নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

কোন এক সময় লেখালেখি শুরু করবো। এখন যা লিখছি তা সেই সময়ের জন্যে প্রস্তুতি আসলে। আর লেখার জন্যে নতুন নতুন তথ্য যোগাড় করছি আপাতত।

ফায়েজুর রহমান সৈকত

মুক্ত সকল চিন্তা করি, নিজের সাথে নিজেই লড়ি।

ফায়েজুর রহমান সৈকত › বিস্তারিত পোস্টঃ

চট্টগ্রাম দেখতে যাই (৩য় পর্ব)

০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১০:৫৩


পরের দিন ভোর ঠিক ৫টা ৩০ মিনিটে আমাদের বাস চট্টগ্রাম থেকে রাঙ্গামাটির দিকে রওয়ানা হয়। কোন মতে ঘুম থেকে উঠে ব্যাগ পত্তর গুছিয়ে নিয়ে বাসে উঠলাম। বাসে বসে আবার একচোট ঘুমিয়ে নিবো কিনা ভাবছি কিন্তু ভোরবেলার শান্ত স্নিগ্ধ চট্টগ্রাম দেখে আর ঘুমাতে ইচ্ছা করলোনা। জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে ঘুম কেটে গেল। এইসব ভোরবেলায় আলাদা একটা মায়া মেশানো থাকে যেন। ছোটকালে প্রতিদিন ভোরে উঠে আম্মা আমাদেরকে মক্তবে পাঠাতো। হাতে একটা রিহাল নিয়ে এক দৌড়ে মক্তবে চলে যেতাম। সেখানে গিয়ে পাড়ার ছেলেমেয়েরা একসাথে বসে গলা ফাটিয়ে কায়দা পড়তাম। পড়ে টরে বাসায় আসলে আম্মা খাইয়ে দিতো। জানালা দিয়ে ছোট ছেলেমেয়েদের মক্তবে যাবার দৃশ্য দেখে সেই কথা মনে পড়ে গেল। ভোরবেলায় শ্রমিকেরা দলবেধে কাজে যায়। তাদের মাঝে আমি বুড়ো তোরাব শেখকে খুঁজি। শহীদুল জহিরের রগচটা তোরাব শেখ নিশ্চয়ই এদের মাঝেই কেউ একজন হবে। দেখি একদল নারী পুরুষ ফাঁকা রাস্তায় ব্যায়াম করছে। এদের কেউ হাঁটছে আর কেউ দৌড়াচ্ছে। আম্মার ডায়াবেটিস ছিল। সাত বছর আগে আম্মাও এভাবে হেঁটে হেঁটে ব্যায়াম করতো। আজকাল ভুঁড়ি বেড়ে যাওয়ায় আমি ভাবছিলাম ভোরে উঠে ব্যায়াম ট্যায়াম করবো কিন্তু আলসেমির কারণে আর উঠতে পারিনা। এইসব ভাবতে ভাবতে সকালের আলো ফুটে উঠলো। এদিকে ক্ষুধায় পেট চুচু করতে শুরু করেছে। বাস থামিয়ে রাস্তার পাশে একটা হোটেলে আমরা সকালের খাবার খেলাম।

খেয়ে দেয়ে আবার যাত্রা শুরু হলো। জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। একটু পরে দেখি বিশাল মাছের বাজার। সোনাই নদীর পাশে আমার এলাকা। সেখানে প্রতিদিন মাছের হাট বসে। বাড়ি গেলে আব্বার সাথে বাজারে যাই। বাপ পুতে মিলে বেছে বেছে কয়েক জাতের মাছ কিনে আনি। মাছ আমার প্রিয় খাবার বলে মাছ বাজার দেখলে আমার কৌতুহল জাগে। কিন্তু এইখানের মাছ দেখে বেশিরভাগ মাছই চিনতে পারিনি। মনে পড়লো সমুদ্রের দেশে এসেছি। তাই অজানা মাছ দেখে অবাক হবো এটিই তো স্বাভাবিক।
কৌতূহলী চোখে বাইরে চেয়ে আছি। দ্রুত গতিতে বাস চলছে। এবার ঝোপঝাড় আর পাহাড় ঘেঁষা আঁকাবাঁকা পথ দেখে বুঝতে পারলাম রাঙ্গামাটির কাছাকাছি চলে এসেছি। আরেকটু সামনে যেতেই দেখি দুই পাহাড়ের মাঝ দিয়ে বয়ে গেছে বিশাল নদী। আর আশ্চর্য সেই নদীর পানি একেবারে গাড় নীল। পাহাড়ের মাঝে জমে আছে কুয়াশা। সূর্য তখন চোখের সামনে তাই ভাল মতন তাকানো যায় না। সূর্যের আলো নদীর পানিতে পড়ে ঝিকিমিকি করছে। হঠাৎ এমন দৃশ্য দেখে ভীষণ মুগ্ধ হয়ে গেছি। সবার সিদ্ধান্তে গাড়ি থামানো হলো। ক্যামেরা বের করো নদীর কিছু ছবি তুলে নিলাম। নিজেরাও নদীর সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুললাম। তারপর স্থানীয় এক লোকের কাছ থেকে জানতে পারলাম এটি শিলছড়ি নদী। ইন্টারনেট ঘেটে শিলছড়ি নদী সম্পর্কে চমৎকার কিছু তথ্য পেলাম,

“ শিলছড়ি নদী কর্ণফুলি নদীর একটি উপনদী। কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা সড়ক বরাবর এই নদী কাপ্তাই থেকে ১০ কিমি পশ্চিমে। সীতাপাহাড় উত্তলভঙ্গের উত্তরাঞ্চল থেকে উদ্ভূত এই উপনদী ভূবন স্তরসমষ্টির শিলা দ্বারা গঠিত। নদীটির দৈর্ঘ্য মাত্র ১.৩ কিমি। শিলছড়ি বাজারের নিকট এটি কর্ণফুলিতে পতিত হয়েছে এবং এর মোহনায় ক্ষুদ্রাকৃতির একটি বদ্বীপ গঠিত হয়েছে। নদীটির মধ্যভাগের তলদেশে পার্শ্বিক ভাঙন ও অবক্ষেপ সংঘটিত হয়েছে। মধ্যভাগের তলদেশের মৃদু ঢাল ও বিসর্পিলতা এর পরিপক্ক পর্যায়ের প্রমাণ। শিলছড়ি বাজার থেকে প্রায় ২৯০ মিটার উজানে বেশকিছু অনুক্রমিক প্রাকৃতিক জলপ্রপাত রয়েছে। এগুলোকে নদীপ্রপাত (rapids) বলা হয়। সবচেয়ে উলে¬খযোগ্য নদীপ্রপাতটি প্রায় ৩৩৫ মিটার উজানে অবস্থিত। এসব নদীপ্রপাত নরম কর্দমশিলার তলদেশ দ্বারা অধিশায়িত তুলনামূলকভাবে শক্ত বেলেপাথরের তলদেশ দ্বারা সৃষ্ট। শিলছড়ি নদীর উজানে অবস্থিত সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক জলপ্রপাতটির জলধারা ১৫.২৪ মিটার উঁচু থেকে সরাসরি উল¬ম্বভাবে সবেগে আছড়ে পড়ছে। [সিফাতুল কাদের চৌধুরী, বাংলাপিডিয়া] ”

এই নদী আমায় এতটাই মুগ্ধ করেছে যে পণ করেছি সুযোগ পেলে কখনো নৌকা দিয়ে এর গর্ভে বেড়িয়ে আসবো। সাথে সঙ্গিনী থাকলে তাকে বলবো, শিলছড়ির কাছে দেওয়া ওয়াদা আজ পূর্ণ করেছি। এই খুশিতে চলো এক কাপ চা খাওয়া যাক এবার।

রাঙ্গামাটির নাম শুনলে আমি প্রায়ই দুইটি গান গুনগুন করে গাইতে শুরু করি। একটি রবী ঠাকুরের “গ্রাম ছাড়া ওই রাঙ্গামাটির পথ আমার মন ভুলায় রে।“ ছোটবেলায় কারেন্ট চলে গেলে অন্ধকার ঘরে শুয়ে আব্বা এই গান সুর করে গাইতো। তখন মনে করতাম রাঙ্গামাটি বুঝি কত সুন্দর, বিশ্বকবি মুগ্ধ হয়ে একেবারে গান বেঁধে ফেলেছেন। বড় হয়ে বুঝলাম কবি তার গাঁয়ের রাঙ্গা মেঠো পথকে নিয়ে গান বেঁধেছিলেন। আরেকটি গান আছে অরুণ চক্রবর্তীর “হাই দ্যাখো গ’ তুই ইখানে কেনে, লাল পাহাড়ির দ্যাশে যা, রাঙা মাটির দ্যাশে যা, হেথাকে তুকে মানাইছে নাই গ’, ইক্কেবারেই মানাইছে নাই গ।“ অনুজ রাহিম এই গানটিকে এত মজা করে গায় যে তার কন্ঠে শুনলে মনে হয় সব ছেড়েছুড়ে এক্ষুনি রাঙ্গামাটির দেশে চলে যাই।

এবার নদী ভ্রমণ। বাস থেকে নেমে আমরা তিনটা মাঝারি সাইজের নৌকা ভাড়া করি। গন্তব্য দেশের সর্ব বৃহৎ বৌদ্ধ মন্দির রাঙ্গামাটির রাজ বন বিহার। কর্নফুলি নদীতে আমাদের নৌকা যখন চলতে শুরু করলো তখন সময় ঠিক বারোটা। সূর্য একেবারে মাথার উপর। কিন্তু ছোটকাল থেকে শোনা কর্নফুলি নদী আর নতুন নতুন জায়গা দেখার উত্তেজনায় রোদের তাপ ফিল করিনা। সবাই নৌকার মাচায় বসে গান গাই। আমাদের সাথে স্থানীয় একটি ছেলে ছিল। তার কাছে এই এলাকার গল্প শুনি। সে দেখায় ওইযে দূরে কাপ্তাই বাঁধ। দেশের সবচেয়ে বড় এই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রতিদিন প্রায় ২৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। সেচ ও পানি ব্যবস্থাপনা অনুষদের শিক্ষার্থী হওয়ায় বাঁধ নিয়ে বিস্তর পড়ালেখা করতে হয়েছে আমাদের। তাই দূর থেকে আগ্রহ সহকারে বাঁধ দেখি। ছেলেটি জানায় আমরা এখন কাপ্তাই হ্রদের উপর। ২৪৯৯ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম মনুষ্যসৃষ্ট স্বাদুপানির হ্রদ। এত বড় মনুষ্যসৃষ্ট স্থাপনার উপর দিয়ে চড়ে আমাদের আনন্দ অনুভব হয়। কিন্তু তাও আমি আনন্দিত হইতে পারিনা। এই হ্রদের করুণ ইতিহাস শুনে আমি বেদনায় কাতর হই। এক লক্ষ আদিবাসী চাকমার কাছে আমি লজ্জিত হই। আমি জড়োসড়ো হয়ে নৌকার এক কিনারে বসে থাকি।

“একদিন হঠাৎ করে
কোত্থেকে সব ঘরবাড়ি আর জমিন উদয় হলো।
প্রভু তবে সবকিছু কি আবার ফিরায় দিল?

বাষট্টিতে ঘর ডুবালো, দোর ডুবালো,
প্রাণটা ছাড়া রাতারাতি যা ছিল তার সব চুবালো।
ফাঁদ পেতে এক বাঁধ বেঁধে
সমতলীরা উঠলো মেতে
ঘরে তাদের বাতি পাখা টিভি সুদ্ধ এলো।
ওইদিকে এক রাত্রি বেলায়
ভীষণ পানির জোয়ার এসে
পাহাড়িদের স্বপ্নগুলো সবটা কেড়ে নিলো।

কি অসহায় মানুষ গুলো পানির ডরে পলায় গেলো।
সুখে দুঃখের সঙ্গী ভিটে মাটিসুদ্ধ জলায় গেল।
প্রিয় রাজার রাজবাড়িটি আহারে সেদিন তলায় গেল।
হঠাৎ নাকি ঘরবাড়ি আর জমিন উদয় হলো?
প্রভু তবে সবকিছু কি আবার ফিরায় দিল?

আর কি তারা ফিরবে ঘরে?
আর কি ফসল পাহাড় বুকে
অট্টহেসে উঠবে ভরে?
এক লক্ষ পাহাড়ি সব
আর কি আসবে ফিরে?

এই কথাটি আর কতবার
ঘুরেফিরে বলছি আবার,
মাগো তুই ঘুমা এখন।
কাপ্তাই তোর সাড়াটা জনম
খাইলো চিড়ে চিড়ে।“

প্রায় দুই ঘন্টা নৌকায় চড়ে অবশেষে আমরা রাজবন বিহারে পৌছাইলাম। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে হোলি প্লেস রাজবন বিহারে ঢুকতেই স্বর্গের সপ্ত সিঁড়ি পড়লো। এর আরেকটি নাম হলো, অষ্টমার্গ। সপ্ত সিঁড়ির প্রথম তলায় মনুষ্যলোক ভূমি অবস্থিত। তারপরে একে একে স্বর্গের ছয়টি ধাপ,
-চর্তুমহারাজিক
-তাবতিংস স্বর্গ
-যাম স্বর্গ
-তুষিত স্বর্গ
-নির্ম্মানরতি স্বর্গ
-পরনির্মিত বশবর্তী স্বর্গ।
স্বর্গ আমাদের কত কাছে ভেবে অভিভূত হলাম। রাজবন বিহারের কাছাকাছি আমার প্রাক্তন রুমমেট অনির্বানদের বাড়ি। তার কাছে এই রাঙ্গামাটির কত গল্প শুনেছি। আমরা যে এখানে আসবো সেটি ও জানতো। তাই আমাদের জন্য বাড়ি থেকে সে পাকা কলা নিয়ে আসলো। অনির্বান আমাদেরকে আশেপাশের এলাকা ঘুরিয়ে দেখালো। দেখি সেখানে চাকমা মেয়েরা নিজের হাতে তৈরি শাল বিক্রি করছিলো। সেখান থেকে আম্মা, শশী আর চাচীর জন্য শাল কিনলাম। রাজবন বিহার আর রাজ মন্দির ঘুরে তারপর আমরা কর্নফুলির ঝুলন্ত ব্রিজ দেখতে গেলাম। টিভিতে আর সিনেমার গানের দৃশ্যে ঝুলন্ত ব্রিজ দেখে একে যেরকম সুন্দর ভেবেছিলাম সামনা সামনি তত সুন্দর লাগেনি। ব্রিজ দেখে তারপর ফেরার জন্য আমরা রওয়ানা হলাম। তখন প্রায় সন্ধ্যা হয়ে আসছে। সূর্য হেলে পড়েছে। নৌকার মাচাইয়ে গোল হয়ে বসে আমরা করিমের গান ধরলাম। আমাদের সাথে ছিলেন মোক্তাদির ভাই। তার কন্ঠে করিমের ভাটিয়ালি গান শুনলে মন বিষণ্ণ হয়ে উঠে। মুক্তাদির ভাইয়ের সাথে আমি, মোতাহের আর রোকনও গলা ছেড়ে গাইলাম। অচেনা কাপ্তাই হ্রদে ভেসে ভেসে বাউল করিম নেমে আসলেন আমাদের কাছে। তিনিও গাইলেন আমাদের সাথে। ধীরে ধীরে সূর্য ডুবে গেলো। নৌকা থেকে নেমে আমরা আবার বাসে উঠলাম। এবারের গন্তব্য সৌন্দর্যের বরপুত্র বান্দরবান জেলা। রাত নটার দিকে বান্দরবান শহরে পৌঁছে আমরা হিলভিঊ হোটেলে উঠলাম। সারাদিনের ভ্রমণের পরে শরীর একেবারে নিস্তেজ হয়ে পড়েছিল। গোসল করে, খেয়ে দেয়ে তাই সোজা বিছানায় চলে গেলাম। আগামীকাল বিস্ময়কর কিছু অপেক্ষা করছে। চান্দের গাড়িতে করে ঘুরবো এই ভেবে ভাল লাগার অনুভূতি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

ভ্রমণের ২য় দিন শেষ হইলো।

(চলবে. . . . .)

(ছবি, শিলছড়ি নদী

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১১:৩৮

ওমেরা বলেছেন: কি গান গেয়েছিলেন তা তো বল্লেন না ভাইয়া ।

২| ০৯ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ১:২০

কালীদাস বলেছেন: মুটামুটি পরিচিত রুটই। নদীর ব্যাপারে আপনার ফিলিংসটা সেরকম দেখা যায় ;)
শিলছড়ি নদীর ছবিটা সুন্দর এসেছে।

১৩ ই ডিসেম্বর, ২০১৭ বিকাল ৪:২২

ফায়েজুর রহমান সৈকত বলেছেন: নদীর ধারে বেড়ে উঠেছি তো তাই ফিলিংস টা বেশি।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.