নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুখীমানুষ

সুখী মানুষ

সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।

সুখী মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

ব্যক্তিগত পোস্ট: আমার দাদাকে নিয়ে।

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ সকাল ১১:৪১

দাদা'র কোন স্মৃতি আমার মনে নাই।

হঠাৎ করে আজ দাদাকে নিয়ে লেখতে ইচ্ছা করলো।



ঘটনা হইলো, কলকাতার এক ভদ্রলোক ইদানিং আমার ফেসবুক ফ্রেন্ড হয়েছেন। তার সাথে গত পরশু আমার দেখা। কথার এক ফাঁকে চোখ মুখ টান টান করে বল্লেন

- এই হয়েচে কি শুনো, তোমার হারুণকে না আমার দেকতে খুচ ইচ্চে হচ্চে মাইরি। (দাদা সরি আপনার মত করে হয়ত বলতে পারিনি)



এমন করে দেখি আমার জীবন থেকে নেওয়া হারুণ, হরমুজ স্যারের মত মানুষগুলো বন্ধুদের মনেও আঁটকে গেছে।



এমনকি ভিনদেশী বন্ধুরাও জিজ্ঞাসা করে না, তোমার ছেলে কেমন আছে। তার সরাসরি জিজ্ঞাসা করে প্রিয় কেমন আছে।



আমার দাদার মত মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার মত এমন লেখনীর ধার আমার এখনো হয়নি। তবু সহজ, সরল এই মানুষটাকে নিয়ে দেখি না কিছু লেখা যায় কি না।

-০-

আমার দাদা মাদ্রাসার শিক্ষক ছিলেন। ঢাকায় কমলাপুরে যে মাদ্রাসায় তিনি পড়াতেন। তার পাশের মসজিদের ইমামও ছিলেন তিনি। মসজিদেই থাকতেন। সমস্ত জায়গাটা ছিলো এক ওয়ারিশবিহীন মহিলার। আমার দাদাকে তিনি ছেলে ডাকতেন। মহিলা একদিন ডেকে বল্লেন

- পুতরে আমার তো মরার বয়স হইছে, এই মসজিদ মাদ্রাসা তুইই দেখিস। আর জমিজমাও তোর নামেই সব দিয়ে যাই।

আমার দাদা হাসি দিয়ে বলেছিলেন

- মা আপনি সব এতিমখানায় দিয়ে যান, আমাকে আল্লাহ অনেক দিয়েছেন।

দাদা নিজে সমস্ত সম্পত্তি এতিমখানার নাম করে কগজপত্র রেডি করলেন। মহিলার মৃত্যুর পর তিনি গ্রামে চলে গেলেন।

-০-

গ্রামের যে মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসাবে জয়েন করলেন সেখানে তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হলো, হুজুর আপনি কোন সাবজেক্ট পড়াবেন? দাদা কম কথা বলতেন, তিনি বল্লেন

- দেন না।

বড় হুজুর কী দিবেন বুঝলেন না। স্পেসিফিকেলি জিজ্ঞাসা করলেন

- সাবজেক্টের নাম বলেন।

দাদা বল্লেন

- অন্যদেরকে আগে বলেন হুজুর, সবাই নেওয়ার পর যে সাবজেক্ট থাকে এইটা আমাকে দিয়েন।

নতুনকে কম মানুষই স্বাগত জানায়। দাদাকে সবাই প্ল্যান করে নাগরী ভাষার গ্রামার পড়াতে দিলেন। দাদা সাত, আটটা ভাষা জানতেন। তাই তিনি বিষয়টাযে পরিকল্পিত তা টের পেলেন না।



দাদা ক্লাশে গিয়ে পড়ানো শুরু করলেন। দাদা দেখতে খুব সিম্পর ছিলেন। জামা কাপড়ের প্রতিও ছিলেন উদাসিন। বড় হুজুর ভাবলেন, কি না কি পড়াবে এই লোক! নিজে স্পাই এর মত ক্লাশের বেড়ার ফাঁকে চোখ রাখলেন।



দাদা'র ক্লাশ নেওয়া শেষ হওয়ার পর যখন শিক্ষকদের রুমে গেলেন তখন বড় হুজুর এসে দাদাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দিলেন। (তখনের মানুষেরা এমনই আবেগঘন ছিলেন হয়ত)। বল্লেন

-হুজুর আমাকে আপনার মাপ করতেই হবে। আমি আপনাকে মনে মনে কম গুনী মনে করেছিলাম। আমারে আপনি মাফ করলেন কি না কন, কইতেই অইবো।

-০-

আমাদের গ্রামের বাড়ীর লাগোয়া একটি পুকুর আছে। পুকুরের সিংহভাগই আমাদের ছিলো। গুচা ভূঁইয়া নামের এক লোক একদিন দাদাকে বাড়ীতে দাওয়াত দিয়া নিলেন। দাদা পান খাইতেন। সুন্দর একটা পান দাদাকে খাইয়ে বল্লেন

- হুজুর আপনারতো অনেক জমিজমা, পুকুর আছে। আমার পোলাপানগুলা গুসল করবে এমন একটা পুকুরও নাই। আপনাদের পুকুরে নামতে গেলে অন্য অংশীদাররা আমার পোলাপানরে অপমান করে। আমারে একটু জায়গা দিবেন পুকুরের?

দাদা হাসি দিয়ে বল্লেন

- জায়গা জমি দিয়া আমি কী করবো?

তিনি অনেক বড় একটা অংশ গুচা ভূঁইয়াকে এমনি এমনি দিয়ে দিলেন। আমার দাদা অবশ্য কোন জমি কিনেন নাই। সব জমিই ছিলো আমার বড় আব্বার কেনা। তাই হয়ত এত সহজেই জমি দিয়ে দিতে পেরেছিলেন।



আমার দাদার জীবদ্দশাতেই এই ঘটনার মজার অংশটুকু দেখেগিয়েছিলেন। গুচা ভুঁইয়া আসলেও গুচা ছিলেন। তিনি তার পেটের নীচে কলশি দিয়ে পুকুরে সাঁতার কাটতেন আর আমাদের হাঁসগুলোকে লাঠি দিয়ে পিটাইতেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যাদের হাঁস তিনি পিটাচ্ছেন তারাই তাকে এই পুকুরের জমিটুকু মগনা দিয়েছিলো।



অবশ্য গুচা ভূঁইয়া মৃত্যুর আগে অভাবে পড়ে এই জমি আমাদের কাছেই বিক্রি করে গিয়েছিলেন।

-০-

মন্তু ছন্দু দুই ভাই। দাদার কাছে এসে বল্লেন

- বাই, টাইলং চলে যাবো। জমিতো কেউ কিনে না। আপনে যদি জমিটা কিনতেন তাইলে আমরা টাইলং গিয়া সুখে থাকতাম। ঐখানে জমি আর জমি।

আমার দাদা টাইলং চিনেন না, জীবনে কোন জমিও কিনেন নাই। সুখে থাকবে শুনে কি মনে করে যেন জীবনে প্রথমবারের মত এই জমিটা কিনে রাখলেন।



মন্তু, ছন্দু দুই ভাই চিটাগাঙ্গে হিলট্রেকের কোন একটা টাইলং নামের পাহাড়ে গিয়ে জুম চাষ শুরু করলেন। মশার কমড়, বন্য জন্তুর যন্ত্রনা ইত্যাদিতে অতিষ্ট হয়ে আবার গ্রামে ফেরত আসলেন। এখনতো জমিজমা কিছু নাই! গ্রামে কিছু দুষ্ট লোক থাকে। তারা বুদ্ধি দিলেন, হুজুরের নামে মামলা করো, যে হুজুর ভয় ভিতি দেখিয়ে তোমাদের জমি কিনে নিয়েছিলো। মন্তু ছন্দু তাই করলেন। আমার সহজ সরল দাদা পড়লেন অকূল পাথারে। তিনি কী করবেন না করবেন কিছুই বুঝতে পারলেন না। সারা জীবন মসজিদে কাটিয়ে দেওয়ার মানুষটা এই প্রথম কঠিন দুনিয়ার চরম বাস্তবতার সামনে পড়লেন।



কয়েকদিন মামলা চালানোর পর মন্তু ছন্দু আরো কঠিন বাস্তবতায় পড়লেন। থাকবে কোথায়, খাবে কী? পকেটে করে যা এনেছিলো ফেরত তা দুষ্ট লোকরা খাওয়ার পর আরতো মেহমান হিসাবে তারা আর ঘরে রাখছে না!



মন্তু ছন্দু আবার দাদার কাছে আসলেন, এসে বল্লেন

- বাই এই এই লোকের দুষ্ট বুদ্ধিতে আমরা এইসব করছি। এখন আপনি ছাড়া আশ্রয় দেওয়ার কেউ নাই।



মেইন রোড থেকে আমাদের বাড়ীটা একটু ভিতরে। মেইন রোডের পাশেই স্কুল, স্কুলের পাশেই আমাদের একটা জমি ছিলো। দাদা এই জমিটায় তাদেরকে থাকতে দিলেন।



দাদা কতটা কষ্ট পেয়েছিলেন মনে তার উদাহরণ দেই। তিনি মন্তু ছন্দুকে বল্লেন

- মন্তু তোরা আমার এই জমিতে থাক। যতদিন অন্যকোথাও কাজ টাজ না পাবি এখানেই থাক আর আমার ঘরেই খা।

কিন্তু জমি তিনি এবার আর লিখে দিলেন না। গুচা ভূঁইয়াকে যেমটা দিয়েছিলেন।



প্রায় তিরিশ বছর ধরেই মন্তু ছন্দু ভাই আমাদের জায়গায় থাকছেন। ঢাকা থেকে যখন বাড়ী যাই তখন আগে মন্তু ছন্দুদের ঘর পড়ে। এদের নাতি পুতি হয়েছে। কয়েক হাতে মিলে কামাই মনে হয় ভালোই করছে। বাসার ভিতর দেখি রঙ্গীণ টিভিও আছে। কিন্তু জমির খাজনা এখনো আমরাই দিচ্ছি। যে জমি মনের কষ্টে দাদা মন্তুদের লিখে দিয়ে যাননি তা আমরাও দিইনি। মন্তু ছন্দু এখনো বেঁচে আছে। বাড়ীতে গেলে খুব আগ্রহ নিয়ে আসে কথা বলতে। নাতি নাতনি বড় হয়েছে, কিন্তু ভাত দেয়না। ছোট্ট একটা টং দোকানে বসেন। যখন যা পারি সাহায্য করি। কিন্তু দাদার মত এক বড় আকারে করতে পারি না।

-০-

দাদার কোন স্মৃতি আমার মনে নাই। আমার তখন তিন কি চার বছর দাদা যখন মারা যান। মৃত্যুর আগে বেশ কিছু দিন বিছানায় পড়া ছিলেন। শুধু মনে আছে, খেলতে টেলতে কোথাও যেতে পারতাম না। বাড়ীর কেউ না কেউ গিয়ে ধরে নিয়ে আসতো। কারন দাদার চোখের সামনে থেকে দূরে

গেলেই তিনি চিৎকার করতেন, তে কই? (ও কোথায়)।



মমতা সব সময় নিম্নগামী। বাড়ীতে আমি সবার ছোট ছিলাম। তাই দাদার সমস্ত মমতা এসে জমেছিলো আমার প্রতি। যে মহান দাদার রক্ত শরীরে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি তার সঠিক পরিচয় যেদিন দিতে পারবো সেদিন নিজেকে মানুষ মনে হবে। এখনো সেই মানুষ হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

মন্তব্য ৩ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৩) মন্তব্য লিখুন

১| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ১২:০৩

বাড্ডা ঢাকা বলেছেন: সুন্দর গল্প লেখেছেন

২| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ দুপুর ২:১০

মামুন ইসলাম বলেছেন: চমৎকার লেখনী ++

৩| ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৪ রাত ৮:৫১

জিরো ডাইমেনশন বলেছেন: পোস্টটা পড়ে অনেক ভালো লাগছে। আসলে ভালো মানুষের কথা পড়লে মনটা অনেক বড় হতে চায়......

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.