নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

পুরোনো দিনে ঢাকায় দূর্গাপূজা

২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৭ দুপুর ২:৫১

মাতৃদেবী রূপসী বাংলায় পূজিত হন শরৎকালে। যখন নীলাকাশে ফুরফুরে হাওয়ায় ভেসে বেড়ায় শাদা মেঘের ভেলা। নদীর ধারে উজ্জ্বল রোদে ফুটে থাকে বাতাসে দোল খাওয়া শাদা কাশের ফুল। আর গ্রামীণ জনপদে দেবীর আগমনী ঘোষণায় উন্মাতাল ঢাকের শব্দে। বাঙালির আদিম রক্ত¯স্রোতে জেগে ওঠে এক আদিম মাতৃভক্ত দেবী দুর্গার প্রতি ভক্তি। শারদীয়া দুর্গা পূজার মাাধ্যমে প্রতিবছরের বাৎসরিক মাতৃপূজার শুভ সূচনা। বারো মাসে তের পার্বণ কথাটি হিন্দু সম্প্রদায়ের জন্য প্রচলিত থাকলেও শারদীয়া বা দূর্গা পূজাই বেশি আনন্দ উৎসবের মাধ্যমে পালন করা হয়। আর আদিম কাল থেকেই ঢাকা শহরে করা হয়ে থাকে দেবী দূর্গার পূজা।

ঢাকায় দূর্গা পূজার ইতিহাস:
ঢাকা শহরে প্রথম কবে দূর্গা পূজার শুরু হয়েছিল এর উত্তরে ১৮৩০ সালে সূত্রাপুরের একটি পূজার কথার উল্লেখ করেছেন অর্থনীতিবিদ ভবতোষ দত্ত তার আত্মজীবনীতে। তিনি বলেছেন, প্রায় দোতলা উঁচু ছিল দুর্গা প্রতিমাটি। সে সময়ে নন্দলাল বাবুর মৈসুন্ডির বাড়িতে পূজাটি হয়েছিল। তবে এরপর আর কোন বিস্তারিত বর্ণনা নেই সে পূজার। আবার ইতিহাসবিদ দানীর মতে, প্রায় সাড়ে পাঁচশো বছর আগে রমনায় কালী মন্দির নির্মিত হয়েছিল এবং এখানেও কালী পূজার সাথে সাথে দূর্গা পূজাও হত। যদিও এ কথাটির কোনো প্রমান পাওয়া যায় না।
ইতিহাস বলে বল্লাল সেন চতুর্দশ শতাব্দীতে তৈরি করেন ঢাকেশ্বরী মন্দির। অর্থাৎ দেবী দূর্গা সে আমলে ঢাকায় অপরিচিত ছিলেন না। যদিও বল্লাল সেনের ঢাকেশ্বরী মন্দির তৈরির ঘটনা এখনো প্রমাণিত নয়। ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রাচীন যে কাঠামো এখনো দাঁড়িয়ে তা কোন ভাবেই কোম্পানি আমলের আগেকার নয় বলে উল্লেখ করেছেন কয়েকজন ইতিহাসবিদ। এছাড়াও ইতিহাস বলে ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশনের পূজার জনপ্রিয়তার কথা পাওয়া যায়।
ঢাকায় দুর্গা পূজা সাধারণ্যে আসতে কেটে যায় অনেক সময়। এর প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকায় সময় কাটানো বিভিন্ন মানুষের আত্মজীবনী থেকেই। হৃদয়নাথ, গণিউর রাজা, বুদ্ধদেব বসুসহ গত শতকের শুরুর দিকে যারা ঢাকায় সময় কাটিয়েছেন, তাদের কারো লেখাতেই আসেনি দুর্গাপূজার প্রসঙ্গ। এছাড়া জেমস টেললের কোম্পানী আমলে ঢাকা , হাকিম হাবিবুর রহমানের ‘ঢাকা পাচাস্ বারস্ পেহেল’ যতীন্দ্রমোহনের ‘ঢাকার ইতিহাস; প্রভৃতি বইয়ে ঢাকায় দূর্গা পূজার ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয় নি। তবে সৈয়দ আলী আহসানের ‘ ষাট বছর আগের ঢাকা’ বইয়ে দূর্গা পূজার সামান্য বর্ণনা পাওয়া যায়।
পূজায় টাকা দিতেন মুসলিম জমিদাররাও:
জেমস ওয়াইজ তার ‘নোট্স অন দ্য রেইজ কাট্স এন্ড ট্রেড অব ইস্টর্ন বেঙ্গল’ বইয়ে উল্লেখ করেছেন, হিন্দু জমিদাররা যেমন মুহররম পারনে অর্থ সাহায্য করে থাকেন মুসলমান জমিদাররাও তেমনি সাহয্য করেন দূর্গা পূজায়। এই ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় এখনো মুসলামানরা পূজায় অর্থ সাহায্য করে থাকেন। পুরাণ ঢাকার শাখারী বাজারের সবচেয়ে প্রাচীন ও বড় পূজা মন্ডপ ‘প্রতিদ্বন্দ্বি’ এর সভাপতি অনিল রায় জানান বহুবছর যাবত আমাদের এখানে সার্বিক আয়োজনে সর্বাতœক সহযোগিতা করেন আব্দুল খালেক নামের একজন।
থাকত পূজার সরকারী ছুটি: ঢাকা শহরে বিত্ত-বিদ্যার দিক দিয়ে তুলনামূলক ভাবে মুসলামানদের থেকে হিন্দু সম্প্রদায় অনেক এগিয়ে ছিলেন। ফলে ইংরেজদের ক্রিসমাসের পরেই সরকারীভাবে তো বটেই সম্প্রদায় গত ও ঐতিহ্যের কারণেও এ অঞ্চলে দূর্গাপূজা হয়ে উঠেছিল জাঁকালো ও গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব।সরকারী ছুটি ঈদের চেয়েও পূজায় ছিল বেশি।

পূজায় নাড়ির টানে গ্রামে যেতেন ঢাকাবাসী:
ঢাকাবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন তার ‘পুরনো ঢাকার উৎসব ও ঘরবাড়ি’ বইটিতে উল্লেখ করেছেন, পূজার ছুটিতে ঢাকায় যারা চাকুরী করতেন কিংবা কাজ করতেন এরকম সনাতন ধর্মীরা গ্রামে যেতেন। যাতে তারা আতœীয়-স্বজনদের সাথে নিয়ে পূজা উদ্যাপন করতে পারেন। গ্রামের সাধারণ মানুষজন ধুমধামের সাথে এ উৎসব পালন করত। পূজা চলতো বেশ কয়েকদিন। এ উপলক্ষে যাত্রা, কিগান নাচ। তাই দূর্গা পূজার এ উৎসবে ছেলে বুড়ো সবাই সাগ্রহে ডোগ দিতেন।
জমিদাররা গ্রামে আসতেন:
পূজা এতোটাই সার্বজনিন ছিল যে , জমিদাররা প্রজাদের সাথে পূজা পালনের জন্য শহর থেকে গ্রামে যেতেন। প্রজাদের খোঁজ খবর নিতেন। আর করতে সাধ্যানুযায়ী দান।তারাও পূজায় অর্থ দিতেন। ফলে ধূমধাম করে উৎসব পালনে বাধা ছিল না।
আর্শীবাদ লাভে নারীরা আসতেন দলবেঁধে:
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন ‘ ঢাকা: স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘দেবী দূর্গার আর্শীবাদ লাভকল্পে পূণ্যার্থীরা বিশেষ করে নারীরা আসতেন দলবেঁধে। দলের মধ্যে একজন মুরব্বী ধরনের লোক থাকতেন। এটি ছিল তাদের সারা বছরের সেরা পর্ব। বহু আশা-প্রত্যাশা নিয়ে তারা ঘর থেকে বের হতেন। নারীদের চোখে মুখে ফুটে উঠত প্রাণের ব্যাকুলতা, পাপ মোচনের ঐকান্তিক আগ্রহ আর আনত মস্তকে দেবী দূর্গার ভক্তিতে নীরবে এগিয়ে চলতেন পূজা মন্ডপের দিকে।
দেবী বিসর্জন হতো বুড়িগঙ্গায়:
সৈয়দ আলী আহসান আরো উল্লেখ করেছেন, দশমীর বিজয়ার মাধ্যমে পূজা শেষে শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে দেবী মূর্তি সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গায় বিসর্জনের জন্য। এখনও ঢাকা শহরের সকল মন্ডপকে বুড়িগঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে বিসর্জন দেয়া হয়।
পূজা শেষে মুসলমানদের মাঝে প্রসাদ বিতরন :
সৈয়দ আলী আহসান তাঁর ‘ষাট বছর আগের ঢাকা’ গ্রন্থে লিখেছেন,পূজা শেষে হিন্দু সমাজপতিরা মুসলানদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করতেন। এসময় তাদের মাঝে প্রসাদ বিতরন করা হত। প্রসাদে চিড়ে থাকত, নাড়কেল জোড়া থাকত, চিনি আর সবরী কলা থাকত। পাকানো মিষ্টির মধ্যে লালমোহনের প্রচলন ছিল বেশি। তখনকার দিনে বিভিন্ন মিষ্টি দোকানে লালমোহনের খুব কদর ছিল।
পূজা উপলক্ষে মেলা:
হাকিম হাবিবুর রহমানের ‘ঢাকা পচাস বারাস পেহেল’ বইতে উল্লেখ আছে যেকোন হিন্দু উৎসবে বাঈজি, খেমটা, সং আর গাঁজার আসর বসতই। আর নেশার চল এমনই ছিল যে, চুরুট তামাক ও চরসের ধোঁয়ায় প্রতিমাই ঢাকা পড়ে যেত। এখন পূজা অনেক ভদ্রস্থ। মূলত পুরোন ঢাকার শাঁখারি বাজার এলাকায় মেলা বসে। প্রবেশ পথেই থাকত বেশ কিছু গজা, মুরালি, সন্দেশের মত মিষ্টান্নের দোকান। নাগরদোলা তো যেকোন মেলার প্রাণ। আর শাঁখারি বাজারের রাস্তায় উঁচু মঞ্চের উপর বসানো হত মন্ডপ। নিচ দিয়ে থাকত মানুষের ভীড়।
দূগাপূজার সার্বজনীনতা: দূর্গা পূজাকে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত করতে অনেক সময় অতিবাহিত হয়েছে। দুর্গাপূজা বিংশ শতকের শুরুতেও ছিল পারিবারিক, অভিজাতদের মাঝে। অভিজাতদের বাইরে কেবল এর সার্বজনীনতা অর্থাৎ এখন যে ধরণের পূজা প্রচলিত, তা শুরু হতে গত শতকের তিরিশের দশক লেগে যায়। তবে সার্বজনীন পূজা ব্যাপক আকারে শুরু হয় ১৯৪৭ এর দেশ বিভাগের পর। দেশ ভাগের পর একক ভাবে পূজা করাটা বেশ ব্যয় সাপেক্ষ হয়ে ওঠে। এর ফলে ব্রাক্ষ্মণ-অব্রাক্ষ্মণ নির্বিশেষে মিলেমিশে পূজা করার চল শুরু হয়। ৭১ এ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কিংবদন্তীর ঢাকেশ্বরী মন্দিরে শুরু হয় দেশের কেন্দ্রীয় দুর্গা পূজা।
পুরোনো দিনের পূজা ও বর্তমানের পূজা:
পুরোনো দিনে কেমন পূজা দেখেন জানতে চাইলে, শাখারী বাজারের প্রবীন ব্যক্তি অমীয় সূর বলেন, আগে এতো লাইটিং ছিল না তবে আমাদের একে অপরের মধ্যে সৌহার্দ্য ছিল খুবই ভালো। পূজা উপলক্ষে আমরা বন্ধু- বান্ধবদের বাসায় দাওয়াত দিতাম খেতেও যেতাম। এখন যেরকম টাকা বেশি টাকা ব্যয় করে মন্ডপ তৈরী করা হতো তখন মন্ডপ তৈরীতে এতো টাকা আমরা কল্পনাও করতে পারতাম না। আর বেশির ভাগ টাকা আমরা কিন্দু মুসণিম সবার কাছ থেকে চাঁদা তুলে সংগ্রহ করতাম। সেসময় টাকা বেশি না থাকলেও আনান্দটা অনেক বেশি ছিল। এখকার পূজা আর আপনার শৈশবের পূজার মধ্যে কোন পূজাকে বেশি ভালো লাগে জানতে চাইলে তিনি বলেন, নিশ্চিই আমাদের কালে যে পূজা হয়েছে তাতে যে আনান্দ হয়েছিল তা আর বর্তমানের পূজায় পাই না।
আগের দিনে পূজা আর বর্তমানের পূজার মধ্যে কি রকম পরির্বত হয়েছে জানতে চাইলে ঢাকেশ্বরী মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তপন চক্রবর্তী বলেন, আমরা আমাদের যাবতীয় ঐতিহ্য রক্ষার ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট আছি। আগে যে ধরনের আনুষ্ঠানিকতা হতো এখনো তাই হয় । মাঝে শুধু বেড়েছে আড়ম্বরতা আর ভক্তের সংখ্যা।
একই বিষয়ে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপক কমিটির সাধারণ সম্পাদক তাপস কুমার পাল বলেন, ‘আগে আমরা ঢাকা শহরে বড় অনেক বড় বড় মেলার আয়োজন করতাম এখন তা জায়গার অভাবে করতে পারছি না। এছাড়া মুসলমান ভাইদের কাছ থেকে আমরা সর্বাত্নক সহযোগিতা আগেও পেয়েছি এখনও পাচ্ছি। উদাহরন হিসেবে তিনি কলা বাগানে পূজার পধান উদ্যেগতা একজন মুসলমান মহিলার নাম বলেন।

লেখক: জাহিদুল ইসলাম
শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক , জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা ।

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.