![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বিজ্ঞান ভাল লাগে তাই বিজ্ঞান পড়া । সামান্য লেখালেখি করি। ভাল লাগে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পড়তে। পড়াশোনা করছি শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
প্রতিদিন প্রভাতের আলো ফোটার আগেই ঝাপসা অন্ধকারে আমার ঘুম ভাঙ্গে। নামাজ পড়ে বাসি ভাত পানি ও কাঁচা ঝাল দিয়ে ঘুটে খেয়ে আমার প্রিয় দুইটি প্রাণী নিয়ে কর্মক্ষেত্রে যায়। সারাদিন দাবদাহ রোদ্রের মধ্যে কঠিন মাটি ফুরে ঝুরঝুর করি। দিনের শেষে হালকা অন্ধকার হলে আবার ফিরে আসি আমার ছোট নিড়ে। আমি বাংলার কৃষক, আমি পদ্মা পাড়ের কৃষক। এই পদ্মা পাড়েই আমার জন্ম। দেখেছি পদ্মার তান্ডবলীলা, অবলোকন করেছি তার শান্ত রূপ। এ এক পাগলা চিত্র কখনো রাগে গর্জন কেড়ে নেই সব, নিজ পেটে গিলে নেই আশপাশের সব জমি জিরাত। আবার কখনো শান্ত পরম আপনজনের মত উগরে দেই সব হারানো সম্পদ। এ গর্জন ভুলবার নয়। পদ্মার এই রাক্ষসী চিত্র দেখেছিলাম একবার ১৯৭১ সালে। হঠাৎ এক রাতে বড় সাবরা অস্ত্র হাতে ভির জমালো আমাদের গ্রামে। মোড়ল, শিক্ষক ,ছাত্র.শিশু,মা-বোনদের নিবর্চিারে হত্যা শুরু করল। ওই একবার আমাদের জমিতে দেখেছিলাম রাক্ষষী পদ্মার বুকের ¯্রােত যার রং চকচকে নয় রক্ত লাল। ওই নেকড়েদের এলাকা ছাড়া করতে আমিও অস্ত্র হাতে নিয়েছিলাম। গ্রামের অনেকের দেখে আমার বুকে সাহস এল। তাছাড়া এমন নেকড়েদের গল্প আমি অনেক শুনেছি। যাত্রা মন্চে সিরাজউদ্দৌলা নাটেকে দেখে মনে মনে এমন নেকড়েদের সম্পর্কে আমার ধারণা জন্মেছিল। তখন থেকেই আমার মনে এই নকড়েগুলোকে মারার নেশা ছিল। বুকে একটা স্বপ্ন ছিল আমার সন্তানদের জন্য স্বাধীন ভূমি রেখে যাব। তবে আমরা জয়ী হলাম, ওরা পালিয়েছিল জঙ্গলে। শরীরের মধ্যে দিয়ে ঠান্ডা ¯্রােত প্রবাহিত হল যেমনটা গভীর রাতে পদ্মা পাড়ে বসে অনুভব করতাম। দেশ স্বাধীন হল, আমরা হলাম স্বাধীন জাতি, আমাদের দেখভাল করার লক্ষ্যে দেশীয় সাবরা দায়িত্ব নিল। তারপর অনেক গল্প। পদ্মা পাড়ে বসে ভাবতাম এবার সুখের দেখা পেলাম। আর কোন বাইরের শিয়াল নেই, নেকড়ে নেই আজ থেকে শুধু সুখ আর শান্তি। কিন্তু সবকিছু এলামেলো হয়ে গেল। জন্ম নিল কিছু হায়েনা, সব কিছু লুটেপুটে খাইতে চাইল। এদিকে পদ্মা আবার গর্জে উঠল। ওর মরণ থাবায় আমার সব জমিজমা হারিয়ে গেল। থাকলো শুধু বাস করার মত ছোট ভিটা। ছেলে দুটো আছে যার যার মত। বড়টা চাকরি জুটিয়েছে একটা, আর ছোটটা কলেজ না কি বলে সেখানে পড়ছে, ছোট মেয়েটা পড়ছে অষ্টম শ্রেণীতে। সব কিছ হারিয়ে গেলেও একটা সুখের স্বপ্ন ছিল আমার মনে। আমাদের গ্রামটিও আর আগের মত নেই। অনেক বড় বড় বাড়ি হয়েছে, দোকান হয়েছে,দল হয়েছে, মোড়ল টোরল নেই এখন যারা আছে তারা চেয়ারম্যান ,মেম্বার। ওনাদের উপরে আছে বড় বাবুরা যারা ঢাকায় থাকেন। তাদেরকে অবশ্য দেখি খুবই কম। পাঁচ বছর পর পর তাদের বেছে নেওয়ার একটি অনুষ্ঠান হয় ঠিক তার আগে তাদের দেখা মেলে। এইতো গতবার একজন বলল
“চাচা দুঃখ করেন না আপনার সব জমি ফিরে পাবেন”
এই বলে একটি ফটোয়ালা কাগজ ধরিয়ে বলল টিপ দিতে। আমি মিনতি করে বললাম গ্রামের ছেলেরা আমার জমি কেড়ে নিয়েছে কিন্তু সে কথা বাবুর কানে পৌঁছাল না। গ্রামের কয়েকটি ছেলে বলেছিল-
চাচা আপনি যুদ্ধ করেছেন, মুক্তিযুদ্ধ সনদ নিয়ে নেন তাহলে কিছু সাহাজ্য পাবেন।
একজনকে সাথে নিয়ে গেলাম। তারা বলল কাজ হবে কিন্তু তাদের চা-পানের জন্য কিছু টাকা দিতে হবে। আমি অবাক হলাম। ভাবলাম কোন সনদ নয়, নেকড়েদের তাড়িয়েছি দেশ স্বাধীনের কাজে, সনদ কেনার জন্য নয়। একথা ভাবছি আর ধীর পায়ে হাঁটছি। হঠাৎ বাড়ির পাশের ছোট একটা ছেলে দৌড়ে এসে বলল-
দাদা চলেন সর্বনাশ হয়ে গেছে,দ্রুত চলেন।
আমি দৌড়ে বাড়ি গিয়ে দেখি অনেক মানুষের জটলা। কিছু ভাবতে পারছি না আমি। ঘরে গিয়ে দেখি আমার আদরের জরিনা ছেড়া কাপর পড়ে বসে আছে।ওর মুখে, শরীরে ছোপ ছোপ রক্ত ,মুখে কোন কথা নেই, আমাকে দেখেও না দেখার ভান করছে। মুখের দিকে তাকিয়ে একবার শুধু বলল “ওরা”, তারপরই আমার কোলে লুটে পড়ল। তাকে সান্তুনা দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়ে আমি বাকরুদ্ধ। আমার সোনা মানিকের শরীর ঠান্ডা, হাত দুটো দুদিকে ছড়ায়ে দিছে। ও নেই!! আমাকে ছেড়ে অনেক অনেক দুরে চলে গেছে যেখানে ওর মা গেছে দশ বছর আগে। ওর শরীরের ছোপ ছোপ রক্ত দেখে আমার বড়ই চেনা মনে হল।এই রক্ত তো দেখেছিলাম একাত্তরে। দৌড়দিয়ে পদ্মা পাড়ে গেলাম, দেখি ও গর্জে বুক ফুলিয়ে আছে। আমার দিকে তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অনেকের কাছে ধরনা দিয়েছি, কেউ ওই ছেলেদের বিচার করে নি, ওরা নাকি বড় বাবুর লোক। এমনকি গ্রামের সভ্য মানুষগুলো কবর দিতেও দিও না। তাদের অভিযোগ আমার সোনা মাণিক ধর্ষিত হয়েছে। ওনাদের সভ্য গোরস্থানে আমার সোনা মাণিকের দাফন হবে না। কি আর করা পদ্মা পাড়ের বালি খুড়ে রেখে দিলাম আমার সোনাকে। সেখানেও পদ্মার আপত্তি ছিল, বারবার গর্জে উঠে আমাকে শাসাচ্ছিল। কয়েকদিন পর দুই ছেলে চলে যাওযায় আমি একা হয়ে গেলাম। সবকিছু আগের মত চলছিল। কিছুদিন যেতে না যেতেই সবকিছু ঘোলা হয়ে এল। আমার ছোট খোকার কলেজে ছাত্ররা মাড়ামাড়ি করেছে। শুনলাম কয়েকজন খুন হয়েছে। কার মায়ের বুক খালি হল ভাবতে ভাবতে পাশের বাড়ির মইন মিঞার মোবাইল থেকে খোকাকে ফোন দিলাম। ফোন কেউ ধরে না, বারবার রিং হয় কিন্তু উত্তর নেই। মনের মধ্যে কেউ যেন জোর করে বলছিল “তোর খোকা নেই” কিন্তু আমার বিশ্বাস হল না। আবার ফোন দিলাম, রিসিভ হল, ওপাশ থেকে উত্তর এল
“সেলিম নেই”।
এ কথা শুনে আমি অবাক হয় নি। কারণ গত তিন দিন ধরে আমার বড় ছেলেটাকে পাওয়া যাচ্ছে না। কে বা কারা নাকি তুলে নিয়ে গেছে, অনেকে বলছে গুম হয়েছে, আর কখনো ফিরে আসবে না। ধীর পায়ে গেলাম পদ্মার পাড়ে। দেখি তার সেই আনন্দ, মহাসমরোহে তার স্রোত বইছে। জল যেন আরও চকচক করছে, নতুন সাজে সেজেছে পদ্মা আজ। আমার যন্ত্রণা দেখে ও আজ মহাখুশি। গ্রামের দিক থেকে চেঁচামেচি দেখে উঠে পড়লাম। বাড়ির কাছাকছি গিয়ে আমার আর পা নড়ছে না। পাড়ার ছেলেদের মধ্যে গন্ডগোল হওয়ায় একদল আগুন ধরিয়ে দিয়েছে, তার বলির পাঠা হয়েছি আমি। আমি স্তব্ধ, বাঁকরুদ্ধ, কিছু বের হচ্ছে না কন্ঠ দিয়ে। কোথায় যাবো? কার কাছে যাবো? কোন লাভ হবে না আমার, কেউ আমার কথা শুনবে না। আমি ধীর পায়ে রাতের অভিশপ্ত অন্ধকারে হেঁটে চলেছি পদ্মার দিকে। বিশাল উঁচু ঢিলার উপর বসে তাকিয়ে আছে পদ্মার বুকের ঠান্ডা শীতল পানির দিকে। ঠিক যেন শরৎচন্দ্রের মহেশ গল্পের কালো গরুর মত “ অবলা জীব কথা বলতে পারে না, শুধু চেয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে জল পড়ে
রফিকুল ইসলাম
১০ মে ২০১৪, সকাল ৯.৩০
২২৭/শেরেবাংলা হল, শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
।
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই মে, ২০১৪ রাত ১২:০৪
অন্ধবিন্দু বলেছেন:
রফিকুল,
আমরা সকলেই হয়তো ধীর পায়ে অভিশপ্ত অন্ধকারের দিকে হেঁটে চলেছি ...
শুধু চেয়ে থাকে আর চোখ দিয়ে জল পড়ে