নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুখীমানুষ

সুখী মানুষ

সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।

সুখী মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

মনে পড়ে রিন সিক পার্ক

২৯ শে অক্টোবর, ২০১৩ রাত ১০:৩৮

ছুটে যাওয়া মাছ বড় থাকে। কুমিল্লার ভাষায় প্রবাদটা অনেকটা এমন - "ছুইট্টা যাওয়া মাছ বড় থাহে"। বন্ধু বিষয়টা আমার কাছে ইদানিং "ছুইট্টা যাওয়া" মাছের অবস্থা। ফেলে আসা বন্ধু, আধা বন্ধু, ক্লাশমেট (যার সাথে আদৌ কোনদিন কথা হয়েছে কিনা সন্দেহ) সবার কথা খুব মনে পড়ছে। বন্ধু আমার, আহারে বন্ধু... এমন একটা আবেগ কাজ করে সবার জন্য।



দেশের বাড়ী গেলে অন্তত একবার হলেও স্কুল, কলেজের মাঠে চলে যাই। মাঠে তিন, চার জনের ছোট ছোট আড্ডা বসে। কোন একটা আড্ডায় যদি পরিচিত মুখ খুঁজে পাই। ফেসবুক আর গুগুল সার্চের কল্যাণে নাম মনে থাকা বন্ধুদের খুঁজে বেড়াই। আরিফ নামের একটা ছেলের কথা প্রায়ই মনে পড়ে। ১৯৯৭-৯৯ সালের ইন্টার ব্যাচ, তীতুমীর কলেজের। ওর বাবা কাজ করতেন রাজউক এ। কত ভাবে যে খুঁজে বেড়াই এই বন্ধুটাকে। নাহ্ কোত্থাও পাই না।



এ তো গেলো দীর্ঘদিন এক সাথে ওঠাবসা বন্ধুদের কথা। এবার বিপাকে পড়েছি কয়েক মিনিটের পরিচয়ের ভিনদেশী এক বন্ধুর স্মৃতি নিয়ে। ভদ্রলোকের নাম রিন সিক পার্ক, দেশ কোরিয়া।



এ বছরের শুরুর দিকে ঘুরতে গিয়েছিলাম নেপাল। অভিধানের ভাষায় বলতে গেলে একেবারে সস্ত্রীক। অবশ্য ১৭ই মার্চের বিবাহ বার্ষিকীটাতো দু'জনেরই তাই একজন ঘুরতে যাবার মানে হয়না। নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু দেখে তো আমি হতাশ। টাকা পয়সা খরচ করে এই হতদরীদ্র দেশে আশার কোন মানে হয়? উঠতি বয়সের তরুনীর সৌন্দর্য্য থাকে। কিন্তু উঠতি শহরের থাকে ময়লা, আবর্জনা, ভাঙ্গা রাস্তার রিপেয়ার ইত্যাদির যন্ত্রনা। এর সবই কাঠমান্ডুতে আছে। প্রায় বিশ বছর আগের ঢাকাও এর চাইতে অন্তত বিশগুন উন্নত ছিলো। আমার ট্যুর প্লেনার হলো বউ। নেপাল যাবার আগে সে অফিসের ফাঁকে ফাঁকে সারাদিন ইন্টারনেট ঘেটে সব হাতের নখের আয়নায় সেট করে ফেলেছে। নখদর্পণ যাহাকে বলে। বউকে বল্লাম, এই আদি ঢাকায় একদিনও না। নেক্সট প্ল্যান এর দিকে চলো।



রাজধানী কাঠমান্ডু ছেড়ে এবার গেলাম পোখাড়া। এই শহরটা বেশ সুন্দর। গোছানো, ছিমছাম। কিন্তু বিপাকে পড়লাম খাওয়া দাওয়া নিয়ে। বেশীর ভাগ আইটেমই পাউরুটি টাইপ দেখতে। বাংলাদেশের বন রুটির মত অনেকটা। পার্থক্য শুধু উপরের প‌্যাঁচ এর ডিজাইনে আর মিষ্টি টাইপ আস্তরণের রং এ। ভাত যে ভাত সেই ভাতেও এরা দেয় নারকেলের টুকরা। খাওয়ার সময় কচকচ করে মুখের ভিতর। অতএব সার্চ দা খোঁজ করতে হবে ইন্ডিয়ান ফুডের। দু'জন খুধা পেটে হাটা শুরু করলাম ফেওয়া লেকের ধার ধরে। এইবার সত্যি মনে হচ্ছে ঘুরতে আসাটা কাজের কাজ হয়েছে। খুধা পেটে ফেওয়া লেকের ধার দিয়ে হাটা যদি এত ভালো লাগে তো জায়গাটা আসলেও সুন্দর। অবশেষে পাওয়া গেলো রাজস্থান টাইপ কিছু একটা নামের দোকান। কালা পাহাড় টাইপ দোকানের সব কর্মচারী। অর্থাৎ এই দোকান ইন্ডিয়ান ফুডের না হয়ে যায়ই না। কাষ্টামার বলতে আমরা দু'জন আর একটু দূরে এক জাপানী দেখতে পঞ্চাষোর্ধ ভদ্রলোক। প্রথম দেখায় কিছুটা মলিন কাপড়ের এই ভদ্রলোককে বেশ গরীব মনে হলো আমাদের কাছে।



ঝাল টাইপ কিছু একটা অর্ডার দিয়ে আমরা অপেক্ষা করছি। বউয়ের কাছে ফিসফিস করে বল্লাম, জাপানী জাপানী চেহারা কিন্তু এমন বেখাপ্পা লাগছে কেন বলতো! এরই মধ্যে আমাদের খাওয়া চলে এসেছে। কিন্তু ভদ্রলোক খাওয়ার মেন্যু হাতে নিয়ে এই যে বসেছে কোন কিছুরই অর্ডার দিচ্ছে না। অবেশেষে অর্ডার দিলো কিছু একটার। যখন খাবার তার টেবিলে দেওয়া হলো তখন মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছোট সাইজের দুইটা আটার রুটি। রুটিগুলা পুড়ে গেছে, দেখতে অখাদ্য মনে হচ্ছে। আর সাথে সামান্য একটু ছোলার ঝোল। সম্ভবত সবচেয়ে কম দামী কোন একটা মেন্যু।



চট্ করে কয়েকটা জিনিস ভেবে নিলাম। প্রথমত, ভদ্রলোককে যে কোন একটা অজুহাতে ভালো একটা মেন্যু খাওয়াতে হবে। দ্বিতীয়ত, বউ যেন আবার হুট করে রাগ করে না বসে এই ভেবে যে, বিদেশে ঘুরতে এসেও তুমি আমার দিকে নজর দিচ্ছো না। একটু রোমান্টিক, অপরাধী চেহারা করে বল্লাম, আজকে আমাদের প্ল্যান কি? বিবাহিত জীবনে বউয়ের চেহারা দেখে যে কয়দিন মনে হয়েছে, সে আমারে বুঝে... ঠিক এমন একটা চেহারা করে হাসি দিয়ে বল্লো, ঠিক আছে তুমি ভদ্রলোককে সময় দাও।



ভদ্রলোকের কাছে গেলাম, যতটা সম্ভব বিনয়ী হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম আমাদের সাথে জয়েন করবেন কি না। তিনি বিনয়ীর চুড়ান্ত হয়ে চট করে ওঠে গেলেন। সিওর সিওর বলতে বলতে আমাদের টেবিলে চলে আসলেন। তার অর্ডার করা রুটি, ছোলার ঝোলের অর্ধেক তখনো খাওয়ার বাকী। এগুলো টেবিলেই রয়ে গেলো।



আমার মাথায় অনেকগুলো জিনিস এক সাথে ঘুরছে। প্রথম চিন্তাটাই হলো, তার দেশের কালচার অনুযায়ী খাওয়া অফার করাটা অপরাধ হবে কি না। যাই হোক, প্রথমেই নাম জিজ্ঞাসা করলাম। ভদ্রলোকের নাম রিন সিক পার্ক, দেশ কোরিয়া। বাংলাদেশ নামের সাথে তিনি পরিচিত কিন্তু দেশটা কোথায় তা জানেন না। নিজের দেশ সম্পর্কে আমরা দু'জনে মিলেই বেশ গুনগান করলাম। গুনের মধ্যে আমরা যে বন্ধু সুলভ জাতি তা যেমন বল্লাম। আবার বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত আছে আমাদের তাও বলতে ভুল্লাম না। কথায় কথায় খাবারের টপিকটা ঢুকিয়ে দিলাম। বল্লাম, আমরা ভুজনরসিক জাতি। প্রতি দশ বাড়োটা দোকান পার হলেই একটা না একটা হোটেল পাওয়া যায়। আর হোটেলে অর্ডার দিয়ে বসে থাকতে হয় না। খাওয়া এক ধারে তৈরী হতে থাকে বা তৈরী থাকে আর এক ধারে খাওয়া চলতে থাকে। এবার মুক্ষম কথাটা বলে ফেল্লাম, আমাদের দেশে বন্ধুকে সম্মান করতে হলে আমরা তাদের খাওয়াই। অতএব তোমাকে যদি বন্ধু হিসাবে সম্মান দিয়ে কোন কিছু খাওয়াই তাহলে কি তোমার কোন আপত্তি আছে? ছোট্ট একটা কথায় ভদ্রলোক আবেগী হয়ে গেলেন। মাই অনার, মাই অনার বলে মাথা ঝাকাতে থাকলেন।



হোটেলের সবচেয়ে ভালো যে মেন্যুটা মনে হলো তার অর্ডার দিলাম। পাশে বসে খাওয়ালাম। খাবার ফাঁকে ফাঁকে টুকটাক গল্প করতে থাকলাম। তিনি বক্তার চেয়ে শ্রোতা হিসাবে বেশী গুনী। কথা যখন শুনেন তখন খুব মনযোগ দিয়ে শুনেন। মজার কথা হচ্ছে, বউকে নিয়ে টেনশানে ছিলাম যে কিছু মনে করে কি না। দেখলাম বউই সবচেয়ে বেশী মজা পাচ্ছে কথা বলে। যে মেয়ে দেশ ছেড়ে বিদেশ চলে যাবার জন্য নিত্য দিন ঘ্যানর ঘ্যানর করে সে দেখি দুর্দান্ত দেশপ্রেমী। দেশের হেন কোন গুন নাই যা বল্রো না। ভিনদেশী এই মানুষটা যদি সত্যিই বউয়ের সব কথা বিশ্বাস করে তাহলে মনে করবে, এই দেশে চলাফিরা করতে বিদেশীদের কোন টাকা পয়সা লাগে না। বন্ধুসুলভ আমরা বাঙ্গালীরা বিদেশীদের ঘরে নিয়ে মেহমান হিসাবে রাখি। আর হোটেলে, বাসে ফ্রি সব সার্ভিস।



রিন কে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কি করেন? ফাঁকে একটা মজার কথা বলে নেই। যখনই মানুষজন বিদেশীদের সাথে কথাবর্তার বাংলা করে তখন আপনি শব্দটার স্থানে "তুই" ব্যাবহার করে। যাই হোক, ভদ্রলোক বল্লেন, আই রাইট। অর্থাৎ তিনি লেখক। মনটা মুচড় দিয়ে ওঠলো। খাইছি ধরা টাইপ মুচড়। বউ দেখি আমার দিকে ট্যারা চোখে তাকাচ্ছে। কারন, বউকে প্রায়ই বলি, বউ তোমার সংসার চলার মত ফিক্সড কোন ইনকামের ব্যাবস্থা করতে পারলে লেখালেখি শুরু করে দিবো ফুল টাইম। আর বউয়েরও কমন উত্তর থাকে, লেখালিখি করলে মাইকেল মধুসুধনের মত না খেয়ে মরতে হয়। রিন ভদ্রলোক দেখি আমাকে ডুবিয়েই ছাড়লো...



রিন একটু উদাস হয়েই বল্লেন, লেখালেখি তার পরিবারের কারো পছন্দ না। তার মেয়ে আর বউ প্রায়ই বলে, তুমি লেখালেখির কাজে দূরে দূরে উধাও হয়ে যাও, তোমাকে আমরা খুব মিস করি। রিন মানুষ, দেশ, রাজনীতি এই সব নিয়ে লেখালিখি করেন। ইমেইল অ্যাড্রেস লিখে দিলেন। ফোন নাম্বার নেই বল্লেন। তাঁর ফোন ভালো লাগে না।



খাওয়া দাওয়া শেষে বিল নিয়ে এলো ওয়েটার। ভদ্রলোক হুমড়ি খেয়ে পড়লেন, বিল তিনি দিবেন। আমি হুমড়ি খেয়ে পড়লাম না বিল দেওয়ার জন্য। আস্তে করে বল্লাম, তবে কি তুমি বন্ধু না? ব্যাস্ আর কিছু করতে হলো না, বিনয়ের সাথে অপরাধী টাইপ একটা হাসি দিয়ে বল্লেন, সিওর সিওর ইউ প্লিজ...। বিল দিয়ে, বিদায় নিয়ে যখন রাস্তায় নামলাম তখন সন্ধার সোনালী আলো পড়েছে হিমালয়ের প্রায় নয় কিলোমিটার উঁচু চূড়ায়। আর এই আকাশে লেগে থাকা হিমালয়ের প্রতিচ্ছবি পড়েছে ফেওয়া লেকে। পৃথিবীর সুন্দরীতম এক নারীর হাত ধরে লেকের ধারে হাটছি আর মনে মনে বলছি, বউ দেখতে আমি তোমার তুলনায় কিছুই না কিন্তু সুন্দর একটা মন আছে আমার। যে মনে মানুষের জন্য রয়েছে অপরিসীম মায়া আর তোমার জন্য এক জীবনের সব শ্বেতশুভ্রতম ভালোবাসা।



পরিশিষ্ট: দেশে এসে [email protected] ইমেইল অ্যাড্রেসটিতে মেইল করে দেখি ইমেইলাটা কাজ করছে না। ভদ্রলোকের নাম দিয়ে গুগল সার্চ করেও দেখি কোন রেজাল্ট আসে না। হয়ত আমার মতই একজন অপরিচিত লেখক তিনি। তবে মানুষ হিসাবে যে আমার চেয়েও বেশী মায়া তিনি মানুষের জন্য হৃদয়ে রাখেন তা আমি নিশ্চিৎ। কারন ফেইস ইজ দ্যা ইনডেক্স অব মাইন্ড। ভদ্রলোকের ফেইস আমি পড়েছি। আমিও যদি মানুষের জন্য এমন মমতা ধারণ করতে পারি তবে আমার মুখেও নিশ্চয়ই এমন একটা ছাপ পড়বে।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.