![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
এস কে এস আলী
মুসলিম ইতিহাস তত্ত্বের ইতিহাসে ইবনে খালদুন ছিলেন এক অসাধারন ব্যক্তিত্ত্ব, যিনি চর্তুদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে আবির্ভূত হন।তিনি একাধারে ছিলেন দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসবিদ। তার বিখ্যাত কীর্তি হল ”কিতাবুল ইবার ওয়া দিওয়ান আল মুবতাদা ওয়াল খবরই আইয়াম আল আরাব আল আযম আল বারবার” নামক ইতিহাস গ্রন্থ। তার এই ইতিহাস গ্রন্থ তিন খন্ডে বিভক্ত,আর ১ম খন্ড ”আল মুকাদ্দিমা”তার শ্রেষ্ঠ অবদান।
পরিচয় : ইবনে খালদুন তিউনিসের এক সভ্রান্ত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন ৭৩২ হিজরীর ১লা রমযান (২৭শে মে,১৩৩২ খ্রী)। তার পূর্বপুরুষগন আরবের কিন্দা গোত্রের অধিবাসী ছিলেন। তিনি প্রাথমিক অবস্থায় কুরআন, হাদীস ও ফিক্হ বিষয়ে ঙ্গানার্জন করেন। লেখাপড়া শেষ করার পর তিউনিসে সরকারী বিভাগে চাকরি করেন। চাকরি ছেড়ে দিয়ে ১৩৫২ সালে তিনি পাশ্চাত্যে পর্যটনে বের হন। তারপর তিনি মিশরের আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেন। পরবর্তীতে মিশরের সরকার তাকে বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন। মিশরে থাকা অবস্থায় ১৪০৬ সালের ১৭ই মার্চ ইন্তেকাল করেন।
আল মুকাদ্দিমা : আল মুকাদ্দিমা ইবনে খালদুনের শ্রেষ্ঠ র্কীতি। আল মুকাদ্দিম আরবী শব্দ, যার অর্থ মুখবন্দ বা ভ’মিকা।কিতাবুল ইবার গ্রন্থটির ভ’মিকা হল ”আল মুকাদ্দিম”। ইবনে খালদুন কিতাবুল ইবারকে তিনি খন্ডে বিভক্ত করেছেন। আল মুকাদ্দিমা ৬টি অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে। ৬টি অধ্যায়ের বিষয়বস্তু হল-
১ম অধ্যায়ে -মানব সভ্যতার বিকাশ।
২য় অধ্যায়ে-–যাযাবর জীবন,বর্বর জাতি ও সভ্যতার পতন।
৩য় অধ্যায়ে-সা¤্রজ্য, রাষ্ট্রশক্তি, খেলাফাত ও শাসন ব্যবস্থা।
৪র্থ অধ্যায়- বিভন্ন্ দেশ ও নগরী।
৫ম অধ্যায়- জী্িবকা অর্জন।
৬ষ্ঠ অধ্যায়- ঙ্গান-বিঙ্গান ও উহাদের বিভিন্ন শাখা।
মুকাদ্দিমা প্রথম আবিষ্কৃত হয় ১৮০৬ সালে। এটি সংরক্ষিত ছিল ফরাসি যাদুঘরে। ১৮৫৭ সালে মিশর থেকে প্রথম পূনাঙ্গ সংকলন প্রকাশিত হয়। বাংলা ভাষায় প্রথম পূনাঙ্গ অনুবাদ করেন গোলাম সামদানী কুরাইশী। ১৯৮২ সালের জুন মাসে প্রথম বাংলা একাডেমী কতৃক প্রকাশিত হয়।
আল মুকাদ্দিমায় বর্ণিত আলোচিত বিষয়বস্তু নিন্মে সংক্ষিপ্ত আকারে আলোচনা করা হয় :-
ইতিহাস সর্ম্পকে আলোচনা : ইবনে খালদুনের ইতিহাস চিন্তা ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের সুচনা করে। তার মতে,ইতিহাস মানব সভ্যতার ক্রমবির্তন ও ক্রমবিকাশের ইতিবৃত্ত। এক্ষেত্রে তিনি মানুষের কর্মকান্ডকে তার ইতিহাস চিন্তায় প্রাধান্য দিয়েছেন। ইতিহাসকে তিনি রাজা বাদাশার কাহিনী হিসেবে না দেখে দেখেছেন সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতির ধারা হিসেবে। মূলত , আদিম ব্যবস্থা থেকে ধাপে ধাপে মানব সভ্যতার স্তরে স্তরে অগ্রসরতার বৈঙ্গানিক ব্যবস্থায় বিশ্লেষনই হলো ইবনে খালদুনের ইতিহসি বিষয়ক আলোচনার মূল বিষয়।
মানুষ ও প্রাকৃতিক পরিবেশ সর্ম্পকে আল্চোনা : ইবনে খালদুন তার আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে স্থান দিয়েছেন মানুষকে। আর মানুষকে প্রাকৃতিক পরিবেশের উপরনির্ভরশীল বলেছেন। পরিবেশগত পার্থক্যের কারনে মানুষের স্বভাব, চরিত্র, আচার আচানের পার্থক্য হয় যা ইতিহাসকে প্রভাবিত করে।
সমাজ ও সভ্যতা বিষয়ক আলোচনা : মধ্য যুগের ইতিহাসে ইবনে খালদুনই একমাত্র ব্যক্তি যিনি সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ সর্ম্পকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষন করেন। তিনি বলেন, মানুষের পারস্পরিক প্রয়োজনবোধই হতেই সমাজ ব্যবস্থার পথ শুরু হয়। মানুষের নতুন নতুন চিন্তাধারা ও চাহিদার আলোকে এই বিকাশ সাধিত হয়।
জাতিতত্ত্ব সর্ম্পকে আলোচনা : ইবনে খালদুন আসারিয় বা এক জাতিতে পরিনত হওয়া নিয়েও আলোচনা করেন। এক্ষেত্রে তিনি বলেন, সচেতনতা, নির্ভরশীলতা, একাতœতা, এক জাতিতে পরিনত হওয়ার মূলে কাজ করে। আর যাদের মধ্যে একাতœতা যত বেশি হবে তারা তত অগ্রগামী হবে।
সভ্যতার অগ্রগতি ও পতন সম্পকে আলোচনা : ইবনে খালদুন সভ্যতার অগ্রগতি ও ধ্বংস সর্¤úকে আলোচনায় সভ্যতার স্থায়িত্¦ নিয়েও আলোচনা করেন। তার মতে,সভ্যতার স্থায়ীকাল ১২০ বছর এবং এর মর্যাদা প্রায় চার পুরুষ পর্যন্ত টিকে থাকে।সভ্যতা বিকাশের পর্যায়ে এমন এক অবস্থা আসে যখন সেই সভ্যতা সব দিক যেমন, শিক্ষা,স্থাপত্য বিঙ্গান থেকে উন্নিতির চরম শিখরে পৌছায়। কিন্তু আস্তে আস্তে যখন এর মধ্যে বিলাসিতা ঢুকে পড়ে তখনই এই সভ্যতার পতনের পথ শুরু হয়। বিলাসিতার প্রয়োজনেই শাসকগন হয়ে ওঠে স্বৈরতান্ত্রিক। ফলে জনগন হয়ে ওঠে বিদ্রোহী। আর এই বিদ্যোহের ফলেই সভ্যতার পতন হয়। এর স্থলে অন্য সভ্যতা স্থান নেই। এভাবে ভাঙা গড়ার মাধ্যমে সভ্যতা এগিয়ে যায়।
শিক্ষা ও সংস্কৃতি সর্ম্পকে আলোচনা : তিনি শিক্ষার বিভিন্ন্ দিক যেমন। ভ’গোল,পৌরনীতি,সমাজবিঙ্গান,অথনীতি নিয়ে আলোচনা করেনা মূলত এসব বিষয়গুলোতে তিনি ইতিহাসের সাথে সর্ম্পকযুক্ত করে আলোচনা করেন। শিক্ষা সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি মূলত আরবদের নিয়েই আলোচনা করেছেন। আরবদের সংস্কৃতির প্রধান দিক ছিল কাজ চর্চা ও সংগীত চর্চা, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তিনি বলেন নাতিতোষ্ক অঞ্চলে সংস্কৃতি হল উচ্চ মানের সংস্কৃতি।
সমাজে ধর্মের ভ’মিকা : ইবনে খালদুন বলেন, সমাজ গঠনে ধর্ম প্রধান ভ’মিকা পালন করে। একটি ধর্ম সমাজের আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। আদর্শ একটি জাতিকে পরিচালনা করতে পারে। উমাইয়া ও আব্বাসীয় খেলাফতকে দেখে তিনি এ মন্তব্য করেন।
সমাজ জীবনের প্রয়োজনীয় : তার মতে, মানুষ একে অপরের উপর নির্ভরশীল। জন্মগতভাবে মানুষ স্বাধীন হলেও সর্বত্র সে শৃঙ্খলিত। এই নির্ভরশীলতা থেকে সমাজ, সমাজ হতে রাষ্ট্র গড়ে উঠেছে।
রাষ্ট্রের ক্ষমতা ও কার্যাবলী : ইবনে খালদুন বলেন, রাষ্ট্রের গঠন ও চারিত্রিক কারনেই সার্বভৌম ক্ষমতা কোন ব্যক্তি বিশেষের হাতে কেন্দীভ’ত হয়ে পড়ে। রাষ্ট্র ক্ষমতা পরিচালনার ব্যাপারে এককেন্দ্রিক ক্ষমতাই অধিকতর ফলপ্রসু। তার মতে, ক্ষমতা বহু হাতে থাকলে শাসন ব্যবস্থার বিশৃংখলার সম্ভবনা বেশি দেখা দেয়। তার মতে, রাষ্ট্রের কর্তব্য হচ্ছে বাচানো এবং বহি:শত্রুর হাতে থেকে দেশকে রক্ষা করা। জনগনের সকল সুযোগ সুবিধার দিকে দৃষ্টি রাখা এবং অর্থ সংক্রান্ত ব্যাপারে সজাগ থাকা
জীবন ও সংস্কৃতিক আবহাওয়ার ভ’মিকা : মানুষের চরিত্র, মেধা, মননশীলতা,দৃষ্টিভঙ্গি সর্বোপরি মানুষের আধ্যাতিœকতা তার উন্নতি সাধনে আবহাওয়া পালন করে। একটি জাতির মনুষ্যত্ব্য নির্মানের ক্ষেত্রেও আবহাওয়া একটি বড় ভ’মিকা পালন করে। অপরদিকে কোন সভ্যতার সংস্কৃতির নির্মানও আবহাওয়ার দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বিজ্ঞানের অগ্রগতি ঃ স্থিতিশীল পরিবেশ আরাম আয়েশ ও বিলা সিতার জন্য শাসকবর্গ মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের কাজে নিয়োজিত লোকদের কিছু অংশকে বিলাস সামগ্রী তৈরীর জন্য পরিচালিত করে। এর ফলে কারুশিলপ,বিভিন্ন কলাকৌশল ও বিঙ্গানের প্রভূত উন্নতি ঊৎকর্ষ সাধিত হয়।
জাতির সম্পদ ঃ তার মতে, জাতির সম্পদ দুটি। একটি হল ধন-সম্পদ অর্থাৎ ভ’মি , শিল্প ও প্রাকৃতিক সম্পদ। অপরটি হচ্ছে মানুষের নৈতিক সম্পদ অর্থাৎ সততা, সাহসিকতা ,বিশ্বস্ততা ইত্যাদি। ধন-সম্পদের সাথে নৈতিক সম্পদের সংযোগ না করলে কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না। ইউরোপীয়রা এবিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে দেখেন।
ইতিহাস সর্¤úকে তার মতামত ঃ (১) ঐতিহাসিককে পক্ষপাতিত্বহীন হতে হবে । (২) কোন একক আদশ্যের বিশ্বাসী হতে পারে না। (৩) উৎসের যাচাই বাচাই করতে হরে অত্যন্ত সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে। (৪) কোন দেশের ইতিহাস লিখতে হলে ঐদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক পটভ’মি জানতে হবে। (৫) লোভ লালসার উর্দ্ধে থাকতে হবে। (৬) কোন বিষয়কে অতির্িঙত করা যাবে না। (৭) সত্য নির্ধারনে যথাযথ কারন অন্ধান করতে হবে।
সমালেচনা ঃ ইবনে খালদুনের ইতিহাস চিন্তায় যুগের প্রেক্ষিতে কিছু সীমাবদ্ধতা দেখা যায়। তিনি রক্ত সম্পকের ভিত্তিতে যে রাষ্ট্র গঠনের কথা বলেছেন, তা ঐ সময়ে সম্ভব হলেও বর্তমান সময়ে তা প্রযোজ্য নয়। সমাজের ভিত্তি হিসেবে তিনি ধর্মকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন যা কিছুটা বিতর্কিত। আবার আবহাওয়ার ফলে সভ্যতার পতন ও বর্তমান সমায়ে প্রযোজ্য নয়। কারন বর্তমান শীত প্রধান দেশে সভ্যতার অগ্রগতি বেশি দেখা যায় না।
মূল্যায়ন ঃ ইবনে খালদুনের ইতিহাস চিন্তার কিছু ক্রুটি-বিচ্যুতি থাকলেও ুতিনি প্রথম ইতিহাস সাহিত্যকে যুক্তি ও ঘটনাবলীকে কার্যকরনগত সর্ম্পকের ভিত্তির উপর দাড় করান। মুসলমান ঐতিহানিক হিসেবে তিনি সর্বপ্রথম বিভিন্ন প্রকার সর্ম্পকে আলোচনা ও তার সমালোচনা মূলক ব্যাখ্যা দেন। তার সভ্যতা সর্ম্পকিত চিন্তাধারাকে আধুনিক ঐতিহাসিক আরনল্ড টয়েনবিও শ্রদ্ধার সাথে স্বরন করেছেন। ১৮৬০ এর দশকে ফরাসি ভাষায় মুকাদ্দিমার সম্পূর্ন অনুবাদের পর তিনি বিঙ্গ সমাজের বিশেষ করে ইউরোপীয় পন্ডিতকূলের দৃষ্টি আর্কষন করেন।
আলোচনা শেষে বুঝা যায় যে, তিনি শুধু ইতিহাসবিদই ছিলেন না বরং প্রকৃত অর্থে তিনি ছিলেন প্রাচ্য জগতের শ্রেষ্ঠ মনীষী। তিনি তার গ্রন্থের ইতিহাস চিন্তায় সামগ্রিক ভাবে মানব ইতিহাস দেখানোর চেষ্টা করেছেন। তার আলোচনা ছিল সম্পূর্ন মৌলিক। সভ্যতার উৎপত্তি, বিকাশ ও আয়ূস্কাল সর্ম্পকে তিনি যে বৈঙ্গানিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখিয়েছেন তা এরিস্টটলের অবদানের সাথে তুলনীয়।
©somewhere in net ltd.