নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কিছু মানুষ অন্য মানুষকে মুগ্ধ করার অসীম ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়। আর কিছু মানুষের ভিতর এই ক্ষমতা কখনই আসে না। আমি দ্বিতীয় দলের মানুষ। কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু কখনই করতে পারি না। কেউ অনেক সুন্দর গান গায়, আমি শুধু শুনে যাই। কেউ অনেক সুন্দর নাচে, আমি শুধু হাত তালি দিয়ে যাই। কেউ অনেক সুন্দর লেখে, আমি শুধু ভেবে যাই, কী করে এত ভালো লেখে কেউ? আমিও লিখি। তবে তা কাউকে মুগ্ধ করার মত কিছু না। আমার লেখায় আমার ভালোবাসা ছাড়া কিছুই নেই। পড়াশুনা শেষ, বুটেক্স থেকে টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বের হয়ে চাকরি, বিয়ে, পেশা পরিবর্তন সব হয়েছে। লেখালেখির ধারাবাহিকতায় চারখানা উপন্যাস অমর একুশে বইমেলায় বেরিয়েছে। টুকরো ছায়া টুকরো মায়া (২০১৫) – সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । একা আলো বাঁকা বিষাদ (২০১৬) – সামাজিক উপন্যাস । মধ্য বৃত্ত (২০১৮) – ডিটেকটিভ সাইকোলজিক্যাল থ্রিলার । অভিসন্ধি (২০২০) – ক্রাইম থ্রিলার । দেশটাকে ভালোবাসি অনেক। অনেক মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে ভাবি, সব বদলে দিতে পারতাম। স্বপ্নের মত না, বাস্তবের মত একটা দেশ গড়তে পারতাম …………………………
তিলকের সাথে প্রথম দেখায়, তিলক একটা নাড়ুর বৈয়াম এগিয়ে দিয়ে আমাকে বলেছিল, “এই খা তো, আমার দিদি বানিয়েছে।”
আমি মফঃস্বলে বড়ো হওয়া ছেলে, আমাদের ওদিকটায় স্কুল কলেজে তখনও হুটহাট সবাইকে তুই বলার প্রচলন হয়নি। কেনো হয়নি, কে জানে? কিন্তু ভার্সিটি হলে প্রথম দিনে, একটা ছেলে আমাকে হুট করে ‘তুই-তোকারি’ করছে ব্যাপারটা কেমন লাগলেও, পরে সয়ে গিয়েছিল। দেখলাম ভার্সিটিতে সবাই সবাইকে তুই বলেই ডাকে। আমি প্রথম দিকে জনা দুয়েক ক্লাসমেটকে ‘তুমি’ করে ডেকে হাসির পাত্র হয়েছিলাম। এরপর থেকে আমিও ও অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে গেলাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, বহু দিন পর, আমার স্কুল কলেজের যে বন্ধুদের সাথে দেখা হতো, যাদের আমি ‘তুমি’ সম্বোধন করেছি ঐ ছেলেবেলা কিংবা কিশোর বয়সে, তাদের আমি অনায়াসে ‘তুই’ বলে ডাকছি, ওরাও আমাকে একই সম্বোধনে ফিরতি কথা-বার্তা বলে যাচ্ছে। সময়ের সাথে কত কিছু বদলে যায়, কত কিছু ভুলে যাই আমরা, কত স্মৃতির হিসাব মিলিয়ে যায়।
ভার্সিটি জীবনের প্রথম হতেই তিলক আমার রুমমেট, প্রথম দেখায় এগিয়ে দেয়া নাড়ু খেয়ে আমার মনে হয়েছিলো, এত বাজে নাড়ু আমি জীবনে কখনও খাইনি। মুখের উপর তা বলা যায় না। আমি বলতে পারিনি।
ভার্সিটিতে তিলকের দুই কারণে নাম ডাক ছিলো- এক, তিলকের মতন এত টিউশনি কেউ করাতো না, ওর বেঁচে যাওয়া টিউশনিগুলো আমরা ভাগে যোগে নিয়ে নিতাম; দুই, দুদিন পর পর ওর দিদির বানানো খুবই বাজে স্বাদের খাবার আমাদের খেতে হতো, যে ওর দিদির খাবারের প্রশংসা করে ভাসিয়ে দিতো, তিলক তাকে টিউশনি দিয়ে উড়িয়ে দিতো।
এই অত্যাচার সবচেয়ে বেশি বোধ হয় সহ্য করেছি আমি। আমার ও রুমমেট ছিলো পাক্কা চার বছর, আমাকে ও নিজের সবচেয়ে কাছের বন্ধু ভাবত। আমি তা ঠিক ভাবতে পারিনি হয়ত কখনও। আমার সাথে তিলকের সম্পর্ক কখনও হয়ত দেয়া নেয়ার বাইরে কিছু ছিলো না। আমি তিলকের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রেখেছিলাম সর্বদা, শুধুমাত্র বিপদের সময় টিউশনি পাওয়ার লোভে, আর কিছুই না।
একবার তিলক আমাকে ওর দিদির বানানো চালতার আচার এনে দিলো। আমি ভয়ে ভয়ে সে আচার নিয়ে খাটের নিচে রেখে দিলাম। কখনও খুলেও দেখিনি। তিলক আমাকে জিজ্ঞেস করত নিয়মিত, “এই, দিদির দেয়া চালতার আচার খেয়েছিস?”
আমি চওড়া হাসি হেসে বলতাম, “হ্যাঁ রে, অমন মজার আচার আমি কখনও খাইনি।”
তার ঠিক মাস দুয়েক পরে, রুম চেঞ্জের দিনটায় খাটের নিচ থেকে ময়লার স্তর জমা চালতার আচার বেরিয়ে আসলো। তিলক দেখে বলে, “এটা কী রে?”
আমি ছো মেরে টেনে নিয়ে, ওটা ফেলে দিয়েছিলাম। “ও কিছু না, ময়লা আবর্জনা।” বলে কথা কাটিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। তিলক আমার মিথ্যে ধরতে পেরেছিলো কি-না কে জানে? কিন্তু আমাকে তার পরদিন ডেকে বলেছিলো, “সায়ন, তোকে আমি পছন্দ করি। আমার সাথে মিথ্যে বলিস না কিছু নিয়ে। আমার সাথে কেউ মিথ্যে বললে, আমি খুব সহজে ধরতে পারি।”
এ কথার উত্তরে কী বলা উচিত আসলে, আমার জানা ছিলো না। আমি কিছু বলতে পারিনি।
মাঝে মাঝে আমার বেশ খারাপও লাগত, নিজেকে বেশ অপরাধীও মনে হতো। প্রতি ইদে, প্রতি উৎসবে দিদি আমার জন্য পাঞ্জাবি পাঠাত, উপহার দিতো, অথচ আমি দিদির জন্য কিছু পাঠাতে চাইলে তিলক কখনও রাজি হতো না। আমিও জোর করতাম না এসব নিয়ে খুব একটা। অপরাধী লাগত এই ভেবে, আমি কখনও তিলকের কাছে বলিনি, তোর দিদির সাথে একবার দেখা করা না? কিংবা তোদের বাড়ি বেড়াতে যাব। অথবা তোর দিদি কখনও ঢাকা আসে না? মনে হতো, এই প্রশ্নের উত্তরেও দিদির হাতের কোনো খাবার চলে আসবে, সে খাবারে ভালোবাসা থাকবে হয়ত, কিন্তু সে ভালোবাসা গ্রহণ করার কিংবা তার মর্যাদা দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই।
মাঝে বহু বছর কেটে যায়, ভার্সিটি জীবন শেষে যে যার মতন জীবন পার করছি। জীবনে অনেকে এসেছে নতুন, পুরনো অনেকে হারিয়ে গিয়েছে। আমার ছেলেবেলার সবচেয়ে কাছের দুই বন্ধু আভাস এবং স্বরূপ দুজনকেই আমি হারিয়েছি এই সময়ের স্রোতে, আমি ওদের বাঁচিয়ে রাখতে পারিনি। আভাস ওর চেয়ে বয়সে বছর চারেক বড়ো এক মেয়েকে ভালোবেসে, দুঃখ পেয়ে, গলায় ফাঁস নিয়ে মরে গেল। স্বরূপ-হারিয়ে গেলো ট্রেনের তলায় পড়ে। মাত্রই বিয়ের কথা চলছিল, স্বরূপের মৃত্যুর মাসখানেক পরেই শুনি, সে মেয়েটাও বিয়ে করে ফেলেছে। কেউ হয়ত কারও জন্য এত অপেক্ষা করে না, আমরা হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর স্মৃতি আজন্মকাল আষ্টেপিষ্টে জড়িয়ে রাখতে পারি না। শুধু উপলক্ষ-ভেদে, কথার-ছলে কিংবা কখনও কোনো আফসোসের সুরে, হাসিমাখা মুখ খানিক সময় মলিন করে বলে দেই, সে বড় ভালো মানুষ ছিলো, আমার কাছের কেউ ছিলো। এর চেয়ে বেশি কিছু না।
সময়ের সাথে খেয়াল করলাম ঐ ছেলেবেলার কিংবা কিশোর বয়স বা ভার্সিটি জীবনের বেশির ভাগের সাথে এক বিশাল দূরত্ব জন্মে গেছে। সবার সাথে দূরত্ব জমলেও, আমার সাথে তিলকের দূরত্ব জন্মেনি। তিলক তা জন্মাতে দেয়নি। তিলকের দিদির উপহার, খাবার এখনও আমার বাসায় আসে, আগের মতন এখন আর তা অখাদ্য লাগে না। ঐ যে সময়ের সাথে কত কিছু বদলে যায়। যেমন প্রতি নিয়ত বদলে যাচ্ছে তিলকের দিদির হাতের রান্না কিংবা আমার মুখের স্বাদ।
আমি কমলাপুর স্টেশনে বসে আছি। আমার স্ত্রী ওর বাপের বাড়ি থেকে ফেরত আসছে, আমরা বেশ ঘটা করে বিয়ের প্রতিটা মাস উদযাপন করি। আজ বিয়ের বয়স আটান্ন মাস হলো। স্টেশনের এক কোণায় আমার চোখ আটকে গেলো। তিলক না? হ্যাঁ তিলকই বসে আছে, উদাস চোখে এদিক ওদিক দেখছে। আমি এগিয়ে যেতেই, বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, “কিরে, ভাবীকে নিতে আসলি বুঝি? আজ তোদের বিয়ের আটান্ন মাস হলো।”
আমি অবাক হওয়া দৃষ্টি মেলে বললাম, “হুম, কিন্তু তুই জানলি কীভাবে?”
“এটা জানা যেন বিশাল কঠিন কোনো কাজ? ধর, কম করে হলেও”, পকেট হতে মোবাইল বের করে খানিক সময় থেমে বলল তিলক, “আট হাজার সাতশ সাতাশ জন জানে। এর থেকে কম বেশিও হতে পারে?”
তিলকের কথার আগা মাথা বুঝতে আমার ইদানীং সময় লাগে, কেমন যেন রহস্য করে কথা বলে।
তিলক হেসে বলে, “বুঝলি না? তুই যে হারে বিয়ের প্রতি মাসে ফেসবুকে জানান দিয়ে বেড়াস, মানুষ জানবে না? তোর ফেসবুকে বন্ধু আছে চার হাজার নয়শ আটান্ন, ফলোয়ার তিন হাজার সাতশ ঊনষাট, যোগ করে দেখ কত হয়।”
আমি কথা বাড়াই না। প্রসঙ্গ পাল্টে বলি, “তুই এখানে কী করিস?”
তিলকের চেহারায় আগের চেয়েও বেশি উৎসাহ।
“তোর বিয়ের আটান্ন মাস, আমার দিদির পাঁচ বছর আট মাস হলো। দারুণ মিল না? দিদি তো জানিস গ্রামের স্কুলে টিচার, জামাইবাবু ঢাকা থাকেন। দিদি আসছে ঢাকা।”
আমি শান্ত গলায় বলি, “আচ্ছা।”
তিলক দ্বিগুণ উৎসাহে বলে, “শোন না, দিদি ভাবীর জন্য রান্না করে নিয়ে আসছে, নিয়ে যাবনি আমি, কেমন?”
আমি, “আচ্ছা” বলে সরে আসি। ট্রেন এসেছে। আমার স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে যাব, তিলকের সাথে দেখা করব না আর।
তিলকের কলেজের এক বন্ধু, আমার অফিসের কলিগ, আমি তিলককে এ খবর জানাইনি। ওকে নিয়ে কী আলাপ করেছি, তাও বলিনি। তিলকের থেকে আমি অনেক কিছুই লুকাই। কিছু বিষয় লুকানো থাকা ভালো। তিলক বলেছিলো, ওর সাথে যেন আমি মিথ্যে না বলি। আমি মিথ্যে বলি না। শুধু চুপ থাকি। তিলক তিলকের মতন বলে যায়, আমি চুপচাপ তা শুনে যাই। তিলক এখনও কোনো চাকরিতে ঢুকেনি। টিউশনি করে বেশ কামায়, সে টাকার পুরোটাই খরচ করে খাবার কেনার পিছনে, এ কাজ করছে ও সেই ভার্সিটি জীবন থেকেই। যে খাবারের কিছু আসে আমার বাসায়, কিছু যায় অন্য কারও ঘরে। সেসবের নাম হয়, দিদির দেয়া খাবার।
আমি স্টেশন হতে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে আসার সময়, শেষবার পিছন ফিরে তাকাই। তিলক ঠায় বসে আছে, দিদি যে ট্রেনে করে আসবে, তার অপেক্ষা করছে। আমি জানি, শেষ ট্রেনেও কেউ ফিরবে না। কিছু মানুষ ফিরে আসে না আবার হারিয়েও যায় না, শুধু বেঁচে রয় প্রিয় মানুষগুলোর গল্পে, অভিনয়ে, জড়িয়ে রয় আষ্টেপিষ্টে তিলকের দিদির মতন আচারের বৈয়াম কিংবা নিত্যনতুন স্বাদের খাবার জুড়ে।
রিয়াদুল রিয়াদ
২| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১:১৫
অধীতি বলেছেন: খুব ভালো লাগল। সুন্দর গল্প। শেষ ট্রেনে কেউ ফিরবেওনা আর।
৩| ০৭ ই জানুয়ারি, ২০২৫ সকাল ১০:৫৯
রাজীব নুর বলেছেন: গল্প পড়লাম।
©somewhere in net ltd.
১| ০৬ ই জানুয়ারি, ২০২৫ রাত ১১:১৭
মাহমুদুর রহমান সুজন বলেছেন: গল্পপাঠে ভালো লাগা।