নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নিত্যকার প্রয়োজনে নিয়ত অভিযোজনের ক্রমাগত নিষ্পেষণ থেকে পরিত্রাণের ফুরসত খুঁজে ফেরা এক পরিশ্রান্ত প্রাণ।
শান্তাহার লোকাল
==========
১
=
রংচটা লোকালটা হুইসেল বাজিয়ে থামলো ছাতিয়ানগ্রাম স্টেশনে । ভাঙ্গা দরজা জানালার আর দশটা লোকাল ট্রেনের যাত্রীদের যে অবস্থা হয় তাই হলো। সকাল থেকে ঝাঁপিয়ে পড়েছে বৃষ্টি। প্রায় যাত্রীই ভিজে ভিজে নামছে। স্টেশনে অল্প কয়েকটা মানুষ। এমনিতেও যে অনেক মানুষ থাকে তা না। আগে আধা ডজন ট্রেন থামতো এই স্টেশনে।যাত্রী,হকার,কুলি,দোকানী সব মিলিয়ে জমজমাট অবস্থা ছিলো। আন্ত:নগরের এই দিনে ট্রেনের সংখ্যা ঠেকেছে একটায়। সবেধন নীলমনি এই সান্তাহার লোকাল। একটা যুবক নামছে ,পিঠে ব্যাগ। অন্য সবার মত তাড়া নেই ছাতা বা ছাদের জন্য।সে শান্ত মনে নেমে ধীরপায়ে হাঁঠছে । উৎসুক দৃষ্টি দিয়ে কিছু খুঁজছে। শার্ট ভিজে লেপ্টে গেছে শরীরের সাথে। বুকের লোম স্পস্ট বোঝা যাচ্ছে। বৃষ্টির ঝাপটায় কষ্ট করে চোখ খোলা রেখে কাউকে খুঁজছে। হতাশ চোখে এদিক ওদিক করতেই এক মধবয়সী লোক এসে ছেলেটির মাথায় ছাতা ধরে একপ্রকার টেনেই নিয়ে গেল । বৃষ্টির প্রতি বিরক্ত মনে হলো লোকটিকে।
২
=
জিতু মাথা নিচু করে খেয়ে যাচ্ছে। মা এটা ওটা তুলে দিতে চাইছে তাকে। সে বারণ করছে। মা শোনেনা। এরকমটাই হয়ে আসছে আজ দু বছর হলো। জিতু শহরের বড় কলেজটায় ভর্তি হবার পর থেকে যখনই কলেজ ছুটিতে বাসায় আসে তখনই মায়ের ভালোবাসার এই অত্যাচার।' এটা খা,ওটা খা,শুকিয়ে তো কাঠ হয়েছিস' । এসব শুনে জিতু হাসতো শুধু। কিন্তু এবার কেন জানি তার হাসি পাচ্ছেনা। একটা বিষয় নিয়ে সে খুব চিন্তিত।
বর্ষার দুপুর। বৃষ্টির চোটে সন্ধ্যা সন্ধ্যা লাগছে। জিতু বালিশে মাথা গুঁজে চিন্তায় মগ্ন। তাহলে কি শফিক ভাই ভুলে গেলো? নাকি খবরটা জানায়নি?
শফিক গ্রামের বাজারে মোবাইল ফোন চালায়। সাত টাকা মিনিট। প্রতিবার বাসায় আসার আগে জিতু কলেজ হোস্টেলের সামনের ফোন ফ্যাক্সের দোকান থেকে শফিক ভাইয়ের ফোনে দুটো যায়গায় খবর দেয়। এক বাসায়,আর অন্যটা তিথীর কাছে। তিথী জিতুর সাথে একসাথে পড়ে সেই প্রাইমারি থেকে। একসাথে স্কুল,স্যারের বাড়ি পড়তে যাওয়া,পড়ায় সহযোগীতা,ক্লাসে প্রথম হওয়ার প্রতিযোগীতা সব মিলিয়ে উঁচু দরের বন্ধুত্ব। এস এস সির ফলাফলের পর জিতুর শহরে পড়তে যাওয়া আর তিথীর মফস্বলের কলেজে ভর্তি হওয়ায় আপাতত একসঙ্গে চলার পরিসমাপ্তি। কিন্তু একটা নিয়ম দাঁড়িয়ে গিয়েছে। জিতু যতবার কলেজ থেকে বাড়ি আসতো তার আগে শফিক ভাইয়ের ফোন মারফত তিথী খবর পেয়ে সান্তাহার লোকালের অপেক্ষায় স্টেশনে অপেক্ষা করতো।
জিতুর রাগ হচ্ছে ভিষণ। শফিক ভাই কেন জানালোনা এবার? বৃষ্টি ছাড়লে না হয় বাজারে যাবে শফিক ভাইয়ের কাছে। নাকি সোজা তিথীদের গ্রামে আকিবের সাথে দেখা করার নামে ওর খোঁজ নিতে যাবে ?
বৃষ্টি ছেড়েছে।
হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে শার্ট পড়ে জিতু বের হচ্ছে । আসরের আযান পড়ে গেছে। জিতু কই যাবে বুঝে উঠতে পারছেনা। বর্ষার কাদা রাস্তায় মানুষ একদম কম। তবুও জিতু একপ্রকার দৌড়াচ্ছে। নানা প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। আজ প্রায় মাস তিনেক পর গ্রামে এলো,অথচ তার ভালো লাগছেনা। তিথী এমন কেন করলো?
আকিবদের বাসার কিছু আগেই বড়াই নদীর লম্বা ব্রীজটা। দুর থেকে জিতু ব্রীজে চোখ রাখতে রাখতে এগিয়ে আসছে। বৃষ্টির পর এক ধোঁয়াশা থাকে,সেটা কাটিয়ে উঠতেই জিতুর চোখে পড়লো শাড়ি পরা এক মেয়ে। ওমা একি! তিথী !
-কিরে তুই এই বর্ষায় শাড়িতে হঠাৎ?
:জিতু তুই কখন এলি রে?
-কেন তোকে বলেছি না ? আজ আসবো শান্তাহার লোকালে! শফিক ভাই জানায়নি?
:না তো!
-কেন ? শফিক ভাই এমন করলো কেন? দাঁড়া উনার কাছে যাচ্ছি।
:আরে দাঁড়া দাঁড়া,আমিতো আজই বাসায় এসেছি। শফিক ভাই আমায় কিভাবে জানাবে?
-বাসায় এসেছিস মানে ? তুই কই থাকিস ?
:ফাজলামো এখনো করিস রে তুই! কিছুই জানোনা তুমি না? চল তোর ভাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই,বাসায় চল। ও কাদায় বের হবেনা বলে একাই ব্রীজে এসেছি।
-'ও কে ? ' 'কিসের ভাই ?' 'তুই শাড়ি পড়েছিস কেন ?' -এসব প্রশ্ন একটার পর একটা চাপছিলো মাথায়। কিন্তু জিতু আর প্রশ্ন বাড়ালো না। তার মাথা ঝিম ধরে আসছে,শরীর অবশ হয়ে যাচ্ছে। ছোট্ট করে তিথীকে "আসি রে " বলেই দ্রুত পায়ে প্রথমে হেঁটে পরে এক প্রকার দৌড়ে যেতে থাকলো জিতু। বুকটা শুন্য অথচ পা টা এত ভারী কেন? কাদায় আজ বুঝি পা বেশি গেঁথে যেতে চাইছে। আকিব মাস কয়েক আগে থেকেই বলছিলো তিথীর নাকি বিয়ে! তা যে সত্যি সত্যিই হবে জিতু কেন আগে ভাবলোনা? আচ্ছা,তিথীর সাথে কি সম্পর্ক ছিলো জিতুর ? প্রেম তো ছিলোনা। সেরকমটা কেউ কাউকে বলেও নি কোনদিন । তাহলে খারাপ লাগছে কেন? তিথীর কি এখন অনেক আনন্দ?সুখী সুখী চেহারাই তো দেখা গেলো। জিতুর কেন কান্না পাচ্ছে? এমন কান্না যেন তিথী মরে গেছে। সে তো আছেই,বাবার বাড়ি এলে তো মাঝে মাঝে দেখা হবেই। কিন্তু বুকটা কেন চেপে আসছে,এত বিষাদ কেন চেনা এই পথটা? চোখে শুধু ভাসছে একটা মেয়ে স্টেশনে দাঁড়িয়ে আছে,আছে মানে ছিলো। এখন নেই। আর থাকবেনা। নাহ কোনো হিসেব মিলছেনা।
৩
=
সান্তাহার লোকালটা আজ চরম লেট করে যখন ছাতিয়ান স্টেশনে থামলো,পড়ন্ত বিকেল তখন। একটা লোক নামছে দুটো বিশাল লাগেজ নিয়ে,সাথে দুটো ছোটছোট বছর চার পাঁচেকের বাচ্চা। বাচ্চাগুলো লাফালাফি করছে,পেছন থেকে বাচ্চার মা বাচ্চা দুটোকে দুহাতে টেনে ধরেও সামলাতে পারছেনা।
কালো সানগ্লাস চোখে বসানো তাই প্রথমে ঠাহর করতে না পারলেও পরে বোঝা গেলো এ তো জিতু!
বিয়ে করেছে বেশ ক বছর আগে। ওর কলেজের ই অধ্যাপকের মেয়েকে।শেষে ঐ কলেজেরই প্রভাষক হয়ে আজ বেশ সুখী।
কাজের ছেলেটা এসে মালপত্র গাড়িতে ওঠানো নিয়ে ব্যাস্ত হতেই জিতু একটু এগিয়ে স্টেশনের একদম দক্ষিনে পুরোন কৃষ্ণচুড়ার গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে গেল। গাছটা এখনো সেদিনের মতই। ছোট্ট ট্রেনের বগি প্ল্যাটফর্মের এতদুর পর্যন্ত আসতোনা। তাই এখানে কোলাহল আর ভীড় লুকিয়ে একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়াতো ,একটা ছেলের মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকতো। ছেলেটার মুখে তখন ক্লান্তির ছায়া মুছে তৃপ্তির আভা ছড়াতো। হঠাৎ ছেলেটার ব্যাগ হ্যাঁচকা টানে মেয়েটা হাতে নিয়ে রিক্সায় উঠে বসতো,পাশে ছেলেটাও। রিক্সা চলতে শুরু করতো। একটা পরিচিত দৃশ্য ছিলো এই ছাতিয়ানগ্রাম স্টেশনে। বেশ ক'বছর আগে।
জিতুর কালো চশমা ভেদ করে চোখের চিকচিকে জল দেখার উপায় ছিলোনা। বুকে মাথা পাতলে ঘনীভূত দীর্ঘশ্বাসটা হয়ত টের পাওয়া যেতো।
"অর্চির আব্বু ,এ্যাই..."
হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেলো জিতু। অর্চি জিতুর বড় মেয়েটা। মেয়ের মা ডাকছে। ছোটটাকে কোলে নিয়ে জিতু গাড়িতে গিয়ে বসলো। পাশে জিতুর স্ত্রী।এই মেয়েটার এই এক সমস্যা, জার্নি করলেই মাথা ব্যাথা করে।জিতুর কাঁধে মাথা দিয়ে আছে তার স্ত্রী। জিতুর সুখী সুখী লাগছে। আচ্ছা,তিথীকেও সেদিন সুখী সুখী লেগেছিলো! তাহলে কি হিসেবটা মিলে গেলো? নাহ,জাগতিক হিসেব মেলা কি এতই সহজ। আর না মিললে তো কি? জিতু শুধু এটুকুই পরিষ্কার জানে,জীবন থামেনা। ঠিক সান্তাহার লোকালটার মত। চলছে। চলতে হয়। গাড়িটা ছেড়েছে...
২| ১২ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:২১
আঘাত প্রাপ্ত একজন বলেছেন: অশেষ ধন্যবাদ। আপনাকেও শুভকামনা
©somewhere in net ltd.
১| ১২ ই জুন, ২০১৭ রাত ৮:১০
প্রতিভাবান অলস বলেছেন: কারো জন্যে কারো জীবন থেমে থাকেনা! দারুন গল্প।
শুভকামনা