেন। ছোট ভাই নুরুল আকবরকে তাঁর দেখা- শোনার দায়িত্ব দেই, যদি তাকে প্রভাবিত করতে পারে। তাঁর সাথে কথাবার্তা বলে, সময় কাটাবার সুযোগ পেয়ে তার গাঁতিদারী গোঁড়ামি কেটে যায়। শেষ পর্যন্ত সেও পার্টিতে যোগ দেয়।তার জমিও তেভাগা দেয়া হয়। ১৯৪২ থেকে সে কমিউনিস্ট পার্টির মেম্বার হয়ে সর্বাত্মক ভাবে আমাদের কাজে জড়িয়ে পড়ে।
১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে কলকাতায় নিখিল ভারত কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে নুরুল আকবর কাউন্সিলর হিসেবে যোগ দেয়। সেখানে পার্টির কর্মীদের মিটিং এ ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে কৃষকদের নিয়ে আনাকে গুরুত্ব দেয়া হয়।তাঁর দায়িত্ব পড়ে সরাসরি কৃষক ফ্রন্টে কাজ করবার। তখন থেকে সে গ্রামে গ্রামে কৃষক সংগঠন করে বেড়াতে লাগলো। কৃষকরা তেমন আগাচ্ছিল না। নানা রকম ভয় আর অবিশ্বাস তাদের মনে। ইংরেজ থাকলে কি আর খেদালে কি, এই নিয়ে তাদের বোধবাসি নেই। খাচ্ছে কি খাচ্ছে না, জমিতে ফসল না হলে বেঁচে দিচ্ছে, বন্ধক দিচ্ছে, মহাজনে গাভান খাচ্ছে, গুতোন খাচ্ছে, পিটন খাচ্ছে, - এ তাদের সয়ে গেছে। পার্টি সিদ্ধান্ত নেয় যে, কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে নিয়ে আসলে তারা জমিদার, মহাজন এবং ব্রিটিশদের – সবাইকেই তাদের শত্রু হিসেবে চিনতে পারবে। জমিদাররা যখন দুইভাগ দিতে চাইবে না, কৃষকরা দুই ভাগ নিয়ে নিলে, তারা কোর্টে যাবে, মামলা করবে, গ্রামে গ্রামে পুলিশ আসবে, কৃষকদের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ বাধবে। এতে করে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সারা ভারতের গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ গড়ে উঠবে।১৯৪৬ সালের ডিসেম্বর ১৯৪৭ এর জানুয়ারি – এসময় ফসল ওঠে- এই সময়েই তেভাগা কার্যকর করতে আমরা প্রস্তুত হলাম। নভেম্বরে চিত্রা নদীর পাড়ে দলজিতপুর গ্রামের উঁচুডাঙ্গায় অগ্রিম আমন ধান কাঁটা শুরু হয়। রূপগঞ্জে বটু দত্তের বাড়ীতে মহকুমা কমিটির সভায় আমি প্রস্তাব করলাম চাষীদের এক সম্মেলন ডাকা হউক। পার্টির সম্পাদক কমরেড অমল সেন একমত হলেন না। তার সাথে মত বিরোধের মধ্যেই তিনভাগ ফসলের দাবী করে দুর্গাপুর মাঠে কৃষকদের সভা করা হল। দুর্গাপুরের চাষি যতীন বিশ্বাস বল্লঃ
- তেভাগার লড়াই তো করবো, কিন্তু পুলিশ যখন ধরে থানায় নিয়ে পেটাবে তখন উপায় কি হবে?
তখন আমি, যতীন বিশ্বাসের মেঝদা রসিক লাল বিশ্বাস বক্তৃতা করলাম।আমাদের বক্তৃতায় কৃষকদের মনে সাহস সঞ্চার হল।
আমার জীবনমরণের সাথী ছিল কবিরাজ কেষ্ট ফকির। সে আমার সাথে বাড়ী ফিরছিল। তার খুড়তুতো ভাই রাজেন্দ্র বিশ্বাস দলজিতপুরের শিব ঠাকুরের একটা জমি বর্গা করতো। ঠাকুর মহাশয় তেভাগার শর্তে রাজী না হওয়াতে জোর করে ফসলের দুই ভাগ কেটে নেয়ার সিন্ধান্ত নেয়া হল। বাগবাড়ির আব্দুল গনির নেতৃত্বে হিন্দু- মুসলমানের সম্মিলিত বাহিনী শিব ঠাকুরের জমিতে তেভাগার নিয়মে দুই ভাগ ফসল রাজেন্দ্র বিশ্বাসের ঘরে তোলা হয়, এক ভাগ মালিকের জন্যে জমিতে রেখে আসা হলো।শিব ঠাকুর গ্রামসুদ্ধ লোকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা করলেন। গ্রামে যে কোন দিন পুলিশ ঢুকতে পারে।
গ্রামে গ্রামে প্রতিরোধ করবার জন্যে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তোলা হল।স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর নেতা ছিল রঘুনাথপুরের আব্দুল গনি। পুলিশ আসলে কি করা হবে তাঁর পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে লড়াইয়ের জন্যে ঘরে ঘরে অস্ত্র-শস্ত্র, লাঠি, সড়কি, রামদা, কুড়াল, তীর- ধনুক জমা করা হল। তখন আমাদের কোন আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। যশোরে একটা গাদা বন্দুক ছিল। মানুষজনকে এক ধরনের সাঙ্কেতিক ব্যাবস্থা করা হল- জয়ঢাক। গাছে আগায় জয়ঢাক বান্ধা থাকতো। এক গ্রামে জয়ঢাক বাজলে আরেক গ্রামে যতদূর তার শব্দ যায় তত দূর থেকে আবার আরেকটা জয়ঢাক বাজবে – এভাবে বিরাট অঞ্চল জুড়ে লোকজন জেনে যায় যে পুলিশ এসেছে বা কোন হামলা হয়েছে। এক জায়গায় সবাই অস্ত্র- শস্ত্র নিয়ে লড়াইয়ের জন্যে জড় হয়।
পুলিশ ঘরবাড়িতে হামলা করতে শুরু করে। আমাদের বাড়ীতে একদিন পুলিশের হামলা শুরু হলে বাড়ির মেয়েরা প্রবলভাবে পুলিশদের সাথে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। আমার মেয়ে রিজিয়াও পুলিশের মাথায় খাপরা ছুঁড়ে মারে। মেয়েরাও এভাবে এই লড়াইয়ে জড়িয়ে পড়ে। পুরুষরা যখন ধান কেটে দুই ভাগ নিয়ে পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়, মেয়েরা তখন ঘরবাড়ি রক্ষা করা, পুরুষদের পালাতে সাহায্য করা, পুলিশদের আক্রমণ করে বা কৌশলে অথবা গ্রাম ছাড়া করে। খালেকের মা ছিল, আমাদের এক চাচী, তিনি বাড়ীতে ব্যারিকেড দিয়ে রাখতেন। পুলিশ আমাদের নামে ওয়ারেন্ট নিয়ে তত্ত্ব- তালাশ করতে আসতো, কখনও লুটপাট করতো। মেয়েরা চারা- খাপরা ছুঁড়ে, মরিচের গুঁড়া মেরে পুলিশদের আটকাতো। পুলিশ চলে গেলে জয়ঢাক বাজিয়ে আমাদের জানিয়ে দিত। এগারোখানের ভীষণ সাহসী একজন মেয়ে ছিল - সরলা সিং। তার সাথে আড়াইশো মেয়েদের একটা বাহিনী ছিল। সরলা বালা পাল, তার সাহস আর বুদ্ধির জন্যে লোকে তাকে সরলা সিং ডাকতো। বাঁকলিতে ছিল অনিমা, বাকড়িতে মহারানী, ফুলমতি, বগলা, এলেন, আরও অনেক মেয়ে পালাম । সরলা আর অনিমার নেতৃত্বে কৃষক সমিতের পাশাপাশি গড়ে উঠল মহিলা সমিতি।এগারোখান থেকে অনেক হিন্দু মেয়ে এই লড়াইয়ে এসেছিলো। মোদাচ্ছের মুন্সী আর আজিজ মোল্লা হল দুই ভাই, তাদের বোন বড়ু বিবি পার্টিতে যোগ দেয়। এদের নামে গান বান্ধা হইল ঃ
“ফুলি, নালী, ভইসোর শালী
পারমিট লাইটে পাইজোয় গেলি
পাইজেয় যায়ে পাইজোর স্কুল
দেহে আসলি কপাল গুণে।”
নড়াইলে অনেক কম লড়াই হয়েছে, নাচোলের ইলা মিত্রদের এলাকায় অনেক বেশী লড়াই হয়েছে। জানুরারি থেকে ফেব্রুয়ারি মার্চ পর্যন্ত গ্রামে গ্রামে অনেক হামলা আর লড়াই চলল। অনেক অঞ্চল স্বাধীন ঘোষণা করা হয়েছিলো, সেখানে ব্রিটিশদের শাসন চলতও না, নিজেরদের কোর্ট পর্যন্ত করা হয়েছিলো। সেই কোর্টে বিচার-আচার শুরু করা হয়েছিলো। হিন্দু- মুসলমান চাষিদের ঐক্যে ভাঙ্গন ধরাবার জন্যে দাঙ্গা বাঁধাবার অনেক চেষ্টা করে আমরা ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম।হিন্দু- মুসলমান মালিকেরা মিলে মুসলমানকে দিয়ে নমঃশূদ্র মহিলাকে দুরব্যাবহার করাতে সক্ষম হয়। কমরেড হেমন্ত সরকারের নেতৃত্বে বিরাট এক হিন্দু বাহিনী দাঙ্গা সৃষ্টিকারী বহিরাগত লাঠিয়ালদের ধাওয়া দিয়ে বের করে দেয়। কিন্তু এসব ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকে। একজন মুসলমান ডাক্তারের স্ত্রীকে এক নমঃশূদ্র অত্যাচার করবার পড়ে পরিস্থিতি প্রায় আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। ২৯ গ্রামের মুসলমানেরা প্রতিশোধের জন্যে মরিয়া হয়ে ওঠে। কিন্তু মুসলমানদের গ্রামগুলো আবার নমঃশূদ্রদের গ্রাম দিয়ে ঘেরা। তারা আক্রমণ করলে সে সমস্ত শত শত মুসলিম নারী ধর্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা। এক ধর্ষণের প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শতশত নারী ও শিশুকে এক ভয়াবহ দাঙ্গার মুখে ঠেলে দেয়ার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিলো। নারী ও শিশুদের গ্রাম থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে সময় নিয়ে সেবারের মত আমরা দাঙ্গা ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম।
অনেক জোতদার, গাঁতিদাররের লোক পুলিশের দালালি করতে শুরু করে। গ্রামের খবরা-খবর, পাঠানো তেভাগা নেতাদের ধরিয়ে দেয়ার কাজ করতে লাগলো। কিছু দালালকে মেরেও ফেলা হল। দালাল হালাল কর্মসূচীতে কিছু দালাল হালাল করা হল। আমার বড় ভাই নুরুল হুদাকেও মেরে ফেলা হয়েছিলো। এপ্রিল-মে–জুন- জুলাই পর্যন্ত এসব চলল। অগাস্ট মাসে দেশ ভাগ হয়ে গেল। ইংরেজ চলে গেল। নড়াইলের অনেক বড় বড় জমিদার পাকিস্তান হওয়ার পরে ইণ্ডিয়া চইলে গেল। ছিল জমিদার কিরণ চন্দ্র রায় বাহাদুর, প্রদ্যোত চন্দ্র রায় বাহাদুর। এরাই কালি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল। ওরা সরাসরি আমাদের সাথে দ্বন্দ্ব করতে আসেনি। দ্বন্দ্ব করাইছে ছোট ছোট জমির মালিকদের দিয়ে। তেভাগা কর্মী ও নেতাদের বিরুদ্ধে অসংখ্য মামলা দায়ের করা হতে থাকে। সেই মামলা ব্রিটিশ চলে গেলও খারিজ হয় নাই। বরং আমাদের উপর অত্যাচার-দমন -পীড়ন চরম আকার ধারণ করে। দেশভাগ হয়ে গেলে আন্দোলন শক্তি হারিয়ে ফেলে।
ক্ষমতা কমিউনিস্টদের হাতে যাতে চলে না আসতে পারে কংগ্রেস আর মুসলিম লীগ ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করে দেশটা ভাগ করে ফেলে। কিন্তু আমরা তো ভারত-পাকিস্তান চাই নাই। চাইছিলাম ইংরেজ খেদায়ে দেই। এতো দিনে গড়ে তোলা সংগ্রামী একতা নষ্ট করে দিলো। হিন্দু-মুসলমানদের ঐক্য নষ্ট করে দেয়া হল। আমি হলাম বিভক্ত বাংলার পূর্বাঞ্চল পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক। তারপর ভাগ হয়ে যাবার পর ইংরেজরা যে অত্যাচার করতো, আমাদের উপর একই রকম অত্যাচার আরও বেশী করে চালালো পাকিস্তান সরকার । ভারত ভাগ হয়ে যাবার পর পার্টি ভাগ হয়ে দুর্বল হয়ে গেল। তখন অনেক কর্মীরা জেল হাজতে, নানান রকম অস্তিত্বের সঙ্কটে আগের সেই শক্তিটা টিকিয়ে রাখতে পারল না। সেই সংগঠন আর থাকলো না। দেশভাগের পরে আমার অনেক সঙ্গীসাথী, অনেক হিন্দু কর্মী দেশত্যাগ করে। অনেক মুসলমান ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় ওপার থেকে এপারে চলে আসে।আমরা কিছুটা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ি।
আমি ১৯৪৯ সালের ৭ সেপ্টেম্বর পাঁজিয়ায় ক্ষেত-মজুরদের সংগঠিত করতে গিয়ে ধরা পড়ি। এর ঠিক এক মাস পর কমরেড আব্দুল হক কয়েকজন কর্মীসহ গ্রেফতার হন। পানসরা অঞ্চলে প্রকাশ্যে ক্ষেত-মজুর সম্মেলন করতে গিয়েই তাঁরা ধরা পড়েন। এই অঞ্চলে যারা আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের কারাগারের ভেতরে বাইরে নির্মম শারীরিক- মানসিক পুলিশি নির্যাতনের শিকার হতে হয়। আমাদের নামে অসংখ্য মামলা চলতে থাকে। মোদাচ্ছের মুন্সীর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়ে ওঠা ক্ষেত-মজুর সংগঠনটি ভেঙ্গে টুকরো হয়ে যায়। তিনিও ধরা পড়েন। শেষ পর্যন্ত এই আন্দোলনের কারণেই ১৯৫০ এ জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেল। ১১ বছর ৪ মাস তিন দিন কারাভোগ করে ১৯৬১ সালের ১২ জানুয়ারি বেলা আটটায় আমি মুক্তি লাভ করি। ততদিনে আমার পরিবার ভেঙ্গে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। ছেলেপিলেদের লেখা-পড়া, বিয়ে-শাদী নানা বিষয়ে সংসারের ছন্নছাড়া অবস্থা। জমিজমা হাতছাড়া হয়ে গেছে। ছেলে মেয়েরা ছোটখাটো চাকরি, ব্যবসা করে কায়ক্লেশে জীবন- ধারণ করছে। আমার সঙ্গী- সাথীরা কে কোথায় ছড়িয়ে গেছে।
দেশভাগের পরে মুক্তিযুদ্ধের সময়ও এ অঞ্চলের অনেক মানুষ দেশ ছাড়ে। অনেকের জমি বেহাত হয়ে যায়। পাঁজিয়ার সার্বজনীন কালি মন্দির তিন একর ২৬ শতাংশ জমির উপর প্রতিষ্ঠিত। কেশবপুর-কলাগাছি সড়কের ৫ শতাংশ জমি দখল করে দোকান ও গুদামঘর নির্মাণ করেছেন হারিয়াঘোপ গ্রামের রইস মিয়া। মন্দির কমিটির সভাপতি জগদীশ ঘোষ জমি দখলের বিরুদ্ধে মামলা করে অবশেষে মন্দিরের জমি ফেরত পান। কিন্তু রইস মিয়া এই জমি তার দাদার আমলে মন্দিরের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন বলে দাবী করে নতুন করে দোকান সংস্কারের কাজ শুরু করেন। যুদ্ধের সময় পলায়ে বর্ডার পার করে কঠিন দুঃখ-কষ্টে পড়ে হাজার হাজার মানুষ। সে সময় প্রফুল্ল মশাইয়ের বান্ধা একটা গান ছিল। উনি স্ত্রীর কাছে বলছেন যে ঃ
“কোন বা ফেরে ছেড়ে গেলি
মনমোহিনী তোর বাড়িঘর
আমার এই সোনার বাংলা বাড়ি ঘর
আমি কেন বা ছেড়ে আইলাম হায় রে
অবুঝ মন আমার
আমি কেন বা ছেড়ে আইলাম আমার বাড়ি ঘর
ছেড়ে নিজের ঘর-দরজা, দালান-কোঠা
গাছ তলায় করিলাম সার
কেন বা ছেড়ে আইলাম বাড়ি ঘর!”
সেই গানটা এখনও মনের ভেতর ঘোরে।
[এই ইতিহাসনির্ভর গল্পটি নড়াইলের প্রখ্যাত কৃষক নেতা নুরজালালের জীবনকাহিনী অবলম্বনে বিরচিত। তার নিজের লেখা ডায়রি থেকে বেশীর ভাগ তথ্য ব্যবহার করা হয়েছে। দেশভাগের পটভূমিতে তেভাগা আন্দোলনের সময়কার ঐতিহাসিক উপাদান ব্যবহার করা হলেও এটি মূলত কল্পনাশ্রিত কাহিনী। এই গল্পের কিছু কিছু চরিত্রের ঐতিহাসিক অস্তিত্ব থাকলেও মূলত লেখকের কল্পনার উপরই সেগুলো গড়ে উঠেছে। তথ্যসূত্রঃ গ্রামবাংলার পথে পথে- সত্যেন সেন, কালিকলম প্রকাশনী, বাংলা বাজার, ঢাকা ১৯৭০, কৃষক নেতা নুরজালালের স্মৃতিকথা, গ্রন্থনা শরিফ আতিক- উজ- জামান, গণ প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৫]
২| ১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৫৯
রাজীব নুর বলেছেন: গান টা খুজে ইউটিউবে পেলাম না। আসলে আমার জানার ইচ্ছা হলো- গানটার সুর কেমন!
১৫ ই মে, ২০২০ রাত ৯:৪৮
সায়েমার ব্লগ বলেছেন: নড়াইলের গ্রামে শোনা লোক গান। সম্ভবত বিজয় সরকারের লেখা ও সুর । আর কোনদিন কোথাও শুনিনি।
©somewhere in net ltd.
১| ১৫ ই মে, ২০২০ দুপুর ১:৩১
নেওয়াজ আলি বলেছেন: ইতিহাস জানলাম । তবে এখন পুলিশের সাথে বন্দুক যুদ্ধ হয় । রামদা চুরির দিন ইতিহাস ।