![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বলা হয় তুমি যদি এক জীবনের পেন্সিল হয়ে দু-এক পাতা লিখে দিতে না পার তবে ইরেজার হয়েই থেকে দুঃখ-কষ্ট গুলো মুছে দিয়ো। আমি বলি আমার ইরেজার হতে কেমন জানি ভয় হয়। ইরেজার হতে গিয়ে মায়ায় জড়ানোর ভয়। এক জীবনে কিছু মায়ার সম্পর্কে জরিয়ে দু-এক পাতা লিখে ফেলেছিলাম নিজের জীবনের খাতায়। আমি এখন সেইসব মোছায় ব্যাস্ত। আমি বরং আমার নিজের ইরেজার হয়েই থাকি।
“মামা, কই তুমি?”–সাত সকালে শুভর কণ্ঠ শুনে মেজাজটাই খারাপ হয়ে গেল। সারারাত মুভি দেখে ভোরের দিকে ঘুমাতে গিয়েছি। আর এই ফাজিল কিনা ৭টার সময় কল দেয়। আবার জিজ্ঞাসা করে আমি কোথায়।
“আমি দোস্ত রাস্তায়। ঝাড়ু দিতে বের হইসি। নতুন চাকরি, আজকেই জইনিং।”– দাঁত মুখ খিঁচে জবাব দিলাম আমি।
“মামা , চ্যাতো ক্যান? তোমারে একটা জবর খবর দিব বইলাই তো কল দিলাম।”
“কি খবর?”– অনেক কষ্টে রাগ চেপে জিজ্ঞাসা করলাম।
“ওইটা তো জানি না। আমারে রাহাত ফোন দিয়া কইলো, জবর একটা খবর আছে। ক্যাম্পাসে যাইতে কইসে। সারপ্রাইজ দিবে বলে।”
“শালা এইটা বলার জন্য তুই আমার ঘুম ভাঙ্গাইসোস?”
ফোনটা সুইচ অফ করে আবার ঘুম দিলাম ।
এগারোটায় ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি শুভ, নাহিদ, জয় সবাই মিলে আড্ডা দিচ্ছে। শুভ, নাহিদ, জয় আর আমি ---এইটা হল আমার গ্রুপ। ক্লাসরুম ছাড়া ক্যাম্পাসের আর সব জায়গায় আমাদের সরব উপস্থিতি। সব সময়ই কোন না কোন কিছু নিয়ে আমরা মেতে থাকি। দূর থেকে দেখলাম নাহিদ কি যেন একটা বোঝাচ্ছে, আর বাকি দুইজন উত্তেজিত ভঙ্গিতে শুনছে। আমি গিয়ে যোগ দিলাম ।
“দোস্ত সিরাম মজা হবে। তোরা সবাই চল। মাছ ধরব, বন-মুরগি শিকার করব, রাতে বারবিকিউ পার্টি হবে। খেজুরের রস তো আছেই।” ---একটানা বলে গেল নাহিদ, আমাদের মধ্যে একমাত্র যার মানিব্যাগই সবসময় ভরা থাকে।
“আমরা সবাই যামু। কি মামা? তুমি জাইবা তো?”–আমাকে জিজ্ঞাসা করলো শুভ।
“তোদের সাথে যখন আছি, তখন মরার আগ পর্যন্ত তো মুক্তি নাই। মরলে না হয় আমি বেহেস্তে যামু আর তরা যাবি নরকে। কিন্তু কথা হইতেসে যাওয়াটা হইতেসে কোথায়?”
“নাহিদদের গ্রামের বাড়ি, শহর থেকে অনেক দূরে।”-বলল আমাদের মধ্যে সবসময় যে চুপচাপ থাকে সেই জয়।
“কখন রওনা দিবি?”
“আজকে রাতে।”-বলল নাহিদ।
“শালা, আজকে রাতে রওনা দিবি আর তোরা আমারে এখন জানাইতেসস?”
“মামা, এইটা কোন প্রবলেমই না। সবকিছুই রেডি। তুই খালি রাইতের ১০ টা নাগাদ নাহিদের বাসায় চইলা আসিস। নাহিদের গাড়িতে যামু আমরা। ভোরের দিকে পৌছামু যদি রাস্তায় জ্যাম না থাকে।”- কাঁধে বিশাল একটা চাপড় মেরে বলল শুভ।
“তাইলে আমরা আজকে ১০ টায় মিট করতেছি।”-নাহিদ উল্লসিত কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলো।
“ইয়াপ”-সবাই একযোগে উত্তর দিলাম।
বাসায় গিয়ে দ্রুত ব্যাগ গুছালাম। মাকে অনেক কষ্টে রাজি করালাম। ফিরে এসে নিয়মিত ক্লাস করবো এই প্রতিজ্ঞা করার পরে অনুমতি মিলল।
ঠিক রাত ৯ টার সময় নাহিদের বাসায় পৌঁছালাম। নাহিদদের বাসাটা বিশাল বড়। আমি অনেকবার এসেছি। ভালই লাগে আমার। সবাইকে যদিও বলা হয়েছিল টাইমলি আসতে কিন্তু সাড়ে দশটার আগে কেউ আসল না। সবাই এসে পড়লে আমরা রওনা দিলাম নাহিদদের ভক্সিতে করে। সাথে ড্রাইভার ছিল, তাই চারজন মিলে জমিয়ে আড্ডা দিতে কোন বাঁধাই আর রইল না। শহর ছেড়ে বাইরে চলে আসার পর চারপাশের অদ্ভুত এক অপরিচিত নৈশব্দ বিরাজ করতে থাকে। সেই নৈশব্দ কেন জানি আমাদের আড্ডার শব্দ হতেও অনেক বেশি তীব্র হয়ে আমাদের কানে বাজে।
খুব ভোরে এসে আমরা পৌঁছাই নাহিদদের গ্রামে। নাহিদদের গ্রামের এই বিশাল বাড়িতে এখন আর কেউ থাকে না। নাহিদের দুর-সম্পর্কের এক চাচা, জলিল শেখ বাড়িটার দেখাশোনা করেন। উনি দেখলাম আমরা আসাতে বেশ খুশিই হয়েছেন। সবকিছুর আয়োজনই করে রেখেছেন। সারারাত জার্নি করে আমরা সবাই খুব ক্লান্ত। ঘুমের দেশে হারাতে সময় লাগলো না।
ঘুম থেকে যখন উঠলাম, তখন বেলা গড়িয়ে দুপুর হয়ে গিয়েছে। আজকে যখন আর মাছ ধরা হল না, তাই সিদ্ধান্ত নিলাম আজকে রাতেই হবে বারবিকিউ পার্টি। বিকাল থেকেই প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু বিধি বাম। সন্ধ্যা থেকেই শীতের আকাশ ভেঙে বৃষ্টি ঝরতে লাগলো। ভেস্তে গেলো বারবিকিউ পার্টি। গ্রামের লোকজন খুব সকাল সকাল ঘুমিয়ে পড়ে। জলিল চাচাও দেখলাম তার ব্যতিক্রম নয়। ৯ টার মধ্যেই খাওয়া-দাওয়া শেষ। এরপর সময় যেন আর কাটতেই চায় না। কিছুক্ষণ 29 খেললাম। কিন্তু সে আর নতুন কি?
হঠাৎ শুভ বলে উঠলো –“মামা একটা কাম করলে হয় না?”
“কি কাজ?”–জিজ্ঞাসা করলো নাহিদ।
“মামা, আসো প্ল্যানচেট করি। আমাগো জয় তো হেভভি একটা মিডিয়াম।”
একটা কথা বলা হয়নি। আমাদের মধ্যে জয় খুব ভাল একজন মিডিয়াম, অন্তত তার মতে। যদিও প্ল্যানচেট ব্যাপারটার উপর আমার তেমন একটা আস্থা নেই, কিন্তু ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে বেশ ইন্টারেস্টিং।
যেই বলা সেই কাজ। বিশাল হলঘরের মাঝে একটা গোলটেবিল এনে তার চারপাশে গোল করে বসলাম আমরা চারজন। আমার ডানপাশে জয়, যার মধ্য দিয়ে আত্মা নামবে; আর অপর পাশে নাহিদ, যে আত্মাকে প্রশ্ন করবে। নাহিদ আর জয়ের মাঝখানে শুভ। ঘরের সব বাতি নিভিয়ে টেবিলের মাঝখানে একটা মোমবাতি রাখা হয়েছে।
প্ল্যানচেটের নিয়ম খুব সোজা। সমস্ত মনোযোগ কেন্দ্রীভুত করে কোন আত্মাকে ডাকা। কিন্তু প্রশ্ন হল আমরা কার আত্মাকে নামাবো। আমরা সবাই একেকজনের নাম বলতে লাগলাম। কিন্তু কোন নামই সবার পছন্দ হল না।
“আচ্ছা, আমরা একজন মুক্তিযোদ্ধার আত্মা নামাই না কেন?”–হঠাৎ করে বলে উঠলো জয়।
তার আকস্মিক প্রস্তাব আমাদের কিছুক্ষণের জন্য নিশ্চুপ করে দিলো। সবসময়কার মতো সেই নীরবতা ভাঙল শুভ।
“চল মামা, শুরু করা যাক।”
আমরা কাজ শুরু করে দিলাম। প্রায় আধঘণ্টার মতো চুপচাপ একমনে বসে থাকার পর হঠাৎ মনে হল টেবিলটা যেন কেঁপে উঠেছে। আমার ডান হাত দিয়ে জয়ের বাম হাতটা ধরা ছিল। এই শীতের রাতে হঠাৎ করে মনে হল তার শরীর আগুন-গরম হয়ে উঠেছে।
“কেউ কি এসেছেন?”–প্রশ্ন করলো নাহিদ।
কিছুক্ষণ কোন সাড়াশব্দ নেই। তারপর বহুদুর থেকে যেন একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল, যার সাথে জয়ের কণ্ঠস্বরের কোন মিল নেই।
“আমায় কেন ডেকেছো?”–প্রশ্ন করলেন আগন্তুক।
নাহিদঃ আপনি কেমন আছেন?
আগন্তুকঃ ভাল না।
নাহিদঃ কেন?
আগন্তুকঃ উত্তর দেয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না।
নাহিদঃ আপনার নাম কি?
আগন্তুকঃ ফজল হোসেন। যদিও তোমাদের এই অঞ্চলের প্রায় কেউই তা জানতো না, জানেও না।
নাহিদঃ আপনি কি মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন?
আগন্তুকঃ ছিলাম। একাত্তর সালে আমরা সবাই মুক্তিযোদ্ধা ছিলাম।
নাহিদঃ কথাটা একটু বুঝিয়ে বলবেন কি?
আগন্তুকঃ যে মানুষটা দিনের পর দিন নিজের চায়ের দোকানে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র লুকিয়ে রেখেছিল, সে কি যুদ্ধ করে নি? যে গরিব চাষি আমাদেরকে একরাত আশ্রয় দিয়েছিল, সে কি যুদ্ধ করে নি? যে বাবা দিন-রাত এক করে নিজের সন্তানকে কাঁধে চাপিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সে কি যুদ্ধ করে নি? যে গর্ভবতী মা তার সন্তানকে পেটে নিয়ে মাইলের পর মাইল ছুটেছিল একটা নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সে কি যুদ্ধ করে নি? যে মেয়ে তার সম্ভ্রম বিলিয়ে দিয়েছিল কিন্তু যুদ্ধে যাওয়া ভাইয়ের কথা বলে দেয় নি ঐ জানোয়ারদের সে কি যুদ্ধ করে নি? যে ছেলেটা বিদেশে বৃত্তি পেয়েও, দেশের এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতে দেশ ছেড়ে যায় নি সে কি যুদ্ধ করে নি?
এই বলে আগন্তুক খানিকক্ষণ নিশ্চুপ থাকলেন, সেই সাথে আমরাও।
এরপর আবার শুরু করলেন--সেই সময়টা এদেশের প্রতিটা মানুষকেই মুক্তিযোদ্ধা বানিয়ে দিয়েছিল।
নাহিদঃ আপনি কি এই অঞ্চলের মানুষ ছিলেন?
আগন্তুকঃ না, যুদ্ধের সময় আমার ডিউটি পড়ে এই জায়গায়। পাকিস্তানিদের বিশাল একটা ক্যাম্প ছিল এই গ্রামে। আমি এবং আমার কয়েকজন সহযোদ্ধা মিলে নানাভাবে, নানাবেশে তাদের উপর নজর রাখতাম। তারপর, একদিন রাজাকারদের কম্যান্ডার নজু বিল্লার কাছে ধরা পড়ি। গাঙ্গের পাড়ে দাঁড় করিয়ে ফায়ার করে। শুনেছি নজু বিল্লাহ এখন এই এলাকার এমপি।
নাহিদঃ আপনার কি মনে হয় আপনাদের যুদ্ধটা সফল হয়েছে?
আগন্তুকঃ যুদ্ধ সফল হবে কি করে? যুদ্ধ তো এখনো চলছে। এই যুদ্ধ সফল করার দায়িত্ব তোমাদের সবার।
নাহিদঃ আপনার কি মনে হয়, আমরা এই যুদ্ধে জিততে পারবো? আমাদের দেশ কি সফল দেশ হতে পারবে?
“Give Me a Glass Of Water“–এটা তো জয়ের গলা।
অর্থাৎ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফজল হোসেনের আত্মা চলে গিয়েছেন। শেষ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তিনিও আমাদের মতো দিশেহারা হয়ে গেলেন কিনা তা আর জানা হল না।
পরদিন সকালে জলিল চাচার সাথে গ্রাম ঘুরে দেখতে বের হলাম আমরা সবাই। গাঙের কাছাকাছি এসে একটা উঁচু ঢিবি দেখতে পেয়ে জয় জানতে চায়লো ওটা কি।
জলিল চাচা বললেন –“একাত্তর সালে যখন যুদ্ধ আরম্ভ তখন এই অঞ্চলে একটা পাগল এসে হাজির হয়। ফইজা পাগল। সারাদিন আর্মি ক্যাম্পের কাছে গিয়ে বসে থাকতো, কখনো সখনো ভিতরেও ঢুকে যেত। পাগল মানুষ তাই কেউ কিছু বলত না। একদিন শালা রাজাকারদের মাথায় কি ভূত চাপলো কে জানে। মিলিটারিদের বলে গাঙের কাছে ব্রাশ ফ্রায়ার করে দিলো। পরে গ্রামের মানুষজন লাশটা এনে এখানে কবর দেয়। আশ্চর্য ব্যাপার এতগুলো বছরেও কবরটার কিছুই হয় নাই।”
আমরা চারজন একে অপরের দিকে তাকাই। এটা বোধহয় শুধুমাত্র এদেশেই সম্ভব।
যখন একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ফজল হোসেন হারিয়ে যান ‘ফইজা পাগল’ হয়ে, তখন সংসদে বসে ভাষণ দেয় ‘নজু বিল্লারা’।
©somewhere in net ltd.