![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
গত ৫ ফেব্রুয়ারী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক ঘোষিত আব্দুল কাদের মোল্লার রায়ের ব্যাপারে জনমনে ব্যাপক কৌতুহল এখনও বিরাজমান। সবার মনে একটাই প্রশ্ন জনাব মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (বাচ্চু রাজাকার) এর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমানিত হওয়ায় তার মৃত্যুদন্ড হয়। অপরদিকে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমানিত হলেও তার মৃত্যুদন্ড না হয়ে যাবৎজীবন কারাদন্ড হয়। দু-জনের অভিযোগ-ই প্রমানিত, তবে রায়ের ক্ষেত্রে পার্থক্য কেন? জনমনে এধরনের প্রশ্নের অবতারনা হওয়াটা স্বাভাবিক। সকল অপরাধের সাজা কি মৃর্ত্যুদন্ড? কখনই না। বলা হয়েছে- অভিযোগ প্রমানিত। আসলে অভিযোগটি কি? সেটাই মূল প্রতিপাদ্য বিষয়।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল কর্তৃক ঘোষিত জনাব মাওলানা আবুল কালাম আযাদ-এর রায়ের কপিতে অভিযোগ হিসাবে উল্লেখ করা হয়- Charges: crimes against Humanity and Genocide as specified in section 3(2)(a) and 3(2)(c)(i) of the Act No. XIX of 1973. রায়ের কপিতে উল্লেখিত অভিযোগ থেকে খুব সহজেই অনুময়ে যে, অভিযুক্ত ব্যাক্তিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (সংশোধিত) আইনের যে ধারার অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছে, সে অপরাধগুলো তিনি নিজে করেছেন অথবা অপরাধগুলো সংগঠনের জন্য তিনি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহন করেছেন। উল্লেখ্য যে, অত্র আইনের ৪(১) ধারা অনুসারে, কয়েকজন ব্যাক্তি একত্রিত হয়ে যদি ৩ ধারায় বর্নিত কোন অপরাধ করেন, তবে তিনি এমনভাবে দায়বদ্ধ হবেন, যেন তিনি একাকি অপরাধটি করেছেন। গঠিত অভিযোগ অনুসারে জনাব মাওলানা আবুল কালাম আযাদ-এর মৃত্যুদন্ড হবে-এটাই স্বাভাবিক। অপরদিকে জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার-এর রায়ের কপিতে উল্লেখ করা হয়েছে- Charges: crimes against Humanity and aiding & complicity to commit such crimes as specified in section 3(2)(a)(g)(h) of the Act No. XIX of 1973. এ ক্ষেত্রে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে সহায়তাকারী হিসাবে। একজন অপরাধী, আর অপরাধীর সহায়তাকারীর দন্ড এক হবে? অত্র আইনের ৪(২) ধারায় সহায়তাকারীর দায়বদ্ধতা সম্পর্কেও বলা হয়েছে। তবে, এ ধারার কোথাও বলা নেই যে, অপরাধ সংগঠনের জন্য আদেশদান, অধস্তনদের নিয়ন্ত্রনে ব্যর্থতা অথবা দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার অপরাধকে, একাকী অপরাধ সংঠনের পর্যায়ভুক্ত হিসাবে ধরে নেয়া হবে। আর তাই হয়ত গঠিত অভিযোগ অনুসারে আদালত কর্তৃক জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার মৃত্যুদন্ড দেওয়া সম্ভব হয়নি বলে আমি মনে করি।
রায়ের বিরুদ্ধে প্রসিকিউটরের আপিল নিয়েও তৈরী হয়েছে ধুম্রজাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল (সংশোধিত) আইনের ২১ ধারা মতে, প্রসিকিউটর কেবল মাত্র খালাসের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। অনেকেই মনে করেন-সংবিধান অনুযায়ী প্রসিকিউটর আপিল করতে পারবেন। যারা ইহা মনে করেন, আমার মনে হয়, তারা কেবল সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদটি-ই পড়েছেন। তাদের উচিত সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদের পাশাপাশি ১৩১ অনুচ্ছেটিও ভালোভাবে পড়া। উল্লেখ্য যে, জেল হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সম্পূর্ন ন্যায় বিচারের জন্য আপিল বিভাগের কাছে আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু আপিল বিভাগ সে আবেদন গ্রহন করেননি।
যাই হোক, জনাব আব্দুল কাদের মোল্লার রায় ঘোষনার পর থেকে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে রাজধানীর শাহবাগ লোকে লোকারন্য। কারো দাবী বিবেচনায়তো আদালত রায় দিতে পারেন না। আদালত রায় দিবে স্বাক্ষ্য-প্রমানের ভিত্তিতে। প্রসিকিউটর যদি প্রয়োজনীয় স্বাক্ষ্য-প্রমান হাজির না করতে পারেন, তবে আদালতের কি করার আছে। আমরা যারা শাহবাগে ফাঁসির দাবিতে আন্দোলন করতেছি-আমরা কেউ কি দেখেছি, তারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন কি না? যেহেতু আন্দোলনকারীদের বেশিরভাগ-ই তরুন, তাই উত্তর হয়ত একটাই হবে যে, আমরা কেউ দেখি নি, শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় বর্তমান বাংলাদেশের শতকরা একশতভাগ লোক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে নিশ্চয় ছিলেন না। যদি মুক্তিযুদ্ধের সময় যদি শতকরা পাঁচভাগ লোক মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে থেকে থাকেন, তারা সবাই কি যুদ্ধাপরাধী? অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে অবস্থানকারী এবং যুদ্ধাপরাধীদের এক পাল্লায় মাপতে চান। আসলে বিষয়টা তা নয়। যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অপরাধমূলক কার্য সংগঠিত করেছেন বা করতে সহায়তা করেছেন, তারাই কেবল যুদ্ধাপরাধী। আর এ অপরাধ প্রমানের বিষয়। এ ক্ষেত্রে প্রসিকিউটরের ভুমিকাই প্রধান। কেউ যদি প্রকৃতপক্ষেই যুদ্ধাপরাধী হয়ে থাকে, আর প্রসিকিউটর যদি যথাযথ স্বাক্ষ্য প্রমানাদী দাখিল করতে ব্যর্থ হয়, তবে তা প্রসিকিউটরের ব্যর্থতা। কে যুদ্ধাপরাধী তা নির্ধারন করবেন আদালত, প্রমানের জন্য স্বাক্ষ্য-প্রমানাদী দাখিল করবেন প্রসিকিউটর, শাহবাগ স্বয়ার নয়। অনেক মন্ত্রী-এমপিরাও কোন ব্যাক্তির নাম ধরে যুদ্ধাপরাধী আখ্যা দিয়ে থাকেন। ইহা কি ঠিক? আদালত কর্তৃক প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত নির্দ্দিষ্ট করে কাউকে যুদ্ধাপরাধী বলা সঠিক নয় বলে আমি মনে করি। রাজধানীর শাহবাগে জনতার সমাবেশ থেকেও নাম উল্লেখপূর্বক অনেককে যুদ্ধাপরাধী বলে যাচ্ছেন। তাদের কাছে কি প্রমান আছে? যদি থাকে, তবে প্রসিকিউটকে দিয়ে যুদ্ধাপরাধী প্রমান করতে সহায়তা করাই হবে উত্তম কাজ। শাহবাগ থেকে দিনের পর দিন গলা ফাটিয়ে ফাঁসি চেয়েও লাভ নেই, যদি প্রমান না থাকে।
শোনা যাচ্ছে, ট্রাইবুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিষয়ে আইন সংশোধন করা হবে। সরকার চাইলে সব-ই পারেন। কিন্তু সেটার গ্রহনযোগ্যতাতো থাকতে হবে। একজন ব্যাক্তি বা একটি নির্দ্দিষ্ট গোষ্টিকে ফাঁসিতে ঝুলানোর প্রয়াসে আইন সংশোধন কি বিচারের স্বচ্চতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে না? আইন সংশোধন করা হোক বা না হোক, স্বচ্ছ বিচারের মাধ্যমে কাউকে মৃত্যুদন্ড দিতে হলে অবশ্যই অপরাধ প্রমান করতে হবে। এ ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক ভেবে চিন্তে সিদ্ধান্ত না নিয়ে মনগড়া সিদ্ধান্ত নিলে হিতে বিপরীতও হতে পারে। বিচারের নামে প্রহসনের অপবাদ থেকে মুক্তি পেতে হলে দল মত নির্বিশেষে সকল যুদ্ধাপরাধীদেরকেই বিচারের কাঠ গড়ায় দাড় করাতে হবে। কে আত্মীয়, আর কে দলীয়, সে বিবেচনায় বিচার করলে- সে বিচার জনগনের কাছে গ্রহনযোগ্যতা পাবে না। সাধারন জনগন শুধু জামায়তপন্থী যুদ্ধাপরাধীদের নয়, সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায়। শাহবাগে জনতার ঢল দেখে বর্তমান সরকারের এ ভেবে খুশি হবার কোন কারন নাই যে- জনগন পদ্মাসেতুর দূর্নীতি, হলমার্ক কেলেংকারী, শেয়ার বাজার কেলেংকারী, ইলিয়াস আলী গুম, সাগর রুনি হত্যা ইত্যাদির কথা ভুলে গেছেন। মনে রাখতে হবে- সকল কর্মকান্ডের জন্যই জনগনের কাছে জবাবদিহী করতে হবে। এ মহুর্তে সরকারের উচিৎ শাহবাগে অবস্থানকারীদের যার যার বাসায় ফিরে যেয়ে, যাদেরকে তারা যুদ্ধাপরাধী ভাবছেন, তাদের অপরাধ প্রমানের জন্য স্বাক্ষ্য-প্রমান সংগ্রহ করে প্রসিকিউটরকে সাহায্য করতে আহবান করা।
©somewhere in net ltd.