নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

খাপ খোলা কলমে শাণিত হোক মঞ্চ...

কূপমন্ডূক

জানা ভালো, না জানা খারাপ, ভুল জানা অপরাধ

কূপমন্ডূক › বিস্তারিত পোস্টঃ

চলচ্চিত্র বিশ্লেষণঃ Lion

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ দুপুর ২:৪৭

দুই ভাইঃ শারু, গুড্ডু। শারু ছোট, বয়স পাঁচ কী ছয়, গুড্ডু একটু বড়। বছর দশেক হবে। শারু, গুড্ডু, ওদের মা কমলা এবং ছোট আরেক বোন শাকিলা কে নিয়ে ওদের সংসার। মা, পাথর টানার কাজ করে কাছেপিঠে কোথাও। খান্ডোয়ার গনেশতলার বস্তিতে বসবাস এই চারটি প্রাণের।

দুই ভাই চুরি করা কয়লা বিক্রি করে মাঝেমধ্যে দুধ কিনে নিয়ে আসে বস্তির ঘুপচি কামরায়। ১৯৮৬ সালের শুকনো, খটখটে এক অজ্ঞাত দিনে চলন্ত ট্রেনের ছাদ থেকে কয়লা চুরি করে, সে কয়লা বেচে দুধ কেনে দুই ভাই। দুধের দোকানের পাশেই ছিলো মিষ্টির দোকান। সে দোকানে ভাজা হচ্ছিলো লাল লাল জিলিপি বা হিন্দী "জালেবী।" শারু জিলিপি খেতে চায়, পকেটে পয়সার অনুপস্থিতিতে জিলিপি খাওয়া আর হয়না। পরে খাওয়াবে বলে ছোটভাই শারুকে নিয়ে বাড়ি আসে গুড্ডু। সে রাতে ট্রেন স্টেশনে আবার আসে দুই ভাই। রাতের স্টেশনে ঘুমন্ত ট্রেন থেকে কিছু হাতানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু, ছোট শারু ঘুমিয়ে পড়ে রাত বাড়তে না বাড়তেই। শারুকে রেলস্টেশনের কাঠের বেঞ্চিতে ঘুম পাড়িয়ে রেখে, জিলিপি আনার প্রতিশ্রুতিতে গুড্ডু চলে যায়, কোনো ট্রেন থেকে কিছু সাফাই করে আনার জন্যে।

কিছুক্ষণ পরে ঘুম থেকে ওঠে শারু। ভাইকে ডাকাডাকি করে, কিন্তু কোথাও তাকে পায় না। এ ট্রেনে, ও ট্রেনে উঠে ভাইকে খুঁজতে খুঁজতে একসময় শারু আটকা পড়ে এক বদ্ধ বগিতে। ট্রেনও চলা শুরু করে। গুড্ডু আর শারু হারিয়ে যেতে থাকে বিপরীত মেরুতে।

ট্রেন খান্ডোয়া থেকে একসময় কলকাতায় এসে পৌঁছায়। সারাদিন এদিক, সেদিক ঘুরে রাতে এক ফ্লাইওভারের নীচে কিছু পথশিশুর সাথে আশ্রয় নেয় শারু। মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে যায় শোরগোলে। কিছু লোক এসে পথশিশুদের তুলে নিয়ে যাচ্ছে। উদ্দেশ্য? শিশুদের পাচার করবে অথবা দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ কেটে বিক্রি করে দেবে চড়াদামে। শারু কোনোরকমে প্রাণ বাঁচিয়ে পালিয়ে আসে সেখান থেকে।

পরদিন, "নুর" নামে এক মহিলার সাথে পরিচয় হয় হাওড়া ট্রেনলাইনের পাশে। সে খাতির করে শারুকে নিয়ে যায় বাসায়। নুরের বাসায় একরাত থাকার পরে শারু বুঝতে পারে, নুরও শিশু পাচারকারী। আবার, পালাতে হয় শারুকে।

জীবন খুব অল্পবয়সেই শারুকে মুদ্রার বিপরীত অংশটি দেখিয়ে দেয়। ধাক্কা খেতে খেতে ছোট শারু এগোয়। নানা ঘাত-প্রতিঘাত, ঘটনা-দুর্ঘটনার পর শারুর জায়গা হয় অস্ট্রেলিয়ায়। অস্ট্রেলিয়ার এক দম্পতি শারুকে দত্তক নেয়। খান্ডোয়ার "শারু" ভাগ্যের ফেরে অস্ট্রেলিয়ায় নতুন জীবন শুরু করে।

কেটে যায় বিশ বছর। ছোট শারু বড় হয়। ভারতীয় কিছু ছাত্রছাত্রীর সাথে কোনো একটি ক্লাস করতে গিয়ে পরিচয় হয়, বন্ধুত্ব হয়। একদুপুরে সবাই মিলে "ভারতীয় খাবার" খাবার সময়ে টেবিলের ওপরে শারু দেখতে পায় সবুজ নকশা করা প্লেটে লাল লাল জিলিপি। রিভিউ'র প্রথম অংশে যে জিলিপির কথা বলেছিলাম। টাকার অভাবে যে জিলিপি খাওয়া হয়নি শারুর, যে জিলিপি আনতে গিয়ে আর ফিরে আসেনি গুড্ডু, সেরকম জিলিপি...

স্মৃতি বড় অসামাজিক বস্তু। হুটহাট, অবাঞ্ছিত অতিথির মত চলে আসে মস্তিষ্কে, গ্রে ম্যাটারকে অযথাই চঞ্চল করে দেয়। শারুর মস্তিষ্কেও তেমনি চলে আসে মরে যাওয়া অতীত, চলে আসে গুড্ডু, চলে আসে বিশ বছর আগের পরিবারের স্মৃতি। কিন্তু, শারু জানতো না যে, সে খান্ডোয়ায় থাকে। সে শুধু তার গ্রামের(গনেশ তলা) নাম জানতো, তাও ভুল নাম জানতো। কারণ, গনেশ তলা নামে কোনো গ্রাম নেই ভারতের মানচিত্রের কোথাও। এ অবস্থায় শুধু তার একটা জিনিসই মনে ছিলো, তার গ্রামের পাশে যে রেলস্টেশন সেখানে রেইন ট্যাঙ্ক ছিলো। কিন্তু, ভারতের অজস্র রেলস্টেশনের পাশেই রেইন ট্যাঙ্ক আছে। তাহলে? এত বছর পরে কীভাবে শারু নিজের বাড়ি ফেরার পথ খুঁজে পাবে?

খড়েরগাদা থেকে সুঁই খোঁজার মত শুরু হয় শারুর অভিযান। যে অভিযানে সঙ্গী কিছু আহত, নিহত অতীত, কিছু টুকরো সমীকরণ আর অন্তর্জালের গুগল আর্থ। শুরু হয় এক শারুর ইরেজারে মুছে যাওয়া সরলরেখা খুঁজে পাওয়ার লড়াই...

শারু কী শেষপর্যন্ত সরলরেখার মূলবিন্দু খুঁজে পাবে? নাকি, খড়েরগাদা থেকে সুঁই আর পাওয়া যাবে না? সমীকরণ কী মিলবে না হিসেবে ভুল হয়ে যাবে?

এসব জানতে হলে "লায়ন" অবশ্যই দেখতে হবে।

ব্যক্তিগত মতামতঃ বইয়ের ক্ষেত্রে আমরা প্রায়ই বলি "অবশ্যপাঠ্য।" তেমনি, এ সিনেমাও "অবশ্যদেখ্য" বলা উচিত। শুরু থেকে কাহিনীর গতিশীলতা বেশি মুগ্ধ করেছে। সিনেমার প্রথম অংশে হিন্দী, বাংলা শব্দই ব্যবহার হয়েছে শুধু। তাই কিছুটা চমকে গিয়েছিলাম। সন্দেহ হচ্ছিলো, আসলেই কী এটা হলিউডি ছবি? দ্বিতীয় অংশে ইংরেজী ভাষার ব্যবহার আশঙ্কা কমিয়েছে। সিনেমার প্রথম অংশের চেয়ে দ্বিতীয় অংশ একটু কম গতিশীল ছিলো। কাহিনী মাঝের দিকে একটু ঝুলে গিয়েছিলো। তবে, ক্লাইম্যাক্সে আবার বাজিমাত। সিনেমার "কলকাতা" অংশে বাংলা ভাষা বেশ ভালো লেগেছে, বাঙ্গালী তো, সেন্টিমেন্ট আর কী! কুশীলব সূচিতে নওয়াজউদ্দিন সিদ্দিকের নাম দেখে একটু নড়েচড়ে বসেছিলাম। কিন্তু, তাকে মাত্র দুই-তিন মিনিটের ছোট একটি দৃশ্যে নেয়া হয়েছে দেখে খানিকটা হতাশ হয়েছি। সিনেম্যাটোগ্রাফী নিয়ে কী বলবো? অসাধারণ! রেলস্টেশনে ভাইকে খুঁজে না পেয়ে অন্ধকারে দিশেহারা হাঁটার দৃশ্য কিংবা ছোট্ট শারুর কলকাতার বিশাল সব অপরিচিত রাস্তায় হাঁটার বৈপরীত্য, অথবা, ক্যাফের বাইরে রাস্তার পাশে ফুটপাতে বসে কল্পিত স্যুপ খাওয়ার অভিনয়ের অভিনবত্ব, অনেকগুলো বাদামী রঙা প্রজাপতির উড়ে যাওয়ার মাঝখানে ছোট শারুর দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকার দৃশ্য... ক্যামেরার চোখে সবকিছুই উঠে এসেছে দারুণ শৈল্পিকভাবে, মুগ্ধ হয়ে দেখেছিও। বেশ কয়েকটি "ড্রন শট" ছিলো, সবকয়টিই অনবদ্য।

"স্লামডগ মিলিয়েনিয়ার"খ্যাত দেভ প্যাটেল ছিলেন বড় শারুর চরিত্রে, দুর্দান্ত অভিনয় করেছেন। শারুর বিদেশি মা চরিত্রে নিকোলে কিডম্যান এবং বাবার চরিত্রে "ডেভিড ওয়েনহাম" অসাধারণ অভিনয় করেছেন। শারুর বান্ধবী "লুসি" চরিত্রে রুনি মারার অভিনয়ও ভালো ছিলো।

তবে, সবাইকে ছাপিয়ে, ছোট্ট শারুর অভিনয় বেশি ভালো লেগেছে। "সানি পাওয়ার" নামের শিশুটি আলুথালু চুল আর বড়বড় চোখে যে অভিনয়টা করেছে, সেটা করা খুবই কঠিন ছিলো। দক্ষতার সাথে অভিনয় করে গেছে সিনেমার "শারু" কিংবা বাস্তবের সানি। অসাধারণ!

ভালো কথা, সিনেমাটি সত্যঘটনা অবলম্বনে নির্মিত। শারু ব্রেইয়ারলির "A Long Way Home" অবলম্বনে "Lion" সিনেমার পরিচালক ছিলেন গ্যারথ ডেভিস।

আচ্ছা, মনে প্রশ্ন জাগছে না, সিনেমাটির নাম "Lion" কেনো? পুরোপুরি একটি অপ্রাসঙ্গিক নামকরণ মনে হচ্ছেনা? ঠিক এমনটা আমিও ভেবেছিলাম। পরে, সম্পূর্ণ ভুল প্রমাণিত হয়েছি। এখানে, নামকরণের পেছনের কারণটা লিখে দিতে চাচ্ছিনা। তাহলে, সিনেমা দেখার মজাটা আর পাবেন না। যখন নামকরণের স্বার্থকতা ধরতে পারবেন, তখন নিজের অজান্তেই মুখে একটা হাসি চলে আসবে আপনার, গ্যারান্টেড।

কিছু ট্রিভিয়া দিই। ভারতে প্রতি বছর প্রায় ৮০,০০০ শিশু হারিয়ে যায় তাদের পরিবার থেকে। "Lion" সিনেমার পেছনে যারা আছেন, তারা ভারতসহ গোটা বিশ্বের যত "পথহারা শিশু" আছে তারা যাতে আবার বাড়ি ফেরার পথটা ফিরে পেতে পারে, সে চেষ্টা করছে। আপনিও শামিল হতে পারেন এ কাজে। ভিজিট করুন http://www.lionmovie.com এবং দেখুন তাদের কাজ এবং আপনি চাইলে সেখানে আপনার অবদানটুকুও রাখতে পারেন।

সবমিলিয়ে, দশে বারো দেয়ার মত সিনেমা "লায়ন।" এ সিনেমা ভালো না লেগে উপায় নেই, আসলেই নেই।

সাধারণ জ্ঞানঃ

Movie: Lion
Director: Garth Davis
Genre: Biography, Drama.
Cast: Dev Patel, Nicole Kidman, Rooney Mara
Release: 6 January, 2017
IMDB Rating: 8.1/10

মন্তব্য ৪ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (৪) মন্তব্য লিখুন

১| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:০৩

নূর মোহাম্মদ নূরু বলেছেন:
ব্যাস্ত জীবনে মুভি দেখার মতো সৌভাগ্যবান কত জন হয় আপনার মতো!!
তবুও ধন্যবাদ আপনাকে ঘোলে দুধের স্বাদ দেবার জন্য।

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:১৬

কূপমন্ডূক বলেছেন: ধন্যবাদ। সপ্তাহে দুয়েকটা মুভি দেখার চেষ্টা করুন। ভালো লাগবে।

২| ১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ বিকাল ৩:০৭

সুমন কর বলেছেন: রিভিউ ভালো লিখেছেন। আমার কাছেও, ছোট্ট শারুর অভিনয় বেশি ভালো লেগেছে। যদি মাঝে একটু স্লো ছিল, তবে মুভিটি ভালো লেগেছে।

+।

১৬ ই এপ্রিল, ২০১৭ রাত ৯:১৭

কূপমন্ডূক বলেছেন: ধন্যবাদ।

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.