![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
আমি লিখি আমার দেখা, শোনা আর অনুভবের গল্প। কল্পনা আর বাস্তবের মিলনে গড়ে তুলি নতুন এক জগত। কলমে আমি হলো আমার একান্ত লেখা, শুধু আমার নিজের শব্দের ভুবন।
“এই যে ভাইয়া, শুনতাছেন…”
পেছন থেকে আনিসকে কে যেন ডেকে উঠলো। আনিস শুনতে পেল কিন্তু না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগল। মনে মনে ভাবতে লাগল—এতো রাতে, এই নির্জন জায়গায় কে তাকে ডাকছে? ডাকাত নয় তো, নাকি কোনো ভূত! ছোটবেলায় শুনেছি, গভীর রাতে গ্রামের খোলা মেলার জায়গায় হঠাৎ করে পেছন থেকে খারাপ ভূতরা ডাক দেয়। যদি পেছনে ফিরে তাকাও, তাহলে আর কোনো রক্ষা নেই। আনিস বুঝে উঠতে পারছে না—তাকাবে কি না।
আবারও একই কণ্ঠস্বর—"এই যে ভাইয়া, শুনতাছেন…”
পেছন থেকে ডাক আসলো।
আনিস আবারও না শোনার ভান করে হাঁটতে লাগল। কিন্তু ভয়ে তার শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা ঘাম নেমে এলো। বুঝতেই পারছে না—চারিদিকে অন্ধকার, ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক, বাতাসে গাছের ডালপালার শব্দ, দূরে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া ডাক। হাঁটার ফাঁকে ফাঁকে খালের পানির ছপছপ শব্দ শোনা যাচ্ছে। এত রাতে কাউকে ডাকার কথা না। আনিস কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না।
আনিস পড়াশোনার জন্য ঢাকা এসেছিল। আসলে তার বাড়ি দাউদকান্দির। অনেক কষ্ট করে কিছুদিন আগে পড়াশোনা শেষ করেছে। সরকারি প্রাইমারি স্কুলে চাকরি পেয়েছে। তার পোস্টিং হয়েছে—তাড়াইলের রাউতি নামে এক গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। ঢাকা থেকে সেই সকালে ৯টায় রওনা দিয়েছিল। নান্দাইল চৌরাস্তায় নামল সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে। এর মধ্যেই লোকজন কমে গেছে। কিছু দোকানে লাইট জ্বলছে, কিছু দোকানে কুপিবাতি। কোথাও ক্যাসেট প্লেয়ারে জারি গান বাজছে। এখনো যেতে হবে আরও ১২–১৩ কিলোমিটার। যাওয়ার উপায়—রিকশা, নৌকা, কিংবা হাঁটা। তিনজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে কথা হলো, কিন্তু কেউ রাজি হলো না। একজন রাজি হলেও যে ভাড়া চাইলো, আনিসের পক্ষে তা দেওয়া সম্ভব না। অল্প কিছু টাকা এনেছে সে, যাতে কিছুদিন চলতে পারে। থাকার-খাওয়ার ব্যবস্থা কী, এখনও জানে না। এখন কী করবে, বুঝতে পারছে না।
(একটা কথা বলে রাখা ভালো—এই ঘটনার সময় ১৯৯০ সালের আগের কথা। তখনও বাংলাদেশের সব জায়গায় বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি।)
আনিস ঢুকল এক চায়ের দোকানে। ভিড় নেই, কারণ দোকানে বিদ্যুৎ নেই। দোকানদার কেরোসিনের কুপী জ্বালিয়ে বসে আছে—মধ্যবয়সী, লুঙ্গি পরা, খালি গা, পুরোনো লুঙ্গিতে তালি দেওয়া। ছোট্ট দোকানটা কাঁঠাল গাছের নিচে, বাঁশের বেঞ্চে কাস্টমার বসে।
পরিবেশটা আনিসের ভালো লাগছিল না। দূরে শেয়ালের ডাক, কোথাও জারি গান। দোকানের পেছনে খাল না পুকুর—অন্ধকারে বোঝা যায় না, তবে সেখান থেকে ব্যাঙ আর ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ভেসে আসছে। আমাবস্যা নয়, তবু আনিসের মনে হলো চারপাশ অন্ধকারে ডুবে গেছে।
দোকানদারের কাছে রাউতি যাবার রাস্তা জিজ্ঞেস করল আনিস। উত্তর শুনে তার মন খারাপ হয়ে গেল। দোকানদার বলল—ওই রাস্তা কাঁচা মাটির, শুধু রিকশা ছাড়া কিছু চলে না। কিন্তু এত রাতে রিকশা পাওয়া প্রায় অসম্ভব। সে আনিসকে না যাওয়ার পরামর্শও দিল, জানাল—ডাকাতের ভয় আছে।
এমনিতেই সারাদিনে প্রচুর ধকল গেছে আনিসের। পথে বাস পাঁচবার নষ্ট হয়েছে। এজন্য সকাল থেকে রওনা দিয়েও সন্ধ্যায় এসে পৌঁছাতে হলো তাকে। অথচ হিসেবমতো দুপুরেই পৌঁছানোর কথা ছিল।
আনিস ভাবল, সঙ্গে তেমন কিছু নেই—শুধু কাপড়ের ব্যাগ আর মায়ের দেওয়া এক টিন মুড়ি। তাছাড়া এখানে সে কাউকে চেনে না যে রাতে থাকতে পারবে। তবে সে গ্রামেই বড় হয়েছে, হাঁটার অভ্যাসও আছে। সমস্যা শুধু একটাই—রাস্তা চেনে না।
এতকিছুর পরও অল্প হাঁটতেই ঝামেলা এসে গেল। কে যেন ডাকছে তাকে। ভাবনার মাঝেই আবারও পেছন থেকে শোনা গেল একই কণ্ঠস্বর।
“এই যে ভাইয়া, শুনতাছেন…”
আনিস আবারও না শোনার ভান করল। এবার হাঁটা জোরে দিল। আর মনে মনে ভাবছে—সামনে কী হতে চলেছে কে জানে।
সাথে সাথে আবারও সেই একই কণ্ঠস্বর। তবে এবার কণ্ঠে হাসির আভাস—
“আরে ভাইয়া, আমি কনো চোর-ডাকাত নাই, এক্টু থামুয়েন…”।
আনিস কি মনে করে জানি থেমে গেল। পিছনে ফিরে তাকাল। তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল সে—মোটামুটি সুদর্শন একজন যুবক এগিয়ে আসছে । বয়স আনিসের সমানই হবে। বেশ পরিপাটি অবস্থা। অন্ধকারের মধ্যেও তার গড়ন স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
লোকটা আনিসের কাছে এসে বলল,
— ভাইয়া, অনেকক্ষণ ধইরা ডাকতাছি। আপনি তো না শোনার ভান কইরা হাঁটতাছেন।
লোকটার কথা শুনে আনিস কিছুটা লজ্জা পেল। সাথে সাথেই বলল,
— ভাই, কিছু মনে করবেন না। আসলে অপরিচিত জায়গা, তার ওপর দোকানদার বলল ডাকাতের ভয় আছে। তাই একটু সংকোচ বোধ হচ্ছিল।
লোকটা হেসে বলল,
— না ভাইয়া, কনো সমস্যা নাই। আসলেই নির্জন রাস্তা, তারপরে ডাকাতের ভয় আছে এই জায়গায়।
তারপরেই প্রশ্ন করল,
— আপনি কি ঢাকা থেইকা আইছেন?
আনিস উত্তর দিল,
— জি, আমি ঢাকা থেকে এসেছি।
লোকটা আবার জিজ্ঞেস করল,
— কৈ যাইবেন?
আনিস বলল,
— রাউতি গ্রামে যাবো।
লোকটা সাথে সাথে বলে উঠল,
— আরে, আমি–ও ওইখানে যামু। আপনি কোন বাড়িত যাইবেন?
আনিস বলল,
— আমি রাউতি প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার তোবারক স্যারের বাড়িতে যাবো।
লোকটা বলল,
— আমার বাড়ির কাছেই উনার বাড়ি। ভালোই হইলো, একসাথে যাইতে পারুম।
আনিস জিজ্ঞেস করল,
— ভাই, আপনার নাম কি?
লোকটা উত্তর দিল,
— আমি মিজান। আপনের নাম কিতা?
আনিস বলল,
— আমার নাম আনিস।
তারপর একটু হেসে যোগ করল,
— ভাই, আপনি তো মনে হয় এখানকার লোক। ভালোই হলো, একসাথে যাওয়া যাবে। আমি তো ভাই অনেক টেনশনে ছিলাম, ঠিকমতো যেতে পারব কি না।
মিজান হেসে বলল,
— কনো সমস্যা নাই ভাইয়া। একসাথে গল্প করতে করতে যাইয়া যামু। তা ভাইয়া, আপনে কি তোবারক স্যারের আত্নীয়?
আনিস উত্তর দিল,
— না ভাই, আমি রাউতি প্রাইমারি স্কুলে টিচার হিসেবে জয়েন করতে এসেছি।
মিজান অবাক হয়ে বলল,
— ওওও, তাই নাকি! আপনে তাহলে আমাগো স্কুলের মাস্টার।
আনিস মাথা নেড়ে বলল,
— জি ভাই।
মিজান প্রশ্ন করল,
— আপনে আগের কোন স্কুলে আছিলেন, নাকি এইডাই আপনের প্রথম?
আনিস উত্তর দিল,
— এটাই আমার প্রথম।
মিজান আবার জিজ্ঞেস করল,
— আপনে কোন বিষয় পড়াইবেন?
আনিস বলল,
— অঙ্ক।
মিজান এবার প্রশ্ন তুলল,
— এত দেরি ক্যান হইলো? রাস্তায় কনো সমস্যা আছিল নাকি?
আনিস দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
— জি ভাই, সেই সকালে রওনা দিয়েছিলাম। রাস্তায় পাঁচবার বাস নষ্ট হয়েছিল।
মিজান মাথা নেড়ে বলল,
— আসলে ঢাকার সাথে আমাগো যাতায়াতের ব্যবস্থা খুব খারাপ। সবই লোকাল বাস।
আনিস হঠাৎ জানতে চাইল,
— তা ভাই, আপনি কি করেন?
মিজান একটু হেসে বলল,
— আমি আসলে কিছুও করি না। গ্রামেই থাকি, ঘুরাফেরা করি।
আনিস অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল,
— তাহলে এত রাতে, আপনি কোথা থেকে আসছেন?
মিজান বলল,
— আমি অনেক দূর থেইকা আইছি।
আনিস কৌতূহলী হয়ে বলল,
— অনেক দূর বলতে?
মিজান হেসে উত্তর দিল,
— আরে ভাইয়া, আপনে তো ঢাকার মানুষ। ওইডা চিনবেন কেমনে?
আনিস কিছুটা লজ্জা পেল। মনে মনে ভাবল—তাই তো, জায়গার নাম শুনলেও চিনতে পারতাম না।
দু’জন কিছুক্ষণ নিঃশব্দে হাঁটল। চারপাশে শুধু ঝিঁঝিঁ পোকার একটানা ডাক, নীরবতাকে আরও ভারী করে তুলছে। দূরে শেয়ালের হুক্কা-হুয়া ডাক শুনে রাতটা ভুতুড়ে মনে হলো।
ফ্যাকাশে চাঁদের আলোয় কাঁচা রাস্তা বোঝা যায়, ধারের লম্বা ঘাস বাতাসে দুলছে। কোথাও ডালে পাখি নড়ে আবার থেমে যাচ্ছে। এই নিশ্চুপ পরিবেশে প্রতিটি শব্দ দশগুণ জোরে শোনা যায়। আনিসের মনে হলো—অন্ধকার তাকে ঘিরে ধরছে।
নীরবতা ভেঙে আনিস বলল,
— মিজান ভাই, কয়টা বাজতে পারে?
মিজান উত্তর দিল,
— সম্ভবত রাত সাড়ে আটটা থেইকা নয়টা বাজত পারে।
আনিস বলল,
— মাত্র নয়টা, অথচ মনে হচ্ছে অনেক রাত। আসলে গ্রামে সন্ধ্যা নামলেই মনে হয় গভীর রাত।
মিজান মাথা নেড়ে বলল,
— হ ভাইয়া, এহনের মানুষ অগো দিক তাড়াতাড়ি ঘুমায়। সইরারও (ডাকাত) ঝামেলা আছে, কিন্তু আপনে ভয় পাইন না। সইরাগো (ডাকাত) সাধরণত রাস্তায় আড্ডা নাই, রাতে মানুষও খুব বাহির হয় না। ওগো টার্গেট বড় বড় বাড়িঘর।
মিজানের এই কথা শুনে আনিস কিছুটা আশ্বস্ত হলো। কিন্তু মিজান হঠাৎ সুর পাল্টাল। ভয় ধরানো কণ্ঠে বলল—
অনেক সময় শেয়ালরা সড়কে উঠে পড়ে দল বেঁধে। তখন যদি কাউকে পায়, একসাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। গ্রামের অনেকেই শেয়ালের আক্রমণের শিকার হয়েছে।
শেয়ালের কথা শুনে আনিস খুব চিন্তিত হলো না। গ্রামেও সে এমন ঘটনা দেখেছে। তাই আগেভাগেই ব্যবস্থা করেছে—ব্যাগে কেরোসিনের ছোট বোতল আর ম্যাচবক্স আছে। প্রয়োজনে কাপড়ে আগুন ধরিয়ে শেয়াল তাড়াবে, কারণ আগুন দেখলেই তারা পালায়।
আনিস মিজানকে জিজ্ঞেস করল—
শেয়াল আর ডাকাত ছাড়া আর কোনো সমস্যা আছে কি না।
মিজান সাথে সাথে উত্তর দিল—
আর কনো সমস্যা নাই।
আনিস তারপর স্কুলের ব্যাপারে কিছু জানতে চাইল—কতজন শিক্ষক আছে, এসব। মিজানও দেরি না করে সব তথ্য দিয়ে দিল।
হাঁটার সময় হঠাৎ মিজান বলে উঠল—
— আনিস ভাইয়া, এক্টু সাবধানে হাঁটেন। সামনে রাস্তায় সাইডে এক্টু কাটা আছে। মাঝখান দিয়া হাঁটেন।
মিজানের কথা শুনে আনিস সাবধান হয়ে গেল। দেখে সত্যিই রাস্তা ভেঙে গেছে। বর্ষার পানি টেনে কিছুটা মাটি সরে গেছে। ওই জায়গা থেকে এখনও ছপাৎ ছপাৎ করে পানির শব্দ আসছে।
ভাঙ্গা রাস্তা টুকু পার হবার পর আনিস দূরে ছোট্ট কিছু আলো দেখতে পেল। মনে হলো, নৌকা থেকে কুপির আলো জ্বলছে।
আনিস জিজ্ঞেস করল—
— ওইখানে কি কোনো বাজার?
মিজান উত্তর দিল—
— না, ওইডা কনো বাজার নাই। মনে হয় কতা (কিছু) মানুষ মাছ ধরতেছে। খুব কাছেই জেলে পাড়া। ওরা অনেক সময় রাতে মাছ ধরে।
আনিস আর মিজান হাঁটতে হাঁটতে এগোচ্ছিল। হঠাৎ গান ভেসে এলো। নদীর দিক থেকে সুর—
“নাও ছাড়িলো বন্দরে, মাঝি নাও বাইয়া যা,
আঁধার রাতে পথ ভুলি না যেন, পার করো টলমল জলে।”
আনিস বলল—
— মিজান ভাই, গানের গলাটা আসলেই অনেক সুন্দর।
কাছে গিয়ে দেখা গেল, সড়ক থেকে বেশ দূরে ওরা মাছ ধরছে। জেলেরা আনিসদের খেয়ালই করেনি।
হাঁটতে হাঁটতে আনিস জানল, মিজানের তিন বোন ঢাকায় থাকে, দুইজনের বিয়ে হয়ে গেছে। এক ভাই বাড়িতে, আরেক ভাই খুলনায় চাকরি করে। তার বাবা গ্রামের চেনা মুখ।
আনিস আরও শুনল—গ্রামে একটা মাত্র ডালিম গাছ আছে, সেটা মিজানের ঘরের পাশে। পাশাপাশি দু’টা নারিকেল গাছও আছে। গ্রামের মধ্যে ওই গাছের ডাব সবচেয়ে মিষ্টি, আর সেখানেই সবচেয়ে বেশি নারিকেল ধরে।
আনিস জিজ্ঞেস করল—
— ভাই, ডালিম গাছের ফলন কেমন হয়?
মিজান উত্তর দিল—
— আমি অহনও খাই নাই, তয় মনে হয় বালা হইবো।
আনিস আবার বলল—
— মনে হয় বলতে, আগে কোনোদিন ডালিম ধরেনি?
মিজান হেসে বলল—
— ধরছে, কিন্তু আমার খাওয়া হয় নাই। তয় এইবার অনেক ফুল ধরছে, এইবার মনে হয় বালা ডালিম আসবো গাছে।
আনিস বলল—
— ডালিম আসলে যাবো আপনার বাড়িতে, ডালিম খাওয়ার জন্য।
মিজান খুশি হয়ে বলল—
— অব্বই (অব্যশই ), যাইবেন। ডাবও আছে অনেক। অব্বই (অব্যশই ) ডাব খাইয়া আসবেন। খাইয়ার পর কইবেন—কেমন মিষ্টি আমার ঘরের পাশের নারিকেল গাছের।
আনিস মাথা নেড়ে বলল—
— জি ভাই, যাবো। আচ্ছা মিজান ভাই, আমাদের আর কত দূর বাকি?
মিজান উত্তর দিল—
— আমরা অর্ধেকের চাইতেও বেশি রাস্তা আইসা গেছি। যেভাবে হাঁটতাছি, আর চল্লিশ মিনিটের মধ্যে পইছাই যামু।
আনিস বলল—
— ভাই, সামনে মনে হয় কোনো বাজার। কিছু আলো দেখা যাচ্ছে।
মিজান বলল—
— হ ভাইয়া, সামনে বাজার।
বাজারের কাছাকাছি এসে আনিস বলল—
— সব দোকান তো বন্ধ, কিন্তু ওই বন্ধ দোকানের ভেতরে হারিকেনের আলো জ্বলছে। একটু পানি খাওয়া দরকার। চলুন যাই, একটু পানি পাওয়া যায় কি না।
মিজান মাথা নেড়ে বলল—
— হ ভাইয়া, আপনে যান। আমি এক্টু সামনে যাইতাছি। সামনে একটা ছোট কালভার্ট আছে, আমি ওইখানে দাঁড়ামু। আপনে পানি খাইয়া আইসেন।
আনিস জিজ্ঞেস করল—
— আপনি যাবেন না?
মিজান উত্তর দিল—
— না ভাইয়া, আমি যামু না। আপনে যান, আমি এক্টু পেশাব করমু। আপনে পানি খাইয়া আইসেন, আমি দাঁড়াইতাছি।
আনিস দোকানের সামনে গিয়ে ডাকল—
— ভাই, কেউ আছেন? একটু পানি খাওয়ানো যাবে? আমি ঢাকা থেকে এসেছি, রাউতি যাবো।
আনিসের কথা শুনে দোকানের আলো হালকা কমে গেল। ভেতর থেকে কেউ বাইরে তাকানোর চেষ্টা করছে। হঠাৎ ভেতর থেকে একজন বলে উঠল—
— এক্টু দাড়ান।
কিছুক্ষণ পর দোকানের চৌপাট অল্প ফাঁক করে খোলা হলো। আনিসকে পানি দেওয়া হলো। আনিস বোঝার চেষ্টা করল—যিনি পানি দিলেন, তার বয়স কত হতে পারে। কিন্তু বোঝা গেল না।
যাই হোক, পানি খেয়ে আনিস জিজ্ঞেস করল—
— রাউতি গ্রাম আর কত দূরে?
ভেতর থেকে উত্তর এল—
— এই গ্রামের পরেই রাউতি, আর তারপরে পুরোরা বাজার। বাজারের লগে বাঁধ আছে, ওইদিয়া গেলেই তাড়াতাড়ি যাইবেন। তয় ওই বাঁধ দিয়া যাইয়েন না, কাইন্ডা (কারণ) শেয়াল ঘুরে।
আনিস, তার কথা শুনে হাঁটা শুরু করল। কালভার্টের কাছে এসে মিজানকে দেখতে পেল—চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে।
মিজানের কাছে গিয়ে আনিস বলল,
— ভাই, চলুন যাওয়া যাক।
মিজান কিছু না বলে আনিসের সাথে হাঁটা শুরু করল।
আনিস জিজ্ঞেস করল,
— এর পরের বাজারের নাম কী?
মিজান উত্তর দিল,
— পুরোরা বাজার।
আনিস আবার জিজ্ঞেস করল,
— পুরোরা বাজার থেকে রাউতি কত দূর?
মিজান উত্তর দিল,
— পুরোরা বাজারের পরেই হইল বান্নাতি বাজার। ওই বাজারের লগে যে রাস্তা গেছে, ওইডা দিয়া এক্টু গেলেই রাউতি গ্রাম। কিন্তু আমরা পুরোরা বাজারের লগে বাঁধ দিয়া রাউতি গ্রামে যামু। তাহেনলে ২০–২৫ মিনিট বাঁচবো।
আনিস জিজ্ঞেস করল,
— এত রাতে বাঁধ দিয়ে গেলে যদি শেয়াল ধরে?
মিজান বলল,
— সমস্যা হইবো না, কারণ ওই বাঁধ থেইকা জঙ্গল অনেক দূর। শেয়াল সাধরণত ওই বাঁধে কম আসে। আর যদি আইসা পড়ে, পরে দেখা যাইবো।
আনিস বলল,
— ভাই, যদিয় আমি গ্রামের ছেলে, কিন্তু তারপরও ভয় করছে।
মিজান হঠাৎ গম্ভীর, কিছুটা রাগান্বিত গলায় বলে উঠল,
— তাহেনলে আপনে বান্নাতি বাজার দিয়া যান, আমি বাঁধ দিয়া যামু।
আনিস কিছুটা অবাক হলো। সাথে মিজানের ব্যবহারে মর্মাহতও হলো। বুঝে উঠতে পারছে না—কী বলবে।
প্রসঙ্গ বদলাতে আনিস জিজ্ঞেস করল,
— শুনেছি, আপনাদের গ্রামে নৌকা দিয়েও যাওয়া যায়? নৌকা দিয়ে গেলে কতক্ষণ লাগে?
মিজান বেশ আগ্রহ নিয়ে উত্তর দিল,
— সকাল থেইকা রওনা দিলে বিকালেই পইছাইয়া (পৌঁছে) যায়।
এরপরও অন্য নানা কথা বলতে বলতে তারা পুরো বাজারে চলে এল।
মিজান বলল,
— ভাইয়া, আমি বাঁধ দিয়া যামু। আপনে নিশ্চিন্তে আমার লগে আইসেন।
আনিস কথা না বাড়িয়ে মিজানের সাথে হাঁটা শুরু করল।
বাঁধে কিছু দূর হাঁটার পর মিজান বলল,
— ভাইয়া, আমরা আইসা গেছি।
এটা শুনে আনিস কিছুটা ঘাবড়ে গেল। মনে মনে বলতে লাগল, কি বলে! আমরা তো এখনও বাঁধের মাঝখানে, লোকালয়ে তো আসি নাই!
মিজান আবার বলল,
— ভাইয়া, আমরা আইসা গেছি। আপনে এই দিক দিয়া সোজা দক্ষিণে হাঁটেন। সামনে বেল্লালদের বাড়ি, ওইডার পাশ দিয়া গেলে বাঁশঝাড় পাইবেন। বাঁশঝাড়ের লগে মসজিদ, মসজিদের পাশেই তোবারক স্যারের বাড়ি। আপনে যান, আমি যাই আমার বাড়ি। বালা থাকেন ভাইয়া, আসসালামু আলাইকুম।
আনিস খুবই অবাক হলো। মিজান আর কোনো কথা না বলেই পশ্চিম দিকে হাঁটা শুরু করল।
আনিস পিছন থেকে বলতে লাগল—
— মিজান ভাই, দয়া করে আমাকে একটু তোবারক স্যারের বাড়িতে নিয়ে যান, কারণ আমি মনে হয় উলট-পালট করে ফেলবো।
মিজান একবারের জন্যও পিছনে তাকাল না। কোনো উত্তরও দিল না। আগের মতো হাঁটতে থাকল।
আনিস এবার একটু জোরেই বলল—
— ভাই, দয়া করে আমাকে একটু দিয়ে আসেন।
মিজান এবারও কোনো কথা বলল না। নিজের মতো হাঁটতে থাকল।
আনিস বুঝতে পারল—তাকে ডেকে আর লাভ হবে না। মনের ভেতর একদিকে অবাক লাগছে, অন্যদিকে রাগও হচ্ছে।
তবু সে মিজানের কথানুযায়ী হাঁটতে থাকল। মনে মনে ভাবল—এই গ্রামের মানুষগুলো কি সবাই মিজানের মতো? দোকানদারও তো পানি দেওয়ার সময় দোকানের ঝাঁপি পুরোটা খোলেনি। শুধু একটু ফাঁক করে পানি দিয়েছে।
হাঁটতে হাঁটতে আনিস আবার চিন্তায় পড়ল—এটা আসলেই রাউতি গ্রাম কি না। মিজান কি তাকে ঠিকঠাক নিয়ে এসেছে? এসব ভাবতে ভাবতেই সে গ্রামে ঢুকে পড়ল। মিজানের বলা দিক ধরে এগোতে থাকল। অদ্ভুতভাবে সবকিছু মিলে যাচ্ছে।
তবুও তার বুক ধুকধুক করছে। যদি এটা রাউতি না হয়, তাহলে সে কী করবে? মসজিদের কাছে এসে চিন্তাটা কিছুটা দূর হলো। ভেবেছিল—যদি এটা রাউতি না হয়, তাহলে মসজিদেই রাত কাটাবে। সকালে জিজ্ঞেস করে রওনা দেবে।
কিন্তু মিজানের ওই ব্যবহার… সেটা তাকে বিশ্বাস করতে দিচ্ছে না।
বিশ্বাস না থাকলেও মিজানের কথামতো মসজিদের পাশের বাড়িতে ঢুকল আনিস। বিশাল উঠান। উঠানের পাশে একটা টিনের ঘর। ঘরের কাছে গিয়ে আনিস ডাক দিল—
— এটা কি তোবারক স্যারের বাড়ি? আমি আনিস, ঢাকা থেকে এসেছি।
ভেতর থেকে কোনো শব্দ নেই। পুরো বাড়ি অন্ধকার। উঠানের পাশে কিছু গাছ। চাঁদের আলোয় মনে হলো—দৈত্যের মতো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে ওখানে।
আনিস আবারও ডাকল। এবার একটু জোরে। ভেতর থেকে এবার একটা গলা এল—
— আপনে কে?
আনিস নিজের পরিচয় দিল।
তারপর মোটা গলার কেউ ভেতর থেকে বলে উঠল—
— ঢাকার মেহমান আইছে, ওঠ তরা।
ঢাকার মেহমানের কথা শুনে আনিস অনেকটা স্বস্তি পেল। মনে মনে মিজানকে ধন্যবাদ দিল। তার প্রতি যে রাগ জন্মেছিল, সেটা কিছুটা কমেও গেল।
আনিস দেখল—ঘরে আলো জ্বলে উঠছে। হারিকেনের আলো। কিছুক্ষণ পর দরজা খোলার শব্দ।
একজন ছোটখাটো বয়স্ক লোক বেরিয়ে এলেন।
তিনি সোজা প্রশ্ন করলেন—
— এত দেরি ক্যান? আপনের তো দুপুরে আসার কথা আছিল।
আনিস উত্তর দিল—
— রাস্তায় বাস নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, তাই দেরি হয়ে গেছে।
লোকটি নিজের পরিচয় দিলেন। তিনি-ই তোবারক, প্রাইমারি স্কুলের হেডমাস্টার।
আনিসকে ঘরে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন—
— হাত-মুখ ধুইয়া খাইতে আইসেন।
আনিস হাত-মুখ ধুয়ে বসল খেতে। মধ্যবয়সী এক মহিলা তাকে খাবার দিলেন। পাশে বসা তোবারক সাহেব।
তোবারক সাহেব জিজ্ঞেস করলেন—
— এত রাতে কেমনে আইলেন এত দূর রাস্তা?
আনিস উত্তর দিল—
— কোনো সমস্যা হয়নি। আপনাদের গ্রামের মিজান ভাইয়ের সাথে দেখা হয়েছিল রাস্তায়। উনার সাথে গল্প করতে করতে চলে এসেছি।
তোবারক সাহেব হঠাৎ থমকে গেলেন।
প্রশ্ন করলেন—
— কার সাথে?
আনিস বলল—
— মিজান ভাই।
তোবারক সাহেব মুখ কালো করে ফেললেন। নিরাশ গলায় বললেন—
— ওহ, আচ্ছা।
খাওয়া-দাওয়া শেষে আনিস রাতে ভালোই ঘুমাল। সকালে উঠেই অবাক হলো—বাড়ির সামনে দিয়ে ভ্রমপুত্রের শাখা বয়ে যাচ্ছে, নৌকা চলছে। দৃশ্য দেখে তার মন হালকা হলো। নাশতার পর তোবারক সাহেব তাকে স্কুলে নিয়ে গেলেন। ক্লাসে ক্লাসে ঘুরিয়ে শিক্ষকদের ও বাচ্চাদের সাথে পরিচয় করালেন। পাশের বড় মাঠ দেখে আনিসের মন ভরে গেল। হেডমাস্টার জানালেন, আপাতত সে তোবারক সাহেবের পুরানো বাড়িতে থাকবে, সঙ্গী হবে তত্ত্বাবধায়ক কবীর। নতুন অতিথি পেয়ে শিক্ষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ল—ঢাকা থেকে এটাই প্রথম শিক্ষক আসা। আনিসও ধীরে ধীরে সবার সাথে মিশে গেল। বিকেলে বাজারে ঘোরা আর গল্পে কেটে গেল তার সময়।
রাউতিতে আসার চার দিন পর, বিকেলের দিকে আনিস তোবারক স্যারকে জিজ্ঞেস করল—
— মিজান ভাইয়ের বাড়ি কোন দিকে?
তোবারক সাহেব বললেন,
— তার বাড়ি পশ্চিম দিকেই, পাঁচটা বাড়ি পরেই মিজানদের বাড়ি।
তারপর একটু থেমে যোগ করলেন,
— ওই বাড়িত যাইবার কি খুব দরকার আছে নাকি?
আনিস বলল,
— না, এমনি যাবো। সেদিন মিজান ভাই আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে এসেছিল। চার দিন হয়ে গেল, এখনও দেখা হয়নি, একটু দেখা করে আসি।
তোবারক সাহেব আর কিছু বললেন না। শুধু আনিসকে মিজানের বাড়ির দিক দেখিয়ে দিলেন। তারপর চুপচাপ নিজ বাড়ির ভেতরে চলে গেলেন।
আনিস মিজানদের বাড়ির দিকে এগোল। দূর থেকেই চোখে পড়ল—দুটি নারিকেল গাছ, তার পাশেই এক টিনের সুন্দর বাড়ি। বাড়ির পাশে একটা পাকা দালান, যার বারান্দাটা যেন পানির উপর ভেসে আছে—দূর থেকে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে।
আরও কাছে যেতেই আনিস দেখতে পেল—একটা ডালিম গাছ। কিছুটা অবাক হলো সে। ডালিম গাছ আর নারিকেল গাছ যেখানে, সেই জায়গাটাই আসলে একটা পারিবারিক কবরস্থান।পারিবারিক কবরস্থান এ , তিন টি কবর , বুজাই যাচ্ছে ২ তা কবর ছোট বাচ্চার , আর ডালিম গ্যাস আর নারিকেল গ্যাসের মাঝ খানে আরেকটি করব। ওই কবরের কালো টিনে সাদা অক্ষরে লেখা
নাম : মৃত. মিজান খান
পিতা : আবুল হোসেন খান
জন্ম : ১/৬/১৯৬৩ ইং বাংলা ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৭০ বঙ্গাব্দ
মৃত্যু : ১০/১০/১৯৮৭ ইং বাংলা ২৪ আশ্বিন ১৩৯৪ বঙ্গাব্দ
পরিশেষে
গল্পটা আমার বানানো। আনিসের চরিত্রটাও আমার সৃষ্টি। কিন্তু মিজান… না, তাকে আমি বানাইনি। সে সত্যিই ছিল। ওই গ্রামে মিজান নামে একজন যুবক বেঁচে ছিল। অল্প বয়সেই মারা যায়।
কিন্তু মৃত্যুর আগেই গ্রামজুড়ে সে ছিল এক অদ্ভুত আলোচিত নাম। কারণ তার ছিল কিছু অস্বাভাবিক ক্ষমতা। এমন ক্ষমতা—যা চোখের সামনে দেখেছে গ্রামবাসীর অনেকে। আর অবিশ্বাস করার মতো শক্তি কারও ছিল না।
মিজানের সেই অস্বাভাবিক ক্ষমতার গল্প এখনও বাতাসে ভেসে বেড়ায়। কারও কানে ফিসফিস করে, কারও মনে ভয়ের কাঁপুনি তোলে।
মিজানের সেই ক্ষমতার অন্ধকার দিক জানতে হলে…
আপনাকে পড়তেই হবে পরের পর্ব।
©somewhere in net ltd.
১|
১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৫:৩০
জেনারেশন একাত্তর বলেছেন:
কিন্ডার গার্টেন?