নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

চিনিলাম আপনারেআঘাতে আঘাতেবেদনায় বেদনায়;সত্য যে কঠিন,কঠিনেরে ভালোবাসিলাম,সে কখনো করে না বঞ্চনা।

সত্যের সারথি সাদেক

সত্য যে বড় কঠিন, কঠিনেরে বাসিলাম ভালো, যে কখনো করেনা বঞ্চনা !

সত্যের সারথি সাদেক › বিস্তারিত পোস্টঃ

নির্বাচনী ইশতেহার যখন ‘কচুরীপানা’ মুক্ত বাংলা

১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০ রাত ১২:০৪

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, ১৯৩৭ সালে বাংলার নির্বাচনে সবগুলো দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানার অভিশাপমুক্ত করার অঙ্গীকার ছিল। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক নির্বাচনে বিজয় লাভ করে তার নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে সবাইকে নিয়ে কাজে লেগে পড়েন এবং কচুরিপানার বিরুদ্ধে জোরদার অভিযান চালান।
কচুরিপানা! কচুরি ফুল! প্রকৃতির অপরূপ দান। যার ফুলে সুশোভিত হয়ে উঠে খাল-বিল, হাওড়-বাওড়, ছোট পুকুর জলাশয় কিংবা দীঘি। পুকুরভরা কচুরি ফুল, যেন প্রদীপ জ্বলছে, এমন সৌন্দর্য বাংলার গ্রাম ছাড়া আর আছে কোথায়? গ্রামের সহজ-সরল মানুষের মাটি-ঘনিষ্ঠ জীবনযাত্রার এক জীবন্ত ছবি। গ্রামে কাটানো কৈশোরের মনে এখনো শৈশবের খুনসুটির কথা মনে পড়ে কচুরিপানার কথায়। কিন্তু শহরের কিশোররা হয়তো সে-স্বাদ নাও পেতে পারেন। শিল্পায়নের কবলে হারিয়ে যাচ্ছে খাল-বিল, পুকুরসহ জলাশয়গুলো। পাড়াগাঁয়েও লেগেছে শহরের গন্ধ। কচুরিপানা ফুলের বেগুনি রঙের বিশাল বিছানার চিত্র হয়তো দেখার ভাগ্য হয়নি শহরের শিশুদের। এই ফুলে অনেকে আকৃষ্ট হয়ে প্রকৃতির এই অপূর্ব সৌন্দর্য উপভোগ করেন অনায়াসে। জানা হয়নি বাংলা মায়ের রূপ বৈচিত্র্যের গল্প।

কচুরিপানার পরিচিতি:
কচুরিপানার সাতটি প্রজাতি আছে এবং এরা মিলে ‘আইকরনিয়া’ গণটি গঠন করেছে। কচুরিপানা মুক্তভাবে ভাসমান বহুবর্ষজীবী জলজ উদ্ভিদ। এর আদি নিবাস দক্ষিণ আমেরিকার ব্রাজিলে। পুরু, চকচকে এবং ডিম্বাকৃতির পাতাবিশিষ্ট কচুরিপানা পানির উপরিপৃষ্ঠের ওপর ১ মিটার পর্যন্ত বাড়তে পারে। এর কান্ড থেকে দীর্ঘ, তন্তুময়, বহুধাবিভক্ত মূল বের হয়, যার রং বেগুনি-কালো। একটি পুষ্পবৃন্ত থেকে ৮-১৫ টি আকর্ষণীয় ৬ পাঁপড়ি বিশিষ্ট ফুলের থোকা তৈরি হয়। এটি প্রচুর পরিমাণে বীজ তৈরি করে যা ৩০ বছর পরও অঙ্কুরোদগম ঘটাতে পারে। সবচেয়ে পরিচিত কচুরিপানা Eichhornia crassipes রাতারাতি বংশবৃদ্ধি করে এবং প্রায় দু’ সপ্তাহে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
ফুলকে গাছ থেকে আলাদা না করে অর্থাৎ নিজের হাতে না নিয়ে দুর থেকে উপভোগ করলে ভাল হয়। এর মাঝে আবার কিছু শিকড় থাকে যারা কচুর লতের মত গাছ থেকে বের হয়ে নতুন গাছের জন্ম দেয়। তাই দেখা যায় একটি গাছকে সরাতে গেলে অন্যরাও সাথে এসে পড়ে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে এই কঁচুরী পানার ভুমিকা ছিল অত্যন্ত সাহসী। আমাদের বীর মুক্তিসেনারা যখন গেরিলা আক্রমন করার প্রস্তুতি নিতে খাল বিলে লুকিয়ে থাকত তখন এই সামান্য বৃক্ষই তাদেরকে মায়ের মত আচল দিয়ে লুকিয়ে ফেলত তাদের। তাই একে মুক্তির ফুল বললেও অতুক্তি হয় না।

আঞ্চলিক নাম

দেশের প্রায় সকল অঞ্চলেই এটাকে পানা বা কচুরিপানা বলে। কিন্তু চাঁদপুর অঞ্চলে বলে কস্তুরি। আমরা জানি, বিশেষ জাতের পুরুষ হরিণের তলপেটে জন্মানো থলের মধ্যে থাকা একধরনের সুগন্ধি দ্রব্যকেই কস্তুরি বলে। এই হরিণের নাম কস্তুরি মৃগ। তবে কি কচুরিপানার ফুলের সৌন্দর্যের সাথে মৃগনাভি বা কস্তুরির মিল খুঁজে পেয়েছেন এ অঞ্চলের পূর্বপুরুষেরা?

বাংলায় কচুরিপানার আগমনের ইতিহাস:

ধারণা করা হয় কচুরিপানার অর্কিড-সদৃশ ফুলের সৌন্দর্যপ্রেমিক এক ব্রাজিলীয় পর্যটক ১৮ শ’ শতাব্দীর শেষভাগে বাংলায় কচুরিপানা নিয়ে আসেন। তারপর তা এতদ্রুত বাড়তে থাকে যে ১৯২০ সালের মধ্যে বাংলার প্রায় প্রতিটি জলাশয় কচুরিপানায় ভরে যায়। নদ-নদীতে চলাচল দুঃসাধ্য হয়ে পড়ে। উপরের পানিপৃষ্ঠ ঢেকে দেওয়ায় সূর্যালোক না পেয়ে পানির নিচের জলজ উদ্ভিদ প্রজাতি মারা যায় এবং অক্সিজেন ঘাটতির কারণে মাছ মারা যেতে থাকে। কচুরিপানা শুধুমাত্র জলাশয়গুলোতেই সীমাবদ্ধ থাকে নি, নিচু জমিতে ধান এবং পাটের আবাদস্থলে এর দৌরাত্ম্য বেড়ে যায়। এমতাবস্থায় দেশের অর্থনীতির হাল বলার অপেক্ষা রাখে না।
এমত পরিস্থিতিতে সরকার কচুরিপানার দৌরাত্ম্য হ্রাসে বাংলার জলাভূমি আইন, বাংলার মিউনিসিপ্যালিটি আইন, বাংলার স্থানীয় সরকার আইন এবং বাংলার স্থানীয় গ্রাম সরকার আইন সংশোধন করে। ১৯৩৬ সালে কচুরিপানা আইন জারি করা হয়, যার মাধ্যমে বাড়ির আশপাশে কচুরিপানা রাখা নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত কচুরিপানা পরিষ্কার অভিযানে অংশ নেয়াকে নাগরিক কর্তব্য ঘোষণা করা হয়। আক্রান্ত এলাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটরা তাদের নিজ নিজ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে কচুরিপানা দমনে কার্যকর অভিযান চালাতে আদিষ্ট হন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনেও সকল দলের নির্বাচনী ইশতেহারে বাংলাকে কচুরিপানা মুক্ত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। এই নির্বাচনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনের পরপরই ‘কচুরিপানা উৎখাত কর্মসূচি’ হাতে নেন। অবশেষে ১৯৪৭ সাল নাগাদ নিয়ন্ত্রণে আনা গেল কচুরিপানা। তবে বিলুপ্তি ঘটে নি। যেটুকু আছে তাতে তেমন সমস্যার সৃষ্টি হয় না বলে পুরোপুরি বিলুপ্তি ঘটানোর ব্যবস্থাও আর নেওয়া হয় নি। এর বিকল্প নানা ব্যবহারও আবিষ্কৃত হচ্ছে দিন দিন।

কচুরিপানার নানা গুণ

কচুরিপানাকে অনেকেই তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেও এর নানা গুণ রয়েছে। আমাদের দেশে গোখাদ্য এবং ফসলি জমিতে জৈব সার হিসেবে ব্যবহার হলেও উন্নত বিশ্বে কচুরিপানার ফুল থেকে ওষুধ তৈরি করে থাকে। বাংলাদেশের বিজ্ঞানীরা কয়েক বছর ধরে কচুরিপানা থেকে কাগজ তৈরির জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন।

কচুরিপানার সাধারণ ব্যবহার

জৈব সার হিসেবে কচুরিপানার ব্যবহার লক্ষণীয়। কচুরিপানার সাথে খড়কুটা, ঝরা পাতা, আগাছা, আবর্জনা, ফসলের অবশিষ্টাংশ মিশিয়ে পচানো হয়, যা থেকে তৈরি হয় উৎকৃষ্ট মানের মিশ্র সার। সার তৈরির জন্য গর্ত করে গর্তের তলায় বালু বা কাঁকর বা খড় দিয়ে কচুরিপানা, আখের ছোবড়া, গোবর, কলাপাতা মিশিয়ে স্তরে স্তরে সাজিয়ে প্রত্যেক স্তরের উপর ইউরিয়া সার দিয়ে তারপর মাটির প্রলেপ দিয়ে গর্ত ভরে দিতে হয়। এভাবে ৩ মাস রাখার পর এই সার ব্যবহার উপযোগী হবে।

কচুরিপানার আসবাবপত্র

ফুজি নারীরা কচুরিপানা শুকিয়ে তা থেকে ব্যবহার উপযোগী ঝুড়ি, আসবাবপত্র তৈরি করে রফতানিও করে থাকে। এই ঝুড়ি ফিলিপাইন, ভারত, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশে পর্যটনের কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। উগান্ডার মানুষ কচুরিপানা থেকে কাগজ ও কাগজের তৈরি ম্যাট ব্যবহার করছে। এ ছাড়া স্কেল ফাইবার বোর্ড, সুতা ও দড়ি তৈরির কাজেও কচুরিপানার ব্যবহার লক্ষ করা যায়।


কচুরিপানা দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য

এছাড়াও গো-খাদ্য হিসেবে, ব্যাগ, দড়ি এবং আসবাবপত্র তৈরিতে ব্যবহৃত হচ্ছে এই কচুরিপানা। তৈরি হচ্ছে লেখার বা ডিজাইনার রঙিন কাগজও। অতি সম্প্রতি কচুরিপানা থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির পদ্ধতিও আবিষ্কৃত হয়েছে।

কচুরিপানার আকর্ষণীয় ফার্নিচার তৈরি

কচুরিপানার এক অভিনব ব্যবহার হলো ফার্নিচার তৈরি। এই ফার্নিচারগুলো যেমন পরিবেশ-বান্ধব তেমনই আকর্ষণীয়। প্রথম দেখায় কচুরিপানা দিয়ে তৈরি ফার্নিচারগুলোকে প্রথম দেখায় বেতের ফার্নিচার মনে হতে পারে। কিন্তু এগুলো বেতের তুলনায় অনেক বেশি নরম, নমনীয়, স্থিতিস্থাপক এবং অন্দরে বেশ আধুনিকতার প্রকাশ ঘটায়।

বসতভিটা মজবুতকরণ ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ

শীতকালীন সবজি বাগানে ব্যবহার করলে শীতকালে মাটির আদ্রতা ধরে রাখ। মাটিকে শক্ত করে ধরে রাখার ফলে মাটি শক্ত হয়। বন্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে বসত ভিটে রক্ষার কাজেও ব্যবহৃত হয়।

কচুরিপানা চাষে ভাগ্যবদল

এই জলজ উদ্ভিদ কচুরিপানা চাষ এখন লাভজনক। যেমন বরিশালের অনুন্নত বিল এলাকা বিশারকান্দি। এখানে বারো মাসই পানিবদ্ধতা থাকে। জনযোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে নৌকা। জীবিকার মাধ্যম চাষাবাদ। এখানকার চাষাবাদ পদ্ধতি ব্যতিক্রমধর্মী। বেশির ভাগ লোকই তরিতরকারি বা সবজি চাষ করে থাকে। ধান চাষ খুব একটা হয় না। এখানকার লোকদের আধুনিক চাষাবাদের সঙ্গে তেমন যোগাযোগ নেই। নিজস্ব উদ্ভাবনীর মধ্যে দিয়েই এবং চিরায়ত ধ্যান-ধারণাকে আঁকড়ে এদের জীবন সংসার এবং পেশাগত কাজ-কর্ম। স্থানীয়ভাবে ওই এলাকার চাষাবাদের জন্য যে উপাদানের প্রয়োজন তা হচ্ছে কচুরিপানা। বেশি ফলন এবং জমির অভাবে অর্থাৎ জলমগ্ন থাকায় পানির ওপর ভাসমান ‘ঢুপ’-এর মাধ্যমে ফসল ফলায়। ঢুপ হচ্ছে ভাসমান বিভিন্ন আর্বজনা বিশেষ করে কচুরিপানার পচনকৃত স্তুপ। যা জৈব সারে পরিণত হয়। ভাসমান এ ঢুপের স্তুপের ওপরই মূলত এরা চাষাবাদ করে বিভিন্ন সবজির। ফলনও হয় খুব বেশি। পানিবদ্ধতা বিল এলাকায় কচুরিপানার চাষ করে প্রতিটি পরিবার। বাধ্য হয়েই এর চাষ করতে হয়। বারো মাসই এ কচুরিপানার প্রয়োজন হয়। শুধু চাষের জন্য নয়। জ্বালানি হিসেবে শুকনো কচুরিপানার প্রয়োজন হয়। শ্রাবণ, ভাদ্র মাসে কচুরিপানার বংশ বৃদ্ধি হয়। চাষের জন্য তেমন বিশেষ কিছু করতে হয় না। শুধুমাত্র পরিচর্যাই প্রধান। যে কোন সুবিধাজনক স্থানে স্থায়ীভাবে জীবিত কচুরিপানা বাঁশ দিয়ে বেড়া দিতে হয়। বাঁশ ছাড়াও অন্যান্যভাবেও শুধুমাত্র কচুরিপানাকে নড়াচড়া না করে এমনভাবে আবদ্ধ রাখা হয়।
রবিশস্যের মৌসুমে এ কচুরিপানা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নিয়ে স্তূপ করা হয়। এক সপ্তাহ থেকে পনের দিনের মধ্যে এর পচন ধরে। তখন সামান্য মাটির আবারণ ক্ষাণিকটা কাঠের গুঁড়ি দিয়ে ওই কচুরিপানার স্তূপের (ঢুপ) ওপর বিভিন্ন সবজির চাষ করা হয়। ওই এলাকার লোকজন কচুরিপানার চাষ করে লাভবান হচ্ছেন। এ ছাড়া ও এলাকার লোকজন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। যারা কচুরিপানা সংগ্রহ করেন না অথচ চাষের ব্যবসায়িক উৎপাদন করেন তারা ওই কচুরিপানা ভালো মূল্য দিয়ে ক্রয় করেন। যে কারণে লোকজন কচুরিপানা চাষের দিকে ঝুঁকছে।

পাল্টে যাচ্ছে মানুষের জীবনযাত্রা, ঘরবাড়ি, পরিবেশ ও রাস্তাঘাট। বেড়েই চলেছে ইট পাথরের দালন-কোঠা ও শিল্প কারখানা। হারিয়ে যাচ্ছে জীব ও বৈচিত্র্যের অপরূপ সৌন্দর্য। এর মাঝে বিভিন্ন জলাশয়ে দেখা মিলে কচুরিপানা ফুলের। খুবই হালকা বেগুনি সাতটি পাপড়ির একটাতেই কেবল এই ময়ূরের পালকের মত আকাশনীল রংয়ের ছোঁয়া। তার মাঝে হলুদ রঙের একটা তিলক। অসাধারণ ব্যাপার। প্রকৃতিপ্রেমিকদের এমন সৌন্দর্য কাছে টেনে নেয় অনায়াসে। নীলচে শিরা-উপশিরায় বিন্যস্ত হালকা বেগুনি রঙের মায়াবী এই ফুল হারানো শৈশবকে খুব কাছে টানে।

শিক্ষার্থী ও সাংবাদিক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
পুরান ঢাকা। ১৯।০২।২০২০

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.