![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
মহারাজা, তোমারে সেলাম
------------------------------------------------------------------------------------
তখন বোধহয় প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। বানান করে করে গল্পের বই পড়ছি একটুআধটু। বড়ভাই চলে গেছে ঢাকায়, নটর ডেম কলেজে পড়াশোনা করছে। এক ছুটিতে বড়ভাই বাড়িতে এলো, সে প্রতিবার ছুটিতে বাড়িতে ফিরলেই আমার জন্যে বই নিয়ে আসতো। সুনীলের কাকাবাবু, হার্জের টিনটিন, প্রাণের চাচা চৌধুরী, সমরেশের ত্রিরত্ন ... নানারকম বই। এবার নিয়ে এলো অন্য একটা বই, বেশ ঢাউস সাইজের। ওপরটা সাদা মলাট দিয়ে বেশ ভালোভাবে আটকানো। সেই মলাটের উপরে সবুজ কালিতে সুন্দর করে আমার নাম লেখা। বইটা খুললাম, বইয়ের নামঃ "শ্রেষ্ঠ ফেলুদা।" ফেলুদার সাথে সেদিন থেকেই পরিচয়। ছয় ফুটের এ "প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর" ফেলুদা তাঁর স্যাটেলাইট তোপসে আর সাদাসিধে রহস্যরোমাঞ্চ ঔপন্যাসিক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ূকে নিয়ে হিল্লী-দিল্লী ঘুরে বেড়াতেন, কখনো মগনলাল মেঘরাজ, কখনো বনবিহারী সরকারের জারিজুরি ফাঁস করতেন... ফেলুদা ওরফে প্রদোষচন্দ্র মিত্রের প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো ভূভারতে জন্মেনি।
"শ্রেষ্ঠ ফেলুদা" তে অল্প কয়টা উপন্যাস আর গল্প ছিলো। এই বই শেষ করার পরে "পাহাড়ে ফেলুদা", "কলকাতায় ফেলুদা" কিনলাম। একবার লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলাম দোকানের তাকে "ফেলুদা সমগ্র-১" বইটা চকচকে চোখে তাকিয়ে আছে। বাবার পকেটের ৫০০ টাকা খসিয়ে বইটা কিনলাম। বাবার থমথমে মুখ দেখে সেদিন খুব মজা পেয়েছিলাম।
বিটিভিতে "ফেলুদা" কে নিয়ে সিরিজ হতো। ফেলুদা চরিত্রে সব্যসাচী চক্রবর্তী, জটায়ূ চরিত্রে বিভু ভট্টাচার্য, তোপসে চরিত্রে শাশ্বত চট্টোপাধ্যায় অভিনয় করতেন। তখন বয়স অল্প ছিলো, অত ভালো বুঝতাম না ডিটেকটিভ সিরিজ। তখন আলিফ লায়লা, সিন্দাবাদ, গডজিলা... টাইপের জিনিসগুলোই ভালো লাগতো। এখন, যখনই সময় পাই, ইউটিউব থেকে দেখি ফেলুদার সিরিজটা। অবসর ভালো কেটে যায়।
একটু যখন বড় হলাম, প্রোফেসর শঙ্কুর সাথে পরিচয় হলো। আধপাগলা বিজ্ঞানী তিনি, গিরিডিতে থাকেন বিড়াল "নিউটন" আর চাকর "প্রহ্লাদ" কে নিয়ে। উদ্ভট উদ্ভট সব আবিষ্কার করেন প্রতিদিন। সায়েন্স ফিকশনের সাথে টানটান এ্যাডভেঞ্চারের এ অপূর্ব মিশেল, তাও বা কে দেখেছে কবে?
আরেকটা চরিত্র ছিলো, তারিণীখুড়ো। আমাদের সবার শৈশবেই কেউ না কেউ ছিলেন, যিনি রাতের অন্ধকারে সলতের নিভু নিভু পিদিমের আলোয় বসে শোনাতেন সুয়োরানী-দুয়োরাণীর গল্প, রাক্ষসের গল্প। তারিণীখুড়োও সেরকম ছিলেন। তাঁর পাঁচটি খুদে শিষ্য ছিলো। এই শিষ্যদের তিনি তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের গল্প শোনাতেন। বৈঠকি চালে বলা গল্পগুলো ছিলো অতিমাত্রায় অদ্ভুতুড়ে , রোমাঞ্চকরও।
এই ফেলুদা, প্রোফেসর শঙ্কু, তারিণী খুড়ো... এই চরিত্রগুলোর স্রষ্টা, আমার প্রিয় লেখক সত্যজিৎ রায়ের আজ জন্মদিন। আমার প্রিয় লেখক অনেকেই আছেন। কিন্তু, আমি এই লোকটির মতই হতে চেয়েছি সবসময়। জানি, "সত্যজিৎ রায়" নামক পর্বতের মত হওয়ার কল্পনা, পরাবাস্তব চিন্তাভাবনা। তবুও, কল্পনায় তো খোঁড়া লোকটাও পাহাড় ডিঙোয়,তাই না?
আসলে, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে কমকথায় কী বলা যায়, বুঝতে পারছিনা। একজন সৃষ্টিশীল মানুষের যা যা গুণ থাকা দরকার, সবই ছিলো তাঁর। স্কেচ করতেন, বই লিখতেন, সিনেমা বানাতেন, সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন, ক্যালিওগ্রাফী করেছেন, বিজ্ঞাপন বানিয়েছেন, গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন, এমনকী "গুপি গাইন বাঘা বাইন" সিনেমায় গানও গেয়েছেন। এ পিওর পলিম্যাথ হি ওয়াজ!
সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলোও অসাধারণ বললে কম হয়ে যায়! "পথের পাঁচালী" দেখা সিনেমাগুলোর মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আছে বহুদিন ধরেই। অশণি সংকেত, অপরাজিত, অপুর সংসার, শাখা-প্রশাখা, পরশপাথর, নায়ক, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা... একেকটা সিনেমা একেকরকম। একেক ধাঁচের, একেক স্টাইলের। কোনটাকে রেখে কোনটাকে শ্রেষ্ঠ বলি! কোনটাকেই বা ফেলে দিই বাতিলের স্তুপে? সে ধৃষ্টতাও বা কোথায় আমার? ভিত্তোরিও ডি সিকার "দ্য বাইসাইকেল থিফ" দেখে ছবি বানানোর ভূত মাথায় আসা লোকটি জীবদ্দশায় তৈরী করেছেন ৩৬ টি চলচ্চিত্র। সেগুলো দেশে-বিদেশে সম্মানিত হয়েছে, ভূয়সী প্রশংসা কুড়িয়েছে।
১৯২১ সালের দোসরা মে'তে কলকাতায় জন্ম এ মানুষটির। বাঙ্গালিদের এমনিতেই বিদেশে খুব একটা সুনাম নেই, বাঙ্গালিকে সবসময়ই অবজ্ঞার চোখে দেখা হয়েছে। কিছুটা নীচু চোখে, কিছুটা অবজ্ঞা মেশানো, তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বাঙ্গালীকে দেখা হয়েছে বরাবর। তবে, বিদেশিরাও দুয়েকজন বাঙালিকে নিয়ে বৈষম্যমূলক কথা বলার দুঃসাহস দেখাতে পারেননি কোনোদিন। রবিঠাকুর তো "সাহিত্যে নোবেল"পেয়ে ভেঙেছিলেন সেকালের ব্রিটিশদের উঁচু নাক, সত্যজিৎ সিনেমা নির্মাণ করে বিদেশিদের বুঝিয়েছিলেন, দুপুরে গাণ্ডেপিণ্ডে গিলে- ভোঁসভোঁস করে ঘুমিয়ে-উঁচু ভুঁড়ি নিয়ে চলারাই শুধু বাঙালি না। বাঙালিরা হলিউডের লাইফটাইম অস্কারও পায়। তিনিই দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব যাঁকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করে (প্রথম চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব হিসেবে অক্সফোর্ডের ডিলিট পেয়েছিলেন চার্লি চ্যাপলিন)। ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সের সরকার তাঁকে সেদেশের বিশেষ সম্মানসূচক পুরস্কার লেজিওঁ দনরে ভূষিত করে। ১৯৮৫ সালে পান ভারতের সর্বোচ্চ চলচ্চিত্র পুরস্কার দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার। ১৯৯২ সালে মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বে একাডেমি অফ মোশন পিকচার আর্টস অ্যান্ড সাইন্সেস তাকে আজীবন সম্মাননাস্বরূপ একাডেমি সম্মানসূচক পুরস্কার প্রদান করে। মৃত্যুর কিছুদিন পূর্বেই ভারত সরকার তাঁকে প্রদান করেন দেশের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্ন। সেই বছরেই মৃত্যুর পরে তাঁকে মরণোত্তর আকিরা কুরোসাওয়া পুরস্কার প্রদান করা হয়। প্রয়াত পরিচালকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন শর্মিলা ঠাকুর।
আসলে, "রায় পরিবার" এর বংশলতিকায় চোখ বুলালে বোঝা যায়, এদের পুরো পরিবারটাই অসাধারণ। সত্যজিৎ রায়ের দাদু উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী ছিলেন কিংবদন্তি লেখক। উপেন্দ্রকিশোরের ছেলে সুকুমার রায়। সুকুমার রায় কে নিয়ে কিছু আর নাই বা বললাম! সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায়। একটা পরিবার বংশপরম্পরায় কীভাবে এরকম ঈর্ষনীয় মেধাবীর জন্ম দেয় বরাবর, সেটা অবশ্যই ভাবার বিষয়!
কথা আর না বাড়াই। সত্যজিৎ রায়ের খুব বড়মাপের ভক্ত আমি, তাই হয়তো লেখাটা অনেকখানিই বেড়ে গেছে। কাটছাঁট করে হয়তো কমানো সম্ভব। তবে, সে চেষ্টা করছিনা। সত্যজিৎ রায়ের নিমিত্তে এ ক্ষুদ্র নৈবেদ্য নাহয় রইলো। দিনশেষে শৈবালের মত উচ্চকণ্ঠে বলতে পারবো, "লিখে রেখো, এক ফোঁটা দিলেম শিশির।"
শুভ জন্মদিন, মানিকবাবু।
০২ রা মে, ২০১৭ রাত ৮:০২
কূপমন্ডূক বলেছেন: শুভ জন্মদিন
©somewhere in net ltd.
১|
০২ রা মে, ২০১৭ সন্ধ্যা ৭:৪৭
রুমি৯৯ বলেছেন: ভালো লাগলো৷
শুভ জন্মদিন স্যার সত্যজিৎ রায়৷৷