![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
‘ভারতবর্ষ এখনো আর্নেস্ট জোনসের স্মৃতির প্রতি যথাযোগ্য শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেনি।’ কথাটি ভারতের বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ ইরফান হাবিবের। আর্নেস্ট জোনস ইংল্যান্ডের চার্টিস্ট আন্দোলনের অন্যতম নেতা এবং ইংরেজি সাহিত্যের বিশিষ্ট কবি। ১৮৪৮ সালে ডাউনিং স্ট্রিটে চার্টিস্টদের সবুজ পতাকা ওড়ানোর হুমকি দেয়ার অভিযোগে কারাগারে পাঠানো হয় তাকে। কবিতা আর বিদ্রোহমূলক লেখা লিখবেন এমন আশঙ্কায় জেলখানায় তাকে কাগজ-কলম দেয়া হতো না। তার বদলে জোনসকে ধরিয়ে দেয়া হয় ওল্ড টেস্টামেন্ট। কিন্তু এত কিছু করেও থামানো যায়নি আর্নেস্ট জোনসকে। কারাবন্দি থাকা অবস্থায় নিজের শরীর চিরে রক্ত বের করে ১৮৫১ সালে সেই ওল্ড টেস্টামেন্টের পাতায় পাতায় একটি কবিতা লেখেন তিনি। কিন্তু না, কবিতার বিষয় তো ইংল্যান্ড কিংবা চার্টিস্ট আন্দোলন নয়, কবিতার বিষয় ভারত, ভারতের মানুষের বিদ্রোহের পূর্বাভাস, সিপাহি বিদ্রোহের পূর্বাভাস। কবিতার নাম ‘দ্য রিভল্ট অব হিন্দুস্তান’ বা ‘দ্য নিউ ওয়ার্ল্ড’। জোনসের বয়স তখন ৩২। ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহের প্রাণ ছিলেন সিপাহিরা। আর ১৮৫১তে জোনসের ‘দ্য রিভল্ট অব হিন্দুস্তান’ কবিতার ভারতীয় বিদ্রোহের পুরোভাগেও রয়েছেন সিপাহিরা। কবিতায় জোনস লিখেছেন-
''And sepoy soldiers, waking band by band
At last remember, they have a fatherland!
Then flies the huntering judge, the pandering peer
The English pauper grown a nabob here!
Counting house tyranny and peddler pride
While blast of freedom sweep the countryside.''
১৮৫৭ সালে সত্যিই শুরু হলো সিপাহিদের নেতৃত্বে ভারতের মহাবিদ্রোহ। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঔপনিবেশিক শাসনবিরোধী বিদ্রোহ। ১ লাখ ২০ হাজারের বেশি ভারতীয় সিপাহি যোগ দেন এ মহাবিদ্রোহে। ইতিহাসে এত বেশি পেশাদার সৈন্যের বিদ্রোহ করার নজির দ্বিতীয়টি নেই। সিপাহি বিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর জেলখানায় এ বিদ্রোহ নিয়ে জোনসের রক্তে লেখা কবিতাটি ছেপে বিতরণ করা হয়। কবিতাটি মৃত স্ত্রীকে উৎসর্গ করে তিনি লেখেন ‘তোমার সমাধিতে মর্মর সৌধ তোলার সঙ্গতি নেই। হৃদয় নিংড়ানো এই কবিতা তোমায় দিলাম।’ কবিতার ভূমিকায় তিনি আরেক ইতিহাস লিখলেন। তখন একটি বিখ্যাত সাম্রাজ্যবাদী স্লোগান ছিল : ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সূর্য কখনো অস্ত যায় না।’ ইংল্যান্ডের মাটিতে দাঁড়িয়ে জোনস এ স্লোগানের বিরুদ্ধে কবিতার ভূমিকায় লিখলেন ‘ব্রিটিশ উপনিবেশে সূর্য কখনো অস্ত যায় না ঠিকই, কিন্তু সেখানে রক্তের দাগও কখনো শুকিয়ে যায় না।’
আর্নেস্ট চার্লস জোনস ১৮১৯ সালের ২৫ জানুয়ারি বার্লিনে এক অভিজাত পরিবারে জন্ম নেন। তার পিতা মেজর চার্লস জোনস ছিলেন ডিউক অব কাম্বারল্যান্ডের ব্যক্তিগত সহকারী। পড়াশোনা করেন অভিজাতদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেন্ট মাইকেল কলেজে। ১৮৪৪ সালে ব্যারিস্টার হন। ১৮৩৮ সালে জোনসের পরিবার বার্লিন ছেড়ে চলে এসেছিল ইংল্যান্ডে। ছাত্রাবস্থাতেই বিয়ে করেন ১৮৪১ সালে। বিয়ে করেন কাম্বারল্যান্ডের এক ভ‚স্বামীর মেয়ে জেন অ্যাথার্লিকে। জোনসের যখন বয়স ১১ তখনই প্রথম তার কবিতা ছাপা হয়েছিল। ছোটবেলা কেটেছে জার্মানির ব্লাক ফরেস্ট অঞ্চলে। ১১ বছর বয়সে জামাকাপড়ের বান্ডিল নিয়ে ব্লাক ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে রওনা হন পোলিশ বিদ্রোহীদের সহায়তা করতে। সেবার নিখোঁজ ছিলেন তিন দিন। ১৮৪৬ সালের আগস্ট মাসে বের হয় তার কবিতার বই ‘চার্টিস্ট সং’। আইন ব্যবসা বাদ দিয়ে শুরু করেন চার্টিস্ট আন্দোলন। তার সঙ্গে যুক্ত হন জর্জ জুলিয়ান হার্নে। এ সময় এ দুজনের সাক্ষাৎ ঘটে ইতিহাসের অনন্য দুই নায়কের সঙ্গে, তারা কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। মার্ক্স-এঙ্গেলসের প্রভাবে জোনসের মধ্যে আসে বামপন্থী চিন্তাধারা। জোনস বলেন, এবার চার্টিস্টদের ‘ওয়ার্কার্স পার্টি’ তৈরি করতে হবে। জোনসকে প্রথম আন্তর্জাতিকের সদস্য করতে চেয়েছিলেন কার্ল মার্ক্স এবং ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস। কিন্তু রাজি হননি জোনস। জোনসের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘দ্য পিপল’স পেপার নামক একটি পত্রিকায় নিয়মিত লিখেছেন কার্ল মার্ক্স। মার্ক্সের অনেক চিঠি এবং লেখায় জোনসের প্রতি তার শ্রদ্ধার প্রকাশ ঘটেছে।
১৮৪৮ সালের ৬ জুন এক ভাষণে জোনস বলেন, শিগগিরই ডাউনিং স্ট্রিটে চার্টিস্টদের সবুজ পতাকা উড়বে। পরিণামে রাজদ্রোহের অভিযোগে দুবছরের জন্য কারাগারে পাঠানো হয় জোনসকে। জেলে তাকে রাখা হয় সলিটারি সেলে। ১৩ ফুট, ৬ ফুট ছিল সেই সেল। এ কারা মেয়াদেই তিনি লেখেন, ‘দ্য রিভল্ট অব হিন্দুস্তান’। জেল থেকে বেরিয়ে নতুন উদ্যমে কাজে নামেন জোনস। ঘোষণা দেন, ‘চার্টিস্ট থেকে আমি এখন প্রজাতন্ত্রী হয়েছি। এখন আমার অঙ্গীকার, ডাউনিং স্ট্রিটের মাথায় লাল পতাকা ওড়াব।’
‘দ্য রিভল্ট অব হিন্দুস্তানে’ আর্নেস্ট জোনস একদিকে যেমন সিপাহিদের নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলেন তেমনি আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনারও ইঙ্গিত রেখেছিলেন। সেটি হলো এ বিদ্রোহে মধ্যবিত্তের ভূমিকা কেমন হবে। বিদ্রোহের ৫ বছর আগেই জোনস তার প্রতিভাদীপ্ত দূরদৃষ্টিতে দেখেছিলেন বিদ্রোহের প্রতি মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত শ্রেণির মুখ ঘুরিয়ে নেয়া এবং প্রতারণা। জোনস কবিতায় লিখেছিলেন-
'From town to town-resounds the enlivening cheer
The danger past-the middle class appear.
Still blood the masses-but they lull the storm
Disarm!-go home!-and wait while-we reform.'
মহাবিদ্রোহে ভারতের ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি সরকারি কর্মচারীদের ইংরেজদের প্রতি আনুগত্য ছিল প্রশ্নাতীত। এজন্য ঐতিহাসিক এল নর্টন তার ‘টপিকস ফর ইন্ডিয়ান স্টেটসম্যান’ গ্রন্থে শিক্ষিত ভারতীয়দের কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন। ১৮৫৮ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের লর্ড সভায় আর্ল গ্র্যানবিল ভারতীয় শিক্ষিত শ্রেণির মহাবিদ্রোহে অংশ না নিয়ে ইংরেজদের অনুগত থাকার বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন। বিনয় ঘোষ ১৮৫৭ সালের মহাবিদ্রোহে বাংলার ইংরেজি শিক্ষিত শ্রেণির ভূমিকাকে দাসসুলভ বলে চিহ্নিত করেন।
শুধু এ কবিতাই ভারতের মহাবিদ্রোহে জোনসের একমাত্র অবদান নয়। মহাবিদ্রোহ শুরু হওয়ার পর নিজের সব লেখা আর প্রকাশ্য ভাষণে ইংল্যান্ডের মাটিতেই অকুণ্ঠচিত্তে সমর্থন দিয়েছেন মহাবিদ্রোহকে আর সমালোচনা করেছেন ব্রিটিশরাজের। সিপাহি বিদ্রোহের শুরুর তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ১৮৫৭ সালের ২২ জুন। সে অনুযায়ী প্রস্তুতি চলছিল সিপাহিদের ব্যারাক আর গ্রামের কৃষকদের মধ্যে। ঠিক একশ বছর আগে ১৭৫৭ সালের ২২ জুন পলাশীর প্রান্তরে ভারতের স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর সে কথা মাথায় রেখেই বিদ্রোহের তারিখ নির্ধারিত হয়েছিল ২২ জুন। কিন্তু বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল মার্চেই। ২৯ মার্চ ব্যারাকপুরে ফাঁসিতে ঝোলানো হলো মঙ্গল পান্ডেকে। প্রতিশোধ নিতে বিভিন্ন স্থানে সিপাহিরা বিদ্রোহ করলেন। ৪ জুলাই জোনস বলেন, “... তোমাদের, ইংল্যান্ডের শ্রমজীবী মানুষদের আহবান জানানো হবে রক্ত ঝরিয়ে এবং চরম মূল্য দিয়ে এক চরমতম অন্যায় অধিগ্রহণকে রক্ষা করার জন্য, যা মানবতাবাদের ইতিহাসকে চিরকালের মতো কলঙ্কিত করেছে। ইংরেজগণ! হিন্দুরা (অর্থাৎ হিন্দুস্তান বা ভারতের অধিবাসীরা) এখন মানুষের সর্বাধিক পবিত্র সবকিছুর জন্যই সংগ্রামে রত। পোলিশ, হাঙ্গেরিয়ান, ইতালিয়ান, আইরিশদের উদ্দেশ্য এর চেয়ে বেশি ন্যায্য বা পবিত্র নয়... তোমাদের, ইংল্যান্ডের জনগণকে আহবান জানানো হবে রক্ত ও সম্পদ খরচ করে বিশ্ব দুনিয়ার জ্ঞাত মহানতম আন্দোলনগুলোর মধ্যে একটিকে ধ্বংস করার জন্য... হে দেশবাসী! অন্যদের স্বাধীনতার ধ্বংসলীলায় যোগদানের তুলনায় তোমাদের আরো উন্নত কিছু করার দায়িত্ব আছে। তা হলো, তোমাদের নিজেদের জন্য লড়াইয়ে নামা।”
এরপর আগস্ট মাসে জোনস সিপাহি বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলন হিসেবে মূল্যায়ন করলেন।
১ আগস্ট লিখলেন, “শুরু থেকেই এই বিদ্রোহ সামরিক বাহিনীর বিদ্রোহ নয়, এক জাতীয় আন্দোলনের রূপ নিয়েছে।”
সিপাহিদের সীমাবদ্ধতা নিয়েও সতর্ক ছিলেন তিনি। তারপরও দৃঢ়ভাবে সমর্থন জানিয়ে গেছেন ভারতের সংগ্রাম আর স্বাধীনতাকে। তিনি লিখেছেন, “আন্দোলনকারীরা নিজেদের মধ্যে বিবাদে জড়িয়ে পড়তেই পারে; ওরা কান্ডজ্ঞানহীনতার পরিচয় দিতেই পারে... একটি বিষয়ে আমরা নিশ্চিত যে, এই অভ্যুত্থান দমিত হোক বা না হোক, ভারতবর্ষে আমাদের পরাজয়ের এ এক পূর্বাভাস... আমাদের পরামর্শ হলো... ভারতীয় জাতির স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয়া হোক... একশ বছর (আগে)... এক বিদেশি জাতি, এই পৃথিবীতে যারা ফেরিওয়ালা, লিডেনহাল স্ট্রিটের বণিক-দস্যুরা, ছলচাতুরীর মাধ্যমে এই প্রবল সাম্রাজ্য সমাবেশের হৃদয় হরণ করেছে এবং লুট করে নিয়েছে তার মহারত্ন স্বাধীনতা... সেই একশ বছরের শাসনের মধ্যে সহস্র বছরের অপরাধকে চাপিয়ে দেয়া হয়ছে।”
বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে আহত বা পঙ্গু ব্রিটিশ সৈন্যদের সাহায্যার্থে ত্রাণ তহবিল গঠিত হয়েছিল। জোনস ইংল্যান্ডের শ্রমিকদের কাছে দাবি জানান তারা যেন এই তহবিলে কোনো অর্থ দান না করেন। জোনসের কথায় “আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করতে চাই যে, এই তহবিলে একটা পয়সা দান করাও শ্রমজীবীদের পক্ষে ঘোরতর অপরাধ। একদল স্বার্থন্বেষী, অর্থপিপাসু হাঙর শয়তানি কপটতায় লুণ্ঠন ও প্রতারণার যে দুঃশাসন কায়েম করেছিল, মজুর ইংরেজের তাতে কোনো স্বার্থ থাকতে পারে না। এই দুঃশাসন ও রাহাজানি থেকে যারা মুনাফা করেছে তারা যত খুশি ত্রাণ তহবিলে দান করুক। ব্রিটেনের মেহনতি মানুষ যেন এই ফাঁদে পা না দেয়।”
প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিভিন্ন স্থানে সমাবেশে বক্তৃতাতেও জোনস সিপাহি বিদ্রোহের সমর্থন জানিয়েছেন। ১৮৫৭ সালের ১২ আগস্ট তিনি বক্তব্য দিয়েছিলেন লন্ডনের ‘সেন্ট জর্জেস হল’-এ, ডিসেম্বরে ‘সেন্ট মার্টিন হল’-এ, ১৮৫৮ সালের জানুয়ারিতে ‘লন্ডন ট্যাভার্ন’-এ।
১৮৫৮ সালের এপ্রিলে ভাষণ দিচ্ছিলেন বার্মিংহামের কোপেনহেগেন মাঠে। সেদিন জোনসের শারীরিক দুরবস্থা আর আর্থিক সঙ্কট নজর এড়ায়নি সতীর্থদের। এ রকম একজনের কথায় “পীড়িত মুখ এবং বহু ব্যবহারে জীর্ণ পোশাকই দুঃখ, কষ্ট ও যন্ত্রণার পরিচায়ক। গলা পর্যন্ত বোতাম আঁটা ছেঁড়াফাটা একটি কোট সম্ভবত দারিদ্র্যকে গোপন রাখার জন্য...।”
এক সময় চার্টিস্ট আন্দোলনের দাবিগুলো পূরণ হওয়ায় তা স্তিমিত হয়ে পড়ে। জোনস ফিরে যান তার আইন পেশায়। কারাবাসে ভেঙে পড়া স্বাস্থ্য আর পুনরুদ্ধার হয়নি। ১৮৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ঠান্ডায় প্লুরিসি হয় তার। ২৬ জানুয়ারি মারা যান আর্নেস্ট জোনস। ম্যানেচস্টারে তার শবযাত্রায় প্রায় ১ লাখ লোক অংশ নিয়েছিলেন। কবিতার পাশাপাশি বেশ কিছু উপন্যাসও লিখেছেন আর্নেস্ট জোনস। এর মধ্যে রয়েছে দ্য ব্যাটলডে (১৮৫৫), দ্য পেইন্টার অব ফ্লোরেন্স (১৮৫৬), দি এমপেরোর’স ভিজিল (১৮৫৬), দ্য বেলডাগন চার্চ (১৮৬০)।
তথ্য সূত্র :
১. মহাবিদ্রোহ ১৮৫৭, সম্পাদক : পি.সি. যোশি
২. সিপাহি বিদ্রোহের ইংরেজ কবিয়াল, গৌতম রায়
৩. মাহাবিদ্রোহ ও তারপর, সুপ্রকাশ রায়
৪. মহাবিদ্রোহের অজানা ইতিহাস, আমিনুল ইসলাম
©somewhere in net ltd.