নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস

সত্য সব সময় জনপ্রিয় হয় না, জনপ্রিয়ও সব সময় সত্য নয়।

পৃথিবীর বুকের ফুলফল লতাগুল্মে যার চোখ নেই, সেই শুধু আকাশের চন্দ্র এবং নক্ষত্রের গল্প করে।

স্প্লিকনট অয়ন

বলা হয় তুমি যদি এক জীবনের পেন্সিল হয়ে দু-এক পাতা লিখে দিতে না পার তবে ইরেজার হয়েই থেকে দুঃখ-কষ্ট গুলো মুছে দিয়ো। আমি বলি আমার ইরেজার হতে কেমন জানি ভয় হয়। ইরেজার হতে গিয়ে মায়ায় জড়ানোর ভয়। এক জীবনে কিছু মায়ার সম্পর্কে জরিয়ে দু-এক পাতা লিখে ফেলেছিলাম নিজের জীবনের খাতায়। আমি এখন সেইসব মোছায় ব্যাস্ত। আমি বরং আমার নিজের ইরেজার হয়েই থাকি।

স্প্লিকনট অয়ন › বিস্তারিত পোস্টঃ

দুষ্টিপাখিরা উড়ে যায়

২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৩ রাত ৩:০৬

রিং বাজছে ফোনে। “Ammu Calling…” এই একটা নাম্বার আমার কাছে রেড এলার্টের মতো। চায়ের দোকানে বসে ফ্রেন্ডদের সাথে সিগারেট টানতে টানতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। জিসান খুব রসিয়ে তার ভার্সিটির একটা মেয়ের বর্ননা দিচ্ছিলো। চিৎকার করে সবাইকে থামতে বললাম। “ঐ ব্যাটারা থাম! Ammu Calling… Ammu Calling…!!!”

এই কোড সবারই জানা। সবাই তাড়াতাড়ি মুখ লক করলো। জিসানকে মাস্টারলক করানো হলো। তার মুখটাই সবথেকে বেশি চলে। সবাই চুপ করার পর ফোন রিসিভ করলাম…

-হ্যালো আম্মু

-কোথায় তুই?

-এইতো আম্মু। কৌশিকদের বাসায়।

-এত শব্দ কিসের?

-ঐতো আম্মু, রাস্তার পাশেই কৌশিকদের বাসা। আর বোলোনা…গাড়ির শব্দে না ঘুমাতে ঘুমাতে কৌশিকের ইনসোমনিয়া হয়ে গেছে।

-বাসায় ফিরবি না?

-হ্যাঁ,ফিরবো তো।

-কয়টা বাজে?

-এই তো আম্মু… উমম সাড়ে সাতটা…

-থাপ্পড় দিয়ে দাঁত ফেলে দিব। সাড়ে নয়টা বাজে। দশটায় গেট বন্ধ করে দিব। এর পরে আসলে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবি সারারাত।

-ঠিক আছে আম্মু। এখুনি আসছি…রাখি। যদিও বললাম তবুও আরো অন্তত এক ঘন্টা থাকার প্ল্যান।

-শোন…

-যতক্ষন কথা বলবা…গেট বন্ধ করার সময়ের সাথে ততক্ষন যোগ হবে।

-চোপ বেয়াদপ। যা বলছি সেটা শোন।

-অলরেডি ৩ মিনিট হয়ে গেছে…১০ টা ৩…

-প্রিয়তির জ্বর দুপুর থেকে…ওর জন্য কয়েকটা নাপা এক্সট্রা নিয়ে আসিস…

-আম্মু একটু ধরো তো…

“এই দোস্তরা থাক আমি গেলাম।প্রিয়তির জ্বর…” বলেই কারোর জবাবের অপেক্ষা না করে হাঁটা দিলাম।

-হ্যাঁ আম্মু,আমি আসতেছি…বাই।





কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও কোন রিকশা পেলাম না। অগত্যা হাঁটতে শুরু করলাম……।

অনেকদিন পর ছুটি পেয়েছি। বাসায় এসেছি গত পরশু। অনেকদিন পর দেখছি সবকিছু। সেই চিরপরিচিত দোকানপাঠ,রাস্তাঘাট,বাড়িঘর,মাঠ,গাছ…মানুষগুলো। পরিচিত যেসব মানুষগুলোর সাথে কখনো তেমনভাবে কথাবার্তাও হয়নি তাদের সাথে কথা বলতেও ভালো লাগে।

সবকিছু আমার একান্ত আপন। আমার নিজের শহর।বন্ধু,আত্মীয়-স্বজন,আব্বু-আম্মু,আর……প্রিয়তি। আমার আদরের ছোট্ট বোন। আর তার মুখের টিয়া পাখির মত সুরে “ভাইয়ামনি” ডাক।





প্রিয়তি……।

আমার জগৎটাকে আমি খুব সহজেই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলতে পারি। একভাগে প্রিয়তি; অন্যভাগে বাকি সব। প্রিয়তির বয়স ৭। ক্লাস টু তে পড়ে। চঞ্চলতার কোন ইভেন্ট অলিম্পিকে থাকলে অনায়াসে সে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণপদকটা এনে দিত। তার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে সবসময় একসাথে কমপক্ষে ১০ টি বিষয় কাজ করে। তাই সে কোনটাতেই স্থির হতে পারেনা। আমাদের কলোনীর সবচেয়ে কিউট বাচ্চা সে। নিজের ছোটবোন বলে বলছি না। সবাই ওকে অনেক আদর করে। কিন্তু লিটল প্রিন্সেস কারো আদরই সহ্য করতে পারেননা। কেও তাকে একটু টাচ করলেই চিৎকার করে কান্নাকাটি শুরু করে। এমনকি সে আব্বুর কাছেও কখনো যেতে চায় না। প্রতিটি ব্যাপারে তার অনেক স্ট্রং অপিনিয়ন। একবার যেটা বলবে সেটাই।





বাসায় পৌঁছে কলিংবেল বাজাতেই টিয়াপাখির চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেলাম। “বিজি বিল্লি” “বিজি বিল্লি”।

কোনো এক ক্লান্ত দুপুরে ঝিমাতে ঝিমাতে 9XM মিউজিক চ্যানেলটা দেখছিলাম। পাশে বসে ছিল প্রিয়তি। টিভির দিকে অনেক্ষন তাকিয়ে থেকে বেশ কিছুক্ষন ভেবে সে ঘোষনা করলো আমি নাকি দেখতে কার্টুন “ভিগি বিল্লি”র মতো। “ভিগি বিল্লি” টার্মটা কোনো এক কারনে তার কাছে মনে হয়েছে “বিজি বিল্লি”।

অনেক চেষ্টা করেছি তাকে বোঝাতে পারলাম না যে আমি দেখতে ওরকম না আর শব্দ টা “ভিগি বিল্লি”।

কিন্তু সে মানতে নারাজ। আগেই বলেছি সব বিষয়ে তার অপিনিয়ন অনেক স্ট্রং। তারপর থেকেই আমি তার “বিজি বিল্লি”। নেহায়েৎ তার মনে গভীর ভাবের উদয় না হলে আজকাল আমাকে “ভাইয়ামনি” বলে ডাকেনা।

যা হোক,বাসার গেট খোলা হলো। খোলার সাথে সাথেই দেখি টিয়াপাখি দুই হাত উঁচু করে চোখ বন্ধ করে লাফাচ্ছে। অর্থ্যাৎ “কোলে নাও”।

কোলে তুলে নিতেই ছোট্ট ছোট্ট হাত দিয়ে শক্ত করে আমার গলা জড়িয়ে ধরলো। শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। তারপরও অস্থিরতার শেষ নেই। আম্মু দেখি পিছন পিছন ভাতের প্লেট হাতে নিয়ে ছুটছে।

-খেয়ে নে মা,আর জ্বালাস না…আম্মু বলল।

-নাআআআ…বলে চিৎকার করে আমাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ লুকালো।

আমি আম্মুকে ইশারা করলাম একটা।

-আম্মু কি ভাত?

-এইতো দুধ ভাত।

-আম্মু দুষ্টিপাখিরা কি খায় যেন?

-দুষ্টিপাখিরা তো দুধভাত খায়।

-ও…আমাদের বাসায় তো কোনো দুষ্টিপাখি নেই। তুমি এক কাজ করো…তাসিন বাবুকে (কাজিন) খাইয়ে দিও ঐটা। তাসিন বাবু দুষ্টিপাখি হয়ে যাবে তাহলে।

-নাআ…আমি দুষ্টিপাখি… আমার কাঁধে মুখ লুকিয়ে রেখেই বললো।

-তাহলে খেয়ে নাও বাবু।

-না…খাবোনা…।

আহ্লাদ করে ফুঁপিয়ে বললো।

বুঝলাম জ্বরে রুচি হারিয়েছে। পকেট থেকে ক্যাডবেরি চকলেট বের করে বললাম,

“আম্মু ক্যাডবেরিটা তাহলে তাসিন বাবুকে দিয়ে দিও।”

এবার কাজ হলো। ক্যাডবেরীর লোভে খেতে চাইল ভাত। কিন্তু আম্মুর হাতে খাবেনা। আমার হাতে খাবে। তাকে কোলে করে বসিয়ে খাওয়াতে লাগলাম। কিছুক্ষন “টম এন্ড জেরি”র গল্প করলো। তারপর কি মনে হলো সিদ্ধান্ত নিল সে নিজ হাতে খাবে। কি আর করা…ছেড়ে দিলাম তার হাতেই। যা খেল তার তিনগুন ছিটালো। নাকে মুখে দুধভাত মাখিয়ে দাঁত বের করে যখন আমার কাছে এসে বলল “খাওয়া শেষ” তখন তাকে দেখতে লাগছে একটা বিড়ালের মত।

বিড়ালের মুখ ধুইয়ে দিয়ে বিছানায় নিয়ে গেলাম কোলে করে। ওষুধ খাওয়াতে গিয়ে ভাত খাওয়ানোর তিনগুন পেইন নিতে হলো। তার “মিস্টার পান্ডু” (টেডি বিয়ার) কে খুঁজে পেতে আরো কিছুক্ষন সময় ব্যয় হলো। অবশেষে লিটল প্রিন্সেস ঘুমানোর জন্য রেডি হলেন মিস্টার পান্ডুকে কোলের মধ্যে নিয়ে। তখনো গায়ে অনেক জ্বর। মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিচ্ছি। বিড়ালের মত আরো কাছে সরে এলো। আমি ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছি। কিন্তু সে শুধু ছটফট করে। বেশ কিছুক্ষন পর নিজের ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল মুখে পুরে নিল। ঘুমানোর পুর্বাভাস। মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলাম। আস্তে আস্তে ওর শ্বাস-প্রশ্বাস ভারী হয়ে এলো। ঘুমিয়ে পড়লো আমার দুষ্টিপাখি। আমি সারারাত জেগে থাকলাম ওর পাশে। শেষ রাতের দিকে ওর জ্বর নেমে এলো।





কিছুদিন পর।

রুমের দরজা ঠেলে দিয়ে বারান্দায় বসে সিগারেট টানছি। কখন যে পিচ্চিটা গুটুর গুটুর করে ঢুকে পড়েছে খেয়াল করিনি। আমার হাতে সিগারেট দেখে সে কিছুক্ষন চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো। তারপরেই তারস্বরে চিৎকার করতে যাবে, “আম…ম…” আম্মু ডাকটা ডেকে শেষ করার আগেই মুখ চেপে ধরলাম। কিছুক্ষন অনেক জোরাজুরি করল। অবশেষে না পেরে হাল ছেড়ে দিলো। আমি তাড়াতাড়ি টেবিল এর ড্রয়ার থেকে ক্যাডবেরী বের করে দিলাম। এসব পরিস্থিতি সামাল দিতে রাখা লাগে। কিন্তু বোঝা গেল ঘুষ যথেষ্ট না। এখন তার সাথে ছাদে গিয়ে তার সাহেবদের কে খাওয়াতে হবে। সাহেব অর্থ্যাৎ তার কবুতররা। উপায় নেই। যেতে হলো।

আমি আর ও মিলে খাওয়াতে লাগলাম। বোঝা গেল কবুতরগুলো তাদের এই পিচ্চি মালকিনকে ভালোই চিনে। ও ওদেরকে ছুটে ছুটে তাড়া করছে। ধরছে। কবুতরগুলো কিছু মনে করছে না। খাওয়ানো শেষে দুষ্টিপাখির সাথে কিছুক্ষন খেলা করতে হলো। শেষ বিকালের দিকে ওকে কোলে করে ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। অনেক্ষন বকবক করে এখন তিনি রেস্ট নিচ্ছেন।

-প্রিয়তি বাবু…

-হুম…

-তোমার ক্লাস পজিশান কত বাবু?

প্রশস্ত একটা হাসি দিয়ে বলল “ফার্স্ট”।

গাল টিপে আদর করে দিয়ে বললাম… “আমার সোনাপাখি”।

অমনি সে ভ্রু কুঁচকে ফেললো। কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে আমার মুখ খাঁমচে ধরল।

-এই এই,কি হলো ও ও…লাগছে তো…

-আমি সোনাপাখি না…দুষ্টিপাখি বল।

-আচ্ছা রে বাবা ঠিক আছে। দুষ্টিপাখি,দুষ্টিপাখি,আমার দুষ্টিপাখি।

অবশেষে থামলো। আমি এবার মেকি মন খারাপ করে বললাম…

-বাবু আমাকে খাঁমচে দিলা এখন কি হবে? আমি যে ব্যাথা পাইলাম…

আমার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষন কি যেন ভাবল। তারপর আমার গালে চুমু দিয়ে দিলো একটা। দুষ্টিপাখিটাকে বুকে চেপে ধরে আদর করে দিলাম। আমার এই জা্নটাকে ছেড়ে দূরে ভার্সিটিতে আমি কিভাবে থাকি সে শুধু আমিই জানি।





সন্ধ্যায় তার মিস এসেছে। কিন্তু সে পড়তে চাইছে না কিছুতেই। পেট চেপে ধরে বসে আছে। আম্মু অনেক বকাবকি করছে। কিন্তু সে পেট চেপে ধরে বসেই আছে। আমি গিয়ে ওকে কোলে করে নিজের রুমে নিয়ে এলাম। জিজ্ঞাসা করলাম…

-বাবু কোথায় ব্যাথা করে?

-এইখানে… পেটে হাত দিয়ে দেখালো।

চকলেট বের করে বললাম… “এইটা খাইলে কি প্রিয়তি বাবুর ব্যাথা ঠিক হবে?”

কিন্তু ও চকলেটও খেতে চাইলো না। অবশষে আমি মিসকে চলে যেতে বললাম। ওকে আমিই পড়িয়ে নিব। কোন পর্যন্ত পড়ানো হয়েছে দেখে নিলাম। কিন্তু রাত্রে ও বমি করলো। বেশ কাহিল হয়ে পড়লো। আমরা কিছুই বুঝতে পারলাম না কেন হচ্ছে। অবশ্য ও বেশ তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়লো।

সকালবেলাতেই স্বাভাবিক। ছুটির দিন। স্বভাবসুলভ দুষ্টামিতে বাসা মাথায় করে রাখলো।

ঈদটা সেবার অনেক ভালো কাটলো। দুষ্টিপাখিকে বড় একটা টেডি বিয়ার ও কিনে দিলাম। ছুটি শেষ হয়ে এল। বুকে পাথর চেপে লিটল প্রিন্সেস টা কে বাসায় রেখে ভার্সিটিতে চলে এলাম।





ল্যাব, অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস টেস্ট এর চাপে যখন জর্জরিত এরকম একটা দিনে আম্মু হঠাৎ ফোন দিয়ে বলল…

-“বাপ কালকে তুই বাসায় আসতে পারবি?”

আম্মুর কন্ঠে কি যেন ছিল। আমি ভয় পেয়ে গেলাম…

-কি হয়েছে আম্মু?

-তেমন কিছু না রে…তোর আব্বু একটু অসুস্থ। কাল তো বৃহস্পতিবার। তুই চলে আয়। শনিবারে চলে যাস আবার।

-আব্বুর কি হয়েছে আম্মু সত্যি করে বলো। আব্বুকে ফোনটা দাও।

-নে কথা বল।

আম্মু আব্বুর হাতে ফোনটা দিলেন।

-হ্যাঁ বাবা, তেমন কিছু হয়নি রে। একটু অসুস্থ হয়ে পড়লাম। তুই সেই কবে গেছিস। বাসা থেকে ঘুরে যা একটু।

-আব্বু তুমি ঠিক আছো তো? শরীর এখন কেমন?

-আমি ঠিক আছি রে বাবা। টেনশান করিস না। তুই চলে আয়।

-ঠিক আছে আব্বু।

-রাখি তাহলে?

-ঠিক আছে আব্বু। আমি চলে আসবো।

আব্বুর একবার হার্ট-এটাক হয়েছে। না জানি আবার কি সমস্যা হল। আমি পরের দিনের অপেক্ষা না করে সেদিনই চলে গেলাম।





বাসায় যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। কলিংবেল চাপলাম। “বিজি বিল্লি” টাইপ কোনো চিৎকার শোনা গেল না। কয়েকবার কলিংবেল চাপার পরেও না। বাচ্চা হলেও বাসার পরিস্থিতিটা হয়ত বুঝতে পারছে প্রিয়তি। আব্বুকে ভয় পেলেও অনেক ভালোবাসে সে। তার ড্রয়িং খাতায় সে আমার পর আব্বুর ছবিই সবচেয়ে বেশি এঁকেছে। গেট খুললেন ফুপি। বাবার খবর পেয়ে মনে হয় সবাই এসেছেন। বাসায় ঢুকে অবশ্য ড্রয়িং রুমে ফুফা বাদে আর কাউকে দেখতে পেলাম না। ব্যাগ রেখে আব্বুর রুমে গিয়ে দেখি আব্বু নেই। বারান্দায় গিয়ে দেখি চেয়ারে বসে আছেন। আমাকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন।

-এসে গেছিস বাবা…

-হ্যাঁ বাবা, তুমি ভালো আছো?

-হ্যাঁ রে…ভালো আছি। তুই কেমন ছিলি? আসতে সমস্যা হয়নি তো কোনো?

-না আব্বু। আমার কথা বাদ দাও। তোমার কি হয়েছিল সেটা বলো।

বাবা চুপ করে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন।

-আর প্রিয়তি আম্মু এরা কই? বাইরে গেছে নাকি? দেখলাম না তো।

বাবা চুপ করেই আছেন।

-কি হলো আব্বু, কথা বলোনা যে?

আব্বু বললেন…

-ঐ যে…প্রিয়তি একটু অসুস্থ তো। ওকে নিয়ে একটু হসপিটালে গেছে।

-মানে????? প্রিয়তির কি হয়েছে আব্বু?

আস্তে আস্তে আমার কাছে সবকিছু পরিস্কার হতে থাকে। আসলে আব্বুর কিছু হয়নি। প্রিয়তির কিছু একটা হয়েছে।

-কি হয়েছে আব্বু বলো…চুপ করে আছো কেন? কোনো এক্সিডেন্ট হয়েছে? আমাকে বলো…

-না রে বাবা…তেমন কিছুই না। একটু সর্দি জ্বর।

-আব্বু আমার কাছ থেকে লুকাবা না। বলো আমাদের প্রিয়তির কি হয়েছে?

আব্বু চুপ করে থাকেন কিছুক্ষন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন…

-বাবা শোন। প্রিয়তি একটু অসুস্থ।

-“আব্বু তুমি অভিনয় করবা না। বলো তুমি আমার প্রিয়তির কি হইছে…” অনিয়ন্ত্রিত ভাবে আমার চোখ বেয়ে কয়েক ফোঁটা অশ্রু নেমে আসে।

আব্বু আবার কিছুক্ষন চুপ করে থাকেন। বেশ কিছু দীর্ঘশ্বাস গোপন করে বলেন…

-শোন…শক্ত হ এ্কটু। প্রিয়তির লিউকোমিয়া হয়েছে। নতুন ব্লাড সেল ফর্ম করছে না।

আমি হা করে আব্বুর দিকে চেয়ে থাকি।

-“আব্বু প্রিয়তি একটা বাচ্চা মেয়ে……”

-“শোন পাগল…এত সিরিয়াস কিছু না। ডক্টর বলেছেন কিছুদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।

আমি চিৎকার করে বলি…“আমাকে শিখাবানা আব্বু। আমি জানি লিউকোমিয়া কি…”

আব্বু আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন।

আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি… “আব্বু ভুল হইছে। ডাক্তাররা অনেক ভুল করে অনেক সময় তুমি জানোনা আব্বু। ওরা ভুল করেছে। প্রিয়তির কিছু হয়নি। ও তো একটা বাচ্চা মেয়ে…”

আর কিছু বলতে পারিনা। গলায় আটকে যায় সবকিছু। আমার জগৎ হঠাৎ অন্ধকার হয়ে যায়।

বাবা অনেক সেন্সেবল মানুষ। আমাকে শকগুলা আস্তে আস্তে দিতে থাকেন। লিউকেমিয়ার প্রতিকার সম্ভব। একুশ দিন পর পর রক্ত পরিবর্তন করা লাগে। কিন্তু প্রিয়তির অনেক দেরি হয়ে গেছে। ওর ব্লাড সেল গুলা খুব তাড়াতাড়ি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। রিকভার করা সম্ভব হচ্ছেনা। যার অর্থ আমার প্রিয়তির হাতে আর বেশিদিন সময় নাই।

আমার বিশ্বাস হয় না। কোন ভাবেই না। এইতো সেদিনকার বাচ্চা। দোলনায় শুয়ে হাত নেড়ে নেড়ে খেলা করতো। আমার কোলে আসলে চোখ বড় বড় করে আমাকে দেখতো। যাই দেখত তাই মুখে দিতে চাইত। আমার কোলে এসেই চশমা ধরে টানাটানি শুরু করত। যাকে এখনো পর্যন্ত কোলে করে বাথরুমে দিয়ে না আসলে সকালে ঘুম ভাঙ্গে না। যে এখনো অরেঞ্জ ফ্লেভারের টুথপেস্ট খেয়ে ফেলে…

আমি আর ভাবতে পারি না…





আব্বু আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যান। কেবিনে ঢোকার আগে নিজেকে পুরোপুরি শান্ত করে ফেলি। ঢুকে দেখি আমার দুষ্টিপাখি শুয়ে আছে…বিছানায় সাদা চাদর পাতা। তার উপর ছোট্ট একটা শরীর। মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে কেমন। ছোট্ট শরীরটা শুকিয়ে আরো ছোট্ট হয়ে গেছে। চোখটা তীক্ষ। কিন্তু আমাকে দেখেই সেই আগের ভঙ্গিমায় ফিক করে হাসিটা দিল। আমার বুকের ভিতর চিনচিন করে একটা ব্যাথা বেজে উঠলো। চোখে অস্থিরতা টা এখনো রয়েছে। কিন্তু হাত-পা নাড়ানোর ক্ষমতা কমে গেছে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো…

-“বিজি বিল্লি”

ওর ছোট্ট মুখটা ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে দিলাম। ওর মাথার কাছে বসলাম। আস্তে আস্তে গুটুর গুটুর করে আমার সাথে গল্প করতে লাগলো।

মামনি যে কত দুষ্টু হয়েছে। হসপিটালে তার মিস্টার পান্ডুকে আনতে ভুলে গেছে। তাই তার ঘুম হয় না। সেকথা বলতেও ভুললো না।

আমি আমার দুষ্টিপাখিটার সারা মুখে আলতো করে হাত বুলিয়ে দেই।

-বাবু তোমার কিছু হবেনা। তুমি আমার দুষ্টিপাখি না? দুষ্টিপাখিদের কি কিছু হয় নাকি? কিচ্ছু হয়না।

আমার বাবু ফিক করে হাসি দিয়ে বলল…

-আম্মু আমাকে বলেছে ডক্টর আঙ্কেলের বাসায় আসার পর ডক্টর আঙ্কেল আমাকে অনেক পছন্দ করেছেন। তাই যেতে দিচ্ছেনা।

-হ্যাঁ তাইতো সোনা। কিন্তু আমি যে তোমাকে ডক্টর আঙ্কেলের থেকেও বেশি পছন্দ করি। আমি তোমাকে তাড়াতাড়ি নিয়ে যাবো।

-হুম…তুমি কিন্তু অনেকদিন থাকবা এবার…তাড়াতাড়ি চলে যাবা না…

-হুম সোনা…তোমাকে ছেড়ে কোথাও যাবোনা…

-আর স্কুলে দুষ্টু ইভন আমার মাথায় মেরেছে…তুমি ওকে মেরে দিবা…

-ঠিক আছে সোনা…অনেক অনেক মেরে দিব। সাহস তো কম না…দুষ্টিপাখির গায়ে হাত তোলে।

ও একটা হাসি দেয়। আমি ওর সারা মুখে চুমু দিয়ে দেই আলতো করে করে। আমার দুষ্টিপাখি আদরটা ধরতে পারে। আমার দিকে ফিরে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকে।





সেদিন রাতে আমি বাসায় ছিলাম। রাত্রে শুনলাম প্রিয়তি বাবু রক্তবমি করেছে। পরদিন সারাদিন ছাড়া ছাড়া ভাবে জ্ঞান আসলো আর গেল। কোনো কথা বলতে পারলো না। তারপরদিন কথা বলার অবস্থা হলো। কিন্তু অনেক আস্তে আস্তে কথা বলতে লাগলো।

ওর কাছে গেলাম।

-দুষ্টিপাখি কেমন আছো?

প্রথমে কছুক্ষন চুপ করে থাকলো। তারপর আমাকে ডেকে বললো, “আম্মুকে দূরে যেতে বলো।” আম্মুকে দূরে যেতে বললাম… -হয়নি,আরো দুরে। আরো দূরে গেলো আম্মু।

প্রিয়তি আমাকে ডেকে কানে কানে বললো…

-ভাইয়ামনি শোন…

-বলো দুষ্টিপাখি।

-তুমি আর কিসারেট (সিগারেট) খাবানা। ডক্টর আঙ্কেল বলে কিসারেট খেলে ক্যান্সার হয়।

আমি প্রচন্ড কষ্টে আমার চোখের পানি আটকাই।

-ঠিক আছে বাবু। আমি আর কক্ষনো কিসারেট খাবোনা।

-প্রমিজ?

-প্রমিজ সোনা…

-না…পিঙ্ক প্রমিজ করো…

-হ্যাঁ সোনা পিঙ্ক প্রমিজ।

-প্রমিজ না রাখলে কিন্তু তোমার জিব্বা কালো হয়ে যাবে।

-আমি রাখবো সোনা। আমি তোমার লক্ষী ভাইয়ামনি না?

ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে দুষ্টামি হাসি দিয়ে বলে…“বিজি বিল্লি”।

আবার বলে…

-ভাইয়ামনি তুমি আমার মিস্টার পান্ডুকে কোলে করে ঘুমাবা বলো…

আমি আমার চোখের অশ্রু বেঁধে রাখার যুদ্ধে হেরে যাই… দু’এক ফোঁটা অশ্রু বেয়ে পড়ে…

-কেন রে সোনা? মিস্টার পান্ডু তো তোর কোল ছাড়া ঘুমায় না…

-আমি মিস্টার পান্ডুকে বলে দিছি… ও তোমার কোলে ঘুমাবে এখন থেকে।

-ঠিক আছে বাবু। আমি তোর মিস্টার পান্ডুকে কোলে করে ঘুমাবো।

-আর তাসিন বাবুকে দুষ্টিপাখি বানাবা না। আমি দুষ্টিপাখি…আম্মু বারবার তাসিন বাবুকে দুষ্টিপাখি বানিয়ে দেয়…

বলতে বলতে আমার প্রিয়তি বাবুর চোখ থেকে মুক্তার মতো কয়েকফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে। ছোট্ট পবিত্র এই বাচ্চাটার অশ্রু সহ্য করার ক্ষমতা আমার ছিলনা। দু’হাতে অর ছোট্ট মুখটা ধরে কপালে একটা চুমু দিয়ে দৌড়ে চলে এলাম বাইরে।





পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেটটা ছুড়ে ফেলে পা দিয়ে সজোরে রাস্তার সাথে পিশলাম। চোখ থেকে অনবরত পানি পড়েই যাচ্ছে…আকাশের দিকে তাকালাম…সপ্তম আসমানে আল্লাহ বলে একজন আছেন। যিনি সকল ক্ষমতার অধিকা্রী…তার কাছে মিনতি করে বললাম…হে আল্লাহ। এই অবুঝ নিষ্পাপ পরীর মত শিশুটি তো জীবনে কোনো পাপ করেনি। তবে কিসের শাস্তি তুমি ওকে দিচ্ছ? ও তো একটা ফেরেস্তা…ছোট্ট ফেরেস্তাটার কষ্ট যে আমি নিতে পারছিনা আর খোদা। আমি সিগারেট খাই…নামাজ পড়িনা। অনেক পাপ করি…তুমি ওর বদলে আমাকে তুলে নাও… কিন্তু আমার ছোট্ট নিষ্পাপ দুষ্টিপাখিটাকে ফিরিয়ে দাও।





আমার মত পাপী বান্দার মিনতি শোনার প্রয়োজন হয়তো আল্লাহ বোধ করেননি। :((……আমার দুষ্টিপাখিটা তাই উড়ে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে

(সংগৃহীত)

মন্তব্য ০ টি রেটিং +০/-০

মন্তব্য (০) মন্তব্য লিখুন

আপনার মন্তব্য লিখুনঃ

মন্তব্য করতে লগ ইন করুন

আলোচিত ব্লগ


full version

©somewhere in net ltd.