নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ

চারুশিল্পী , লেখক

শাহ আজিজ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ইউরোপীয়দের চোখে সতীদাহ

০৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১০:১৮




আবারো রানা বাবুর লেখা ছেপে দিলাম । লেখাটিতে সতীদাহ বিষয়ে অনেক নতুন তথ্য জানতে পারবেন ।

---------------------------------------------------------------------------------------------------
‘ইউরোপীয়দের চোখে সতীদাহ’
©️রানা©️
ইউরোপীয়দের লেখায় বঙ্গদেশে সতীদাহের প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা খুব একটা বেশি পাওয়া যায় না। বাংলার সতীদাহের বিষয়ে তাঁদের অধিকাংশ বর্ণনাই তাঁরা পরের কাছ থেকে শুনে লিখেছিলেন। আর সেকাজ করতে গিয়ে কয়েকজন মেমসাহেব তো তাঁদের বাড়ির দাসদাসীদের মুখের ঝাল খেয়ে বিস্তৃত ভয়াল ভয়ঙ্কর রোমহর্ষক গল্প ফেঁদে বসেছিলেন। মনে রাখা দরকার যে, সতীদাহ কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ছিল না। সেটা অর্থনৈতিক ও সংস্কারগত কারণে উদ্ভূত দেশাচারমাত্র ছিল। ভারতে মুসলিম শাসনকালে হিন্দুঘরের নারীদের পর্দানসীন হতে হলেও, সতীদাহ কিন্তু সেই সময়ে ব্যাপক আকার ধারণ করেনি। সেই সময়ে যেটা নিতান্ত ঐচ্ছিক বিষয় ছিল, পরে ইংরেজ শাসনকালে সেটাই আবশ্যিক হয়ে উঠেছিল। সতীদাহ বস্তুতঃ ভারতে বৃটিশ শাসনের সূচনায় আইন ও শৃঙ্খলার শোচনীয় অধঃপতনের ঐতিহাসিক প্রমাণ। কিন্তু ইংরেজরা কোনদিনই সেকথা স্বীকার করেন নি। তাঁরা সতীদাহ বিষয়ে সব দোষই হিন্দুদের কুসংস্কারবোধের উপরে চাপিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়েছিলেন। আর সতীদাহ-নিবারণী আইন ও আন্দোলনের কৃতিত্বও কোন ইংরেজের নয়। ‘রাজা রামমোহন রায়’ সেই গৌরবের অধিকারী। তিনি সতীদাহ রোধ করবার বিষয়ে এগিয়ে না আসলে, ইংরেজ সরকার স্বেচ্ছায় সতীদাহ বন্ধ করতে কোন পদক্ষেপ নিত কিনা, সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এই প্রসঙ্গে এটাও একইসাথে স্মরণীয়, যে ইংরেজ নরনারীরা সতীদাহের বিভৎস বর্ণনায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন, সেই তাঁরাই কিন্তু দাস ব্যবসার মত ঘৃণ্য ব্যবসার বিরুদ্ধে কখনো একটি কথাও বলেননি। কারণ, বঙ্গদেশে পর্তুগীজদের পরে দাস ব্যবসা ইংরেজদেরই একচেটিয়া ছিল। আর সতীদাহ যখন আইনের দ্বারা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়েছিল, তখনও পর্যন্ত দাসব্যবসা উচ্ছেদের জন্য কোন ইংরেজকণ্ঠে মৃদু প্রতিবাদ পর্যন্ত শোনা যায়নি। উল্লেখ্য যে, সতীদাহ রদ হয়েছিল ১৮৩০ সালে, আর দাস ব্যবসা বন্ধ করা হয়েছিল আরো পনেরো বছর পরে, অর্থাৎ ১৮৪৫ সালে। এখন একথা ভাবতে রীতিমত অবাক লাগে, যে ইংরেজ জাতি রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটির মত বিদ্বজ্জন সমিতি গড়েছিল, পশুক্লেশ নিবারণের জন্য আইন প্রণয়ন করেছিল; চারুকলা, বিজ্ঞানের অকুণ্ঠ পৃষ্ঠপোষকতা করে সারা বিশ্বের বিস্ময় ঘটিয়েছিল, সেই ইংরেজ নরনারীদের ব্যক্তিগত ডায়েরী বা চিঠিপত্রের মধ্যেও কোথাও কিন্তু দাস ব্যবসার বিরুদ্ধে বিন্দুমাত্রও প্রতিবাদ ধ্বনিত হয়েছিল বলে দেখতে পাওয়া যায় না। অথচ, আরব আফ্রিকা থেকে ক্রীতদাসদের হাত-পা বেঁধে ভারতে নিয়ে এসে যাঁরা বিক্রি করতেন, তাঁরা জাতিতে খাঁটি ইংরেজ ছিলেন। এই প্রসঙ্গে এটাও স্মরণীয় যে, মার্কিন কংগ্রেসে ক্রীতদাস প্রথা উচ্ছেদের জন্য জনৈক শ্বেতাঙ্গ নাগরিক ১৮৩৩ সালে যে আবেদনপত্রটি পাঠিয়েছিলেন, তাতে তিনি ‘রাজা রামমোহন রায়’ ছদ্মনামটি ব্যবহার করেছিলেন। কারণ, তখনকার জীবিত মানুষদের মধ্যে রাজাই সর্বাধিক মানবদরদী বলে পরিচিত ছিলেন। [“In closing this addern (Address to the Members of the Congress on the abolition of Slavery, Washington) allow me to assume the name of the most enlightened and benevolent of the human race now living, though not a white man, Rammohan Roy.” - Rammohan Roy, and America Andaianue Moore] ইউরোপীয়দের মধ্যে কেউই সতীদাহকে কখনোই দ্রষ্টব্য হিসেবে দেখেননি। যে আকর্ষণে তাঁরা নাচ বা দুর্গাপূজা দেখতে যেতেন, সেই আকর্ষণে তাঁরা কখনও সতীদাহ দেখতে যাননি। কিন্তু তবুও তাঁদের সতীদাহ দেখতে হয়েছিল, কারণ বঙ্গদেশে তখন নদীপথই প্রধান যাতায়াতের পথ ছিল, এবং সতীদাহ নামক ঘটনাগুলি নদীতীরেই বেশি ঘটেছিল। সদ্য-বিধবা হিন্দুরমণী স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় আরোহণ করেন, নাকি সেকাজ করবার জন্য তাঁর উপরে বলপ্রয়োগ করা হয় - সেটি নিঃসন্দেহে জানবার কৌতূহল হয়তো কোন কোন বিদেশীর মনে ছিল। কিন্তু সে ছাড়াও তাঁদের ওই কৌতূহলের পিছনে খৃষ্টান এথিকসও ছিল। একজন জ্যান্ত মানুষকে হত্যা অথবা একজন জ্যান্ত মানুষের সর্বসমক্ষে আত্মহত্যা - ওই অনুষ্ঠানটি যেটাই হোক না কেন, নিশ্চিতভাবে বর্বরতার পরিচয়বাহী ছিল; এবং কোন শুদ্ধবিবেকী মানুষের পক্ষেই সেটা সমর্থন করা সম্ভব ছিল না। ইউরোপীয়দের চোখে তাই সেই প্রথা অবিমিশ্র বর্বরতা অন্য কিছুই ছিল না। আর বাস্তবে, কোন যুক্তির দ্বারাই সতীদাহের সমর্থন করা চলে না।


‘উইলিয়ম কেরী’র বর্ণনায় আঠারো শতকের একেবারে শেষের বছরের বাংলার একটি সতীদাহের সামগ্রিক ছবি পাওয়া যায়। ১৭৯৯ সালে কলকাতার ত্রিশ মাইল দূরে অবস্থিত একটি গ্রামে তিনি সেই সতীদাহের প্রত্যক্ষদর্শী হয়েছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “দেখলাম বহু লোক নদী তীরে সমবেত হয়েছেন। তাঁদের এই সমাবেশের কারণ জিজ্ঞাসা করায় তাঁরা আমায় জানালেন যে একটি শবদাহ করতে আসছে। আমি তাঁদের শুধালাম, মৃতব্যক্তির স্ত্রীও সহমরণে যোগ দেবে কিনা। তাঁরা বললেন - হ্যাঁ। এবং মৃতের স্ত্রীকে দেখালেন। স্তূপীকৃত জ্বালানি কাঠের একপাশে মহিলাটি বসেছিলেন, সেই কাঠের স্তূপের মাথায় তাঁর স্বামীর মৃতদেহটি রাখা ছিল। মহিলাটির পাশে তাঁর নিকট আত্মীয়রা বসেছিলেন। একপাশে একটি ঝুড়িতে কিছু মিষ্টান্ন ছিল। আমি প্রশ্ন করলাম, তিনি স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতে চলেছেন কিনা। অথবা কোন অন্যায় প্রভাবে বাধ্য হয়ে এই পথ বেছে নিচ্ছেন। তাঁরা জবাব দিলেন, সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। আমি যতক্ষণ পারলাম যুক্তি দিয়ে তাঁদের বোঝাবার চেষ্টা করলাম। তারপর ব্যর্থ হয়ে আমার সকল শক্তি দিয়ে মনের ক্ষোভ প্রকাশ করে বললাম, তোমরা যে কাজটা করছ সেটা আসলে নৃশংস নরহত্যা। কিন্তু তাঁরা বললেন, এ হল পুণ্যকর্ম, এবং শ্লেষভরে জানালেন, আমার যদি দেখতে ভাল না লাগে তাহলে আমি যেন স্থানত্যাগ করি। আমি বললাম, না, আমি যাব না। এই নরহত্যা আমি নিশ্চই দেখব, ঈশ্বরের দরবারে বিচারের সময় আমি সাক্ষী দেব। বিধবার কাছে গিয়ে নিজের জীবন নষ্ট না করবার জন্য কাতর অনুনয় করলাম। তাঁকে বললাম, ভয়ের কিছু নেই, যদি তুমি নিজেকে আগুনে পোড়াতে অস্বীকার কর তাহলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। কিন্তু মহিলাটি বেশ শান্তচিত্তে চিতায় আরোহণ করলেন, এবং হৃদয়ের প্রশাস্তি প্রকাশের জন্যই বোধহয় দু’হাত বাড়িয়ে নাচলেন। অবশ্য চিতায় আরোহণের আগে তাঁর আত্মীয়রা তাঁকে চিতার চারিদিক ছ’বার প্রদক্ষিণ করায়, এবং সেই প্রদক্ষিণকালে বিধবাটি সন্দেশগুলি উপস্থিত জনমণ্ডলীর মধ্যে বিতরণ করে দেন। জনমণ্ডলীও সেই সন্দেশ পবিত্র প্রসাদের মত ভক্ষণ করে। তারপরে তিনি চিতায় উঠে মৃত স্বামীর পাশে শয়ন করে একটি হাত তাঁর কাঁধের নিচে ও অপর হাতটি তাঁর কাঁধের উপরে স্থাপন করেন। এই দুই দেহের উপর শুকনো নারকেল পাতা ও অন্যান্য দ্রব্যাদি স্থাপন করা হয়, সর্বোপরি ঘি ঢেলে দেওয়া হয়। তারপর বাঁশ দিয়ে বেশ শক্ত করে চেপে রাখা হয়। তারপরে আগুন লাগানো হল। শুকনো দাহ্য বস্তু সাজানো হয়েছিল, কাজেই আগুন দ্রুত দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। আগুন জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে জনতা শিবের নাম নিয়ে উচ্চৈস্বরে চেঁচাতে শুরু করল। সেই চেঁচামেচিতে মহিলাটির কণ্ঠস্বর শোনার কোন উপায় ছিল না। সে আর্তস্বরে চিৎকার করেছিল কিনা সেটা কোলাহলের জন্য শোনা গেল না। তাঁর পক্ষে ঠেলে উঠে আসা বা বের হয়ে আসবার জন্য চেষ্টা করবার পথও বন্ধ ছিল, কারণ বাঁশ দিয়ে তাঁকে ঠেসে বেঁধে রাখা হয়েছিল। ছাপাখানায় কাগজকে যেমন দু’পাশ থেকে চেপে দেওয়া হয়, ঠিক তেমনি।


আমরা প্রবল প্রতিবাদের সুরে বললাম, ‘এভাবে জোর করা অন্যায়, আগুনের যন্ত্রণায় পালিয়ে আসবার পথ রোধ করা কেন?’ তাঁরা বললেন, আগুন যাতে নিচে পড়ে না যায় সেজন্যই বাঁশ বাঁধার ব্যবস্থা। এই দৃশ্য বেশীক্ষণ দেখা যায় না। জোর করে তাঁদের বললাম, এটা সহমরণ নয়, এটা হল নৃশংস হত্যাকাণ্ড - এই কথা বলে সেই স্থান ত্যাগ করলাম।”
১৮২৪ সালের ‘এশিয়াটিক জার্নালে’ জনৈক ইউরোপীয়ান প্রত্যক্ষদর্শী একই স্বামীর চিতায় দুই সতীনকে একযোগে আত্মাহুতি দিতে দেখেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। নিজের দেখা সেই নৃশংস অভিজ্ঞতার বিবরণ দিয়ে তিনি লিখেছিলেন, “কাউকে বাঁশ দিয়ে বাঁধা হয়নি। বড় বৌয়ের বয়স পঞ্চাশ, ছোটর প্রায় চল্লিশ। চারদিকে প্রবল হরিবোল হরিবোল ধ্বনি, তার মধ্যে দু’জনে চিতার উপরে উঠে স্বামীর শবের দুইপাশে শয়ন করল। দেখতে দেখতে চিতার আগুনের অন্তরালে তাঁরা অদৃশ্য হয়ে গেল। কোনপ্রকার বলপ্রয়োগ করা হয়নি, ঔষুধ খাইয়ে নেশাগ্রস্তও করা হয়নি। এমন কি বাঁশ দিয়েও বেঁধে রাখা হয়নি। বিনা প্রতিবাদে তাঁরা মৃত্যু বরণ করল। এরপরে হরিবোল ধ্বনি প্রবলতর হয়ে উঠল, এবং তাঁদের নিকট আত্মীয়জনের মুখ দেখে মনে হল যেন তাঁরা খুশি হয়েছেন। আমি ভীত সন্ত্রস্তচিত্তে ঘটনাস্থল ত্যাগ করলাম।”


সতীদাহ সম্পর্কে শ্রীরামপুর মিশনের প্রখ্যাত পণ্ডিত ‘মার্শম্যানের’ সঙ্গে ‘বিশপ হেবারের’ বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনার বিবরণ জানিয়ে বিশপ হেবার লিখেছিলেন, “ডাঃ মার্শম্যান বললেন, তিনি প্রথম যখন বঙ্গদেশে আসেন, তখনকার তুলনায় আজকাল এই বীভৎস অনুষ্ঠানের সংখ্যা অনেক বেড়ে গিয়েছে। এই বৃদ্ধির কারণ হিসাবে তিনি মনে করেন, ধনী ও মধ্যবিত্ত হিন্দু পরিবারের জীবনযাত্রায় পশ্চিমী প্রভাবের ফলে ব্যয়বৃদ্ধি ও তার ফলে অভাব; সেই অভাবের ফলে বিধবা মা বা অন্যান্য স্ত্রীলোকদের ভার বহনের অনিচ্ছা, পরিণতিতে সহমরণ। আরেক সম্ভাব্য কারণ, বয়স্ক পুরুষদের ঈর্ষা। তাঁরা ইহজীবনে একাধিক দারপরিগ্রহ করেই খুশী নন, মৃত্যুর পরেও স্ত্রীদের উপরে অধিকার যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে, সেজন্য জীবদ্দশায় তাঁরা তাঁদের দিয়ে অথবা আত্মীয়দের দিয়ে সহমরণ অনুষ্ঠানের শপথ করিয়ে নেন। তাঁর (মার্শম্যানের) দৃঢ় বিশ্বাস যে, বঙ্গদেশে এই ঘটনা প্রায়ই ঘটে বটে, কিন্তু এই বঙ্গদেশেই এই প্রথা রহিত করা সম্ভব, তাতে বড় জোর মৃদু প্রতিবাদ উঠবে। … সতীদাহ রহিত করবার উদ্যোগকে কেবল এদেশের রমণীরাই উচ্চকণ্ঠে অভিনন্দিত করবেন তাই নয়, পুরুষরাও করবেন।

কারণ যাঁরা সহমরণের সময়ে সমবেত হন, তাঁদের মধ্যে অতি সামান্য কয়েকজনের স্বার্থ এই অনুষ্ঠানের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত থাকে, আর যে মা, ভগিনী বা পরিবারের অন্যান্য রমণীর স্নেহচ্ছায়ায় একজন লালিত-পালিত হয়েছে, যে রমণীর জন্য পুত্র পৃথিবীর আলোক দর্শনে ধন্য হয়েছে, সেই মা ভগিনীকে আগুনে ঠেলে হত্যা করতে কেউ সহজে চাইবেন না। … মার্শম্যান বললেন, তিনি যখন প্রথমে ভারতে আসেন তখনকার মত ব্রাহ্মণদের আর সে ক্ষমতা নেই, প্রতিপত্তিও অন্তর্হিত। সাধারণ মানুষের মধ্যেও বহু ধনী প্রভাবশালী ব্যক্তি আজ রাজা রামমোহন রায়ের সঙ্গে একযোগে এই প্রথা উচ্ছেদের জন্য প্রকাশ্যেই অভিমত প্রকাশ করছেন। এবং একথাও আজ সকলেই জেনে ফেলেছে যে, কোন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে এই রকম কোন বিধান নেই। অবশ্য কেউ কেউ এই রীতির গুণগান যে করেন না - এমনও নয়। … ডাঃ মার্শমান যে কথা বললেন, অনুরূপ অভিমত আমি সদর দেওয়ানি আদালতের এক প্রবীণ বিচারকের মুখে শুনেছি। অবশ্য এই বিষয়ে গভর্নমেন্টের অভিমত স্বতন্ত্র। গভর্নমেন্টের অভিমত এই যে, জোর করে আইনের দ্বারা যদি এই প্রথা রহিত করবার চেষ্টা করা হয়, তাহলে জেদের ফলে এই প্রথা আরও জনপ্রিয় হয়ে উঠবে। এই অন্যায় প্রথা গর্বের বস্তু হয়ে উঠবে। এখন তো অবস্থা তবুও মন্দের ভালো। এখন চিতায় আরোহণের আগে বিধবা মহিলাকে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে জানাতে হয় যে সে স্বেচ্ছায় সহমৃতা হতে চায়। এবং তবেই জেলা ম্যাজিস্ট্রেট তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। এই প্রথা যদি আইনের সাহায্যে রহিত করা হয়, তবে লাইসেন্সের জন্য কেউ আর অপেক্ষা করবেন না। সমাজের নিন্দা ও ঘৃণার ভয়ে আগেভাগেই হিন্দু বিধবারা চিতায় আরোহণ করে বসবেন। এদেশের হিন্দুদের যদি খৃস্টধর্মে দীক্ষিত করতে হয়, তাহলে সর্বাগ্রে গভর্নমেন্টকে দূরে সরে থাকতে হবে। মনে রাখা দরকার, এদেশের আচার-অনুষ্ঠান আমাদের দৃষ্টিতে যতই হিংস্র বর্বরতা হোক না কেন, এঁদের নিজেদের কাছে সেসব পবিত্র ধর্মানুষ্ঠান।”


সতীদাহ রোধের ব্যাপারে তৎকালীন বিদেশী সরকারের আপোষমুখী মনোভাবে হেবার আংশিক সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও, হাচিসন কিন্তু সেই বিষয়ে সরকারকে ক্ষমা করতে প্রস্তুত ছিলেন। তাই কঠোর ভাষায় সরকারের সমালোচনা করে ১৮২৬ সালের ১৯শে অক্টোবর তারিখে তিনি লিখেছিলেন, “ভাবলে কষ্ট হয় যে, বৃটিশ সিংহ গভর্নমেন্ট হাউসের চূড়ায় বসে দীর্ঘ দিন আত্মসন্তুষ্ট দৃষ্টিতে কেবল চেয়ে দেখেছেন, এবং টাকার ঝলকানি বা ঝনঝনির দ্বারা তাঁর রাগ শান্ত করা যায়। … পুত্র তাঁর জীবন্ত মাকে চিতায় তুলে দিচ্ছেন, এমন দৃশ্য কখনো ভাবতে পারো! কিন্তু বাংলায় এই ঘৃণ্য কুৎসিত অনুষ্ঠান চলতে দেওয়া হয়, এবং সারাদেশে ইউরোপীয় ম্যাজিস্ট্রেট প্রদত্ত লাইসেন্সের দ্বারা এই প্রথাকে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে।”


অতীতে ‘ক্যালকাটা জার্নাল’ পত্রিকায় বাংলার সতীদাহের অনেক বর্ণনা প্রকাশিত হয়েছিল। সেখানে সতীদাহের নিন্দা করে, এবং সেই বিষয়ে সরকারী অকর্মণ্যতায় ক্ষোভ প্রকাশ করে যেমন ইউরোপীয়দের লেখা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল, তেমনি তখনকার প্রগতিশীল সংস্কৃতিকামী হিন্দুদের পত্রও ওই পত্রিকার ইউরোপীয় সম্পাদক সানন্দে প্রকাশ করেছিলেন। ‘নটিকাস’ ছদ্মনামে জনৈক ইউরোপীয় পাঠক ক্যালকাটা জার্নালে একটি পত্রে লিখেছিলেন, “নরম লোকহিতর আইন বা ধর্মের দ্বারা বাঙালীর কোন সুফল হয়নি। কারণ এই দুটোকেই তাঁরা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির কাজে লাগিয়েছে, হতভাগ্য রমণীর অনুকূলে একটিকেও তাঁরা ব্যবহার করেনি। আমাদের দোষগুলিকে তাঁরা চমৎকারভাবে আত্মসাৎ করে নিয়েছে। কিন্তু আমাদের একটি গুণও কি তাঁরা গ্রহণ করেছে? আমাদের আগেরটি যেমন আছে, তেমনি ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরেরটিও আছে। কিন্তু বঙ্গদেশের ঠাণ্ডা নির্দোষ অধিবাসীদের সম্পর্কে একথা বলা যায় কি? ইউরোপের সর্বশ্রেষ্ঠ জাতির ঘনিষ্ঠ সাহচর্য ও ভাবের আদান প্রদানের পরিমাণ বাঙালীদের মধ্যে বেড়েই চলেছে, ইউরোপীয় প্রভাবও বাঙালীদের মধ্যে বড় কম নয়। অথচ দেখা যায়, আমরা এই প্রথার বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও, বাঙালীরা নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে এই প্রথাকে সমর্থন জানিয়ে চলেছে। … গত দশ মাসে আমি একই জায়গায় তিনটি নারীহত্যা (সতীদাহ) ঘটতে দেখেছি। প্রতিবারই এই ঘটনার কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করেছি, এই আশায় যে, আইন সভায় তথা বৃহত্তর সমাজের দৃষ্টি আকর্ষিত হবে। আজও সেই আশা ত্যাগ করিনি কারণ ভারতের অন্যান্য ‘বিদেশী’ উপনিবেশগুলিতে এই হত্যাকাণ্ড রোধের জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা অবলম্বিত হয়েছে। আমি একথা বিশ্বাস করি না যে, ফরাসি, পর্তুগীজ এমন কি ডাচরাও যে মানবতাবোধে অনুপ্রাণিত হয়ে এই প্রথা রহিত করেছে, সেই মানবতাবোধ ইংরেজদের মধ্যে নেই।”


সতীদাহের রমরমার সময়ে, বাংলার সব বিধবাই কি স্বেচ্ছায় স্বামীর চিতায় সহমৃতা হতেন? না, এই বিষয়ে সেকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত অনেক খবর ও প্রত্যক্ষদর্শীদের চিঠিপত্র বিপরীত প্রমাণ দেয়। এই প্রসঙ্গে ১৮২৭ সালের ৫ই মে তারিখের সংবাদপত্রে যা লেখা হয়েছিল, সেটা থেকে বিধবাদের সতী হওয়ার অনিচ্ছাই প্রকাশ পায়। সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল - “অবলা অনভিজ্ঞা স্ত্রীলোককে শাস্ত্রোপদেশ দ্বারা ভ্রম জন্মাইয়া এ রূপ উৎকট কর্মে প্রবৃত্ত করান সাক্ষাৎ যমদূতের ন্যায় হস্তধারণ পূর্বক ঘূর্ণপাকে সাতবার ঘুরাইয়া শীঘ্র চিতারোহণ করাইয়া শবের সহিত দৃঢ় বন্ধন পুরঃসরে জলদগ্নিতে দগ্ধকরণ ও বংশদ্বারা শবের সহিত তাঁহার শরীর দাবিয়া রাখন ও তাঁহার কথা কেহ শুনিতে না পায় এ নিমিত্তে গোলমাল ধ্বনি করণ অতি দুরাচার নির্মায়িক মনুষ্যের কর্ম। এমত বিষয়ে তাহার সাহায্যকারি ও সঙ্গিলোক সকলেই দোষী হইতেছেন। শাস্ত্রের ভালমন্দ ভগবান জানেন। আপাতত শাস্ত্র দেখাইয়া এমত কর্মে প্রবৃত্ত হওন কিংবা করান বিশিষ্ট লোকের অনুচিত।” তখন হাত-পা বেঁধে যে সতীদের যে পুড়িয়ে মারা হত, সেটার উল্লেখ রামমোহন নিজেও তাঁর লেখার মধ্যে করেছিলেন। অবশ্য নারী স্বামীর সাথে চিতার আগুনে না পুড়ে মরলেও কোন ক্ষতি ছিল না। তাঁকে অন্যভাবে তাঁর মৃত স্বামীর সাথে তথাকথিত স্বর্গে পাঠানোর বন্দোবস্তও তখনকার সমাজপতিরা রাখতেন। ‘লর্ড আমহার্স্ট’-এর স্ত্রীর রোজনামচায় সেই নৃশংসতার চিত্র পাওয়া যায়। আমহার্স্ট পত্নী লিখেছিলেন, “জনৈক যুবক কলেরায় মারা গেলে তাঁর বিধবা পত্নী সহমৃতা হবার সংকল্প করেন। তদনুযায়ী ব্যবস্থাদি করা হয়। ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে অনুমতি পত্রও সংগ্রহ করা হয়। নিকটতম আত্মীয়েরা চিতাগ্নি প্রজ্জ্বলিত করেন। কিন্তু অগ্নিশিখা যখন হতভাগিনীকে স্পর্শ করল তখন তাঁর সাহস উবে গেল। জনতার কর্ণপটাহবিদারণকারী চিৎকার, ঢাক-ঢোল-কাঁসির বাজনার মধ্যে ধূম্র কুণ্ডলীর আড়ালে সকলের অলক্ষ্যে সে চিতা থেকে নেমে পড়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলের মধ্যে আত্মগোপন করে। সে যে পলায়ন করেছে প্রথমে তা ধরা পড়েনি। কিন্তু ধোঁয়া কেটে যেতে ধরা পড়ে গেল যে, হতভাগিনী চিতায় নেই। হৈ-হৈ পড়ে গেল। ক্রুদ্ধ জনতা জঙ্গল-ঢুড়ে হতভাগিনীকে টেনে-হিচঁচড়ে বের করে আনলো। তারপর একটা ডিঙিতে করে মাঝ নদীতে নিয়ে গিয়ে জলে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হল। হতভাগিনী সেই যে ডুবল আর ওঠেনি।” এই ঘটনা সেকালের বঙ্গদেশে বিশেষ চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। এরপরে রাজা রামমোহন রায় প্রমুখের নেতৃত্বে সতীদাহ প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন সবিশেষ জোরদার হয়ে উঠেছিল। ১৮২৯ সালের ৮ই আগস্ট তারিখের সংবাদপত্রে লেখা হয়েছিল - “২৭ জুলাই ইণ্ডিয়া গেজেট নামক পত্রে এই এক অশুভ সমাচার প্রচার হইয়াছে যে গবর্ণমেণ্ট এক্ষণে সহমরণ নবারণের চেষ্টাতে আছেন এবং এতদ্দেশীয় এক খ্যাত ব্যক্তি সকল নগর বাসীর প্রতিনিধি ইইয়া ঐ অনুচিত বিষয়ের প্রমাণ ও প্রয়োগ লিখিয়া সমর্পণ করিতে স্বীকার করিয়াছেন এবং তিনি মহামহিম শ্রীযুত গবর্ণর জেনারেল বাহাদূরের সহিত সাক্ষাৎ করিয়াছেন এবং শ্রীযুতও এই বিষয় নিবারণে নিতান্ত মান্য প্রকাশ করিয়াছেন।” বলা বাহুল্য যে, সেই ‘খ্যাত ব্যক্তি’ স্বয়ং রামমোহন ছাড়া আর কেউই ছিলেন না। সেই উপলক্ষেই রামমোহন সহমরণ সম্বন্ধে ‘সহমরণ বিষয়’ আখ্যাত তাঁর শেষ নিবন্ধটি লিখেছিলেন। শেষে রামমোহনেরই চেষ্টায় যে ব্রিটিশ সরকার ১৮২৯ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর তারিখে যে সহমরণ নিষিদ্ধ করেছিল - সেটা এখন আর কেউ অজ্ঞাত নন। এর বিরুদ্ধে ইংল্যাণ্ডের রাজার কাছে আর্জিও পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৮৩২ সালের ১০ই নভেম্বর তারিখের একটি সংবাদপত্রে পাওয়া যায় - “শ্রীল শীযুত ইংলণ্ডাধিপতি গত জুলাই মাসের একাদশ দিবস বুধবারে প্রবি কৌন্সেলে হিন্দুদের স্ত্রী দাহ বিষয়ে ভাবতবর্ষের গবর্ণমেণ্টের ১৮২৯ সালের ৪ ডিসেম্বরের আজ্ঞা গ্রাহ্য করিয়াছেন এবং এদেশের দু’-একজন হিন্দু যে পুনরায় স্ত্রী দাহ হয় এজন্য আবেদন লিপি প্রেরণ করিয়াছিলেন, তাহা গ্রাহ্য করেন নাই।”


বঙ্গদেশে সতীদাহ বিরোধী আইন যখন জারী করা হয়েছিল, তখন ‘স্যার হ্যালিডে’ (পরে যিনি বাংলার ‘ছোটলাট’ হয়েছিলেন) হুগলীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। ওই আইন চালু হওয়ার আগে হুগলীতে একটি সতীদাহের ঘটনা ঘটেছিল। স্যার হ্যালিডের মতে সেটাই বঙ্গদেশের শেষ সতীদাহ ছিল। স্যার হ্যালিডে তাঁর লেখায় সেই শেষ সতীদাহের একটি অতি কৌতূহলোদ্দীপক বিবরণ লিপিবদ্ধ করে গিয়েছিলেন। তবে সেটির মধ্যে কতটা কল্পনা আর কতটা সত্যি মিশে রয়েছে, সেটা এখন আর যাচাই করা সম্ভব নয়। কিন্তু কাহিনীটি যে গল্পের চেয়েও বেশি রোমাঞ্চকর, তাতে কোন সন্দেহ নেই। তাই ঘটনাটিকে সরাসরি স্যার হ্যালিডের লেখার বঙ্গানুবাদ করে তুলে ধরা যাক। তবে বলে রাখা প্রয়োজন যে, ঘটনাটির বিবরণ অতীব নৃশংস ও হাড় হিম করে দেওয়া। স্যার হ্যালিডে লিখেছিলেন - “১৮২৯ সালে আইন করে সতীদাহ প্রথা নিবারণ করা হয়। সেই সময় আমি হুগলীর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। আইন চালু হবার কিছুদিন আগে আমাকে জানানো হল যে, আমার বাড়ী থেকে কয়েক মাইল দূরে একটি সতীদাহ অনুষ্ঠিত হবে। হুগলীতে এই ধরনের ব্যাপার প্রায়ই ঘটত। লোকের ধারণা ছিল, নদীর এই পাড়টাই এইরূপ পুণ্যের কাজের পক্ষে প্রশস্ত। … খবরটা যখন আমার কাছে পৌঁছাল তখন চিকিৎসা বিভাগের ডাঃ ওয়াইজ এবং গভর্নর-জেনারেলের (ভদ্রলোকের নামটা আমার মনে নেই) পুরোহিত আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। তাঁরা অনুষ্ঠানটি প্রত্যক্ষ করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। সেই অনুসারে গাড়ী করে আমরা নির্দিষ্ট স্থান অভিমুখে যাত্রা করলাম। তখন নদীর পাড়ে দেশীয় লোকদের একটি ভিড় জড়ো হয়ে গেছে। চিতা জ্বালানো হয়েছে। যিনি সতী হবেন তিনি সেই জ্বলন্ত চিতার সামনে মাটিতে বসে আছেন। আমাদের বসতে দেওয়ার জন্যে চেয়ার আনানো হল। আমরা মহিলাটির সন্নিকটে বসলাম। আমার সঙ্গীদ্বয় দেশীয় ভাষা না জানলেও মহিলাকে এই কার্য থেকে প্রতিনিবৃত্ত করার জন্যে যুক্তি প্রয়োগ করতে লাগলেন। তাঁদের বক্তব্য আমি মহিলাকে তাঁর ভাষায় তর্জমা করে শোনাতে লাগলাম। মহিলা সশ্রদ্ধ গাম্ভীর্যের সঙ্গে আমাদের প্রতিটি কথা শুনলেন। কিন্তু আমাদের যুক্তি তাঁর মনে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করতে পেরেছে বলে মনে হল না। পুরোহিত এবং সমবেত জনতাও মন দিয়ে আমাদের কথা শুনছিল। অবশেষে মহিলার মধ্যে একটু যেন চাঞ্চল্য প্রকাশ পেল। তিনি চিতায় প্রবেশের অনুমতি প্রার্থনা করলেন। আমাদের করার আর কিছু নেই দেখে আমি মহিলাকে অনুমতি দিলাম। কিন্তু চিতায় আরোহণের আগে পাদ্রী সাহেব মহিলাকে আরেকটি প্রশ্ন করতে অনুরোধ করলেন - ‘মহিলা কি জানেন, কি নিদারুণ শারীরিক যন্ত্রণা তাঁকে ভোগ করতে হবে?’ ভদ্রমহিলা আমার পায়ের কাছে বসেছিলেন। হঠাৎ দেখলাম তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত-মুখে ঈষৎ ব্যঙ্গের অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে। প্রশ্নের জবাবে মহিলা বললেন - ‘একটা প্রদীপ আনান।’ প্রদীপ আনানো হল - নৌকো ধরনের যে প্রদীপ চাষীরা সাধারণতঃ ব্যবহার করে থাকে। সেই সঙ্গে এলো ঘি আর বেশ বড় একটা সলতে। প্রদীপটা মহিলা নিজেই যথারীতি সাজালেন। তারপর বললেন - ‘এইবার জ্বালান।’ প্রদীপটা জ্বালিয়ে মহিলার সামনে রাখা হল। তারপর উপেক্ষার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে মহিলা মাটিতে কনুই রেখে একটা আঙুল প্রদীপের শিখার উপরে ধরলেন। প্রথমে আঙুলটা পুড়ে ফোস্কা উঠল, তারপরে কালো হয়ে ঝুলে পড়লো - পালকের কলম মোমবাতির উপর ধরলে যেমনটি হয়। মহিলা কিন্তু এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর আঙুল সরালেন না। একটি শব্দ করলেন না বা তাঁর মুখের অভিব্যক্তি একটুও পরিবর্তিত হল না। এইরকম কিছুক্ষণ চললো। তারপর ভদ্রমহিলা বললেন - ‘এইবার আপনার সন্দেহভঞ্জন হয়েছে তো?’ আমি বললাম - ‘হ্যাঁ, হয়েছে।’ মহিলা তখন আঙুল সরিয়ে দিয়ে দৃঢ়তাব্যঞ্জক কণ্ঠে বললেন - ‘এইবার তাহলে আমি চিতায় আরোহণ করতে পারি?’ আমরা সম্মতি দিলাম। ভদ্রমহিলা তখন ধীরে ধীরে চিতায় আরোহণ করলেন। নদীর পাড় ঘেষে চিতাটি রচনা করা হয়েছিল। চিতাটি ছিল প্রায় সাড়ে চার ফুট উঁচু, এবং প্রায় ততটাই লম্বা। চওড়া ছিল প্রায় তিন ফুট। মহিলাকে বার-তিনেক চিতাটি প্রদক্ষিণ করানো হল। তারপর তিনি চিতায় আরোহণ করলেন। উপুড় হয়ে হাতের উপর মুখ রেখে মহিলা চিতার উপরে শুলেন - যেন ঘুমাতে যাচ্ছেন। মহিলার উপরে তারপরে আর এক-পর্দা কাঠ চাপানো হল। ইচ্ছে করলেও যাতে তিনি চিতা ছেড়ে বেরোতে না পারেন সেই উদ্দেশ্যে জনতা তাঁকে চিতার সঙ্গে বাঁধতে যাচ্ছিল। আমি বাধা দিলাম। তাঁরা অনিচ্ছার সঙ্গে আমার নিষেধ শুনল। এইবার তাঁর ছেলেকে ডাকা হল চিতায় আগুন দিতে। … ভদ্রমহিলার স্বামী দূরদেশে মারা গিয়েছিলেন। তাই তাঁর দেহ আনা সম্ভব হয়নি। তার বদলে তাঁর পরিধেয়র কিছু অংশ মহিলার সঙ্গে চিতায় দেওয়া হল। তারপরে ধূপের গুঁড়ো আর ঘি দিয়ে চিতা জ্বেলে দেওয়া হল। প্রথমে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠল পাক-খেয়ে। তারপরে চিতা দপ করে জ্বলে উঠল৷ আগুনের তাপ অসহ্য না হয়ে ওঠা পর্যন্ত আমি চিতার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিলাম। কিন্তু কোন ধরণের নড়াচড়া বা যন্ত্রণার আর্তনাদ আমি শুনতে পাইনি। যে পুত্র চিতায় অগ্নি-সংযোগ করেছিল, সে-ও চিতার কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতে সে কান্নায় ভেঙে পড়ল। এইভাবে হুগলী জেলার এবং সম্ভবতঃ বঙ্গদেশের শেষ আইনসম্মত সতীদাহ অনুষ্ঠিত হলো।” বলে রাখা দরকার যে, বাংলার এই শেষ সতীদাহটি সহমরণ হয়, ‘অনুমরণ’ বা ‘অনুমৃতা’ হওয়ার ঘটনা ছিল।


হ্যালিডে সাহেব ‘সম্ভবতঃ’ লিখলেও, সরকারি নথি অনুসারে সেটাই তৎকালীন বঙ্গদেশের সর্বশেষ সতীদাহ ছিল। উপরোক্ত ঘটনাটি সম্ভবতঃ ১৮২৯ সালের নভেম্বর মাসের একেবারে শেষ দিকে অথবা ডিসেম্বর মাসের দুই তারিখের মধ্যে ঘটেছিল। সেই হতভাগিনীর নাম ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ নেই। আর থেকেও বা কি আর হত? আঠারো-ঊনিশ শতকের বাংলায় চিতার আগুনে এমন কত হতভাগিনী নারীরা জ্বলে খাক হয়ে গিয়েছিলেন, সে খবর কেই বা রেখেছিল?
©️রানা©️
(তথ্যসূত্র:
১- Memories Of Our Life Together, William Carey & Barbara Carey.
২- The Life and Writings of Bishop Heber: The Great Missionary to Calcutta, the Scholar, the Poet, and the Christian; Reginald Heber.
৩- Hutchinson’s story of the nations.
৪- Frederick James Halliday: An Autobiography, Edited by - Russell Jesse, Weidenfeld & Nicolson.)
©️রানা চক্রবর্তী©️

মন্তব্য ৬ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৬) মন্তব্য লিখুন

১| ০৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:০০

সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই বলেছেন: সময়ের অভাবে পুরোটা পড়তে পারলাম না। উইলিয়াম কেরির বর্ণনায় তো গা শিউরে উঠলো!

যারা ভুক্তভোগী, তাদের কমিউনিটি থেকেই তো সতীদাহ প্রথা রদের উদ্যোগ নিতে হবে, তাই নেয়া হয়েছিল। রানা চক্রবর্তীর আক্ষেপ তাহলে কোন জায়গায়?

০৬ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ১১:৫২

শাহ আজিজ বলেছেন: পুরোটা পড়লে বোঝা যাবে ক্ষোভটা কোথায় ।

২| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ রাত ৩:১৯

কামাল১৮ বলেছেন: স্বর্গে যাবার একটা সুন্দর পথ থেকে বঞ্চিত হলো হিন্দু নারীরা।আমাদেরটা কিন্তু খোলা আছে “জিহাদ”।

০৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ সকাল ১০:৩০

শাহ আজিজ বলেছেন: কিভাবে একটা কর্মমুখিন সমাজ গড়ে তোলা যায় সেটাকে অগ্রাধিকার দিন । এখনো নারীরা শোষিত এবং নির্যাতিত । তাদের স্বর্গের লোভ দেখিয়ে বিপথগামী না করাই শ্রেয়।

৩| ০৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:০৩

রাজীব নুর বলেছেন: রাজা রামমোহন ভারতীয় নারীদের জন্য ফেরেশতা হয়ে এসেছিলেন।

০৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ দুপুর ১:০৫

শাহ আজিজ বলেছেন: হুম , ওটাই আসল সত্যি ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.