নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সুখীমানুষ

সুখী মানুষ

সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।

সুখী মানুষ › বিস্তারিত পোস্টঃ

শিক্ষকের মায়া দিয়েই সব ছাত্রকে মানুষ বানানো যায়। এখানে মাইরের কোনই জায়গা নাই

১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৩০

হাইস্কুল জীবনের প্রথম যেদিন স্কুলে গেলাম। গিয়া আমি তাজ্জব! স্কুল মাঠের এক কোনায় কুন্ডলী পাকানো বেতের ঝাড় থেকে প্রমান সাইজের জালি বেত কাটা হচ্ছে। জানুয়ারী মাস, শীতের দিন। শিক্ষকরা রোদ পোহাচ্ছেন। আর দপ্তরীদেরকে বেতের সাইজ বলে দিচ্ছেন। সর্বমোট তিনটা ক্যাটাগরীতে বেত কাটা হচ্ছে, বড়, মাঝারী এবং ছোট।

দুই দপ্তরী তাহের ভাই, এবং রতন দা নিরশ মুখে বেত কেটে যাচ্ছেন। ভগবান সরকারী স্কুল ছিলো আমাদের বাড়ী থেকে মাইল দুইএক দূরে। এতটা দূরে এর আগে কখনোই একা একা আসি নাই। ভর্তি পরীক্ষার দিন বড় আপা সাথে এসেছিলেন। পরে আপা যখন জিজ্ঞাসা করলেন
- কি রে তোর সাথে যাওয়া লাগবো?
আমি কনফিডেন্স নিয়ে বলছিলাম
- আমার সাথে যাবি মানে? আমি কি চিনি না?

এখন মনে হচ্ছে আপা পাশে থাকলেই ভালো হইতো। আপা'র কাছে বলতে পারতাম, এই স্কুলে আমি পড়বো না।
কয়েক'শ বেত কাটা হয়ে গেছে। ভয়ে ভিতর থেকে হুহু করে কান্না আসছে। গলার ভেতর কেমন করে যেই এই কান্নাটা আটকে আছে। এমন সময় চিকন চাকন একজন দাড়িওয়ালা স্যার ডাকলেন
- এ্যাই এই দিকে আয়।

ভয়ে ভয়ে কাছে গেলাম। স্কুলের প্রথম দিন আমার শুরু হইলো চরম ভয়ের মধ্য দিয়ে। স্যারের কাছে দাঁড়াইলাম, তিনি হুজুর স্যার। বললেন
- বাড়ী কই?
বললাম
- স্যার সাহেবাবাদ
স্যার হু হু করে হাসি দিয়ে বললেন
- বলদা বল, বলদা। গ্রামের নাম হইলো বলদা, আর কইতাছোস সাহেবাবাদ! আইচ্ছা ঠিক আছে, তোর বাপের নাম কী?
বললাম
- স্যার আব্দুল আউয়াল।

স্যার দুই সেকেন্ডের মত চুপ করে থাকলেন। এর পর বললেন
- আব্দুল আউয়াল মাষ্টার?
আমি অবাক হয়ে গেলাম! আব্বাকে এত দূরের একজন মানুষ কিভাবে চিনে? বললাম
- জ্বী।

ব্যাস, হুজুর স্যার আমার ঘাড়ে চাপ দিয়া ধরলেন। শক্ত করেই ধরলেন। গলার ভিতরের চাপা কান্না আর চাপা রইলো না। কান্না শুরু করে দিলাম। কিন্তু ভয়ে শব্দ পর্যন্ত করছি না! স্যার আমাকে ঘাড় ধরে নীচে চাপ দিয়ে বললেন
- তোর বাপরে পড়াইছি।
এরপর আবার ঘাড় উপরে উঠায়ে একে একে বলা শুরু করলেন, তোর বড় ভাইরে পড়াইছি, তোর মেঝো ভাই রে পড়াইছি, তোর বড় আপারে পড়াইছি, তোর ছোট আপারে পড়াইছি।

প্রত্যেক বার বলেন আর ঘাড়টা নীচে চাপা দিয়ে আবার উপরে উঠান। পড়ে বড় করে একটা চাপ দিয়া ধরে আমার মাথা প্রায় মাটির কাছে নিয়া গেলেন। বললেন
- আর এখন তোরে পড়াই।

এতক্ষণে স্যারের মজা করার বিষয়টা বুঝে গেছি। কিন্তু শুরুতে যে কান্না করে চোখ ভিজায়ে রাখছি, তা তো আর মুছে যায় নাই! সব শেষে স্যার খেয়াল করলেন আমার চোখে পানি। স্যার দাঁড়ায়ে আমাকে বুকে জড়ায়ে ধরলেন। বললেন
- কি রে পাগল, তুই কানতাছক ক্যান?

তার পর খুব আন্তরিকতা নিয়ে পারিবারিক গল্প করলেন। বললেন, তোর দাদী এখনো আছে? বললাম জ্বী স্যার আছেন। বললেন, খুব ভালো মানুষ, আমার সালাম দিস। আর তোর বাপরে কইস, সময় পাইলে যেন আমারে দেইখ্যা যায়। একটা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন, আর তো বেশী দিন চাকরী নাই। কে জানে বাইচাই বা কয় দিন থাকি।
-০-

হুজুর স্যারের ক্লাশে কোন দিন আর বকুনি খাই নাই। স্যার খুব আদর করতেন। আমি যতটা ভালো ছাত্র, তার চাইতেও অনেক বেশী ভালো মনে করতেন। আর স্যারের এই মনে করার বিষয়টা বুঝতে পারতাম বলে, খুব মনযোগ দিয়ে স্যারের ক্লাশ করতাম।

কিন্তু সমস্যা হয়ে গেলো ফরিদ স্যারকে নিয়ে। মোটাকাটা, ইয়া বড় সাইজের একটা মানুষ। ছোটখাটো বিষয় নিয়ে খুব মারতেন ক্লাশে। একদিন এমন মাইর মারলেন! ইস্যু টা ছিলো, তিনি যেভাবে বই ধরতে বলেছিলেন, এই ভাবে কেন বই ধরলাম না। বই ধরার ষ্টাইলটা উনি শিখিয়েছিলেন তিনটা আঙ্গুল পিছনে, আর দুই টা আঙ্গুল সামনে দিয়ে। যাই হোক, মাইরটা কত বড় ছিলো বুঝতে পারি নাই। বাড়ীতে গিয়ে আর শার্ট খুলি না। কারন শার্ট খুললেই তো মা পিঠের দাগ দেখে ফেলবে! কিন্তু শার্ট যে ছিড়ে রক্তাত্ত হয়ে গেছে তা তো আর বুঝি নাই!

আমার বাড়ী নিমিষেই করুক্ষেত্র হয়ে গেলো। মা'র কাছ থেকে কথা গেলো আব্বার কানে। আব্বা দৌড় দিয়া আইসাই আমার পিঠ দেখলেন। সামনে মাটি'র কি যেন ছিলো, আছাড় দিয়া তা ভাঙ্গলেন। আব্বা'র ভাঙ্গাভাঙ্গির স্বভাব আছে। তিনি সেন্ডুগেঞ্জি পড় ছিলেন। আব্বা এই অবস্থায় আমার বাহু ধইরা হেচকা টান দিয়া বললেন
- চল্, সে কি মানুষ না ___ এই কথাটা শুধু তারে আমি গিয়া জিজ্ঞাসা করবো।

তখনো রাস্তাটা হাটা'র ছিলো। আব্বার সাথে ভয়ে ভয়ে আবার গেলাম স্কুলে। এতক্ষণে স্কুলের সবাই চলে গেছে বাড়ী। কিছুটা দূরে ছিলো হেড স্যার সহিদ স্যারের বাসা। আব্বা নিয়া গেলেন সহিদ স্যারের বাসায়। আব্বা রাগে কিড়িমির করতে করতে বললেন
- স্যার এত ছোট একটা মানুষরে এমনে পিটায়! দেখেন আপনার সহিদ মাষ্টার আমার পোলাটারে রক্তাক্ত কইরা ফেলছে।

সহিদ স্যার আরো তিন ডিগ্রি উপরে। তিনি আব্বাকে ধমক দিয়া বললেন
- পিডাইছে ভালো করছে। এখন তোরে যদি পিডাই, তুই কিছু করতে পারবি?

সহিদ স্যার আমার আব্বারও শিক্ষক ছিলেন। আব্বা চুপ মেরে গেলেন। আব্বা আর একটা সেকেন্ডও দাঁড়াইলে না। দুই বাপ, বেটা অবনত মাথায় সহিদ স্যারের বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম। বাড়ীতে ফেরার সময় ভুলেই গেলাম, আমার পিঠ ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। কেবল মনে হইতে লাগলো, আহারে আব্বা না জানি কতটা কষ্ট পাচ্ছে মনে মনে।

কষ্ট এইখানেই শেষ না। পরের পাঁচটা বছর এই ফরিদ স্যার আমাকে অসম্ভব এক মানষিক কষ্ট দিয়েছেন। সামনে পড়লেই খুব ঘিন্না নিয়ে বলতেন, কি রে তোর বাপে পারলো না আমার __ __ড়তে? আর অন্য শিক্ষকদের সামনে আমি পড়ে গেলে ঐ শিক্ষকদের বলতেন, ওর বাপ একটা আজব চিড়িয়া; পোলার হাত ধইরা ডেনডেনাইয়া (এই শব্দটা এখনো কানে ভাসে, তবে অর্থ জানি না) চইলা আসছে বিচার দিতে।
-০-

আমি ঠিক জানি না, ভগবান স্কুলে এখনো এমন অমানবিক ভাবে পেটানো হয় কি না। আমি ঠিক জানি না এখনো ওই স্কুলে'র প্রথম দিনটা ছাত্রদের কিভাবে অভ্যর্থনা জানানো হয়।

তবে আমি এইটা জানি, আমার ছেলে প্রিয় স্কুলে পড়া পর্যন্ত যদি উপরওয়াল সব ঠিকঠাক রাখেন। আর আমার ছেলের উপর ফুলের টোকাটা পর্যন্ত শিক্ষক দেন, আমি আমার পোলার হাত ধইরা ডেনডেনাইয়া হেড স্যারের কাছে বিচার দিতে যাবো না। আমার সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে আমি শেষ দেখে ছাড়বো।

এতদিন হয়ত শিখানো হয়েছে, শিক্ষকের মাইরের জায়গাটা বেহেস্তে যায়। কিন্তু আমি নতুন কথা বলতে এসেছি। আমার কথা হইলো

"শিক্ষকের মায়া দিয়েই সব ছাত্রকে মানুষ বানানো যায়। এখানে মাইরের কোনই জায়গা নাই।"

মন্তব্য ২ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (২) মন্তব্য লিখুন

১| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫১

প্রামানিক বলেছেন: স্মৃতিচারণ ভাল লাগল। ধন্যবাদ

২| ১৭ ই ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২১

গিয়াস উদ্দিন লিটন বলেছেন: "শিক্ষকের মায়া দিয়েই সব ছাত্রকে মানুষ বানানো যায়। কথা সইত্য !

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.