![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
বই জ্ঞানের প্রতীক। বই আনন্দের প্রতীক। বলা হয় যে ব্যাক্তি বই পড়ে তার শত্রু থাকে না। বই পড়ে অনেককিছু না দেখেও যেন দেখা যায়। না গিয়েও যেন যাওয়া হয়ে যায়। মানুষ প্রিয়জনকে নিয়ে হাত ধরাধরি করে বইমেলায় আসে; বই উপহার দেয়। প্রিয় মানুষটির মুখে হাসি ফুটে। এভাবে মানুষের ভেতর একটা ভালবাসার সম্পর্ক তৈরী হয়। মায়ার বন্ধন সৃষ্টি হয়। যারা বই পড়ে তারা বইয়ের মাঝে খুঁজে পান দুনিয়ার তাবত সুখ আর আনন্দ। বইয়ের সাগরে সিঞ্চন করে তুলে আনেন অমূল্য সব রতœরাজি আর খুঁজে পায় বিগত দিনের সুখ,হাসি-কাণœা, আর আনন্দ-বেদনা। বই পড়ে আমাদের দু’টো চোখকে হাজার চোখে উত্তীর্ণ করতে পারি। বই আমাদের চারপাশের পরিবেশ এবং দুনিয়াকে জানাকে শেখায়। অনেকে বলে থাকেন বাঙালী বই কম পড়ে ; কথাটা ঠিক; তবে পুরোপুরি না আংশিক সত্য। কারণ, যে দেশের মানুষের নুন আনতে পান্তা পুরোয় সে দেশে আবার বই পড়া কি? তবু আমাদের মত দেশে বইমেলা আসলে দেখা যায় অকল্পনীয় দৃশ্য মানুষ দলবেঁধে বইমেলায় আসছে। বই কিনছে প্রিয় মানুষের জন্য। তবুও মেলায় এসে বগলদাবা করে বই নিয়ে তারপর মেলা ত্যাগ করবে। হয়তো বই পড়েন না তবুও মেলায় আসলে অন্তত একটা কি দুইটা বই কিনে আনে। বই এনে ঘরের বুক সেলফে মনের মত করে সাজিয়ে রাখে।
আবার অনেকে আছে সকাল-বিকাল বই পড়ে কাটিয়ে দেয়। এমন বই পাগলদের দেখতে পাওয়া যাবে পাবলিক লাইব্রেরীতে গেলে। বই পাগলদের দেখতে ভাল লাগে । আমিও পাগল হওয়ার জন্য মাঝেমাঝে লাইব্রেরীতে গিয়ে হাজির হই। তবে বইমেলায় বইয়ের দাম বেশী অনেক সময় নাগালের বাইরে থাকে তখন বই কেনার কোন উপায় থাকে না। শুধু দাম জিজ্ঞাসা করে চলে আসা ছাড়া উপায় থাকে না। না হয় মানুষ এখন যা কিনছে তার থেকে দ্বিগুন বই কিনতো।
বাংলা একাডেমী আয়োজিত একুশে গ্রন্থমেলায় গেলে মনটা কেন যেন শীতল হয়ে যায়। অজানা এক পুলকে মন নেচে উঠে। মেলায় গেলে বুঝা যায় বাংলাদেশের মানুষ বইকে কতকটা মন-প্রাণ দিয়ে ভালবাসে। প্রতিদিন হাজার হাজার বইপ্রেমী মানুষের হাস্য কলরলে মুখরিত হয় একাডেমি চত্বর। নজরুল মঞ্চে প্রতিদিন মোড়ক উম্মোচিত হয় নতুন বইয়ের। দেশের প্রথিতযশা কবি-সাহিত্যিক আর লেখক বুদ্ধিজীবীদের পদধুলিতে ধন্য হচ্ছে মেলার প্রাঙ্গণ।
বইমেলার পথিকৃৎ হিসেবে অনেকের চেষ্টা-সাধনা থাকলেও একজন ব্যাক্তির নাম সর্বাগ্রে। তিনি হলেন মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী চিত্তরঞ্জনসাহা। তিনি প্রথম তার প্রকাশিত বই মাটিতে চট বিছিয়ে বিশেষ কমিশনে বিক্রি করতেন। ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমী প্রথম গ্রন্থমেলার আয়োজন করে। ১৯৭৫ সালে একুশে ফেব্রুয়ারির উনুষ্ঠানে চিত্তরঞ্জনসাহা বাংলা একাডেমীর কাছে বই বিক্রির অনুমতি চান এবং অনুমতি লাভ করেন। তখন থেকে বাংলা একাডেমীতে একুশের অনুষ্ঠানমালার ব্যাপ্তি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে এক নবযুগের সূচনা হয়। ১৯৭৮ সালে এসে সরকার এটিকে পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থমেলা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য সরকারিভাবে আইন পাশ করা হয়; এবং গ্রন্থমেলার নামকরণ করা হয়”অমর একুশে গ্রন্থমেলা” সেই সময় থেকে আজ অবধি চলছে তার পথচলা। সেই জন্য চিত্তরঞ্জনসাহাকে একুশে গ্রন্থমেলার জনক বলা হয়। চিত্তরঞ্জনসাহার স্মৃতি রক্ষার্থে বাংলা একাডেমী ২০১০ সালে প্রবর্তন করে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার। সেরা গ্রন্থের প্রকাশককে দেয়া হয় এ পুরস্কার।
বইমেলা বাংলাদেশের সাহিত্য ও সংস্কৃতির পক্ষে অসাধারণ অবদান রেখে চলছে। আর এ ধরনের একটা প্রতিষ্ঠান স্থাপনে লক্ষে যিনি প্রথম স্বপ্নের জালবুনেন, স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন তিনি হলেন সর্বজন স্বীকৃত পন্ডিত বহুভাষাবিদ শ্রদ্ধেয় ব্যাক্তিত্ব ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ(১৮৮৫-১৯৬৯)। তিনি চেয়েছেন এমন একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলতে যা প্রকৃত অর্থেই বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগার হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করে। বিশ্বসাহিত্যের দরবারে আমাদের মাতৃভাষাকে স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করা যাতে সম্ভব হয় সে লক্ষ্যে তিনি আজীবন কাজ করে গেছেন। ১৯৫৫ সালে বাংলা একাডেমী প্রাতিষ্ঠানিক স্বীকৃতি লাভ করে। ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলাভাষা ও সাহিত্যের জন্য আমৃত্যু প্রচেষ্টা ও সাধনা করে গেছেন। এ প্রসঙ্গে তাঁর সুস্পষ্ট বক্তব্য হচ্ছে:”স্বাধীনতার (১৯৪৭ সালে পাকিস্তান অর্জন) নতুন নেশা আমাদের মতিচ্ছন্ন করে দিয়েছে। আরবি হরফে বাংলা লেখা, বাংলাভাষায় প্রচলিত আরবি-ফারসি শব্দের অবাধ আমদানি, প্রচলিত বাংলাভাষাকে গঙ্গাতীরের ভাষা বলে, তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের ভাষা বলে, তার পরিবর্তে পদ্মাতীরের প্রচলনের খেয়াল প্রভৃতি বাতুলতা আমাদের একদল সাহিত্যিকদেও পেয়ে বসল। তারা এসব মাতলামিতে এমন মেতে গেলেন যে, প্রকৃত সাহিত্যসেবা যাতে দেশের ও দশের মঙ্গল হতে পারে, তাঁরা পথে আবর্জনার স্ত’প দিয়ে সাহিত্যের উণœতির পথ কেবল রুদ্ধ করেই খুশিতে ভূষিত হলেন না বরং খাঁটি সাহিত্য সেবীদিগকে নানা প্রকারে বিড়ম্বিত ও বিপদগ্রস্থকরতে আদাজল খেয়ে কোমর বেঁধে লেখে গেলেন। তাতে কতক উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারীরা উসকানি দিতে কসুর করলেন না। ফলে বাংলাভাষা ও সাহিত্যেও চর্চা, রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্র ও অন্যান্য পশ্চিমবঙ্গেও কবি ও সাহিত্যিকগণের কাব্য ও গ্রন্থ আলোচনা এমনকি’বাঙালি’ নামটি পর্যন্ত যেন পাকিস্তানের বিরূদ্ধে ষড়ষন্ত্র কেউ কেউ মনে করতে লাগলেন।...আমাদের মনে রাখতে হবে ভাষার ক্ষেত্রে গোঁড়ামি ছুঁৎমার্গের কেনো স্থান নেই।...ঘৃণা ঘৃণাকে জন্ম দেয়; গোঁড়ামি গোঁড়ামিকে জন্ম দেয়। একদল যেমন বাংলাকে সংস্কৃত-ঘেঁষা করতে চেয়েছে; তেমনি আর একদল বাংলাকে আরবি-ফারসি ঘেঁষা করতে উদ্যত হয়েছে। একদল চাচ্ছে খাঁটি বাংলাকে ’বলি’ দিতে; আর একদল চাচ্ছে’জবেহ’ করতে। একদিকে কামারের খাঁড়া আর একদিকে কসাই-এর ছুরি।’’
নদীর গতিপথ যেমন কেউ ঠিক করে দিতে পারে না। সে যেদিকে ইচ্ছা আঁকাকবাঁকা বয়ে চলে। ভাষা ও ঠিক তেমনি। নোয়াখালীতে গেলে একভাষায় কথা শুনতে পাই আর চট্টগ্রাম গেলে ভিন্ন ভাষায় কথা শুনতে পাই।
একমাত্র কালই ভাষার গতিপথ নির্দিষ্ট করে দেয়। যেরূপ নির্দিষ্ট করেছিল ১৯৫২ সালে। ২১ ফেব্রুয়ারি আমাদের ভাইয়েরা রক্তদিয়ে লড়াই করেছিল মায়ের ভাষার জন্য। কিন্তু এখন আমরা হিন্দির ভূতে আক্রান্ত। জানিনা এ ভূত তাড়াতে আমাদেরকে কত লড়াই, সংগ্রাম আর রক্ত দিতে হয়।
ভাষার গতি ও রীতি কোনো নির্দিষ্ট ধরাবাঁধা নিয়মের অধীন হতে পারে না। স্থান,কাল,মানুষে,মানুূষে যেমন পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় ভাষাতে তেমনি। যেমন চট্টগ্রামের মানুষরা বলেন,অঁনে কেন আছন? নোয়াখালী-ফেনী অঞ্চলের মানুষরা বলেন, আন্নে বালা আছেননি? তেমনি লেখকরাও আঞ্চলিকতাকে পরিহার করতে পারেন না। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় তার উপন্যাসে পদ্মাতীরের মানুষের মুখের ভাষা প্রয়োগ করেছেন।
আজ বাংলা একাডেমী প্রতিষ্ঠার ৫৭ বছর অতিক্রান্ত হতে চলছে। তবুও এই প্রতিষ্ঠানটি নিজেকে বাংলাভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির প্রকৃত গবেষণাঘার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়নি। এক্ষেত্রে যে শোরগোল চারদিকে শোনা যাচ্ছে তা হল, ব্যাপক দলীয়করণের মাধ্যমে এর ভাবমূর্তিকে বারবার কলূষিত করা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে দেশের বিশিষ্ট কবি সজ্জাদ হোসাইন খান বলেছেন,”বইমেলার আর একটি দৃষ্টিকটু দিক হলো রাজনীতিকরণ। স্টলের নামে রাজনৈতিক জবরদস্তি যখন যে সরকার ক্ষমতায় থাকেন তখন তাদের নাম ভাঙ্গিয়ে স্টল বরাদ্দ নেন। মেলা ঘির একটা অবিবেচক হিংসা-বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেয়া হয়।”(সংগ্রাম ২৩ জানুয়ারী ২০১২)। এরজন্য দায়ভার কিন্তু নির্দিষ্ট সরকারের নয়, সব সরকারই তাদের দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছেন।
এক্ষেত্রে আমার ক্ষুদ্র একটা অভিজ্ঞতা এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি তা হল,বাংলা একাডেমী-ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতি ও পত্রিকা বিভাগ প্রতি ছয়মাস পরপর তরুণ লেখক প্রশিক্ষণের আয়োজন করে থাকে কিছুদিন আগে যে কোর্স শুরু হয়েছে সেখানে আমি একজন লেখক হিসেবে আবেদন করার সুযোগ পেয়েছি আমাকে তিনটি প্রশ্ন করা হয়েছে আমি প্রতিটি প্রশ্নে উত্তর দিয়েছি; এর পাশাপাশি আরেকটা প্রশ্ন করা হয় আমাকে বলা হয় ,আপনি সংগ্রাম আর আমার দেশে বেশী লেখেন তাইনা। আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নোয়ালাম। পরদিন রেজাল্ট বের হলে দেখি আমার নাম নেই। শুনেছি এখানে অনেককেই এই জন্য নেয়া হয়েছে যে, সে সাঁতার কাটতে ভালবাসে। এভাবে চলছে বর্তমান বাংলা একাডেমী। তাহলে প্রশ্ন জাগে সাঁতার কাটা প্রতিভা হলে লেখালেখি করা কি? বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ এর কি জবাব দিবেন জানিনা।
তাই পরিচালকদের কিছুই করার থাকে না। তারা কর্তার ইচ্ছায় কর্ম করেন। এক সরকারের আমলে যে কবি সাহিত্যিক দাওয়াত পান আরেক সরকারের আমলে তারা হন অবহেলিত। আর বাংলা একাডেমীর পদক তো একমাত্র দলীয় বিবেচনায় নির্ধারিত হয় এতে কোন সন্দেহের অবকাশ থাকে না। যার কারণে গত বছর বইমেলায় আমাদের দেশের নোবেল জয়ী ড.ইউনূস এর স্থলে দাওয়াত দেয়া হয়েছে ভারতের নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনকে। এনিয়ে গত বছর চিন্তাশীল মানুষের মনে ঝড় বয়ে গেছে। এটা কি আমাদের স্পষ্ট দৈন্যতার লক্ষণ নয়।
বাংলা একাডেমী প্রতিষ্টার পরবর্তীতে কাজের সুবিধার জন্য পৃথক পৃথকভাবে শিল্পকলা একাডেমী, শিশু একাডেমী, নজরুল ইনষ্টিটিউট, ইসলামিক ফাউন্ডেশন ও জাতীয় গ্রন্থাগার প্রভূতি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। উদ্দেশ্য একটাই বাংলাভাষা ও সহিত্যের অগ্রগতি সাধিত করা। আশার কথা হচ্ছে এর অনেকটাই সাধিত হয়েছে কিন্তু বাকী রয়েছে ঢ়ের বেশি।
এক সময় কলকাতাকে সাহিত্য সংস্কৃতির তীর্থভূমি বলা হত। আশার কথা হচ্ছে সে ধারণা আস্তে আস্তে মিঁইয়ে যাচ্ছে। আমাদের ঢাকা এখন সাহিত্য সংস্কৃতি ও নাটকে সমৃদ্ধতা লাভ করেছে। ঢাকায় বসে সাহিত্যিকরা, নাট্যকাররা,চলচ্চিত্র নির্মাতারা বিশ্বমানের সাহিত্য, নাটক ও চলচ্চিত্র তৈরী করছেন। এটা কিন্তু আমাদের জন্য কম নয়।
তবুও বলবো বাংলা একাডেমী যদি সব মত ও পথের ঊর্ধ্বে উঠে কাজ করতে পারেন, বাংলাভাষার সাহিত্যকর্মগুলো বিভিণœ ভাষায় অনুবাদ করে পৃথিবীর দিগ দিগন্তে ছড়িয়ে দিতে পারেন। তরুণ কবি সাহিত্যিকদেরকে আরো বেশী পৃষ্ঠপোষকতা দিতে পারেন, নিয়মিত সাহিত্য সাধনা অব্যাহত রাখেন তাহলে বলবো বাংলা একাডেমী আরো অনেক অনেক দূর এগিয়ে যাবে। যে ভাষার জন্য মানুষ রক্ত ঢেলে দিতে পারে সে ভাষা কত যে মহান কত যে পবিত্র তা বলে কয়ে লিখে শেষ করা যাবে না।
লেখক: সাহিত্যিক ও সাংবাদিক
মোবাইল-০১৭৬৬১০৭০৮৮
©somewhere in net ltd.