![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এক.
পুরো গাঁ তলিয়ে আছে অন্ধকারে। ঘনঘন ঝি ঝি পোকাদের ডাক। দূর থেকে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া ভেসে আসছে। কোন কোন বাড়িতে টিমটিময়ে কুপি জ্বলছে। মাথায় একটা গামছা ঘোমটার মতন পেঁচিয়ে নদীর পাড় ধরে হাঁটছে সলিম। রাত এখন তেমন একটা না হলেও, গ্রামের জন্য গভীর রাত। সলিম যাচ্ছে কুসুমদের বাড়ি। কুসুমের সাথে দেখা করে বিদায় নিতে যাচ্ছে সে। কুসুমকে ভীষণ ভালোবাসে সলিম। কুসুমও কম না। সেই ছোট বেলা থেকে তাঁরা একে-অপরকে ভালোবাসে। গত দুইমাস পূর্বে তাদের বিয়ে হওয়ার কথা ছিলও। দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ায়, বিয়েটা থেমে যায়।
ঘরের জানালা দিয়ে ফিসফিস করে কুসুমকে ডেকে তোলে সলিম। কুসুম একটা কুপি হাতে জানালা খোলে___
-কেডা ? ওহ তুমি।
-হ রে। আমি, আমি রে কুসুম। কেমন আছস রে তুই?
-কেমন আছি, এতো রাইতে তুমি এইডা জিগাইতে আইছ !
-আরে নাহ। তোরে দেখবার জন্য পরানডা পুড়াইতাছিলো। ঘাটলা পাড় একটু আয় না। কি রে সখী, আহস না।
-বাজান উইঠা পড়ব। দেখলে সর্বনাশ হইয়া যাইব। তুমি যাও। কাইল দেহা করুম নে। যাও তো।
-কাইল ! নাহ রে। এহন একটু আয় না। আমি ঘাটলার পাড় খাড়াইলাম। তুই আয়।
বক্তাবলী গ্রামটি কৃষি প্রধান। এটি একটি বিচ্ছিন্ন চরাঞ্চল। এখানকার মানুষ কালে ভদ্রে শহর দেখে। শহর কেমন তা পুরুষরা কিছুটা জানলেও নারীরা বলতেও পারবে না শহর দেখতে কেমন হয়। স্বামী-সন্তানদের মুখেই কেবল শোনা হয় শহর, শহর। তাদের দেখা আর হয় না__শহর কেমন।
গ্রামটি আয়তনের দিক দিয়ে তেমন একটা ছোট না হলেও জনবসতি খুবই কম। এখানে শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যম কেবল মক্তব। স্কুল বা কলেজ নেই এখানে। এখানকার মানুষগুলোও শিক্ষিত নয়। তবে অনেক সহজ-সরল।
তমিজ বেপারী এই গ্রামের মধ্যে টাকাওয়ালা লোক। গঞ্জে তাঁর মোকাম আছে। তমিজ বেপারীর ছেলে সলিম। সলিমের দিক চেয়ে তমিজ বেপারী হাশেমের মেয়ে কুসুমের সাথে তাঁর বিয়ে ঠিক করে। সলিমের সাথে কুসুমকে বিয়ে দিতে হাশেমের কোন আপত্তি নেই। বরং তিনি খুশিই হয়েছেন। হাশেম বলেছিল, এবারের ফসল উঠলে তা বিক্রি করে মেয়ের বিয়ে দিবেন। তমিজ বেপারীও তাই ভালো বলে মত দেন। তবে বিয়ের পাকা কথা তাদের মধ্যে হয়ে আছে।
কুসুমদের ফসল উঠতে আরও অন্তত ৫ মাস। কিছুতেই তর সহ্য হচ্ছে না সলিমের। সলিম ঘুরে ফিরে কুসুমদের ক্ষেতটাকে দেখা যায়। ফসল কতোটুকও কি হলও, তাই সে দেখে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ফলস উঠার সময় যেনও ঘনাচ্ছে না। এরমধ্যেই দেশের পরিস্থিতি ভয়াবহ।
ঢাকার শহর পাকিস্তানি আর্মিরা একরকম দখলে নিয়েছে। তাঁরা নিরস্ত্র বাঙালীদের উপর নির্বিচারে গুলি করছে। মানুষ মারছে হাজারে হাজারে। ছাত্ররাও জয় বাংলা শ্লোগানকে পুঁজি করে একাট্টা হচ্ছে। পাশাপাশি সারা দেশের মানুষও মুখে তুলে নিয়েছে জয় বাঙলা শ্লোগান।
এমন পরিস্থিতিতে সলিম আর কুসুমের বিয়েটা সময় মতো হয় নি। সলিম সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যুদ্ধ না থামা পর্যন্ত সে-ও বিয়ে করবে না। এমন কি নিজেও যোগ দিবে মুক্তি বাহিনীতে। কাল ভোরের আলো ফুটে উঠার আগেই সলিম ট্রেনিং এর জন্য কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিবে। তাই কুসুমের সাথে শেষ দেখাটা করার জন্য সে এতো রাতে এসেছে। এই গ্রামের আরও ক'জন যুবক ও কিশোর-ও যোগ দিবে কাদেরিয়া বাহিনীতে।
সলিম ঘাটলা পাড় অপেক্ষা করছে কুসুমের জন্য। কুসুম ভীরু পায়ে হাতে কুপি নিয়ে সলিমের পিছনে এসে দাঁড়ায়। আলো দেখতেই সলিম বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। অপার মুগ্ধতা নিয়ে কুসুমের ভয়ার্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কুপির আলোতে আরও অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে কুসুমকে। কালো মুখটাতে একটা কেমন যেন লজ্জা। দেখতেই ভালো লাগছে। নীরবতা ভাঙে কুসুম, বলে___
-কি দেহ অমন কইরা? চোখ নামাও কইতেছি, আমার শরম লাগে___বলেই কুসুমের ঠোঁটে স্মিত একটা হাসি খেলে যায়।
-হা হা। শরম ! শরম কিসের ? আমার চান বদনি সখী-ডারে নয়ন ভইরা দেখবার কি আমার মুন চায় না।
-যাও, ঢঙ করন লাগব না।
সলিম ঘাটের পাড় দূর্বা ঘাসের উপর বসে পড়ে। এক হাত দিয়ে সলিম কুসুমকেও টেনে বসিয়ে দেয় পাশে। দু'জন পাশাপাশি বসে আছে। কুসুমের একটা হাত পরম আদরে নিজের হাতের মুঠোয় তুলে নেয় সলিম। কুসুম সলিমের হাত থেকে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নেয়, বলে___
-হইছে, ছাড়ো। আর নয়নায় করতে হইব না। তোমার মতলব ভালা ঠেকতাছে না।
-হা হা___খিলখিল করে হেসে উঠে সলিম।
কুসুম সলিমের হাসি থামিয়ে দেয়, অবাক চোখে সলিমের দিকে তাকিয়ে কুসুম, বলে___
-আইচ্ছা, এই যুদ্ধ কী শেষ হইব না ! আমার অনেক ডর করে। আল্লাহ জানে__কি যে হইব।
-ভাবিস না। আর ক'ডা দিন। দেখবি যুদ্ধ থাইমা যাইব। সারা দেশের মানুষ জাইগা উঠছে। বাংলাদেশ স্বাধীন করনের লাইগা জান বাজি ধরতাছে মানুষ। জোরে জোরে চিক্কুর দিয়া কইতাছে___জয় বাঙলা। জয় বাঙলা।
-আমার অনেক ডর করে। মেলেটারিরা বলে পাখি মারার লাহান হমানে মানুষ মারতাছে? লও, আমরা পলাইয়া যাই অন্য-হানে।
-নাহ রে। তা কি হয়! বাপ-দাদার ভিটা-মাটি ফালাইয়া কই যামু ? আর বেবাগখানেই তো এমন যুদ্ধ! তুই ডরাইস না।
-তুমি-ও কি মুক্তি বাহিনীত যাইবা ?
-হ, যামু তো। বেহান বেলায় যামু। হের লাইগ্যাই তো তরে কইতে আইছি।
-নাহ, তুমি যাইও না। লও, আমরা অন্য কুনখানে পালাইয়া যাই। বিয়া করি। সংসার করি। লও...
-ধুর পাগল। মায়ের এমুন বিপদে সন্তান কী পালাইতে পারে ? যারা পারে, তাঁরা হইলো কুলাঙ্গার পোলা। তুই ডরাইস না। আমার কিচ্ছু অইব না।
-নাহ, তবুও তুমি যাইও না। তোমার কিছু হইলে আমি বাচুম না। দোহায় তোমার। তুমি যাইও না।
- তুই ভাবিস না কুসুম। ডরাইস না। আমি মুক্তি ভাইয়ে গো লগে যুদ্ধে যামু। মারে বিপদ থাইকা রক্ষা করুম। তারপর, আমারা বিয়া করুম। সুখের সংসার করুম। তুই ভাবিস না কুসুম। দেখিস, সব আবার আগের লাহান হইয়া যাইব।
দুই.
-বাজান, আমারে কইচ্চা (সবুজ) জামা আর লাল ফিতা কবে আইনা দিবা?
-দিমু রে মা, দিমু। ফসল তো বেচবার পারতাছি না। তয় ভাবিস না। তাড়াতাড়িই কিনা দিমুনি।
রমজান'র কিশোরী মেয়ে রানু। অনেকদিন আগের থেকেই বাবাকে বলেছিল একটা সবুজ জামা আর লাল ফিতা কিনে দিতে। রমজান-ও বলেছিল এবার ফসল বিক্রি করে ফেরার পথে মেয়ের জামা আর ফিতা কিনে আনবে। এর মধ্যে শুরু হলো দেশে যুদ্ধ। ফসল-ও বিক্রি হয় নি। মেয়ে-ও ঘুরেফিরে বাবার কাছে একই বায়না। বাবা-ও প্রতিদিন সান্ত্বনা দিচ্ছে।
রমজান'র ভিটে বাড়ি ছাড়া কোন জমি নেই। তমিজ বেপারীর একটা জমিতে বর্গা চাষ করেই চলে। পাশাপাশি নদীতে মাছ ধরা আর অন্যের জমিতে বদলা খেটেই আয় রোজগার। দেশে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই পরিবারটির মাঝে চরম অভাব দেখা দিয়েছে। রমজানের স্ত্রী রাশিদা। সে ক্ষেত এবং মাঠ সহ বিলের জল থেকে শাক কুড়িয়ে এনে কোন রকমে রান্না করে সংসার চালাচ্ছেন। এরমধ্যে মেয়ের আবদার। রীতি মতো সে তিক্ত-বিরক্ত। রানু ফের কি যেন বলার চেষ্টা করছিলো রমজানকে। রাশিদা মেয়েকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেন। রাশিদা অনেকটা বিরক্ত নিয়ে মেয়েকে বলেন___
-ওই মাইয়া, অমন পরপর করিস না। মেলা রাইত অইছে। অহন ঘুমা___এই বলেই রাশিদা কুপির আগুনটা দম দিয়ে নিভিয়ে দেন। রাশিদার মাথার কাছেই জ্বালানো ছিলো কুপিটা। রানু আর কোন কথা না বলে চুপ হয়ে যায়।
তিন.
মিনতি শীল। পরিমল শীলের মা। বয়সের ভারে প্রায় ন্যুব্জ। কিন্তু এখনো পূজা অর্চনায় যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করেন। রোজ নিয়ম করেই দু'বেলা পুঁজর জোগাড়-যন্তর তিনি নিজেই করেন। দেশের এমন পরিস্থিতিতে তিনি বেশ উতলা। তাদের আশপাশের অন্যান্য হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ইতোমধ্যেই ভারত পারি জমিয়েছে। তিনিও বেশ ক'বার পরিমলকে বলেছিল___
-ল বাপ, আমরা ভারত চইলা যাই।
পরিমল তার মাকে স্পট জানিয়ে দিয়েছে___
-ওইহানে যাইয়া আমাগো কাম কি! কেডা আছে ওইহানে আমাগো। ওইডা তো আমগো দেশ না। তাইলে ক্যান যামু নিজেগো দেশ ছাইড়া ? মরতে অয় এইহানেই মরমু। তবুও বিনদেশী গো ডরে নিজের বাপ-ঠাকুর দার ভিটে মাটি ছাড়ুম না।
-বাপ রে। ওইহানে নাকি কিয়ের শিবির আছে। এই দেশ থাইকা যারা যায়, তাগরে নাকি ওইহানে থাকন আর খাওন দেয়। ল বাপ, আমরা ওইহানেই যাই।
-তোমারে কেডা কইছে এই কতা ?
-ক্যান, তুলসীরা যাওনের সময় তো এইডাই কইলো। শম্ভুরা-ও তো তাই কইলো। তাঁরা তো বেহাগতেই ওই দেশে চইলা গেছে।
-না মা, যারা গেছে যাউক। তুমি চাইলে তুমিও যাও। আমি এই দেশ ছাইড়া কুনোখানে যামু না।
পরিমল এই গ্রামের একমাত্র নরসুন্দর। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে চুল দাড়ি কামিয়ে তাঁর সংসার চলে। বয়স হয়ে এলোও এখনো সে ছেলে-পুলের মুখ দেখে নি। নিঃসন্তান পরিমল। সন্তান না হওয়া নিয়ে তাঁর স্ত্রী সুশীলার কষ্টের অন্ত নেই। তবুও সব কিছুই সে হাসি মুখে মানিয়ে নিচ্ছে।
পরিমলের বাড়িতে তাদের সাথে তাঁর সদ্য অষ্টাদশী বিধবা বোন জয়ন্তী-ও থাকেন। নদীর ওপাড়ে সাপের চর বিয়ে হয়েছিলো জয়ন্তীর। বিয়ের ছ'মাসের মাথায় স্বামী মারা যায়। চোখের সামনে অল্প বয়সের বোনটা সাদা থান পড়ে মন মরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়, দেখলেই কষ্টে বুকটা ফেটে যায় পরিমলের। ওদিকে মায়ের ঘ্যানর ঘ্যানর। তারপর আগের মতো আর রোজগারও নেই। সব মিলিয়ে পরিমল বেশ চিন্তিত।
চার.
শফিক সবে মাত্র মেট্রিক পাস করেছে। শহরে খালার বাড়ি থেকে পড়াশোনা করেছে। এই গ্রামের মধ্যে একমাত্র শিক্ষিত ছেলেই সে। বাবা হাফিজউদ্দিন। পেশায় কৃষক। দুই ভাই দুই বোনের মধ্যে বড় শফিক। খালার বাড়ি থেকে কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা তাঁর। কিন্তু সে দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত কলেজে ভর্তি হবে না। এরমধ্যে আবার সে যুদ্ধে যাবে বলেও বাড়িতে জানিয়েছে। তাঁর মা আমিনা খাতুন, কিছুতেই ছেলেকে যুদ্ধে যেতে দিবেন না। বাবারও কড়া নিষেধ। কিন্তু শফিক কোন নিষেধই মানছে না। সে যুদ্ধে যাবেই।
-ওই পোলা কি কস ! তুই এমুন গেদা পোলা কিয়েরে যুদ্ধে যাবি! কি কস এগুলান ?
-মা, আমি যামু। আমি গেদা না। এইবার মেট্রিক পাস করছি আমি। আমার মতন আরো অনেকেই যুদ্ধে গেছে। আমারে না কইরো না মা।
-নাহ বাজান। তুই পোলাপান মানুষ। এই বন্দুক লইয়া যুদ্ধ করনের কাম তোর না।
-মা, এইডা কেমুন কতা কও! তুমি না মা! এই দেশডাও তো তোমার লাহান। তোমার উপর কেউ আঘাত করলে কি আমি চুপ ক'রে ব'সে থাকমু ! উত্তর দ্যাও মা। কতা কও।
ছেলের এমন কথার কি উত্তর হয় ? আমিনার জানা নেই। আমিনা আকাশের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে আছে। ছেলের কথা শোনে তাঁর চোখ দিয়ে গড়গড় করে পানি গড়িয়ে পড়ছে। আমিনা একটু সময় চুপ থেকে নিজের আঁচল দিয়ে চোখ মুছে নেন। আমিনা ছেলেকে জোড় হাতে ছেলেকে বুকে চেপে ঢুকরে ঢুকরে কেঁদে উঠেন। তিনি তাঁর কান্না থামাতে পারেন না। কাঁদতে কাঁদতে তিনি শফিককে বলেন___
-যা বাপ। যা তুই, যুদ্ধে যা। আমি এই দেশডার জন্য তোরে উৎসর্গ করলাম। যা বাপ। মায়ের সম্মান রক্ষা করে ফিরা আয়।
হাফিজউদ্দিন মা আর ছেলের কাণ্ড দেখা থ মেরে দাঁড়িয়ে থাকেন। কি বলবেন তিনি! নিজেও কিছু বুঝতে পারছেন না। হাফিজউদ্দিন শুধু আমিনার কাঁধে হাত রাখেন নিঃশব্দে। ছেলে যুদ্ধে যাক, তা হাফিজউদ্দিন চাননি সত্যি। কিন্তু সেটা তিনি চাননি আমিনার কথা ভেবে। এখন আমিনা ছেলেকে ছাড়তে চাইছেন। এটা ভাবতেই তাঁর খুব ভালো লাগছে।
(চলবে)
©somewhere in net ltd.