![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।
আমার বাবা বাঁশের কঞ্চি কেঁটে দুইটা কাজ করতেন।
প্রথম কাজটা খুব কমন, ছাত্র পিটানোর অস্ত্র বানাতেন। দ্বিতীয় কাজটা একটু আনকমন, ছাত্রদের জন্য মজার মজার খেলনা বানাতেন। অংক শেখানোর জন্য কাঁটাকম্পাস, চাঁদা, বৃত্ত ইত্যাদি বানাতেন।
আব্বা প্রাইমারী স্কুলে শিক্ষকতা করেছেন সারা জীবন। আমি তাঁকে ক্লাশের শিক্ষক হিসাবে পাইনি। আমি যখন ছাত্র তখন তিনি আশেপাশের গ্রামে শিক্ষকতা করতেন।
আব্বা ছাত্রদেরকে পিটাতেন প্রচুর। কোন এক অদ্ভুত কারেন ছাত্ররা তাঁকে পছন্দ করতো তার চেয়েও বেশী। আর তার প্রমান পাই যখন আমি হাই স্কুলে উঠলাম তখন। কারন আব্বার শিক্ষকতা জীবনে অনেকগুলো স্কুলে ছিলেন। সব স্কুল থেকেই কোন না কোন ছাত্র আমি যে হাই স্কুলে পড়তাম তার ছাত্র ছিলো।
আব্বা তার ছাত্রদের আব্বা আব্বা ডাকতেন। স্কুল শেষে দূর্বল ছাত্রদের আলাদা করে পড়াতেন। যেহেতু প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক, গননা শিখাতে নতুন নতুন খেলনা দিয়ে গননা শিখাতেন।
আব্বার জনপ্রিয়তার একটা উদাহরণ দেই -
আব্বা তখন নাইঘর গ্রামের প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। বাড়ী থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরে স্কুল। তিনি হেটে আসা যাওয়া করতেন। তখনো এই রোডে গাড়ী চলেনা। আর এত দূর রিক্সা দিয়ে যাতায়াত করার মত টাকা একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষকের থাকার কথা না।
একদিন আব্বা স্কুল থেকে বের হয়ে হেটে হেটে বাড়ী ফিরছেন। স্কুলের মাইল খানেক দূরে আসার পর একই পথে হেটে যাওয়া এক বৃদ্ধার সাথে দেখা। আব্বাকে জিজ্ঞাসা করলেন
- বাজান আপনে কই যাইবেন?
- সাহেবাবাদ
মহিলা তখন একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞাসা করলো
- আ ও বাজান সাহেবাবাদ নি আপনের বাড়ী!
- কেন মা কী হইছে?
- একটা পাগলা স্যার আইছে আমাগো ইসকুলে। যেমন রাগী, তেমন মায়া, তেমন ভালো পড়ায়। পোলাপানরে বাড়ী থেইক্কা ধইরা ধইরা ইসকুলে নিয়া যায়।
মহিলা প্রশংসা করেই যাচ্ছেন করেই যাচ্ছেন। আব্বা আর কিছু বলার সুযোগ পেলেন না।
একেবারে আমাদের গ্রামের কাছে এসে গেলেন। এখন আব্বা মেইন রোড থেকে ছোট রোডে ঢুকে যাবেন। মহিলা মেইন রোড ধরে যাবেন। আব্বাকে বল্লন
- বাজান আপনের নামইতো জিগাইলাম না।
আব্বা একটা হাসি দিয়ে বল্লেন
- মা আমিই সেই শিক্ষক।
-০-
ছোট বেলার একটা স্মৃতি বলি। রসুল নামের একটা ছেলে ছিলো, পাড়ার নুরু কাকু'র ছেলে। তাকে একদিন দিলাম কঠিন এক গালি। সে গিয়ে তার মায়ের কাছে বিচার দিলো। রসুল কী বিচার দেয় তা শুনার জন্য তাদের ঘরের পিছনে আমি দাঁড়িয়ে আছি গোপনে। তার মা সব কথা শুনে বল্লেন
- স্যারের পোলা তরে গালি দিছে! আর কথা পাস না কিছু? কে না কে গালি দিসে আইসা কয় স্যারের পোলা গালি দিসে। যা ভাগ...
ঠিক ঐদিনই যা শিক্ষা হওয়ার হয়ে গেলো। আমি বুঝে গেলাম, আমি স্যারের পোলা, আমি কাউকে গালি দিতে পারি না।
আমার আশেপাশের মানুষগুলো বলতে পারবেন, এই শিক্ষা আমি আদৌ কতটা মেনে চলি আজও।
-০-
বাসায় আমরা ভাইবোনদের বন্ধুবান্ধবদের আদর করতেন আব্বা দেখার মত করে। টান দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে বলতেন, আমার এক একটা সন্তান দিয়ে আমি অনেকগুলা সন্তান পাইছি।
ফেসবুকে আমার স্কুলের অনেক বন্ধু আছেন যারা হয়ত পুরনো স্মৃতিগুলো মনে করে আবেগাপ্লুত হয়ে যাবে। তাদেরকে বলছি, ভাইরে আমার মা চলে গেছেন। বাপটা এখনো বেঁচে আছেন। কাছের মানুষগুলো বলছেন, বৃদ্ধ বয়সের জোড়া ভেঙ্গে গেলে নাকি যিনি বেঁচে আছেন তিনিও বেশী দিন বাঁচেন না। যারা গ্রামে আছো বা কাছাকাছি আছো আমাদের বাড়ী যেও। আমি কাজের জন্য ঢাকা থাকি। আর আব্বা শহর পছন্দ করেন না। তাই তোমরা যেও। আব্বা তোমাদেরকে দেখে খুব খুশি হবেন। বাড়িতে মা নেই। হয়ত আগের মত করে আপ্যায়ন করতে পারবেন না আব্বা একা। কিন্তু আগের মত বুকে জড়িয়ে ধরতে পারবেন। হযত পুরনো ডায়লগটা মনে থাকলে বলতেও পারবেন, আমার এক একটা সন্তান দিয়ে আমি অনেকগুলো সন্তান পেয়েছি।
আর আব্বা ঢাকা এসে থাকবেনটা কিভাবে? এখনো আব্বার পিছন পিছন যখন গ্রামের রাস্তায় হাটি তখন দেখি - দূরে হয়ত মাঠে কোন লোক কাজ করছে, দৌড় দিয়ে রাস্তার কাছে এসে আসসালামু আলায়কুম স্যার বলে আবার দৌড়ে মাঠে কাজে ফিরে যায়। সম্মান প্রাপ্তিরও একটা নেশা আছে। এই নেশা কাটানো বড় কঠিন।
-০-
আমার বাপ বড় মাপের কোন মানুষ না। শুদ্ধ ভাষায় বলতে গেলে, সাধারণ স্কুল শিক্ষক। তাঁর ছোট্ট গন্ডির এই জীবনের একটা সফলতা হলো - যে প্রাইমারী স্কুলে তার শিক্ষা জীবন শুরু, সেই স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক হিসাবে তাঁর অবসর।
©somewhere in net ltd.
১|
২১ শে জানুয়ারি, ২০১৫ সকাল ১০:২৮
আহলান বলেছেন: হিরার টুকরো এই মানুষ গুলোর জন্যই হয়তো এখনো এই দেশের মানুষ এখনো মানুষ আছে .....