নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
কবিতার প্রেমে অক্ষরের সঙ্গে শুরু হয়েছিল ঘরবসতি। এখন আমি কবিতার; কবিতা আমার। শব্দচাষে সময় কাটাই...
ট্রেনের কেবিনে বসে আছে মায়া। সামনের গৌরীপুর স্টেশনেই কায়াও ওঠবে ট্রেনে। দু’জনেই পুরো কেবিনটা নিয়েছে। মায়ার প্ল্যানেই হয়েছে সব। এই প্রথম মায়া নিজেকে একজন সফল মানুষ ভাবছে। এর আগে মায়ার কোন সিদ্ধান্তকে এতটা গুরুত্ব কেউই দিত না। না মা, না বাবা, না ভাই-বোনেরা। মধুচন্দ্রিমার প্রতিটা প্ল্যানেই কায়া মায়ার ওপর নির্ভর করেছে। নিজেদের গাড়ি থাকার পরও ট্রেনে যেতে কায়া মৃদু আপত্তি করেছিল। মায়া বলেছিল – “দেখো, যদি গাড়িতে যাই; তাহলে ড্রাইভার থাকবে। সতর্ক থাকতে হবে প্রতিটি কথায়। আবার ড্রাইভার না থাকলে – তুমি ড্রাইভ করবে। ফলাফল দু’জনের মনযোগ দুই দিকে। আমি চাচ্ছি সময়টা একান্ত আপন হয়ে কাটাতে।” মায়ার যুক্তি শুনে কায়া বলেছিল, “ওয়াও! তুমি এত কিছু আগাম ভাবো?”
বিজয় এক্সপ্রেস এক নম্বর লাইন থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে ক্রমান্বয়ে গতি বাড়াচ্ছে। মায়ার আত্মার ঠিকানা – ময়মনসিংহ ক্রমশঃ দৃশ্যের আড়ালে যাচ্ছে। মায়ার ভেতরে কী যেন এক তোলপাড় কেবল বাড়ছেই। মায়া নিজেকে শান্তনা দিচ্ছে, “এই তো দশটা দিন। মাত্র দশটা দিন। এত নস্টালজিক হবার কী আছে?” কিন্তু কোন কাজ হয় না। মায়ার দু’চোখ ভরে ওঠে জলে। দু’হাতে মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠে। “ভালই হল। কায়া গৌরিপুর থেকে ওঠার সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। না হলে সে এই কান্না দেখলে কী যে ভাবতো! ” কান্নার ভেতরেই একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মায়া।
মায়ার পরিবার বারহাট্টা থেকে এই শহরে আসে মায়া ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পাওয়ার পর। কায়ার বাবা মনীন্দ্র বর্মন মায়ার বাবার বন্ধু। পেশায় সাংবাদিক। শহরে এসে মায়ার বাবা বন্ধুর পাশের ফ্ল্যাটেই ওঠে। দু’জনের প্রথম সন্তানই হয় একই দিনে। একই সময়ে। ওরা দু’জন একই দিনে জন্ম নেওয়ায় মনীন্দ্র তাদের দু’জনের নাম রাখেন। মায়া ও কায়া।
বিজয় স্যান্নাল মেয়েকে বিদ্যাময়ী সরকারি স্কুলে ভর্তি করেই ছোট বাজারে ট্রান্সপোর্টের ব্যাবসা শুরু করেন। সেই থেকে মায়ার কাছে এই শহরই আপন হয়ে ওঠে। এক রাতের বেশি কোথাও থাকেনি মায়া ময়মনসিংহ ছেড়ে। এমনকি রাত দশটার আগে ফেরা-সম্ভব দূরত্বে যত আপনজনের বাড়িই হোক না কেন, মায়া শহরেই ফিরে আসতো। সহজে কোথাও রাত কাটাতো না মায়া। সে-ই মায়াই আজ দশ দিনের জন্য সাবেক প্রেমিক, বর্তমানের স্বামীর সঙ্গে দশ দিনের জন্য মধুচন্দ্রিমায় যাচ্ছে। আপন শহরের প্রতি মায়ার টান মায়াকে চোখের অশ্রু ঝড়াতে বাধ্য করল।
০২.
বিশ মিনিটেই ট্রেন গৌরিপুর পৌঁছে যায়। ইঞ্জিন বদলানোর ফাঁকে কায়া ট্রেনে ওঠে। কায়ার নানুও আসে নাতবৌকে আশীর্বাদ করতে। সঙ্গে নিয়ে আসে নানা রকমের খাবার। বলে, “বউ মেলা দুরা যাইবা। ফতে খিদা-টিদা লাগলে কী খাইবা। আইজ-কাইলের দোহানের জিনিস খাওন বালা না গো বউ। ফেডে অসুখ-বিসুখ করতে ফারে। এইল্লাগ্যা বাড়িত্তে কিছু খাওন-টাওন বানায়া আনছি।” “নানু আপনি এত কষ্ট করতে গলেন কেন? মাও তো নাস্তা বানিয়ে দিছেন।” বলে মায়া। “ আরে তোমার মা তো দিসেই। মা’রগুলির মজা আর নানুরগুলির মজা তো আলগা আলগা।” নানুর এমন কথায় কায়া ও মায়াসহ তিনজনই হেসে ওঠে। স্টেশনের পাশেই কায়ার নানুর বাসা। গতকাল রাতে কায়ার মামার সন্তান জন্ম হওয়ায় নানুকে নিয়ে সে গৌরিপুর আসে।
– গাড়ির ইঞ্জিল বদলায়ালছে। আমি যাইগা। মায়া, আমার নাতিরে দেইখ্যা রাইখ্যো। হগলে বিদেশতে আইছে, দেশের সব কিছু ভাল কইরা বুঝে না। তুমি সব বাউ-চাও কইরা নিয়ো।
– নানু এসব বলা লাগবে না। আপনার নাতিও তো আর বাবু না। সব বুঝে। বলেই মায়া কায়ার দিকে তাকায়। কায়া মুচকি হাসে।
– কিছু না বুঝলে কি আর তুমি আমার নাতিরে বিয়া করছো? থাউক আর কথা কওনের দরহার নাই। বালায় বালায় যাইও। নানুর কথায় দু’জনেই শব্দ করে হেসে ওঠে। তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ট্রেন ছুঠে চলে সুদূরের পথে।
জানলায় তাকায় কায়া। দেখে ট্রেনের গতি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমতলের প্রতিটি বৃক্ষ-তরু কেমন যেন দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তর হচ্ছে। জানালায় তাকিয়ে দু’জনই কিছুটা নিরব হয়ে আছে। বিজয় এক্সপ্রেস তার পূর্ণ গতি তুলে ছোটছে। কায়া মৃদু আওয়াজে মায়াকে ডাকে।
– কী বলবে? জানতে চায় মায়া।
– দেখো, গাড়িটা ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কেমন করে সব প্রতিবেশ দৃশ্যের আড়ালে চলে যাচ্ছে। গতি যত বাড়ছে দৃশ্যান্তরও তত দ্রুত হচ্ছে। এই ভাবেই আমরাও পৃথিবীতে যখন আসছিলাম – তখন সব কিছুই আমার কাছে সহজ মনে হচ্ছিল। আমরা তখন গতিহীন ছিলাম। আমাদের চারপাশও ধীর এবং শান্ত ছিল। বয়স যতই বাড়ছে, আমরাও গতি পাচ্ছি – জীবনও গতিময় হচ্ছে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে আমাদের চারপাশ। সমাপ্তির দিকে দ্রুত দৌড়াচ্ছি। যেমন ট্রেনের গতি বাড়তেই প্রতিবেশ যাচ্ছে দৃশ্যান্তরে। তেমনই জীবনের গতি বাড়তেই – পৃথিবীর অবস্থানের সময়ও দৃশ্যান্তরে চলে যাচ্ছে।
– এভাবে তো কখনই ভাবিনি। বলে মায়া।
– পৃথিবীটা আসলে কায়ার মায়া। বুঝলে! বাবার চোখের দৃষ্টি অনেক গভীর ছিল। তাই আমাদের নামটা তিনি এভাবেই রেখেছিলেন। বাবা বেঁচে থাকলে আজ বড় খুশি হতেন। কায়ার প্রতি মায়া না থাকলে পৃথিবীর আসলে কোন দরকারই হতো না।
– হুমম! এখন একটু ঘুমানো দরকার। তুমি মনে হয় রাতে ঘুমাতে পারনি। একটু ঘুমাও। বলে মায়া।
– আসলেই রাতে সবার সঙ্গে আড্ডা দিয়ে ঘুমাতে পারিনি। তাহলে একটু ঘুমানো যাক।
ঘুমানোর কথা বলেই কায়া ঘুমিয়ে যায়। কিন্তু মায়ার মনে শুরু হয় আরেক ভাঙচুর। তাহলে ইউরোপে গিয়ে কায়া কি বদলে গেছে? কায়া কি চিন্তা-চেতনায় দার্শনিক হয়ে ওঠছে? আমাদের ‘কাছে আসার’ সময়ের কায়া কি বদলে গেছে? শুনেছি বাইরে পড়াশোনা করতে যাওয়া অনেকেই চরম বাস্তববাদী হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে অনেকটাই নিরাবেগ। কায়া যদি তেমনই হয়ে ওঠে তাহলে আমার মত এমন উচ্ছল, হইহুল্লোর করা একজনকে কেন বিয়ে করল? নাকি কৈশোরে প্রেম আর আমার সঙ্গে দেয়া অঙ্গিকার রক্ষা করতেই কায়ার দেশে আসা এবং আমাকে বিয়ে করা! ভাবতে ভাবতে নিজেই নিজেকে উত্তর দেয়, “আরে এত ভাবনার কি আছে? মাত্র তো শুরু। যাক না কয়েকটা দিন। আগে-ভাগেই সিদ্ধান্তমূলক চিন্তা না করাই ভাল।” নিজেকে নিজে শান্তনা দেওয়ার পদ্ধতিটা তেমন কাজ করে না। মায়ার ভেতরে দুশ্চিন্তা বাড়তেই থাকে। মায়া চিন্তা করে, চিকিৎসা পেশার মত এমন নিরাবেগ কাজের পরে যদি আমার জীবন সঙ্গিটিও সংসার জীবনে নিরাবেগ হয়ে ওঠে তাহলে তো জীবনটা মরুভূমি হয়ে ওঠবে। কৈশোরিক আবেগকে জীবনের অন্দরে ডেকে এনে কি ভুলই করলাম কি না! কায়া ট্রেনে ওঠেই যেভাবে কথা শুরু করেছে। সেভাবে যদি অলটাইম কথা বলে, চিন্তা করে তাহলে তো আমার লাইফটা পুরাই কেরসিন হয়ে ওঠবে!
ভাবতে ভাবতে মায়ার মনে পড়ে ইন্টার পরীক্ষার শেষের দিনের কথা – ‘‘সেদিন যে কায়াকে পেয়েছিলাম – আমি তো মূলত সেই কায়াকেই ভালবেসেছিলাম। সেই উচ্ছল আর দুঃসাহসিক কায়ার জন্যই তো এই দীর্ঘ প্রতীক্ষা আমার। মেডিকেলের ইন্টার্নি শেষ করে দু’টো বিসিএস দিলাম। কতজন কতভাবে বিয়ের কথা পেরেছে আমার কাছে। কিন্তু আমি কেবল কায়ার অপেক্ষায়ই ছিলাম।” তার মনে পড়ে – ইন্টার পরীক্ষার শেষের দিন মায়া রিকশায় আর কায়া সাইকেল বাসায় ফিরছিল। হঠাত কায়া ইশারায় রিকশা থামায়। বলে – “মায়া চলো, আজ অজিতদের বাসায় যাই।” মায়া বলে, ‘কেন?’ “এমনিতেই আমরা সবাই আজ অজিতদের বাসায় খাব। তুমিও খাবে। কাকা, কাকী কিছু মনে করবে না। অর্চিতা, ঐশীও আসবে।” বলে কায়া। কী ভেবে যেন মায়াও রাজি হয় কোচিংমেট অজিতদের বাসায় যেতে। গিয়ে দেখে সত্যিই অনেকেই আছে সেখানে। খাবারও রেডি। খাবার-দাবার শেষ হয়ে। অজিতদের ড্রইং রুমে বসে সবাই টিভি দেখতেছে। এমন সময় কায়া কা-টি করে বসে – একটা বলাকা ব্লেড বের করে। অজিত বলে, “আরেহ! কায়া তুই হঠাৎ করে ব্লেড দিয়া কী করবি...? অজিতের কথা শেষ হওয়ার আগেই সবাই দেখে কায়ার ডান হাতের মধ্যমা রক্তাক্ত হয়ে ওঠছে। রক্তদর্শনবিমূঢ়তা কাটিয়ে ওঠার আগেই কায়া মায়ার সিঁথিতে রক্তাক্ত আঙ্গুলের রক্তটা লাগিয়ে দেয়। কম্পিত কণ্ঠে বলে, “মায়া, আমি তোমকে ভালবাসি। আমার শরীরের রক্ত দিয়ে তোমাকে সিঁদুর পড়ালাম। তুমি আমি ছাড়া অন্য কারো হতে পারবে না।” মায়া কেঁপে ওঠেছিল। বন্ধুদের সবাই বিস্ময়-বিমূঢ়তা কাটিয়ে হাতে হাত রেখে প্রমিজ করেছিল এই ঘটনা তারা কোনদিন কারো সঙ্গে শেয়ার করবে না। বন্ধুদের কেউই আজও এই ঘটনা কারো কাছে বলেনি।
মায়া সেই সিঁদুর পড়ানো কায়ার কামনা করছে। অথচ কায়ার কথা-বার্তায় গভীর জীবনবোধের ছাপ স্পষ্ট। তার ভাবনা জুড়ে কেবল অনাগত দিনের অশান্তির পদধ্বনি। ভাবতে ভাবতে মায়াও ঘুমিয়ে যায়।
০৩.
কেবিনের দরোজায় প্রচ- ধাক্কা-ধাক্কিতে মায়া ও কায়ার ঘুম ভাঙ্গে। বিস্ময় আর বিরক্তি নিয়ে দরজা খোলে মায়া। খুলতেই হুড়মুড় করে ভেতের ঢুকে পড়ে পাঁচ-ছ’জন হিজড়ার একটা দল। ‘আরে কী করেন! কী করেন!!’ বলে ওঠে কায়া। মায়াও বলে, “কী ব্যাপার! এভাবে দরজায় ধাক্কাতে হয় নাকি?”
– উঁহ! দরজা দাক্কাতে হয় নাকি? আবার সুদ্দ বাসা কয় দুন? বলে সরদার গোছের একজন।
– গরিপুর তাইক্যা তরারে বিছড়াইতাছি। তরা আয়া কেবিনের বিত্রে লুগাইছস। খালি কেবিন ফায়া দুইজনে মেলা ফিরিত করসস, এলা ফাচাজার টেহা দে। চিকন মতন একজন কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি করে বলে।
অবাক হয়ে চেয়ে দেখে কায়া। পনের বছর পর দেশে এসেছে সে। সে যখন অস্ট্রিয়ায় যায়, তখন দেশে হিজরাদের এমন বাড়াবাড়ির কথা কেউ ভাবতেই পারতো না। যদিও মায়া হিজরাদের ব্যাপারে কিছুটা জানে। তবে সরাসরি এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি সে কোনদিন হয়নি। হঠাৎ করে মায়ার ক’দিন আগের একটা নিউজের কথা মনে হয়। মায়া ভয়ে সিঁটিয়ে যায়। ঘটনাটা এমন, “একজন ভদ্রলোক ট্রেনে হিজড়াদের টাকা দিতে অস্বীকার করে। তারা বহু চেষ্টা করেও টাকা আদায় করতে না পেরে ভদ্রলোকের গায়ে উলঙ্গ হয়ে প্র¯্রাব করে দেয়।” মায়া জানে তাদের হাতে নগদ হাজার খানেক টাকা আছে। চট্টগ্রাম নেমে বুথ থেকে টাকা উঠিয়ে কক্সবাজারে যাবে। এখন এই হিজড়ারা যদি টাকা না পেয়ে এভাবে অপমান করে তাহলে তো পুরো বিষয়টাই খুব অস্বস্তিকর হয়ে যাবে।
মায়ার এমন ভাবানার মধ্যেই ওদের ভয়ঙ্কর হাততালি শুরু হয়ে গেছে। টেকা দে! টেকা দে!! বলে অসহ্য কোরাসও শুরুর করেছে। মায়া ব্যাগ হাতড়ে দেখে পনের শ’ টাকা আছে। পাঁচ শ’ টাকা দিতে চাইলে কায়া বলে, “কেন টাকা দিতে হবে মায়া? একটা টাকাও দেব না। ওদের আগে বলতে হবে, কেন তাদের টাকা দিতে হবে? আর দান বা সাহায্য হলে পাঁচ হাজার কেন? আমি কোন অন্যায়কে প্রশ্রয় দেব না। এটা স্পষ্ট অপরাধ এবং সন্ত্রাসীপনা। আমি কিছুতেই এটা হতে দেব না।”
কায়ার গম্ভীর কণ্ঠে হিজড়াদের দলটা কিছুটা বিভ্রন্ত হয়। একজন বলে, ‘চল যাইগা।’ কিন্তু, সরদার গোছেরটা বলে, “টেকা না লইয়া যামু না। এই পোলা টাকা তর দিতে অইব। সুন্দরী মাইয়া নিয়া একলা একলা কেবিনে বইয়া টিপাটিপি করলে বুঝি অফরাদ অয় না? না! খালি হিজড়াদের টেকা দিতে গেলেই অফরাধ অইয়া যায়! তুই তো টেকা দিবিই। তর বাফেও দিব!”
– কায়া তুমি বিদেশ থেকে বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশর কথা জান না। যা আছে দিয়া দাও। ঝামেলা শেষ হয়ে যাক। বলে মায়া।
– মায়া! এভাবেই অন্যায়কে প্রশ্রয় দিতে দিতে আমার প্রাণের এই দেশটাকে তোমরা ক্রমশঃ একটা মৃত্যুপুরীতে রুপান্তর করে ফেলছো। তুমি টাকা দিতে পারো তবে আমি এদরে নামে আইনের আশ্রয়ে যাব। বলেই ফটো তোলে কায়া।
সমস্যা আরো বাড়ে। এবার বলে, আমরার ফডু তুলছস? দেহি তোর কোন বাফে আমরার বিচার করে! তুই টেহা দে। শুরু হয় অশ্লীল খিস্তি। আর নানা কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি। একসময় কায়া জিআরপি পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পুলিশ একটা ‘মিচকা শয়তানি’ হাসি দিয়ে বলে, “সাহেব কম-বেশি দিয়ে বিদায় করে দেন। এরা কেউর কথা হুনে না।”
পুলিশের কথায় কায়া হাল ছেড়ে দেয়। বলে মায়া টাকা দিয়ে বিদায় কর। মায়া এক হাজার টাকা দেয়। সরদার টাকা ঢিল দিয়ে মায়ার মুখে ছুড়ে মারে। বলে, “ফাচাজারই দিতে হবে। নাইলে তরা দুইডারে ধইরা বিয়া করায়া দিমু। জনমের লাইগ্যা ফিরিতের মজা বুঝায়া দিমু।”
– দেখো, এসব বাজে কথা বলবে না। আমরা গত সপ্তাহে বিয়ে করেছি। কক্সবাজারে বেড়াতে যাচ্ছি। বলে কায়া।
– তাইলে সাতাজার দিবি। ফাচাজার দিবি চান্দা। আর দ্ইুআজার দিবি বখশিশ। বলেই সবগুলো এক সঙ্গে বেসুরো গলায় গান গাইতে থাকে।
কায়া অসহায়ের মত চার দিকে তাকাতে থাকে। ট্রেনের কেবিনের পাশ দিয়ে কত মানুষ আসে আর যায়। কিন্তু কেউই কায়াদের এই অসহায় অবসস্থায় সাহায্যে এগিয়ে আসে না। কেউ বলে না, এসব অন্যায়। বরং কিছু যুবক কেবিনের ভেতরে উঁকি দিয়ে মজা করে। অনুমানের ওপর নানা কথা বলে। কায়া শুনতে পায়, ‘কোন এক যুবক বলতেছে, মাইয়া মানুষ লইয়া কেউ ট্রেনে ডেটিং করতে আসে?’ কায়ার শরীর গুলিয়ে ওঠে। সে কোনভাবেই আর কক্সবাজারে দিকে যাওয়ার প্রেরণা পায় না।
মায়া বলছে, দেখুন আমাদের হাতে মাত্র নগদ পনের শত টাকা আছে। আর কোন টাকা নাই। চট্টগ্রামে নেমে আমরা ব্যাংক থেকে টাকা তোলব। কিন্তু মায়ার কথা তারা বিশ্বাস করে না। ইতোমধ্যে মায়া তাদের জানিয়েছে তার দু’জনই ডাক্তার। কিন্তু এতে হিজড়াদের দলটা আরো ক্ষেপে ওঠে। বলে, “দুইডাই ডাক্তর! ফহিন্নি ডাক্তর। টেহা দে। নাইলে আজগোয়া ডাক্তরি ফুটকি দেয়া ডুহায়া দেয়াম।”
টাকা নাই কথাটা কোনভাবেই ওদের বিশ্বাস করানো গেল না। একসময় সবগুলো মিলে মায়া আর কায়ার দেহ তল্লাশি শুরু করে। তবে, তল্লাশির আগে ওদের একটু দয়া হয়। দরজাটা লাগিয়ে নেয়। মায়া আর কায়ার জন্য এ এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। কায়ার পেন্টের চেইন খুলে দেখে সেখানে টাকা লুকানো আছে কিনা। শিশ্নে হাত দিয়ে আরেকটা বলে ওঠে – ‘‘ওমা এইডা দিয়া বউ রাখবি কেমনে?” সবগুলো হেসে ওঠে। কায়ার চরম অসহায় লাগে। ট্রেনের মেঝের সঙ্গে মিশে যেতে চায়। আরেকটা হিজড়া মায়ার বুকের ভেতরে হাত দিয়ে দেখে জামার ভেতরে টাকা লুকিয়ে রেখেছে কিনা। তখন মায়ার স্তনে চাপ দেয়। বলে, “কিছতা নাই রে! কিছতা নাই!! তরটিরতে তো আমারটিই মেলা শক্তরে মাগি! পুলাইনরে দুধ টিপতে দিয়া টেহা কম কামাইসছ! আমরারে দিতে জ্বলে কেরে?”
মায়া কেঁদে ওঠে। কেঁদে ওঠে কায়াও। সবগুলো হায়েনার মত হেসে ওঠে। ছোট বাচ্চাদের যেভাবে বলে; সেইভাবে বলে ওঠে... কাইন্দো না! কাইন্দো না!! এরপর পনেরশত টাকা নিয়ে কায়ার সাদা শার্টটিতে পানের ফিক ফেলে নষ্ট করে দেয়। হুট করেই মায়ার মনে হয় এরা প্রকৃত হিজড়া না। হিজড়ার ভরং নিয়ে চাঁদাবাজি করে ওরা। হয়তো দু’য়েকটা হিজড়াও থাকতে পারে। মায়াদের কেবিন ছেড়ে দিয়ে পাশের কেবিনে যায় হিজড়ার দলটি।
হঠাৎ মায়ার মনে হয় ট্রেনের চেইন টানার কথা। দেখে কেবিনের সীটের ওপরেই চেইনটা আছে। কায়ার সঙ্গে পরামর্শ করে। একটু পড়ে কায়া গিয়ে পাশের কেবিনের দরজাটা বাইরে থেকে আলতো করে লাগিয়ে দেয়। চেয়ে দেখে ট্রেন ভৈরবে ঢুকছে। ইশারায় মায়াকে বলে চেইন টানতে। মায়া চেইন টানে। ঠিক ভৈরব রেল স্টেশনে ট্রেন থামে। আরো আগেই নেট থেকে নম্বর নিয়ে ভৈরব থানায় ফোন করে দিয়েছে মায়া। ট্রেন থামতেই পুলিশ আসে। মায়া হাত ইশারায় পুলিশের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বাইরে থেকে লাগানো কেবনিরে কাছে নিয়ে যায় পুলিশকে। সবগুলোকে আটক করে পুলিশ। আটক হলেও হিজড়াদের কোন ভাবান্তর দেখা যায়নি। বরং পুলিশের সঙ্গে বেশ খোশ মেজাজেই খুনসুটি করছে ওরা।
০৪.
কায়া ও মায়া তাদের যাত্রা বাতিল করে। ভৈরব থেকেই ময়মনসিংহে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেয়। একটা গাড়ি ভাড়া নেয়। থানায় গিয়ে মামলা করতে চাইলে। একজন সাংবাদিক বলেন – “দেখেন, আপনি যে মামলটি করবেন এটার জন্য আপনি যতবার পুলিশের মুখোমুখি হবেন বা জবানবন্দি দিবেন ততবার আপনাকে এইসব ঘটনা বলতে হবে। তার মানে আপনি প্রতিবার নির্যাতিত হবেন। আবার হিজড়াদের বিরুদ্ধে মামলা করেও খুব কিছু করতে পারবেন বলে মনে হয় না। হ্যাঁ, যদি প্রশাসনিক হাত লম্বা থাকে – তাহলে কিছু একটা হতে পারে।” সাংবাদিকের কথার পরও কায়া মামলা করতেই গো ধরে। কিন্তু! মায়া জানে এই মামলায় কী হতে পারে। একজন ডাক্তার হিসেবে নারী বিষয়ক মামলার সদর-অন্দর তার আরো বেশি জানা। তাই সে কায়াকে বুঝিয়ে ময়মনসিংহের পথ ধরে।
গাড়ি ভৈরব ছাড়তেই মায়ার মোবাইলে মেসেজ আসে। তেত্রিশতম বিসিএসের ভাইভায় সে ঠিকে গেছে। খুব নিরস ভাবে কায়াকে খবরটা জানায় মায়া। অথচ ট্রেনের এই বিভৎস সময়টা না আসলে – কত আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়েই না কায়াকে খবরটা জানাতো মায়া। আর কায়াও খবরটাতে বেশ উৎফুল্লা হতো। কারণ, কায়া বলেছিল – “যদি তোমার বিসিএস হয়ে যায়; তাহলে আমিও দেশে চলে আসবো। দেশের মানুষের সেবা করব। আমার চিকিৎসা জ্ঞান – আমার স্বদেশের মানুষের কাজে লাগবে সেটা ভাবতেই আমি গর্বিত হই।” অথচ মায়ার বিসিএসের খবরে কায়ার কোন ভাবান্তরই হল না। উল্টো সে বলে, “কী হবে?” মায়ার আর কোন কথা বলে না। “কী হবে?-এর মানে নিয়ে মায়ার ভেতরে শুরু হয়ে যায় ভূকম্পন। মায়া দেখতে পায় অল্প দিনের মধ্যেই কায়ার সঙ্গে ভিয়েনার উদ্দেশ্যে যাত্রা করছে সে।
পেছনে পরে থেকে থেকে কেঁদে ওঠছে তার স্বজন, প্রিয় শহর, শহরের বন্ধুজন। অসহায় পড়ে আছে মায়ার চেম্বার। কাতর হয়ে ওঠছে, মায়ার অল্প সময়ের চিকিৎসা পেশায় স্বজন হয়ে ওঠা রোগীরা। পেছনে হাহাকার করে ওঠছে, মায়ার স্মৃতির হাজারো ঘটনা-অণুঘটনা। মায়া শুনতে পাচ্ছে তার ভেতরে হাহাকারগুলো গুমরে মরছে। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে তার চারপাশের সুদীর্ঘ যতনে আপন হয়ে ওটা প্রতিবেশটা ক্রমশঃ সেই ট্রেনের জানালায় দৃশ্যান্তরে চলে যাওয়ার মত প্লেনের জানালায় দৃশ্যান্তর হয়ে ওঠছে। মায়া দেখছে, মায়ার ভেতরেও দার্শনিক বাস্তবতা ফুটে ওঠছে।
মায়া চেয়ে দেখে ঘুমন্ত কায়ার চোখের পাপড়িগুলো ভিজে ওঠছে। মায়া তাকায় গাড়ির জানালায়। এই প্রথম মায়ার মনে হয় সবুজের ভেতর অসংখ্য মৃত আত্মার হাহাকার। অসংখ্য অতৃপ্ত চেতনার কান্না। মায়া অনুভব করে; ক্রমশ তার বাস্তবতাবোধ রহিত হচ্ছে। চার চাকার গাড়িটাকেই এখন তার কাছে প্লেন মনে হচ্ছে। মায়ার অনুভবে এখন ময়মনসিংহ নাই; শুধুই ভিয়েনা। হঠাৎ চিৎকার করে ওঠে। বলে, “এত লাশের মিছিলের ভেতর দিয়ে আমি যেতে পারবো না। আমি এখনই লাশ হয়ে যাবো! লাশ হয়ে যাবো! প্লেন থামাও! প্লেন থামাও...”
কায়া ড্রাইভারকে বলে – “দ্রুত হাসপাতালের দিকে যাও...”
০২. ০৮. ২০১৫
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৪
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: ধন্যবাদ। সময়, নেট স্লো, কর্মব্যস্ততা সব মিলিয়ে নিয়মিত আসতে পারি না।
হিজড়াদের এই চাঁদাবাজি এখনই নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। নইলে চলতি পথে এরা সাক্ষাৎ জমের ভূমিকায় নেমে আসছে।
২| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ২:৩৫
হাসান মাহবুব বলেছেন: ভালো লাগলো। হিজরাদের অংশটা ভয়াবহ হয়েছে।
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১০:৫৯
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ। গল্পে আসার পেছনে কিন্তু আপনারও ভূমিকা আছে।
৩| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৭:২৩
শতদ্রু একটি নদী... বলেছেন: হিজড়াদের এই আচরনের কারনটা কি? এই চাদাবাজির ভাগ কি অন্যরাও পায়না? এই ধরেন পুলিশ, স্থানীয় নেতারা?
গল্প ভালোলাগলো সাইফ ভাই।
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:০১
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: হুমম! আপনি তো আমার সবই জানেন। আপনাকে জানা হলো না এখনও। ধন্যবাদ জানবেন।
৪| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২৭
সুমন কর বলেছেন: শেষে ভালো লাগল। সাবলীল বর্ণনায় +।
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ সকাল ১১:১৩
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ। শুভকামনা নিরন্তর।
৫| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ১১:১৮
রক্তিম দিগন্ত বলেছেন: লেখার বর্ণনা বেশ ভাল লাগলো। হিজড়াদের অত্যাচার ইদানিং বেশি বেড়ে গেছে। সাধারণ আইন-কানুনের হাতে তাদেরও আনা দরকার। হ্যান্ডিক্যাপড বলে অনেক ছাড় পায়, আর একটা কথা শুনেছি - চাঁদাবাজী করা হিজড়াগুলো সত্যিই হ্যান্ডিক্যাপড না। সাধারণেরাই হিজড়ার বেশে চাঁদাবাজী করে। বিনা পুঁজিতে তাদের জন্য ভাল ব্যবসা সাথে কষ্টও কম, আইনের ঝামেলাও নেই।
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৩
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: আপনার পর্যবেক্ষণে সহমত।
ধন্যবাদ পাঠের জন্য। মন্তব্যের জন্য।
ভাল থাকবেন সময়ে, অসময়েও।
৬| ০৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৩:১৩
আরণ্যক রাখাল বলেছেন: অসাধারণ| খুব ভাল লেগেছে
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৪:৪৮
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ।
৭| ০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ বিকাল ৫:৪২
শায়মা বলেছেন: ভাইয়া কেমন আছো?
লেখাটা পড়তে গিয়ে হিজড়াদের কথা পড়ে আমি ভয়ে শেষ!
০৮ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:৫৪
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: এই তো বেঁচেবর্তে আছি। মহান রবের কৃতজ্ঞতা।
আপু কেমনাছো?
হ্যাঁ, আমি ইদানিং ট্রেনেই উঠি না ওদের ভয়ে। দাঁড়ি টুপিওলা একজন মানুষকে ওদের চাহিদামত টাকা না দেওয়ায় ওরা অপমান করছে। লোকজন চেয়ে দেখছে। কী ভয়ঙ্কর! সেদিনও পঞ্চাশ টাকা দাবী করেছে। বলে, আপনেরা তো এক ঘন্টা ওয়াজ করলে দশ হাজার টেকা পান। তারপর আমার বন্ধুর চকিত ও চালাকি উত্তরে দশ টাকায় রফা করেছি।
৮| ১৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১২:২১
নির্লিপ্ততা বলেছেন: সাধারন মানুষগুলো আজ অসহায় হয়ে পরছি। জিম্মি হয়ে যাচ্ছি কিছু অপশক্তি আর অবিচারের করাল গ্রাসে।
সাহায্য আর সহযোগিতার শেষ আশ্রয়টুকুও মনে হয়ে হারিয়ে ফেলেছি চিরতরে। অন্যায় আর অবিচারকে বরন করে নিয়েছি অসহায়ের মতো। তবু স্বপ্ন দেখি জেগে ওঠার। স্বপ্ন দেখি জেগে ওঠা মানবতার।
১৬ ই নভেম্বর, ২০১৫ রাত ৮:২২
সুপান্থ সুরাহী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ নির্লিপ্ততা। পুরনো লেখায় কমেন্ট আসলে আসলেই ভাল লাগে।
মানবতার জয় হোক...
©somewhere in net ltd.
১| ০৫ ই নভেম্বর, ২০১৫ দুপুর ১:৫৪
আমিনুর রহমান বলেছেন:
অনেকদিন পর।
গল্প ভালো হয়েছে। হিজড়াদের চাঁদাবাজি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখন মগের মুল্লুক। যে যার মতো অন্যায় করে যাচ্ছে। এখানে অনিয়মই এখন নিয়ম হয়ে গেছে।