নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। স্মৃতির পাতা থেকে -১৯৭১

২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ দুপুর ১:২৫








২০ ডিসেম্বর বিকেল । বাড়ি থেকে বেরুলাম ঘুরতে যাব বলে । আমি ও আমার মেজভাই ১৩ ডিসেম্বর খুলনা শহর ছেড়ে চুলকাটি একরাত থেকে পরদিন গ্রামের বাড়ি রামপাল পৌছালাম । রামপাল কদিন আগেই রাজাকার মুক্ত , এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে । ১৮ ডিসেম্বরে খুলনা মুক্ত । আমি ফিরে এলাম । গেট থেকে বেরিয়েই স্কুলের মুখচেনা তিনজন একটা বাইসাইকেল নিয়ে যাচ্ছিল , আমায় দেখে তারা থেমে গেলো । খুব স্বল্প কথা হল তারপর স্কুলে হাজির । স্কাউট লিডার কমলদাকে দেখে আশ্বস্ত হলাম । আমরা সবাই স্কাউট । ক্যাডেট রুম সাফ করতে লাগলাম । ডামি রাইফেলগুলো পাশের রুমে রেখে কাজ শেষ করতে করতে রাত হয়ে গেলো । এরপর ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অফ রেড ক্রসের নতুন অফিসে । ক'জন বিদেশি আছেন । আমাদের সিনিয়র রোভাররা আমাদের কাজ বুঝিয়ে বললেন ।
বাড়িতে এসে খেতে খেতে মাকে বললাম কাল ভারত থেকে আসা শরণার্থীদের সেবা দিতে হবে । মা খুশি খুব । স্কুলে গিয়ে ট্রাক ভরে আসা বিবিধ মালামাল নামাতে লাগলো লেবাররা । ওরা চলে গেলেই ক্যাডেট রুমের আশেপাশে উকি ঝুকি মারতে শুরু করতে করল শরণার্থীরা । তারা রিফিউজি কার্ড দেখিয়ে তাদের জন্য বরাদ্দ মাল নিয়ে যেতে শুরু করল । চুলকানির মলম , কাপড় ধোয়া সাবান , পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট , ধুতি , সয়া মিল ইত্যাদি বিলি শুরু হল । আমরা ছয়জন কাজ ভাগ করে খুব দ্রুত বণ্টন করতে লাগলাম । দুপুরে এক দৌড়ে বাসা থেকে খেয়ে আসতাম । স্কুলের পুব দিকে বিশাল ডেগ নিয়ে চালে ডালে খিচুড়ি রান্না হচ্ছে হাজার মানুষের জন্য । রিফিউজিরা এক রাত থেকেই পরদিন এলাকা বেসিস ভাড়া করা লঞ্চে যেতে লাগলো । বেনাপোল থেকে প্রতিদিন এক হাজার রিফিউজি আসছে রেড ক্রসের জাপানের দান করা ট্রাকে । আমাদের উপর অবর্ণনীয় চাপ , ১৪ বছর বয়স আমার , ছোট দুটো হাত নিয়ে ক্লান্ত হয়ে গেলাম কিন্তু ভেঙ্গে পড়িনি । দিন পনেরো চলল বিলি বণ্টনের কাজ । আমাদের তিনতলা স্কুলের ক্লাসরুম গুলো যাচ্ছেতাই হয়ে গেছে । টয়লেটে গু মুত ভাসছে । এরপর রেড ক্রস অফিসে আড্ডা ।

হটাত একদিন সকালে ঘোষণা দিল আজই দুপুরের পর লঞ্চ ভর্তি রিলিফের মাল নিয়ে বিবিধ থানা সদরে যেতে হবে । একজন সিনিয়র থাকবেন আমার সাথে । মাকে বলে খেয়ে কাপড় নিয়ে ছুট ছুট । আমাদের গন্তব্য চালনা বাজার । চালনাতে বড় সংখ্যার হিন্দুদের বসবাস । আমরা হাজার দশেক কম্বল আর সয়া মিল , পানি বিশুদ্ধকরন ট্যাবলেট নিয়ে এসেছি। আমাদের সাথে ধুতি আর শাড়ি আছে । পরদিন আমরা নদীর পাড়ে ডাকবাংলায় বিলির কাজ শুরু করলাম । আমি ভোটার লিস্ট খুজে নাম কাটি , আঙ্গুলের টিপ সই নেই আর সিনিয়র আরও কজন স্থানীয় যুবকের সহযোগিতায় বিলির কাজ করেন । আমরা রাতে রিলিফের কম্বলের ওপর ঘুমাই । আমরা ঈশ্বরের দয়ায় দুটো ভাত পাই । পুরো এলাকা খালি করে ভারতে পালিয়ে জীবন বাচিয়েছিল । তাদের কারো কাছে চাল নেই কারন গেলো সিজনে ধান চাষ হয়নি । আমাদের জন্য প্রায় ভিক্ষা করে চাল আনতেন মিরা দিদি , সমাজসেবক । সরকারী চাকুরে মুসলিমরা আসতে শুরু করলে আমাদের খাবারের সমস্যা কিছুটা দূর হল কিন্তু হিন্দু সমাজ প্রায় অভুক্ত । সিনিয়র বললেন চাল আসছে দু একদিনের মধ্যে । এমন দুর্বিষহ অবস্থা ওই বয়েসে দেখি নি । পশুর নদীর ওপারের রাজাকাররা নারকেল গাছের মাথা মুড়ে দিয়েছে যাতে হিন্দুরা কিছুই ভোগ করতে না পারে । বাকি ফল গাছ কেটে সাফ করে রেখেছে । একজন তার বড় বাড়ির চালহিন দুর্দশা দেখাচ্ছিলেন । তাদের ঘরের চাল কেটে নিয়ে গেছে নদীর ওপারের লোকেরা । তারা এখন ছোট গোয়াল ঘরে গাদাগাদি করে ঘুমাচ্ছে ।
চারদিন অপারেশন শেষ করে স্থানীয় যুবক যারা আমাদের সাথে কাজ শিখেছে তারা দায়িত্ব নিল বিলি বণ্টনের । লোকাল এম পি , দাকোপ থেকে মুক্তিযোদ্ধারা এসেছিল আমাদের ধন্যবাদ দিতে । আমরা চলে এলাম । মা বসে আমার গল্প শুনলেন এবং বললেন তুই এক থলে চাল নিয়ে যেতে পারতিস । বাবা তুই তো আমার জন্য একটা কম্বল আনতে পারতিস , লজ্জায় পড়ে গেলাম ।

পরের ডিউটি খালিশপুরের বিহারী ক্যাম্পে । প্রথমদিন আমার রীতিমত হাত পা কাপতে লাগলো । আমরা ট্রাক ভর্তি গম নিয়ে যেতাম । আমাদের একজন ক্যাম্পের ভিতরে পাকিস্তান থেকে আসা রেড ক্রসের ফর্দে চিঠি বিলাত এবং এদের লেখা চিঠি নিয়ে অফিসে নিয়ে বিদেশীদের হাতে তুলে দিত । সবই উর্দুতে লেখা । কি সাহস সুলতান ভাইয়ের , সিনিয়র স্কাউট ।
প্রায় দেড় মাস বাদে আমাদের দিনপ্রতি ৪ ডলার / ৪ রুপি মোট ১৬০ রুপি দিয়ে আমাদের বিদায় দিল কারন স্কুল খোলার নোটিশ এসে গেছে । জীবনের প্রথম আয় দিয়ে ১২ আনায় খাসির হাফ বিরিয়ানি খেতাম । কয়েকজন একরকম শার্ট বানালাম প্রতিটি ৫ রুপি কাপড় ও মজুরি দিয়ে । মায়ের জন্য এক বিড়া পান , সুপারি , চুন কিনলাম ।

বয়স বাড়ছে আর স্মৃতিময় অর্ধশতক সন আগের ঘটনা জেগে উঠছে প্রবল বেগে ।

আমার বাবা ওয়েলফেয়ারের দিকে ভীষণ নজর দিতেন , পুত্র হিসাবে আমিও এখনও করোনার সময়ে গরিব পরিবারের খাদ্য বিতরন করেছি ।

ছবিঃ গেটি , রঘু রায় ।

মন্তব্য ৭ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৭) মন্তব্য লিখুন

১| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ বিকাল ৩:০১

কাজী ফাতেমা ছবি বলেছেন: ভালো লাগলো

২| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৬:৩২

সোনাগাজী বলেছেন:



রঘু রায় বাবুটা কে?

২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সন্ধ্যা ৭:৩২

শাহ আজিজ বলেছেন: একজন ভারতীয় ফটোগ্রাফার ।

৩| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১০:৫৮

কামাল১৮ বলেছেন: জহির রায়হানের তোলা ছবি গুলো ঐ সময়কার জীবন্ত দলিল ছিল।আছে নাকি সব ধংস হয়ে গেছে তাও জানি না।কোন পত্রিকায় এখন আর দেখি না।
দেশের জন্য দেশের মানুষের জন্য অনেক কিছু করেছেন।

২১ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৪২

শাহ আজিজ বলেছেন: ওগুলো আর্কাইভে আছে , কিছু মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরে ।

৪| ২০ শে ডিসেম্বর, ২০২২ রাত ১১:০৩

রাজীব নুর বলেছেন: খুলনা শহর ছেড়ে চুলকাটি বা রামপাল কিভাবে গেলেন? মানে সে সময় পরিবহন ব্যবস্থা কি ছিলো?

২১ শে ডিসেম্বর, ২০২২ সকাল ১০:৪০

শাহ আজিজ বলেছেন: খেয়া নৌকায় রূপসা ঘাট , মান্ধাতা আমলের বাসে চুলকাটি । আমার বড় ভাবী ও বাচ্চারা সাথে ছিল । গিয়ে জানলাম বড় ভাবির বাবা শান্তি কমিটির মেম্বার । স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শোনা একধরনের গুনাহ । পরদিন ভোরেই নৌকায় নদীপথে রামপাল । বেলা ২ টা বেজেছিল । রামপাল তখন মুক্ত । আনন্দে মেতে উঠলাম সবাই । লঞ্চে করে মংলা - খুলনা বা লঞ্চে বাগেরহাট হয়ে স্কুটারে বা ট্রেনে খুলনা যাতায়াত ব্যাবস্থা ছিল । এখন মহাসড়ক হয়ে গেছে , আধা ঘণ্টায় পৌঁছানো যায় ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.