![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বলা হয় তুমি যদি এক জীবনের পেন্সিল হয়ে দু-এক পাতা লিখে দিতে না পার তবে ইরেজার হয়েই থেকে দুঃখ-কষ্ট গুলো মুছে দিয়ো। আমি বলি আমার ইরেজার হতে কেমন জানি ভয় হয়। ইরেজার হতে গিয়ে মায়ায় জড়ানোর ভয়। এক জীবনে কিছু মায়ার সম্পর্কে জরিয়ে দু-এক পাতা লিখে ফেলেছিলাম নিজের জীবনের খাতায়। আমি এখন সেইসব মোছায় ব্যাস্ত। আমি বরং আমার নিজের ইরেজার হয়েই থাকি।
আজ অর্নবের জন্মদিন। অর্নব,আমার সবচেয়ে ভাল বন্ধুটার নাম। ওর জন্মদিন উপলক্ষে রাতেই ওকে উইশ করা উচিত ছিল। কিন্তু কিভাবে উইশ করবো? উইশ করার কোন পথই যে ও খোলা রাখেনি। ওর আগের জন্মদিনগুলোতে যদি কখনো আমার উইশ করতে দেরী হতো তবে অর্নবই আমাকে ফোন করে বলতো, "শুভ,দোস্ত উইশ কর" আমি উইশ করতাম। একটু পাগলাটে টাইপের ছিল অর্নবটা। মাঝে মাঝেই রাতে ফোন করে বলতো, "দোস্ত,আজ রাতে হিমু টাইপের হন্টন প্রক্রিয়া চালালে কেমন হয়?" আমি বিরক্ত হয়ে বলতাম, "তোর যদি হিমু হওয়ার শখ থাকে, তাহলে একা একাই হাঁটা শুরু কর,আমার হিমু হওয়ার শখ নাই। আমার কাছে রাতে হেঁটে বেড়ানোর চেয়ে ঘুমিয়ে থাকাটাই বেশী প্রয়োজনীয়।"
ও বলতো, "একা হাঁটতে ভাল লাগেনা, তাই তোকে বললাম। যাবিনা যখন তখন তো আর কিছু করার নেই, তবে আমি সত্যি সত্যিই একদিন এই হন্টন প্রক্রিয়া বাস্তবায়িত করবো।"
এরকম অদ্ভুত অনেক চিন্তা ভাবনা ওর মাথায় উঁকি দিতো। ওর রাত জাগার স্বভাব ছিলো। প্রায়ই রাত জাগতো অর্নব। আর ওর এই রাত জাগাটাই হতো আমার কষ্টের কারণ। রাত ৩-৪ টায় ফোন করে বলতো, দোস্ত এতো সকাল সকাল ঘুমাচ্ছিস কেন? ওর যন্ত্রণায় অনেক রাতেই আমার ফোন বন্ধ করে ঘুমাতে হয়েছে। রাত জেগে ও কি করে তা জানার খুব ইচ্ছা ছিল আমার। একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম। বলবেনা বলবেনা করে শেষ পর্যন্ত ও বলেছিলো, "দোস্ত, রাতে কেন যেন ঘুম হয়না, জেগে জেগে কবিতা লেখার চেষ্টা করি।"
ওর কথা শুনে সেদিন অনেক হেসেছিলাম, "তুই লিখিস কবিতা! দোস্ত, তুই কবিতা লেখা শুরু করলে তো জীবিত কবিরা আত্নহত্যা করবেই আর যারা মারা গেছে তারা বিধাতার কাছে প্রার্থনা করবে, হে বিধাতা! আর একবার আমাদের পৃথিবীতে পাঠাও, নিজেদের কবি উপাধিটা মুছে দিয়ে আসি।"
তখন কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র আমরা। কয়েকদিন পরই এইচ.এস.সি পরীক্ষা দেবো। অনেক বড় হয়ে গেছি এটা প্রমাণ করতে মাঝে মাঝে সিগারেটে ২-১টা টান দেওয়া পড়তো। মাঝে মাঝে অর্নব বলতো, চল দোস্ত, আজ একটা টান দিয়ে আসি। এমন ভাবে কথাগুলো বলতো যেন ও চেইন স্মোকার, অথচ সিগারেটের প্রথম ধোঁয়াটুকু ভেতরে নিতেই কাশি দিতে দিতে চোখমুখ লাল করে ফেলতো। একবার এরকম অবস্থা হওয়ার পর অর্নব বললো, "দোস্ত,এ জিনিস আর খাওয়া যাবেনা।"
হ্যাঁ, অর্নব ওর কথা রেখেছিলো, ও আর সিগারেট ধরেনি। আমি আর অর্নব একসাথেই স্কুল এবং কলেজ লাইফ শেষ করেছি, এই জন্য আমাদের বন্ধুত্ব ছিলো অনেক গভীর। আমাদের দুজনেরই ইচ্ছা ছিলো স্কুল কলেজের মতো আমাদের ভার্সিটি ও একই হোক। হয়তো বা আমাদের ইচ্ছা পূরণ হতো যদি অর্নব থাকতো। এইচ.এস.সি পরীক্ষার পর আমি আর অর্নব একই কোচিং সেন্টারে যেতাম। স্কুল কলেজের মতো এখানে ও আমরা একসাথেই যেতাম, কখনোই ব্যতিক্রম হয়নি। না হয়েছে, একদিনই ব্যতিক্রম হয়েছে। ঐ দিনটার কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সেদিন আমার প্রচন্ড জ্বর ছিলো, আমি সেদিন কোচিং এ যেতে পারিনি। অর্নবকে জানিয়ে দিয়েছিলাম কোচিং এ যেতে পারবোনা। তবু ও পরে আমাকে ফোন করে বলেছিলো, "দোস্ত যেতে পারবিতো?"
আমি বললাম, "না"।
ও বললো, "তাহলে দোস্ত, আমি ও যাবো না। তার চেয়ে বরং তোর বাসায় আসি, দু'জন মিলে আড্ডা দেবো, তোর ভালো লাগবে।"
আমি বললাম, "অর্নব, আজ একটা গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস আছে। তুই যা। দুজনের কেউ যদি না যাই তবে পরবর্তীতে কিছুই বুঝতে পারবোনা। তুই যা তাহলে তুই আমাকে পরবর্তীতে আজকের ক্লাসে যা যা পড়াবে তা বুঝিয়ে দিতে পারবি।"
অনেক জোরাজুরি করেই ওকে কোচিং এ পাঠিয়েছিলাম সেদিন। আর আমার ভুল ও ছিল ওটাই। প্রচন্ড জ্বরে বেহুশের মতো পড়েছিলাম সেদিন। রাতে মা খাওয়ার জন্য ডাকলেন। বাবাকে দেখছিলাম না, ভাবলাম হয়তোবা এখনো বাসায় আসেননি। একটু পরই দেখলাম বাবা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছেন। এসেই বললেন অর্নব অ্যাকসিডেন্ট করেছে। হাসপাতালে আছে। হাসপাতালে পৌঁছে দেখি আংকেল আন্টি ভীষন কান্নাকাটি করছেন। আমি দ্রুত অর্নবের কেবিনের দিকে এগোলাম। ভেতরে ঢুকে দেখলাম এক নতুন অর্নবকে। পুরো শরীরেই সাদা ব্যান্ডেজ আর লাল রক্ত। যারা ওকে হাসপাতালে নিয়ে এসেছে তাদের একজনের মুখে শুনতে পেলাম, রাস্তা পার হওয়ার সময় একটা বেপরোয়া গাড়ি এসে ওকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় এবং পরবর্তীতে ওকে চাপা দিয়ে চলে যায়। কেবিনে ঢোকার সময় বাবাকে দেখলাম ডাক্তারের সাথে কথা বলছেন। আমার কানে শুধু পৌঁছেছিলো ডাক্তারের এই কথাটা, "আঘাতটা বেশী লেগেছে মাথায় এবং আঘাতটা গুরুতর। "আমি হা করে অর্নবের দিকে তাকিয়ে থাকি, এই কি আমার সেই হাসিখুশী বন্ধুটা?
আমি ওর মাথার ব্যান্ডেজটার দিকে তাকাই। সাদা রঙের ব্যান্ডেজটা রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে।
আমি আলতো করে অর্নবের হাতটা ধরি,ফিসফিসিয়ে ওর কানেকানে বলি, "দোস্ত,তুই যা বলবি আমি এখন থেকে তাই হবে।তুই যদি বলিস, রাতে তোর সাথে হাঁটবো। তুই যদি বলিস রোনাল্ডো সেরা, মেসি খেলতেই পারেনা, আমি এককথায় মেনে নেবো, তবুও তুই সুস্থ হয়ে ওঠ।"
আমার কথা বোধহয় ও শুনতে পায়নি সেদিন। ও আর সুস্থ হয়ে ওঠেনি। সেদিন রাতেই ও আমাকে অবাক করে দিয়ে অজানার দেশে চলে যায়।
"মামা চলে আসছি" রিকশাওলার ডাকে বাস্তবে ফিরে আসি।
পুরনো কথা চিন্তা করতে করতে কখন যে অর্নবের বাসার সামনে চলে এসেছি, টেরই পাইনি। ভেতরে ঢুকতেই কেমন যেন একটা শূন্যতা এসে গ্রাস করে নিলো আমাকে। আমি আর বাসার ভেতর ঢুকলাম না।
এগিয়ে গেলাম অর্নব যেখানে চিরদিনের জন্য ঘুমিয়ে আছে সেখানে। মাটির উঁচু ঐ স্তরটার দিকে তাকিয়ে ফিসফিসিয়ে বললাম অর্নব, "এবার কিন্তু আমিই আগে তোকে উইশ করতে এসেছি, আর গিফ্ট হিসেবে নিয়ে এসেছি চোখের জল..."
নিজেকে ধরে রাখতে পারিনা আর,ভাঙ্গা গলায় শুধু বলি "শুভ জন্মদিন দোস্ত,শুভ জন্মদিন.........।"
(ভালবাসার অনেক রকম সম্পর্কই হয়। তবে মনে হয়, বন্ধুত্বের যে ভালবাসা, কোনদিন তা তুলনা করার নয়।
বন্ধুত্বের এই অকৃত্রিম ভালবাসা বেঁচে থাকুক আজীবন... এমনই নিঃস্বার্থভাবে..)
©somewhere in net ltd.