![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
শহরের এক তুমুল ব্যস্ত সড়ক, সে সড়কে সকাল থেকে জনকোলাহল। তিন নাম্বার বাস যাচ্ছে সূত্রাপুর, সাত নাম্বার বাস ধানমন্ডি, উনিশ নম্বর বাস যাচ্ছে বাড্ডা, কোন কোনো বাসের শরীরজুড়ে তীব্র ক্ষত, কোনো বাসের দেহে এখনো ক্ষত হয়নি, তবে হয়ে যাবে, এই ক্ষতবিহীন বাসগুলো সম্প্রতি রাস্তায় নেমেছে, তাই চকচকে দেহ, কিছুদিন ধাক্কা-টাক্কা খাক, লাইনে এসে যাবে। এ রাস্তায় শুধু বাস চলেনা। ছোট ছোট সিএনজি চলে, যাদের পেছনে লেখা “আমি ছোট, আমাকে মারবেন না,” এ রাস্তায় বড় বড় বিলাসবহুল ব্যক্তিগত গাড়িও চলে। সাদা, কালো, নীল, হলুদ... তাদের অধিকাংশের দেহই চকচকে।
এ রাস্তায় মানুষও হাঁটে, কালো-সাদা, বেঁটে-ঢ্যাঙা, মোটা-চিকন, পয়সাওয়ালা- পয়সাছাড়া সব মানু্ষই হাঁটে। তবে, সবার লক্ষ্য ভিন্ন। সবার চোখও ভিন্ন। টোকাইয়ের চোখ যখন খুঁজছে প্লাস্টিকের খালি বোতল, এলাকার রংবাজের চোখ তখন হয়তো আশ্রয় গেড়েছে কোনো অজ্ঞাতনামা তরুনীর দেহের মাংসল, আবৃত অংশে। ব্যাচেলরের চোখ তখন দেয়ালে দেয়ালে খুঁজে বেড়াচ্ছে “To Let” লেখা কোন সাদা কাগজের অস্তিত্ব, যেখানে ব্যাচেলরকে ঘরভাড়া দেয়া হবে।
আজকের গল্প এদের কাউকে নিয়ে না। আজকের গল্প একটা জারুল গাছের, যে গাছটা এ ব্যস্ত সড়কের এককোণে অপ্রস্তুত দাঁড়িয়ে আছে অনেকদিন আগে থেকেই, কতদিন আগে থেকে সেটা অবশ্য কেউ জানেনা। জানার দরকারও নেই, কারন বিসিএস পরীক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তিপরীক্ষায় এ প্রশ্ন কোনদিনই আসবেনা, মনে রাখার দরকার তাহলে কেন?
বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু বলেছিলেন, বৃক্ষেরও প্রাণ আছে। বৃক্ষের হৃদয় আমাদের হৃদয়ের মত ধুকপুক না করলেও, সে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস প্রক্রিয়ার সাথে সংযুক্ত। কিন্তু, বৃক্ষের প্রাণ থাকলেও মস্তিষ্ক আছে কী না, সে কথা অবশ্য বিজ্ঞানী আমাদের জানিয়ে যেতে পারেননি। তবে, এ গল্পের জারুল গাছটার মস্তিষ্ক আছে। সে সবকিছুই বোঝে। গাছটা কথাও বলতে পারে , তবে সে নির্বাকই থাকে বরাবর। কারণ, জারুল গাছটার চারপাশে অন্য কোনো গাছ নেই। সঙ্গীর অভাবে চুপচাপই দাঁড়িয়ে থাকে সে। মানুষজনের সাথে কথা বলা অবশ্য যেতো। কিন্তু, তাতে কেলেঙ্কারির সমূহ সম্ভাবনা। দেখা গেলো, কোনো মানুষ সকালে হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছে, জারুল গাছটা বলে উঠলো “ওহে মানবশিশু, একটু তিষ্ঠোও। আমি জারুল গাছ, আলাপচারিতায় আগ্রহী।“ এ কথা শুনলে হয় লোকটা চোঁ চোঁ করে দৌড় দেবে, নাহলে অজ্ঞান হয়ে রাস্তার মাঝখানেই অবস্থান নেবে...তখন আরেক বিড়ম্বনা। এজন্যেই, নানাদিক বিশ্লেষণ করে, জারুল গাছ স্তব্ধ, বাকরুদ্ধ। পরিস্থিতি বিবেচনায় সে মৌনব্রত ধারণ করেছে।
এই জারুল গাছটার একটা নাম দেয়া দরকার। সারাক্ষণ জারুল গাছ, জারুল গাছ... বললে ভাষার সৌন্দর্য বিঘ্নিত হয়। ওর নাম দেয়া হলো “লেস্পে।“ নামটা বিদেশী, বিদেশী। এ গল্পটা আন্তর্জাতিক হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা আছে। লেস্পে শিল্পসাহিত্য সম্পর্কেও বেশ ধারণা রাখে। এ ধারণা সে বইটই পড়ে পায়নি। প্রতি সন্ধ্যায় তার আঠারো মিটার উচুঁ দেহের ঠিক পাদদেশে বসে গল্প, কবিতা, উপন্যাস পড়ে এক যুবক। তার নাম কফিলউদ্দিন। ঠিক এখানে এসে বসার পেছনে একটা যুক্তিসঙ্গত কারণও আছে। লেস্পে যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশেই একটা ল্যাম্পপোস্ট, সেই ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোতে, লেস্পের শেকড়ে আয়েশ করে বসে, সাইডে একটা গোল কয়েল জ্বালিয়ে, সন্ধ্যার অনেকটা সময় বসে বসে বই পড়ে কফিলউদ্দিন। মাঝেমধ্যে কবিতাও আওড়ায় সে। কফিলউদ্দিনের মুখে শুনে শুনে অনেকগুলো গল্প, কবিতা, বেশ কয়েকজন লেখক-লেখিকার নাম মুখস্থ হয়ে গেছে লেস্পের। প্রতি সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হবার ক্ষণকাল পরে হাতে একটা বই আর মশার কয়েল নিয়ে চলে আসে কফিলউদ্দিন। ভরাট গলায় আবৃত্তি করে কবিতা, আজ করছে জীবনানন্দের কবিতা। যে কবিতার এক অংশে লেস্পের কথাও আছে। কবিতাটা শুনে লেস্পে যারপরনাই আনন্দিত হয়ে দুলে দুলে হেসে ওঠে। কফিলউদ্দিন একটু বিব্রতই হয়। মনে মনে ভাবে এই গাছটা দোলে কেন? ভূমিকম্প নাকি!
এরপর থেকে অনুভূতি প্রকাশের ব্যাপারে লেস্পে খুব সংযত হয়ে গেছে। তবে কবিতাটি লেস্পে মাঝেমধ্যেই আওড়ায়, মনে মনে আবৃত্তি করে।
“এই পৃথিবীর এক স্থান আছে- সবচেয়ে সুন্দর করুণ
যেখানে সবুজ ডাঙ্গা ভরে আছে মধুকুপী ঘাসে অবিরল,
সেখানে গাছের নামঃ কাঁঠাল, অশ্বত্থ, বট, জারুল, হিজল।“
আহা কী সুন্দর! মাঝেমধ্যে লেস্পের খুব শখ হয়, জীবনানন্দকে খুব কাছ থেকে দেখার। জীবনানন্দ এই রাস্তা দিয়ে কী চলাফেরা করেনা কখনো? লেস্পের খুব জানতে ইচ্ছে করে।
ইদানীং, কফিলউদ্দিন প্রায় সারারাতই লেস্পের গোড়ায় বসে থাকে। আজকাল, রাতের খাওয়াও এখানে বসেই সারে। খাবার বলতে দুটো গোল রুটি, ডাল-ভাজি। খয়েরী রংয়ের চায়ের ফ্লাক্স নিয়ে আসে সাথে করে। রাতের বিভিন্ন সময়ে অল্প অল্প চা খায়। লেস্পে সবই লক্ষ্য করে, ঘুম তো আর আসেনা চোখে। সারারাত তাকিয়েই থাকতে হয়। তবে, কফিলের কর্মকান্ড লেস্পের ভালো লাগে।
সেদিন কফিলউদ্দিন এলো দুইটা বিড়াল সঙ্গে নিয়ে, নিজে লেস্পের গোড়ায় বসে এদের বসালো ফুটপাতের ধূলিধূসর রাস্তায়, বিড়াল দুটোর সাথেই কফিলউদ্দিন শুরু করে দিলো শিল্পসাহিত্য নিয়ে আলোচনা। সেদিন অবশ্য বেশ মজা হয়েছিলো।
কয়েকদিন ধরে বেশ ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছে। সারাদিন আকাশ কালো হয়ে থাকে, থেকে থেকে মেঘের গর্জন, ঝোড়ো বাতাস, বৃষ্টি। তুমুল ব্যস্ত সড়কটা যেন স্নান করে ওঠে বৃষ্টিতে, লেস্পেরও আশ্চর্য লাগে বৃষ্টির জল গায়ে মেখে। কফিলউদ্দিন সন্ধ্যা হলেই একটা ছাতা নিয়ে আসে, সাথে কয়েল, বই, ফ্লাক্স। বই পড়ে, চা খায়, কয়েল ফুরোয়। রাত দশটা বাজে, বারোটা বাজে, চারটে বাজে। সকাল হয়, কফিলউদ্দিন চলে যায়।
আজ সন্ধ্যা থেকেই ঘোরতর বৃষ্টি হচ্ছে। লেস্পে ভেবেছিলো, আজ কফিলউদ্দিন আসবেনা। কিন্তু, সে এলো। সন্ধ্যার খানিকক্ষণ পরেই এলো। কিন্তু, আজ তার হাতে কোনো বই নেই, কয়েল নেই, ফ্লাক্স নেই। সে এসে লেস্পের শেকড়ে বসে, মাথা নুইয়ে কিছুক্ষণ কাঁদলো। কান্নাকাটি শেষে উঠতে যাবে, সহসা তার সামনে এসে দাঁড়ালো দুইজন লোক। দুজনের হাতেই ধারালো চাকু, মুখে রুমাল বাঁধা, কফিলের কাছে যা আছে, সব দিয়ে দিতে বললো তারা। কফিলউদ্দিনের কাছে কিছুই ছিলোনা। কাকুতিমিনতি করছিলো সে, তারই এক ফাঁকে, এক দমকা হাওয়া এসে একজনের মুখের রুমাল খুলে দিলো। কফিল অবাক বিস্ময়ে বললো, “হেলাল,তুই?”
অপ্রস্তুত হেলাল আবৃত পরিচয় অনাবৃত হওয়ায় ক্ষোভে, জেদে ধারালো চাকুর ফলাটা কফিলের বুকে বিদ্ধ করার জন্যে প্রচণ্ডবেগে বাড়িয়ে দিলো। কিন্তু, তার আগেই মট মট করে ভেঙ্গে পড়লো জারুল গাছটা, মাঝবরাবর। দুই ছিনতাইকারীকে চাপা দিলো চাপা ক্রোধে। বেঁচে গেলো কফিলউদ্দিন।
পরিশিষ্টঃ
পরদিন পেপারগুলোর শিরোনামঃ
“গাছ ভেঙ্গে পড়ে দুই পথচারীর মৃত্যু।“
জারুল গাছটা মরে গিয়েছে সেদিনই। মরা গাছের সামান্য অংশ এখনো ভূমির সাথে সংযোগস্থাপণ করে আছে। সেখানে অস্থায়ী চায়ের দোকান দিয়েছে মানিক মিয়া, দিন-রাত সেখানে চায়ের কাপে সশব্দ চুমুক, স্টীলের চামচের টুং টাং, মানুষের গুঞ্জণ।
কফিলউদ্দিন এখনো সাহিত্য চর্চা করে, নতুন একটা গাছ সে খুঁজে পেয়েছে। সে গাছের নীচে বসে সে আজকাল শেক্সপীয়ার পড়ে, মিল্টনের “প্যারাডাইজ লস্ট” পড়ে, তারাশঙ্করের “কবি”ও পড়ে। কিন্তু, নতুন এ গাছটার মস্তিষ্ক নেই। সে লেস্পের মত কান খাড়া করে কফিলউদ্দিনের কথাগুলো শোনেনা, জীবনানন্দের সাথে দেখা হবে কী না, তা ভেবে মনখারাপও করেনা। সে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। তবে প্রাণ কিন্তু তারও আছে।
কারণ, বিজ্ঞানী বলেছিলেনঃ বৃক্ষেরও প্রাণ আছে।
১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:০৭
কূপমন্ডূক বলেছেন: গঠনমূলক মন্তব্যের জন্যে ধন্যবাদ
২| ১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:০৭
সুমন কর বলেছেন: চমৎকার বর্ণনায়, চমৎকার গল্প। উপস্থাপন দারুণ।
+।
১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ রাত ৮:১০
কূপমন্ডূক বলেছেন: চমৎকার মন্তব্য
©somewhere in net ltd.
১|
১৬ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:০১
পুলহ বলেছেন: এমন ক্রিটিকাল এবং সুন্দর একটা লেখায় কোন মন্তব্য নেই- বিষয়টা দেখে একটু খারাপ লাগলো।
গল্পে লেখক পরিমিতবোধের পরিচয় দিয়েছেন, ট্রানজিশনগুলোও বেখাপ্পা নয়। "কারণ, বিজ্ঞানী বলেছিলেনঃ বৃক্ষেরও প্রাণ আছে।" আলদাভাবে সাধারণ একটা লাইন, কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপটে লাইনটা গভীর!
লেখার বর্ণনামূলক অংশগুলো পাঠকের কল্পনাকে প্রবলভাবেই আলোড়িত করে। যখন সে আলোড়ন থেমে যায়, তখন শান্ত পানির বিম্বের মতই সেখানে স্পষ্ট হয় নানারকম ছবি...
সব মিলে এপ্রিসিয়েট করার মত একটা পোস্ট।
শুভকামনা !