![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
সত্যিকারের সুখীমানুষের সাথে আমার একটাই পার্থক্য, সুখীমানুষের গায়ের জামা ছিলো না, আমার আছে।
টাকা পয়সা একলা আসে না। সাথে কিছু শখও আসে। জহির সাহেবের সখ হইলো, জ্বীন পরীর গল্প শোনা। গল্প বলা লোকের অভাব নাই। যারা গল্প বলেন তারা সময় বুঝেই গল্প বলেন। সন্ধার আগে কেউই গল্প বলেন না। কারন সন্ধার আগে একেতো গল্প বলার পরিবেশ থাকে না। তার উপর আবার উপরতিও কিছু পাওয়া যায় না।
আজকের ঘটনা ভিন্ন। আজ দুপুর থেকেই জহির সাহেব কিছুটা রোমাঞ্চিত। তিনি অপেক্ষা করে আছেন ফখরুলের জন্য। ফখরুল একজনকে নিয়ে আসার কথা। যাকে নিয়ে আসবেন তিনি জ্বিন চালান দিতে পারেন। ভদ্রলোকের নাম ইখতিয়ারউদ্দিন। জহির সাহেব ফোন দিলেন
- ফখরুল আজকে আসতেছো তো?
ফখরুল মিন মিন করে বললো
- স্যার রওয়ানা দিয়া দিছি, আর ঘন্টা তিনেক লাগবো।
ফোন রাখার পরে ফখরুল টেনশনে পড়ে গেলো। মিথ্যা কথাতো সে অলরেডি বলে দিয়েছে। ইখতিয়ারউদ্দিনের জ্বর, ভালোই জ্বর। আজতো কিছুতেই যেতে পারবে না। কিন্তু ক্ষমতাওয়ালাদেরকে না করতে হয় না। ঘটনা তুচ্ছ হইলেও না। ফখরুল আস্তে করে হাত দিলো ইখতিয়ারউদ্দিনের মাথায়। কপাল পুড়ে যাচ্ছে। মিথ্যা একটা বলা হয়ে গেছে, আরেকটা বলতে দোষ নাই। একটা হাসি দিয়ে সে বললো
- নাপা তো কাজ করা শুরু করে দিছে ভাই সাব। জ্বরতো মনে হয় অর্ধেক নাই। তাইলে যাওয়া যায়, কী কন?
ইখতিয়ারউদ্দিন উঠে দাঁড়াইলেন। শরীর একেবারে হালকা লাগছে। পা ফেলার আগেই পা সামনে চলে যায়। ঘর থেকে বের হয়ে উঠানে আসলেন। ইখতিয়ারউদ্দিনের আর্থিক অবস্থা ভালো না। উঠানে দাঁড়ায়ে থাকা তার ছেলেটার শরীরে তার ছাপ স্পষ্ট। ছেলেটার বয়স চার বছর। এই বয়সের ছেলেরা নাদুস নুদুস হয়। কিন্তু ছেলেটা দিন দিন শুকায়ে যাচ্ছে।
ইখতিয়ারউদ্দিন আগে একটা স্কুলে দপ্তরীর কাজ করতেন। দপ্তরী বলতে যা বুঝায় তা না। আসলে করতেন নাইট ডিউটির কাজ। কিন্তু পদবী ছিলো দপ্তরী। সাত হাজার টাকা বেতন পাইতেন। সংসার ভালোই চলতো। জ্বীন চালানোর ক্ষমতাটা আসার পর তিনি চাকরীটা ছেড়ে দিলেন। বছর খানেক চাকরী নাই। এতেই সংসারের বেহাল অবস্থা। ছেলেটাকে ডাক দিয়ে বললেন
- লোকমান তোর মা কই?
লোকমান মনযোগ দিয়ে বালু নিয়ে খেলা করছিলো। সে খেলা করে যেতেই লাগলো। কোন উত্তর দিলো না। ইখতিয়ারউদ্দিনের বউ গেছে পাশের গ্রামে তার বাবার বাড়ীতে। বাপের বাড়ীতে বড় ভাইয়ের বউয়ের গঞ্জনার সাথে সাথে কিছু চাউলও আসে। আজকাল এই ভাবেই তার সংসারটা চলছে। ইখতিয়ারউদ্দিন তার ভগ্নদশা ঘরে ফখরুলকে বসিয়ে রেখে বাড়ী থেকে বের হইলেন। ঘন্টা খানেক পর এসে বললেন, চলেন যাই।
সন্ধা পার হয়ে গেলো। জহির সাহেব অপেক্ষা করে আছেন। রাত প্রায় নয়টার দিকে ফখরুল এসে হাজির হইলো। সাথে ইখতিয়ারউদ্দিন। জহির সাহেব মনে করেছিলেন হয়ত বয়স্ক লোক হবে। কিন্তু একটু অবাক হইলেন ইখতিয়ারউদ্দিনকে দেখে। বয়স হবে পয়েত্রিশের মত। রোগা শরীর, শরীরের তুলনায় মাথাটা বেশ ছোট, ঘাড়টা অনেকটা বড়। এই গরমের দিনেও ইখতিয়ারউদ্দিন জোব্বা টাইপ একটা কোট পড়েছে। গলায় মাফলারও আছে। বসার ঘরের এসিটা বন্ধ। জহির সাহেব এসি'র বাতাস সহ্য করতে পারেন না। একটু অবাক হয়ে বললেন
- গরমের দিন, এমন কাপর চোপড় পড়ছেন কেন।
ফখরুল মিনমিন করে, মাথা চুলকায়ে উত্তর দিলো
- স্যার ইখতিয়ার ভাইয়ের জ্বর।
জহির সাহেব ঝাড়ি দিয়া বললেন
- ফখরুল তুমি কি পাগল হইছো? জ্বর নিয়া ভদ্রলোকরে তুমি এত দূর থেকে কেন নিয়া আসছো?
জহির সাহেবের আগ্রহ ও আদর দেখে ইখতিয়ারউদ্দিন মুগ্ধ। জহির সাহেব একাই কথা বলে যাচ্ছেন। কিন্তু ইখতিয়ারউদ্দিন চুপ করে সোফার এক কোনায় জুবুথুবু হয়ে বসে আছে। জহির সাহেব বললেন
- তো ভাই আপনি কিভাবে এই বিদ্যা পাইলেন বলেন তো?
ইখতিয়ারউদ্দিন খুব বিব্রত হয়ে বললেন
- স্যার আমাকে ইখতিয়ার ডাকবেন, আর তুমি করে বলবেন।
তারপর যে গল্পটা ইখতিয়ারউদ্দিন বারবার করেন, এই একই গল্প করলেন - ইস্কুলে নাইট ডিউটি করতাম। একদিন স্বপ্নে আইসা আমারে ধরা দিলেন। আমি পাত্তা দিলাম না। এর পর থেইকা প্রতিদিন স্বপ্নে আসা শুরু করলো। আমি পাত্তা দেই না। পরে একদিন ভোর বেলা ঘুম ভাইঙ্গা গেলো। দেখি আমার পাশে তিনি বইসা আছেন। আমিতো ভয় পাইয়া গেলাম। খুব নরম ভাবে বললেন, ভয় পাইস না ইখতিয়ার, তোরে আমার ভালো লাগছে। তুই যখন ডাকবি আমারে পাশে পাইবি। এই বইলা, আমারে ডাকা'র নিয়মটা বইলা দিলেন।
ফখরুল খুব আগ্রহ নিয়া বললো
- ইখতিয়ার ভাই, ঐটা কন, ঐযে রাইতের বেলা আপনের পাশের বাড়ীর মহিলার পেট ব্যথা শুরু হইলো। ঔষধ দোকান দুই মাইল দূরে। অথচ দুই মিনিটের মাথায় আপনি বোটাপেন ঔষদ আইনা দিলেন!
ঘটনা ইখতিয়ারের আর বলা লাগলো না। কারন যা বলার তা অলরেডি বলা হয়ে গেছে। ইখতিয়ারের জ্বর বেড়েছে। তার কেমন যেন ঘোরের মত লাগছে। তিনি ঘোর লাগা কণ্ঠে বললেন
- রাইতের বেলা একদিন রাস্তা দিয়া যাইতেছি। মাঝখানে ধরলো ডাকাইতে। আমি জ্বিনরে ক্কিমুৎক্কিন ক্কিমুৎকিন কইয়া ডাকলেই হইতো। আমি কেন জানি বললাম, একটা ছুড়ি লাগবো, ছুড়ি। ওমা হাতে দেখি ছুড়ি চইলা আসলো। ছুড়ি দেইখা ডাকাইত পালাইয়া গেলো। আমি অবাক হইয়া বললাম, তোমারে ডাকলাম না, এর পরেও তুমি কেমনে আসলা! ক্কিমুৎক্কিন কয়, আমি তো তোমার আশেপাশেই থাকি সবসময়।
ইখতিয়ারউদ্দিনের শরীরটা ভালো লাগছে না। আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করতে পারবে বলে মনে হয় না। তিনি ঈশারা দিয়া বললেন
- একটা পেলেইট দেন।
জহির সাহেব নিজে ভিতরের রুমে গিয়ে প্লেইট নিয়া আসলেন। এবার ইখতিয়ারউদ্দিন ঈশারা দিয়ে বললেন, বাত্তিগুলা নিভায়া দেন। ঘরের লাইটগুলা অফ করে দেওয়া হইলো। কিছুক্ষণ পর ইখতিয়ারউদ্দিন বললেন, বাত্তি জালান।
ঘরের লাইট অন করা হইলো। প্লেইট ভর্তি আঙ্গুর। ইখতিয়ারউদ্দিন উঠে দাঁড়াইলেন। রাত প্রায় দশটা বেজে গেছে। জ্বরটা আরো বেড়েছে। তিনি ঘোর লাগা চোখে বললেন, যাই। জহির সাহেব আর ফখরুল মনে করলো, জ্বিনের আছড়ের কারনে ইখতিয়ারউদ্দিন এমন ভাবে কথা বলছে। আসলে ঘটনা তা না। আসল ঘটনা হইলো, জ্বরের ঘোরে এখন তার বমি বমি লাগছে। সমস্ত শরীর কেমন যেন গুলায়ে উঠতেছে।
জহির সাহেব জ্বিনের গল্প শুনেই হাজার খানেক টাকা দেন। আজ স্বয়ং জ্বিন চালান দেখলেন। তিনি খুশি হয়ে পকেট থেকে পাঁচ হাজার টাকা দিবেন ঠিক করলেন। ইখতিয়ারউদ্দিন ঘর থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। জহির সাহেব বললেন, ভাই কিছু টাকা রাখছিলাম আপনার জন্য। ইখতিয়ারউদ্দিনের শরীর আরো খারাপ লাগছে। তিনি কিছুই শুনলেন না। ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। ফখরুল সাথে বের হবে ভাবছিলো। কিন্তু টাকাটা কিভাবে নিজের পকেটে নিবে তা ভাবতে ভাবতে একটু দেরী হয়ে গেলো। টাকা নিয়ে যখন একটু পর বের হলো, দেখে ইখতিয়ারউদ্দিন আশেপাশে কোথাও নাই।
ইখতিয়ারউদ্দিন রাস্তা ভুল করেছে। সে এখন কোথায় আছে কিছুই মনে করতে পারছে না। একটু আগে সে রাস্তায় বসে বমি করেছে। বমি কিছুই বের হয় নাই। পেটে খাওয়া নাই, বমি হবে কোত্থেকে? পকেটে টাকাও নাই। ভাবছিলো জ্বিনের খেলা দেখায়ে কিছু টাকা পাবে। কিন্তু বমি বমি ভাব হওয়াতে সব উল্টা পাল্টা হয়ে গেলো। গত সপ্তাহে খুব দেন দরবার করে এক হাজার টাকা ধার নিয়েছিলো একজনের কাছ থেকে। খরচ হইতে হইতে আর দুইশো টাকা ছিলো। আজ দুপুর বেলা আঙ্গুর কিনে এই দুইশো টাকাও শেষ হয়ে গেলো।
ইখতিয়ারউদ্দিনের আজ জ্বর বলেই যে এমন জুব্বা টাইপ কোট পড়েছে তা না। সে এই কোটটা সব সময়ই জ্বিনের খেলা দেখানোর আগে পড়ে। এই কোটের ভিতরেই সে কায়দা করে আঙ্গুর বা অন্য সিজনাল ফল লুকায়ে রাখে। খেলাটা একদিন রাত্র বেলায় তার মাথায় আসে। কিন্তু এমন সুন্দর করে যে সে দেখাতে পারবে তা কোনদিন ভাবে নাই। প্রথম যেদিন বউকে এই খেলাটা দেখাইলো সে নিশ্চিৎ ছিলো ধরা খাবে। কিন্তু তার বউ অন্য সব মিথ্যা সাথে সাথেই ধরে ফেলতে পারলেও এই খেলার তেলেসমতি ধরতে পারলো না। এর পর থেকেই সে ধীরে ধিরে এই খেলা দেখানো শুরু করলো।
ইখতিয়ারউদ্দিন ভাবছিলো, এই খেলা দেখায়ে ভালোই ইনকাম হবে। প্রথম প্রথম সে টাকা নিতো না। বলতো, জ্বিন ডাকায়ে টাকা নেওয়ার নিয়ম নাই। কিছুদিন পর দেখলো তার সংসার চলে না। তখন দুই এক জায়গায় বলার চেষ্টা করলো, জ্বিন চালান দিয়ে টাকা নেই না। তবে হাদিয়া হিসাবে কিছু দিতে পারেন। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোন জায়গা থেকেই সে টাকা নিতে পারে নাই। টাকা নেওয়ার ঠিক আগ মুহূর্তে একটা না একটা সমস্যা হয়ে যায়।
ইখতিয়ারউদ্দিনের বউ বুদ্ধিমতী মেয়ে। প্রথম দিনই সব তিনি ধরে ফেলেছিলেন। কিন্তু লোকটাকে তার এত মায়া লাগে! কিছু বললে লোকটা যদি মনে কষ্ট পায় তাই কিছু বলে নাই। এই যে সংসারের ঘানি একা তার বইতে হচ্ছে, তাতেও কোন কষ্ট নাই। বরং তার কাছে আরো ভালো লাগে। আগে লোকটাকে সারা রাত কাছে পাইতো না। দিনের বেলায়ও ঘুমায়ে কাটায়ে দিতো। এখন সব সময় লোকটাকে কাছে পাওয়া যায়, এই আনন্দ স্বর্গীয়।
ইদানিং ইখতিয়ারউদ্দিনেরও কেন জানি মনে হয়, বউ মনে হয় সব বুঝতে পারে। ভেঙ্গে তবু কিছুই সে বলে না। শুধু সান্তনা দিয়ে বলে
- বউ একদিন দেখবা টাকা পইসা ভালোই ইনকাম হইবো। তখন আমাগো দুঃখ থাকবো না।
ইখতিয়ারউদ্দিনের জ্বর আরো বেড়েছে। সে জ্বরের ঘোরে রাস্তার এক পাশে উবু হয়ে পড়ে গেলো। ঢাকা শহরের মানুষ মানবতা নিয়ে খুব গল্প করে, লেখালেখি করে। কিন্তু রাস্তার পাশে কোন মানব সন্তান পড়ে থাকলে কেউ কাছে যায় না। মানবতা নিয়ে কথা বলা সহজ, কিন্তু জড়ায়ে যাওয়া সহজ না। ইখতিয়ারউদ্দিন জ্বরের ঘোরে তার বউকে ডাকলেন, রুকমনি, রুকমনি। ছেলেটাকে ডাকলেন, লোকমান, লোকমান।
জহির সাহেব আঙ্গুর মুখে দিলেন। তার গা শিউরে উঠলো, এত মজা আঙ্গুর হয়! তিনি বউকে ডাক দিয়ে বললেন
- বউ, তুমিতো জ্বিন বিশ্বাস করো না, দেখো, দোখো তুমি, এইটা কি দুনিয়ার কোন আঙ্গুর!
©somewhere in net ltd.