![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
পেশায় সাহিত্যের শিক্ষক। মতাদর্শে মার্কসবাদী। কোলকাতার বাসিন্দা
কিছুদিন আগে, গত ১৬ ডিসেম্বর গোটা বাংলাদেশ জুড়ে বিরাট সমারোহে পালিত হল বিজয় দিবস। ৭১ এ মুক্তিযুদ্ধে জয়ের পঁয়তাল্লিশতম বার্ষিকীতে, এবারের এই ১৬ ডিসেম্বর, ২০১৬ র বিজয় দিবসের উৎসবে এপার বাংলা থেকেও যোগ দিয়েছিলেন অসংখ্য মানুষ। অনেকে সরকারি অতিথি হিসেবে আর তার বহুগুণ মানুষ নেহাৎই প্রাণের আবেগে। দুই বাংলার মিলিত প্রাণের আকুতি যে সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া বারবার অতিক্রম করে যায়, সাম্প্রতিক বিজয় দিবসকে কেন্দ্র করে আরেকবার তা প্রমাণিত হলো। বাংলাদেশের ওঠা পড়া ভালোমন্দ তাই আমাদের কাছে কোনওদিনই “পররাষ্ট্র চর্চা” নয়, আন্তর্জাতিক কূটনীতির চর্চা নয়। আমাদের প্রাণের আবেগ, নাড়ির বন্ধনকে ফিরে ফিরে দেখা।
সাম্প্রতিক এই দশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নতুনভাবে গড়ে পিঠে নেওয়া ও তাকে ভাঙতে চাওয়ার বহু বিচিত্র দ্বন্দ্ব আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। এই দ্বন্দ্বের একদিকে যেমন ছিল শাহবাগ আন্দোলন, তেমনি অন্যদিকে ছিল ব্লগার হত্যা, পুরোহিত সুফী বৌদ্ধ হত্যার মর্মান্তিক ধারাবাহিকতা। বিজয় দিবসের উৎসবের আবেগঘন মুহূর্তে এই প্রগতি প্রতিক্রিয়ার দ্বন্দ্বকে ফিরে দেখা বিশেষভাবেই জরুরী।
২০১৩ সাল জুড়ে আমরা দেখেছিলাম বাংলাদেশে আছড়ে পড়ছে এক নতুন ধরনের গণ আন্দোলনের ঢেউ। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েরা লাখে লাখে জমায়েত হয়েছেন ঢাকার শাহবাগে, জমায়েত হয়েছেন সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া সহ দেশের সর্বত্র। দাবী মুক্তিযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতক গণহত্যাকারীদের ন্যায় বিচার ও সর্বোচ্চ শাস্তি চাই, দাবী মৌলবাদকে শিকড় শুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎপাটন করা হোক। প্রবাসী বাংলাদেশীরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আন্দোলনের সহমর্মিতায় জারী রেখেছেন বিভিন্ন ধরণের কার্যক্রম। গোটা বাংলাদেশ জুড়ে আন্দোলন কে কেন্দ্র করে এসেছে কবিতা, গান, ছবি, তথ্যচিত্রসহ বিভিন্ন সৃজনধর্মী কাজের এক জোয়ার। মূলত তরুণ প্রজন্মের এই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, দেশের বিশিষ্ট জনেরা। পাশাপাশি এই আন্দোলন আবার মুখোমুখি হয়েছে জামাতে ইসলামি সহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠনের তীব্র বিরোধিতার। ভাঙচুর, বন্ধ, হত্যার মধ্য দিয়ে তারা রুখতে চেয়েছেন আন্দোলনের গতি, স্থিমিত করে দিতে চেয়েছেন এর দাবী গুলিকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক এক দেশ গড়ে তোলার স্বপ্ন আর মৌলবাদকে টিকিয়ে রেখে কায়েমী স্বার্থসিদ্ধির অভিলাষ এক মুখোমুখি সংঘর্ষে সামিল ছিল শাহবাগের দিনগুলিতে। তিন বছর পর সেই সংঘর্ষ বহমান আজকের বাংলাদেশেও।
১৯৫২ র ভাষা শহীদদের আত্মবলিদানের সেই ফেব্রুয়ারী মাসেই আত্মপ্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত ২০১৩ র এই শাহবাগ আন্দোলন। ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ একটি রায় বেরোয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধগুলির বিচারের জন্য গঠিত ট্রাইবুনালের। সেই রায়ে ’৭১ এর ঘৃণ্য ঘাতক আব্দুল কাদের মোল্লাকে প্রত্যাশিত মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তার নামে অভিযোগ ছিল কবি মেহেরুন্নেসাকে হত্যা, আলুন্দি গ্রামে ৩৪৪ জন মানুষের হত্যার সঙ্গে যুক্ত থাকা, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধের। এইসব মারাত্মক অভিযোগের পাঁচটি প্রমাণিত হবার পরও ঘাতককে সর্বোচ্চ শাস্তি না দেবার এই রায়কে বাংলাদেশের জনসাধারণ মেনে নিতে পারেনি। ট্রাইবুনালের রায় প্রকাশের পরেই বিক্ষুব্ধরা প্রতিবাদ জানাতে জমা হন ঢাকার শাহবাগ চত্বরে। প্রথমে বিভিন্ন ব্লগ ও সোশ্যাল ফোরামের মাধ্যমেই ডাক দেওয়া হয় প্রতিবাদের। পরে সংগঠিত গণমাধ্যমগুলিও এর সমর্থনে দাঁড়ায়। দ্রুতই বাড়তে থাকে প্রতিবাদ ও তার অভিঘাত। ঢাকার শাহবাগ চত্বর সহ গোটা দেশ সমস্ত স্তরের মানুষের, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের বিক্ষোভে প্লাবিত হয়ে যায়। শাহবাগেই জমায়েত সংখ্যা পাঁচলক্ষ ছাপিয়ে যায়, জনপ্লাবনে ভেসে যায় সিলেট, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল, বগুড়া, যশোর, কুমিল্লা, কুষ্টিয়া সহ গোটা বাংলাদেশের বিক্ষোভ কেন্দ্রগুলি। পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির প্রক্রিয়া ও চলমান আন্দোলনকে রুখতে সক্রিয় হয়ে ওঠে জামায়েতে ইসলামি সহ বিভিন্ন মৌলবাদী সংগঠন, বাংলাদেশে যাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রতিপত্তি যথেষ্ট। এতদ সত্ত্বেও যুদ্ধাপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবিতে বিক্ষোভ বাংলাদেশকে এক যুগসন্ধিক্ষণে এসে দাঁড় করিয়ে দেয়। বিচারের একটি রায়কে উপলক্ষ্য করে যে আন্দোলনের সূত্রপাত, তা নিয়ে আন্দোলন সংঘর্ষ বাংলাদেশের রাজনৈতিক চেহারাকে নতুন করে নির্মাণ করতে উদ্যত হয়।
’৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে গিয়েছিল অজস্র মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যার করুণ ঘটনা, শত সহস্র নারীর লাঞ্ছনার বেদনাদায়ক ইতিবৃত্ত। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পূর্ব পাকিস্থানের একদল মানুষ মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্থানের পক্ষ নিয়ে এই অপরাধ সংগঠিত করেছিল। দেশদ্রোহী এই মানুষগুলিই, যারা মূলত ছিল জামায়েতে ইসলামি ও তার বিভিন্ন গণ সংগঠনের সদস্য, সমর্থক; বাংলাদেশে ‘রাজাকার’ নামে কুখ্যাত। যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেবার জন্য স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে একটি আইন তৈরি হয়। কিন্তু অচিরেই রাজনৈতিক পালাবদলের সূত্রে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়াটি স্থগিত হয়ে যায়। রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর বাড়িতে কয়েকজন সেনাকর্তার ষড়যন্ত্র ও আক্রমণে সপরিবার খুন হন। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব জামায়েতে ইসলামিকে পুনরায় বাংলাদেশের রাজনীতিতে বৈধতা দেন এবং তাদের সঙ্গে জোট সরকারও গঠন করেন। স্বাধীনতার পরে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রর জায়গা থেকে সরে এসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ইসলামকে স্বীকৃতি দেন সামরিক শাসক এরশাদ। বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতির একটা ভালো অংশের নিয়ন্ত্রক হয়ে বসে জামায়েতে ইসলামির মত মৌলবাদী সংগঠন। এই পরিস্থিতিতে পিছনের সারিতে চলে যাওয়া যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গটিকে ১৯৯২ সালে কিছুদিনের জন্য হলেও সামনে নিয়ে আসেন শহীদ জননী জাহানারা ইমাম। এই শাহবাগের পাশেই বসেছিল তাঁর প্রতীকী গণ আদালত। কিছুদিন আলোড়নের পর বিচার নিয়ে আবার স্থিতাবস্থার পর্ব চলে প্রায় দু দশক। শেষপর্যন্ত বিগত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতার মসনদে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা আসীন হবার পর ২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য গঠিত হয় আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল। চোরা স্রোতের মত বহমান মুক্তিযুদ্ধকালীন ঘাতকদের উপযুক্ত শাস্তির দাবী আবার স্ফীত হয়।
অবশ্য বাংলাদেশের শাহবাগ গণ জাগরণ শুধু মুক্তিযুদ্ধের অতীত কলঙ্কগুলির ক্ষত মোচনের পরিসরেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বস্তুতপক্ষে তরুণ প্রজন্মের আন্দোলনকারীরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত হয়ে ডাক দেয় জামায়েতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করার, বাংলাদেশের সমাজ রাজনীতি থেকে মৌলবাদি আস্ফালনকে উৎপাটন করার। ডাক দেয় এক আধুনিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলার। তরুণ প্রজন্মের এই আহ্বান, তাঁদের দৃঢ় মতাদর্শ ও শাণিত উপস্থাপণ বাংলাদেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলিকেও বাধ্য করে স্পষ্ট অবস্থান নিতে। শাসক আওয়ামী লিগের গরিষ্ঠ অংশ জামায়েতে ইসলামিকে নিষিদ্ধ করা সহ একাত্তরের ঘাতকদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যাপারে মত প্রকাশ করেছেন। তাদের নেতৃত্ব শাহবাগ চত্বরে হাজির হয়ে আন্দোলনের প্রতি সংহতিও ব্যক্ত করেছিলেন। বাংলাদেশের বামপন্থী, প্রগতিশীল শিবির মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবাহী এই আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে সামনের সারিতে ছিল।
অন্যদিকে স্বাভাবিক ভাবেই জামায়েতে ইসলামি ও তাদের সমর্থক দলগুলি দাঁতে নখে আন্দোলনের বিরোধিতা করে। আন্দোলন ভাঙতে ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচাল করতে তারা সক্রিয় হয়। বন্ধ, হামলা, আন্দোলনকারীদের খুন জখমের মধ্য দিয়ে তারা বার্তা দিতে চায়। একাত্তরের স্মৃতিকে উসকে দিয়ে তারা হত্যা করে আন্দোলন সমর্থকদের। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে আন্দোলনের শিবির গুলিতে চলে তাদের সশস্ত্র হামলার চেষ্টাও। প্রধান বিরোধী দল বি এন পি প্রথম দিকে আন্দোলনকে সমর্থন করলেও দ্রুতই তার অবস্থান পরিবর্তন করে এবং নিজের নির্বাচনী জোটসঙ্গী জামায়েতে ইসলামির সদস্য সমর্থকদের ওপর পুলিশি নির্যাতন ইত্যাদির বিরোধিতাতেই নিজেকে নিয়োজিত রাখে। সমর্থন করে জামায়েতে ইসলামির সমর্থক দলগুলির ডাকা ধর্মঘট। কোলকাতাতে জামায়েতে ইসলামির সমর্থকরা আন্দোলনের বিরুদ্ধে তাদের বিক্ষোভ সংগঠিত করার চেষ্টা করে। তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্যসভার সাংসদ ইমরান এতে মদত দেন। অন্যত্রও তারা তাদের শক্তি সমর্থনকে সংহত করে নিজেদের মৌলবাদী আস্ফালনকে বজায় রাখার চেষ্টা চালিয়ে যায়।
শাহবাগ আন্দোলনের চেতনা ছড়িয়ে পড়ে নতুন নতুন ক্ষেত্রে। ব্লগের অপ্রাতিষ্ঠানিক লেখালেখির মধ্যে দিয়ে ধর্মান্ধতাকে কড়া চ্যালেঞ্জ জানানো এবং যুক্তিবাদী চেতনার বিকাশ ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। বাংলাদেশের তরুণ সমাজ ও ব্যাপক গণমনে তা নির্ণায়ক প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। একেই থামাতে নতুনভাবে কাজ শুরু করে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি। মুক্তিযুদ্ধের গতি রুদ্ধ করতে উদ্যত রাজাকার আলবদরদের কুখ্যাত ইতিহাসকে মনে করিয়ে দিয়ে শুরু হয় গোপন হত্যা।
২০১৩ র ফেব্রুয়ারীতে শুরু হয়েছিল শাহবাগ আন্দোলন আর তাঁর দু বছর পর ২০১৫ র ফেব্রুয়ারী মাসেই একুশে বইমেলা চলাকালীন খুন হয়ে গেলেন অভিজিৎ রায়। ২৬ ফেব্রুয়ারী প্রকাশ্য রাজপথে কিছু ধর্মান্ধ মুসলিম মৌলবাদী তথা দুষ্কৃতির হাতে নৃশংসভাবে খুন হয়ে যান এই লেখক সংগঠক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক এবং পরিচিত শিক্ষাবিদ অজয় রায়ের পুত্র অভিজিৎ কর্মসূত্রে আমেরিকায় থাকতেন। সেখান থেকেই তিনি বাংলা ভাষায় লেখালেখিতে সক্রিয় ছিলেন এবং বিজ্ঞানমনস্কতার প্রচার প্রসারে চালাতেন ‘মুক্তমনা’ নামের একটি জনপ্রিয় ও প্রভাবসঞ্চারী বাংলা ব্লগ। বিজ্ঞানের দর্শন, ধর্মের অধিবিদ্যক দিক, মৌলবাদের নানা প্রবণতা নিয়ে তিনি অজস্র লেখালেখি করেছেন, নতুন লেখকদের লালন করেছেন, সাহস দিয়েছেন, সহায়তা পরামর্শে ঋদ্ধ করেছেন। মুসলিম মৌলবাদের পাশাপাশি হিন্দু মৌলবাদ যেমন তার লেখার বিষয় হয়েছে, তেমনি প্যালেস্টাইনের ওপর ইজরায়েলের আক্রমণের বিরুদ্ধেও তার কলম শাণিত ভাষায় কথা বলেছে। অভিজিতের লেখা পড়লেই দেখা যায় যেখানে তিনি বিরুদ্ধে মতের বিরুদ্ধে কলম শানাচ্ছেন, সেখানেও তিনি ভাষায় ভঙ্গীতে অত্যন্ত মার্জিত এবং আগাগোড়া যুক্তিনির্ভর। বিরুদ্ধ মতকে আহত করা নয়, তার সঙ্গে বিতর্কের মাধ্যমে সত্যে পৌঁছনোর দিকেই তার লেখালেখি উন্মুখ ছিল। ইতোপূর্বেই আলোড়ন তুলেছিল তার ‘আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী’ (২০০৫), মহাবিশ্বে প্রাণ ও বুদ্ধিমত্তার খোঁজে (২০০৭), ‘স্বতন্ত্র ভাবনা : মুক্তচিন্তা ও বুদ্ধির মুক্তি’ (২০০৮), ‘অবিশ্বাসের দর্শন’ (২০১১), ‘বিশ্বাস ও বিজ্ঞান’ (২০১২), ‘ভালোবাসা কারে কয়’ (২০১২), ‘সমকামিতা’ (২০১২) প্রভৃতি গ্রন্থ। নতুন দুটি বইয়ের প্রকাশের কথা ছিল ২০১৫ র ঢাকার একুশের বইমেলাতে। সেই উপলক্ষ্যেই অভিজিৎ স্ত্রী রাফিদা আহমেদ এর সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। ২৬ তারিখ বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে তাকে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে খুন করে কিছু দুষ্কৃতি। রাফিদাও মারাত্মকভাবে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য নিরীশ্বরবাদের পক্ষে লেখালেখি করায় বাংলাদেশের ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িক মুসলিম মৌলবাদীরা অতীতে অনেক বারই তাকে হুমকি দিয়েছে; এমনকী এও বলেছে যে আমেরিকাপ্রবাসী হওয়ায় তাকে এখন শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না, কিন্তু বাংলাদেশে এলেই তাকে কোতল করা হবে। অভিজিৎ ঢাকায় আসার পর এই হুমকির বাস্তবায়ন ঘটায় মৌলবাদীরা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় বিবৃতি দিয়ে এই খুনের দায় স্বীকার করে নানাভাবে তাদের জান্তব আনন্দোল্লাস তারা চালিয়ে যায়।
অভিজিতের ওপর এই আক্রমণ অবশ্যই বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা ছিল না। অভিজিতের মৃত্যুর পরবর্তী কয়েকদিন প্রতিবাদের পাশাপাশি সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ধর্মান্ধ জল্লাদদের উল্লাসধ্বনিও বিপুলভাবে উপস্থিত ছিল। অভিজিতের মর্মান্তিক পরিণতি আমাদের মনে করিয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক, ভাষাতাত্ত্বিক, সমাজতাত্ত্বিক হুমায়ুন আজাদের হত্যার কথা। ২১ এর বইমেলা চলাকালীন যেখানে অভিজিৎকে হত্যা করা হলো সেখানেই হুমায়ুন আজাদকে প্রাণাত্মক আঘাত দিয়েছিল মুসলিম মৌলবাদীরা। অভিজিৎকে হত্যার কিছুদিন আগে শাহবাগ আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও লেখক রাজীব হায়দরকে একইভাবে খুন করে তারা। যারা অভিজিৎ হত্যার প্রতিবাদ করেন তাদের ‘কল্লা নামানোর’ হুমকি দেওয়া হয় মুসলিম মৌলবাদীদের তরফে।
এটা যে নেহাৎ ফাঁকা আওয়াজ নয় তার প্রমাণ পরপর পাওয়া যেতে থাকে। ৩০ মার্চ রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বেগুনবাড়িতে ব্লগার ওয়াশিকুর রহমানকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। পালানোর সময় কয়েকজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হাতেনাতে দুই হত্যাকারীকে আটক করে পুলিশে দেয়। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদের পর পুলিশ জানায়, হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে ‘আনসারুল্লাহ বাংলা টিম’। ওয়াশিকুর হত্যায় হাতেনাতে গ্রেফতারকৃতরা পুলিশকে জানিয়েছে, চট্টগ্রামে হেফাজতে ইসলাম পরিচালিত মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন তারা। এরপর ১২ মে সিলেটে খুন হন মুক্তমনা ব্লগার অনন্ত বিজয় দাস। পুলিশ জানায়, এই হত্যাকাণ্ডও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের স্লিপার সেলের কাজ। লক্ষ্যনীয়, এই তিনটি হত্যাকাণ্ডেই অংশ নেওয়া জঙ্গিরা খুনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছিল চাপাতি। প্রতিটি খুনই সংগঠিত হয়েছে রাজপথে অতর্কিত হামলায়। কিন্তু এরপরেই বদলে যায় হত্যার ধরণ। চাপাতির সঙ্গে যোগ হয় পিস্তল-রিভালবারের মতো সহজে বহনযোগ্য আগ্নেয়াস্ত্র। বাসায়-অফিস কক্ষে ঢুকে সশস্ত্র হামলা চালাতে থাকে জিহাদীরা। ৭ আগস্ট ঢাকার দক্ষিণ গোড়ানে বাসায় ঢুকে সন্ত্রাসীরা চাপাতির কোপে খুন করে আরেক মুক্তমনা ব্লগার নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে (২৭)। এবার জঙ্গিরা পিস্তলের মুখে জিম্মী করে রেখেছিল নীলাদ্রীর স্ত্রী আশামনিকে। ৩১ অক্টোবর বিকেলে ঢাকার আজিজ সুপার মার্কেটের কার্যালয়ে ঢুকে ‘জাগৃতি’ প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। একই দিন সকালে সন্ত্রাসীরা লালমাটিয়ার কার্যালয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করে ‘শুদ্ধস্বর’ এর প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল, ব্লগার রণদীপম বসু ও ব্লগার তারেক রহিমকে। এই ‘জিহাদী মিশন’ শেষে চলে যাওয়ার আগে জঙ্গিগোষ্ঠী পিস্তল থেকে পর পর দুটি গুলি করে তারেককে। সৌভাগ্যক্রমে চিকিৎসায় তারা তিনজনই প্রাণে বেঁচে যান। ২০১৬ র ৮ এপ্রিল রাতে রাজধানীর সূত্রাপুরের একরামপুর মোড়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয় সিলেট গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নাজিমুদ্দিন সামাদকে। হত্যাযজ্ঞে চাপাতি ব্যবহার করার পাশাপাশি খুনি নাজিমের মৃত্যু নিশ্চিত করতে তার মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে এক রাউন্ড গুলি করে বলে নিহতের সঙ্গী ও প্রত্যক্ষদর্শী পুলিশকে জানিয়েছে। ঘটনাস্থল ত্যাগ করার সময় জিহাদীরা ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দিয়েছিল। এর এক সপ্তাহের মধ্যেই কট্টর মৌলবাদীদের হাতে পরপর খুন হন সংস্কৃতি চর্চাকারী এক প্রবীণ অধ্যাপক ও এল জি বি টি আন্দোলনের দুই সুপরিচিত কর্মী সংগঠক।
২৩ এপ্রিল,২০১৬ শনিবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে রাস্তায় চাপাতির কোপ মেরে খুন করা হয়। বিভাগের ক্লাস নিতে আসার জন্য বাড়ি থেকে বেরনোর পরেই বাড়ির মাত্র ৫০ গজ দূরে নগরীর শালবাগান বটতলা এলাকায় অপেক্ষারত আততায়ীরা তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অধ্যাপক রেজাউল করিম ‘কোমলগান্ধার’ নামে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিবিষয়ক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। তিনি ভালো সেতারও বাজাতেন এবং ‘সুন্দরম’ নামে একটি সাংস্কৃতিক বিষয়ক সংগঠনের উপদেষ্টা ছিলেন। তিনি ইংরেজি বিভাগে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কক্ষটি ছিল সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম কেন্দ্র। তিনি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে শুদ্ধ সংগীত চর্চায় উৎসাহিত করতেন। অনেকে বলেছেন কিছু মতান্ধ গান বাজনার চর্চাকে ‘সহি ইসলাম’ সম্মত বলে মনে করে না এবং এই কারণেই তারা অধ্যাপকের ওপর হামলা চালিয়ে থাকতে পারে।
রাজশাহীতে অধ্যাপক রেজাউল করিম সিদ্দিকীকে চাপাতির কোপে খুন করার দুদিনের মধ্যেই সংগঠিত হয় আরো দুটি খুন। ২৫ এপ্রিল জঙ্গিরা ঢাকার কলাবাগানের বাসায় ঢুকে কুপিয়ে খুন করে জুলহাজ মান্নান ও তার বন্ধু তনয়কে। প্রত্যক্ষদর্শিরা জানিয়েছেন, পাঁচ-সাতজন যুবকের পরনে এবার ছিল জিন্সের প্যান্ট-টি শর্ট ও কাঁধে ল্যাপটপের ব্যাগ। আর তাদের কারো কারো হাতে ছিল পিস্তলও। খুন করে চলে যাবার সময় ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি দেয় তারা। জুলহাজ মান্নান সমকামী ও রূপান্তরকামীদের অধিকারের দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, সেইসব দাবি দাওয়া নিয়েই সম্পাদনা করতেন ‘রূপবান’ নামক সমকামীদের একটি পত্রিকা। সমকামী ও রূপান্তরকামী আন্দোলনের তীব্র দ্বেষক মতান্ধরা কেন সরিয়ে দেয় মার্কিন দূতাবাসের এই সাবেক কর্মকর্তাকে,তা বোঝা কঠিন নয়।
এরপরেও লাগাতার চলে গুপ্তহত্যা। ব্লগার মুক্তচিন্তকদের হত্যার পর শুরু হয় অ-মুসলিম ধর্মযাজকদের হত্যাকাণ্ড। কখনো কোনও বৌদ্ধ শ্রমণকে, কখনো খ্রীষ্টান যাজককে, কখনো কোনও হিন্দু পুরোহিতকে খুন করা হয়। কখনো আবার সহি মুসলিম বলে গণ্য করতে না চাওয়া সুফী সাধককে।
ব্লগার হত্যাকাণ্ডগুলি যখন ঘটছে তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জানিয়েছিলেন,‘মুক্তচিন্তার নামে কারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়া বিকৃত রুচি ও নোংরা রুচির পরিচয়’। পাশাপাশি তিনি এ ধরনের লেখালেখির কারণে হামলার শিকার হলে তার দায় সরকার নেবে না বলেও জানান। প্রধানমন্ত্রীর তরফে এই ধরনের কথা খুনীদেরই প্রকাশ্যে উষ্কানি দেয় বলে অনেকে অভিযোগ করে আর বলেন এ ধরনের দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় সরকার মুক্তচিন্তার প্রকাশে যত্নবান তো নয়ই,এমনকী মুক্তচিন্তকদের প্রাণ রক্ষার্থেও তার কোনও দায়বদ্ধতা নেই। এ ধরনের একের পর এক ঘটনা বাংলাদেশকে ক্রমেই আরো অন্ধকারের দিকে নিয়ে যাচ্ছে,এটা সরকার ও তার কর্তাব্যক্তিরা বোঝার চেষ্টা করছেন না।
এই অন্ধকার থেকে আলোর দিকে যাবার জন্য সরকারী শুভবুদ্ধি ও উদ্যোগের ওপর ভরসা করে বসে থাকার যে কোনও উপায় নেই,তা বাংলাদেশের মুক্তচিন্তকেরা ক্রমেই বুঝতে পারছেন। দরকার জোরদার আন্দোলন,বিবেকবান সাহসী মানুষের সঙ্ঘবদ্ধ প্রতিবাদ প্রতিরোধের। বিজয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধ কেন্দ্রিক যে আবেগ উৎসারিত হলো – তাকে ছড়িয়ে দেওয়া দরকার। প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে প্রগতিশীল শিবিরের লড়াই সেটাই।
©somewhere in net ltd.