নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সৌর কলঙ্কে পর্যবসিত (সৌকপ)

সৌর কলঙ্কে পর্যবসিত

আমি আসলে কেউ নই ।

সৌর কলঙ্কে পর্যবসিত › বিস্তারিত পোস্টঃ

গহীনে ......... (১)

২১ শে জুন, ২০১৬ রাত ১:৪৩

আজ দশ বছর পর এখানে এলাম। মনে পড়ে যাচ্ছে সেই দিনের কথা। এখানেই থাকতাম আমরা। আমার বাবা, চাচা, বড় ভাই, সবাইকে নিয়ে। কিন্তু আজ দশ বছর পর যদিও আমি বহাল তবিয়তেই আছি; আছেন মা, বোন ও, আছে গোত্রের সব মহিলারাই ঠিক, শুধু নেই পুরুষেরা। সেদিনের সেই আত্মাহুতি......... শুধু বেঁচে গেছে মহিলারা আর সমস্ত শিশুরা। কোন পুরুষই বাচেনি। আসলে বলা যায় বাচতে চায়নি কেউ । আমার এখনো মনে পড়ে সবকিছু। একেবারে শুরু থেকে শেষ.........

ঘটনার যখন শুরু তখন বয়স ছিল নয় কি দশ বছর। আমাদের গোত্রের নিয়ম অনুযায়ী বারো বছর বয়সে একজন ছেলেকে পুরুষ হিসেবে ধরা হয়। আর পুরুষ হিসেবে জঙ্গলে গোত্রের একজন কর্মঠ সদস্য হয়ে বেঁচে থাকার জন্য যা যা শেখার দরকার, যেমন শিকার, আত্মরক্ষা, সেসবের পাঠদান শুরু হয় আট-নবছর বয়সে। আমি মাত্র নতুন নতুন জঙ্গলে যাওয়া শুরু করেছি। এমনই একদিন তাকে দেখতে পেলাম আমরা। একজন বিদেশী। আসলে আমরা না বলে আমি বলাই ভালো। কেননা দলছুট হয়ে হারিয়ে গিয়েছিলাম। কেউ দলছুট হয়ে গেলে বলা হতো নদী খুঁজে বের করে স্রোতের দিকে হেঁটে চলার জন্য। কেননা আমরা আমাদের বসতির সব সময় উজানে শিকারে যেতাম। যাতে করে শত্রুর আক্রমনে কেউ নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়লে ধীরে ধীরে সে আমাদের বসতির দিকেই ফিরে আসে।

নতুন কেউ দলছুট হতেই পারে। অস্বাভাবিক ঘটনা নয়। ঠিক তেমনি দলছুটদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়াটাও অস্বাভাবিক নয়। বেশির ভাগই বাঘের আধখাওয়া দেহ। কুমিরে ধরলে অবশ্য কিছু পাওয়া যায় না শুধু মাত্র কিছু ধস্তাধস্তির চিহ্ন ছাড়া।

প্রথম প্রথম জঙ্গলে যাওয়া শুরু করেছি মাত্র । এবার এসেছি দুদিন হলো । সকাল বেলা সবাই চলছিলাম। কিন্তু কেমন যেন ঝিম ঝিম লাগছিল। তাছাড়া ছিল কুয়াশা। কিছুক্ষণ পর দেখি আমি আছি , আর কেউ নেই। ঘুম-ঘাম সবই ছুটে গেল । গেল তো গেল, আরো একটু আগে গেলে কি এমন হতো? হাতে মশাল আছে, রাত হলে আলোর সংকেত দেয়া যেত। কিন্তু দিনের বেলা কিছু করার নেই। আর ডাকা ডাকি করলে আরো সবার মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হতে পারে। এমন অবস্থায় পড়লে কি করতে হবে তা অনেকবার শেখানো হয়েছে। একটু খুঁজে খুঁজে নদীর কাছে চলে আসি। তখনই দেখতে পাই সেই বিদেশীকে । গায়ের কাপড়টা সাদা। তবে মনে হয় অনেকদিন জঙ্গলে ঘোরা ফেরার জন্য ময়লা হয়ে বাদামী হয়ে গেছে। বিশালদেহী। লম্বা দাঁড়ি আর মাথায় পাগড়ি। শরীর দেখেই বিদেশী বলে চেনা যায়। আর পোশাকটা যা বললো তা হলো এই লোক এই এলাকায় এসেছে বেশিদিন হয়নি। নদীর তীরে একটা বড়সড় ভেলা ভাসানো। তাতে একটা পুটলি। আর লোকটা ভেলার মধ্যে কাপড় বিছিয়ে কি যেন করছে। একবার দাঁড়াচ্ছে, একবার বসছে। যেন কোন দিকেই খেয়াল নেই। “এভাবে এ জঙ্গলে বেশিদিন থাকতে পারবে না এই লোক। বাঘের পেটে যাবে” বলে উঠলো মনটা। আমরা যেখানে চোখ কান সব খোলা রেখেও পারি না আর এখানে সে কেমন করে পরিবেশের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হয়ে ভেলার মধ্যে বসে আছে। তাও যদি নদীতে ভাসানো থাকতো এক কথা, কিন্তু এ তো তীরে ভেড়ানো। লোকটা আমার দিকে মুখ ঘোরালো। যদিও আমি তার থেকে প্রায় হাত দশেক দূরে একটা ঝোপের মধ্যে আছি, একটু ভালো করে লক্ষ্য করলেই দেখা যায়। লুকাতে যে পারি না তা নয়, কিন্তু এর এই উদাসীনতা দেখে কেন যেন আমিও লুকানোর কথা ভুলে গেছিলাম । লোকটা আমার দিকে মুখ ঘোরাতেই আমাকে দেখে ফেললো। মুহুর্তের মধ্যে দুটো লাফ দিয়ে একেবার সামনে এসে দাঁড়িয়ে সাঁই করে ঘোরালো একটা তলোয়ার। আমি অপেক্ষা করছি তীব্র ব্যথা অনুভব করার জন্য, শরীর বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের উষ্ণতা টের পাবার জন্য। কিন্তু এমন কিছুই ঘটলো না...... বরং পেছন থেকে একটা বিকট আওয়াজ শুনলাম।

এ আওয়াজটা আমাদের পরিচিত। জন্মের পর প্রথম দিন থেকেই এটা শুনে আসছি । কিন্তু প্রতিদিনকার শোনা আর আজকের শোনায় কিছু পার্থক্য ছিল। প্রতিদিন রাতে যা শুনতাম তা ছিল কারো দম্ভের আওয়াজ। কেউ যেন গলা উঁচিয়ে জানান দিচ্ছে, “এ আমার রাজ্য, আমিই রাজা” । কিন্তু আজকের শোনাটা হচ্ছে কারো তীব্র যন্ত্রণা , মরণব্যথার আওয়াজ।
লোকটা আমাকে তার ভালুকের মতন হাতগুলোর একটা দিয়ে উঁচু করে পেছনে ছুঁড়ে ফেললো। আর তখনই দেখলাম, একটা বাঘ। বেশ বড়সড় কিন্তু রক্তাক্ত। মুখের কাছে নিচের চোয়ালটা নেই। সেই লোকের এক কোপে তার নিচের চোয়ালখানা উড়ে গিয়ে কোথায় যেন পড়েছে। বাঘটা তার আসল অস্ত্রই হারিয়ে ফেলেছে। এখন আর ঘাড় কামড়ে ধরার ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু তাও সে পিছু হটছে না। কামড়ে ধরতে পারবে না বুঝে সে থাবা চালাচ্ছে। আর সেই থাবার ওজন যেন দুই-তিন মণ। একটা আঘাত লাগলে যে হাড় পুরো গুড়ো গুড়ো হয়ে যাবে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু বিদেশী লোকটাও যেন অন্য ধাতুতে গড়া। লড়ছে বাঘের সাথে সমানে সমান। যদিও চোয়াল হাড়িয়ে বাঘটার ইন্দ্রিয় গুলো ঠিক কাজ করছে না, রক্তের জন্য আর ব্যথায় চোখ নাক প্রায় বেকার; তবুও বাঘ তো। পেছনের দুপায়ে ভর দিয়ে সামনের থাবা গুলো দিয়ে সাঁই সাঁই করে বাতাসে মারছে। তার সাথে কি করে সমানে সমান থাকতে পারছে লোকটা ? কিছুক্ষণের মাঝেই বাঘটার মৃতদেহ তা তুলে ছুঁড়ে ফেললো নদীতে। সাথে সাথেই একটা কুমির সেটাকে নিয়ে ভেসে গেল। আমি কুঁকড়ে ওঠলাম ভয়ে। আমার পেছনে , মাত্র হাত বিশেক দূরে একতা কুমির কিন্তু আমি টেরই পাইনি। “জলে থেকেই বুদ্ধিমানের কাজ করেছিস। ডাঙ্গায় উঠলে তোরও একই অবস্থা হতো।” নদীর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো লোকটা। মনে হলো কুমিরটাকে বললো। তলোয়ারটা মুছে খাপে ঢোকালো । পরে এক সময় তলোয়ারটা ধরে দেখেছি। আমার বড় ভাই, যে কিনা ষোল বছর বয়সের এক শক্ত সামর্থ্য ছেলে , সেও এটা তুলতে পারেনি।

“আমার ওপর অনেকক্ষণ ধরেই নজর রাখছিল। কিন্তু সুবিধা করে উঠতে পারছিল না। কিন্তু তুমি ঝোপের মধ্যে এসে দাঁড়ানোতে সহজ শিকার পেয়ে তোমাকে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয় বাঘটা ।” আমার কাছে এসে আমাকে তুলতে তুলতে বললো লোকটা।

“আপনি দেখেন?” আসলে আমি হতভম্ব হয়ে ছিলাম তখন পর্যন্ত, তাই আসলে কি বোঝাতে তা মুখ দিয়ে বেরোচ্ছিল না। “অবশ্যই আমি দেখি। দেখবো না কেন? আমার চোখে দেখ, কত সুন্দর, কোন সমস্যা নাই। ” হাসতে হাসতে বললো লোকটা মনেই হলো না যে সে কিছুক্ষণ আগে একটা বিরাট বাঘকে কুপোকাত করেছে আর একটা কুমিড়কে তাড়িয়েছে। তার মোলায়েম হাসি দেখে আমার মন কিছুটা সহজ হলো। “আপনি কে? এভাবে লড়লেন কি করে? আপনি না ভেলায় কি সব করছিলেন, এদিকে তো চোখ ছিল না। এতসব দেখলেন কি করে?”
“আমি আমার সৃষ্টিকর্তার উপাসনা করছিলাম। আর , এক সময় যুদ্ধ করতাম তো, চোখ কান গুলো এমনই হয়ে গেছে।, অনেক চেষ্টা করেও বন্ধ রাখতে পারি না। তা, তোমার কোথাও লাগেনি তো? এভাবে ছুঁড়ে ফেলার জন্য দুঃখিত । আসলে বাঘটা থাবা মারতে যাচ্ছিল দেখলাম , তাই এভাবে ছুঁড়ে ফেলা ছাড়া উপায় ছিল না। অন্তত কুমিড়টার থেকে তো বিশ হাত দূরে ফেলেছি তাই না?” বলেই একটা মুচকি হাসি দিল। এ কেমন লোক? একে তো আমার জীবন বাঁচালো, তার পর আবার ক্ষমা চাইছে। এমনভাবে বাঘ আর কুমিড়ের কথা বলছে যেন কোন বন্ধু আরেক বন্ধুর সাথে মশামাছি নিয়ে তামাশা করছে। আমি বলার কিছুই খুঁজে পেলাম না।
“তুমি থাকো কোথায়? চলো, তোমাকে পৌছে দিয়ে আসি। নইলে পথে আবার বিপদে পড়বে। তাছাড়া তুমি এই বয়সে একা একা জঙ্গলে কি করছো? আশেপাশে যে কোন বসতি নেই তা তো আমি ভালোমতনই দেখেছি।”
“শিকারে এসেছিলাম।” বললাম আমি।
“একা একা?” আবারো মুচকি হাসি ।
“হারিয়ে গেছি।” মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখতে হলো। কেননা আমি ভালো মতনই বুঝতে পারছিলাম, আমার হারিয়ে যাবার ব্যপারটা বলার আগেই সে বুঝতে পেরেছে। ভেলাটায় চড়ে রওনা হলাম আমরা।

আমাদের বসতিটা যে খুব একটা লুকানো তা নয়। মাইল দশেক দূরেই সাগর। আর সাগরে পড়ার আগে নদীগুলো থেকে অসখ্য জালের মতন শাখা প্রশাখা সৃষ্টি হয়েছে। তেমনই এক মোটামুটি অপ্রচলিত শাখার ধারে আমাদের বাস। খুব একটা বেশি লোক জনের বাস নেই এখানে। যদিও লোকটা বিদেশী, তবুও মনে হলো চাচা তাকে দেখতে চাইবেন। একটা বিদেশী লোক আমাদের এলাকায় ঘোরাফেরা করছে , তার উপর এমন শক্তিমান লোক, গোত্রপতি হিসেবে বড় চাচা তার সম্পর্কে জানতে চাইবেন বলেই আমার ধারনা ছিল। তাই লোকটিকে নিয়ে যাবার ব্যপারে কোন দুশ্চিন্তা ছিল না।
যখন বসতিতে এসে পৌঁছলাম তখন সূর্য মাথার উপর । কিন্তু এসেই যা দেখলাম তা দেখার জন্য আমরা মোটেই প্রস্তুত ছিলাম না। শিকারের দলটা ফিরে এসেছে। আমাকে হারিয়ে তারা আন্দাজ করেছিল আমি নদীর তীরে ঘেঁষে ফিরবো। তাই তারাও নদীতে চলে আসে । কিন্তু আমি সম্ভবত নদী খোজার সময় পথভুলে কিছুটা উত্তরে এগিয়ে গিয়েছিলাম, তাই তারা আসলে আমার অনেক আগেই নদীতে পৌছে যায় আর ফলশ্রুতিতে আমার আগেই গন্তব্যে পৌছে যায়। তবে এটা তা নয় যা দেখে আমি শিউরে উঠেছিলাম। তখন কেমন লেগেছিল তা আমি বোঝাতে পারবো না। সঠিক ভাষা আমার জানা নেই। দেখলাম শিকারের দলটি দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু আর কেউ কোথাও নেই। ..........................................

ছবিঃ নেট


মন্তব্য ০ টি রেটিং +১/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.