নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
প্রত্যাশাদের স্বপ্ন, আকাঙ্ক্ষা আর প্রত্যাশা পূরণ হয় না... তাও তারা স্বপ্নচারিণী নামে পরিচিতি পেয়ে গেল... ইন্সটাগ্রাম ― @swarochita
“আমি চিরদিনই চার দেওয়ালের মধ্যে বন্দী। আমার পৃথিবী জানলা দিয়ে দেখা। একেই তো খুব রক্ষণশীল বাড়ীর মেয়ে আবার প্রায় তেমন রক্ষণশীল বাড়ীর বৌও। চল্লিশ বছর বয়স পর্যন্ত কেউ জানতো না আসলে ‘আশাপূর্ণা দেবী’ কে? ওটা কোনো পুরুষ লেখকের ছদ্মনাম নয়তো? পরে যখন বাইরের জগতে বেরিয়ে পড়ে সকলের সঙ্গে দেখা-টেখা হয়েছে, অনেকে বলেছেন, এই যেমন সজনীকান্ত দাস, প্রেমেন্দ্র মিত্র, ‘আমরা তো ভাবতাম ওটা বোধহয় একটা ছদ্মনাম। আসলে পুরুষের লেখা। এমন বলিষ্ঠ লেখা।”
আশাপূর্ণা দেবী আমার অসম্ভব প্রিয় লেখিকাদের ভেতর একজন। তাঁর বিখ্যাত সত্যবতী ট্রিলজি আমার কতখানি পছন্দ সেটা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। তাঁর লেখায় ফুটে উঠেছে বিংশ শতাব্দীর মানুষের জীবনযাত্রা। মেয়েদের মনস্তত্ত্ব তাঁর মত সুন্দর করে খুব কম লেখকই লিখেছেন। আজ সেসব কথা থাক। তাঁর বই “আর এক আশাপূর্ণা” নিয়ে কিছু বলি। সাথে এই বইয়ের প্রিয় কিছু উক্তিও জুড়ে দিয়েছি। তাঁর জীবনবৃত্তান্ত, স্মৃতিকথা, সাহিত্যভাবনা আর সাহিত্যলোচনা থেকে শুরু করে অনেক কিছুর পুঙ্খনাপুঙ্খ বর্ণনা সুন্দরভাবে এই বইতে তিনি তুলে ধরেছেন।
বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে অতি রক্ষণশীল পরিবারে বড় হয়েছেন লেখিকা। তাই ঠাকুরমার কল্যাণে স্কুলে যাওয়ার বালাই ছিল না। কিন্তু তাই বলে তাঁর সাহিত্যরসাস্বাদন থেমে থাকেনি। দাদারা যখন পড়ত, বর্ণ পরিচয়ের হাতেখড়ি সেখান থেকেই। আর মাতৃদেবীর অফুরন্ত সাহিত্যক্ষুধার ফলে তিন-চারটা লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই আসতো। আর বাড়িতেও তো বই আর পত্রপত্রিকার অভাব ছিল না। এভাবেই পড়তে পড়তে তাঁর লেখা শুরু। বয়স যখন তেরো তখন শিশুসাথী পত্রিকায় ছাপা হল তাঁর লেখা প্রথম কবিতা ‘বাইরের ডাক’। প্রথম লেখাই ছাপা হল, আর সাথে পত্র এল সহ-সম্পাদকের নিকট থেকে গল্প লিখতে পারবেন কিনা? এর আগে তো আর কখনও লিখেন নি। ভাবলেন চেষ্টা করে দেখি, আসলেই লিখতে পারি কিনা। এরপরে আর তাঁকে পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক লিখে গেছেন গল্প আর উপন্যাস। অনেকগুলো ছোট মাপের উপন্যাস লেখার পর একটা বিস্তৃত কিছু লেখার ইচ্ছা জাগে তাঁর। অনেক প্রশ্ন তাঁকে আবাল্য বিক্ষত করেছে, আর তাই সেগুলো প্রকাশ করার জন্যই সত্যবতী ট্রিলজিকে বেছে নিয়েছিলেন। যার জন্যই তিনি পেয়েছেন পাঠকপাঠিকা সমাজের অকুন্ঠ অভিনন্দন আর এত এত সম্মাননা।
সেই বিখ্যাত ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’র লেখিকার ছেলেবেলা কেটেছে উত্তর কলকাতার সরু গলির ধারে পুরনো বাড়ির চার দেওয়ালের মধ্যে। লালিত হয়েছেন পরষ্পরবিরোধী দুটো হাওয়ার মধ্যে। বাবা পরম রাজভক্ত প্রজা, আর মা মনেপ্রাণে কট্টর স্বদেশী। মার জীবনে একটি মাত্রই পরমার্থ, সেটা হচ্ছে সাহিত্য। আর বাবার মতে চব্বিশ ঘণ্টা বই পড়া একটা বাহুল্য বাতিক। তাঁর নেশা এবং পেশা দুটোই ছিল ছবি আঁকা। বোনেরাও ছবি আঁকতে পারতেন, কিন্তু লেখিকার প্রিয় তো মায়ের মত সেই বই। এরই মধ্যে দিদির বিয়ে হয়ে গেল, পুরো বাড়ি খাঁ খাঁ। এক কান্ড করে বসলেন। বাড়ির কাউকে না জানিয়ে ‘শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর’ এর নামে একটি চিঠি প্রেরণ করলেন দুই বোনের যুগল স্বাক্ষরে। বিষয়বস্তু কিছুই না, শুধু একটি আবেদন। নিজের হাতে নাম লিখে একটি উত্তর দিবেন। কিন্তু চিঠি পাঠিয়েই শুরু হল বুক ধড়ফড়। যদি বড়রা বকে? যদি বলে বসেন কোন সাহসে রবি ঠাকুরকে চিঠি লিখেছ? কিন্তু আশ্চর্য ঘটনা যে আসলেও ঘটে! স্বয়ং রবি ঠাকুর নিজের হাতে চিঠি পাঠিয়েছেন। ছুটে গেলেন মার কাছে। মা একটুক্ষণ সেই হাতের লেখার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোরা পারলি? আমি শুধুই স্বপ্ন দেখেছি।” দুঃসাহসে দুঃসাহস বাড়ে। এবার আর যুগল স্বাক্ষর নয়, একাই পাঠিয়ে দিলেন পত্রিকায় সেই বাইরের ডাক কবিতাটি। তারও কিছুদিন পর খোকাখুকু পত্রিকায় কবিতা প্রতিযোগিতার ঘোষণা হল। প্রতিযোগীর বয়স পনের হওয়া আবশ্যক। মহোৎসবে কবিতা লিখে পাঠালেন আর ফলাফল প্রথম পুরস্কার। কিন্তু সেই পুরস্কার পেতে পেতেই আইবুড়ো নাম খন্ডন করলেন। পুরস্কারলব্দ ভালো ভালো বই – যার মধ্যে ছিল ‘রাজকাহিনী’, ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘নালক’, ‘নীলপাখী’, ‘টমকাকার কুটির’, ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’ ইত্যাদি নতুন ট্রাঙ্কে ভরে এক গলা ঘোমটা টেনে শেয়ালদা স্টেশনের ট্রেনে চেপে গুটি গুটি শ্বশুরবাড়ি যাত্রা!
আরও আছে কত কি। লিখলে কি আর এসব শেষ হবে?!! তাঁর সেই ছেলেবেলার দুর্গোৎসব আর বড়দিন উদযাপনের বর্ণনা, আর সেই সাথে উঠে এসেছে এখনকার উৎসবের সাথে তুলনামূলক আলোচনা। আর আছে তাঁর সেই প্রাণের কলকাতার একাল সেকাল। তাঁর ভাষায় বলতে গেলে তখনকার কলকাতার রাস্তায় বাস চলত না, লরি চলত না, মটরগাড়ির রমরমা ছিল না, ছিল না — সিনেমা, রেডিও, টিভি, ফ্রিজ, টেপ রেকর্ডার, ফাউন্টেন পেন, ডটপেন, রান্নার গ্যাস, প্রেসার কুকার আরও কত কি! কিন্তু যেটা ছিল সেটা যে এখনকার যুগে দুর্লভ। সেই সময় শান্তি ছিল, স্বস্তি ছিল, আর ছিল ভালবাসা। অবাক লাগে, তাই না?!! সাহিত্য জিনিসটা সব জায়গায় বোধ হয় একই রকম। আর এ তো রীতিমত সত্য কথা। আমাদেরও মনে হয় সেই ছোটবেলার ঢাকা আর এখনকার ঢাকার মধ্যে কী বিস্তর পার্থক্য! কয়েক বছর আগের নানী-দাদী বাড়ির সাথে যেন এখন কয়েক যুগের তফাৎ। খুব বেশিদিন হয়ও নি। কিন্তু মনে হয় এই তো সেই দিন। নাইনটিস কিডস নিয়ে একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। যার সারাংশ এটাই ছিল। এখনকার যুগের কোন কিছুই আর ভালো লাগে না। মনে হয় আগের সময়টাই ভালো ছিল। নতুন একটা জিনিসও দুইদিন পর পর পুরানো হয়ে যায়। কিন্তু আগের জিনিসগুলোর আবেদন কোনদিনই যেন ফুরাবার নয়। একবিংশ শতাব্দীর বাচ্চারা মনে হয় সেটা কোনদিন বুঝতেও পারবে না। আমরা যারা নাইনটিস কিডস মোটেও আর কিডস নই এখন, সবাই গ্রোন আপ। কিন্তু মনে হয় এই না সেই দিন, কী অদ্ভুত সুন্দর দিন কাটাতাম...!!!
বইয়ের কথায় ফিরে আসি আবার। শুধু এই সাহিত্যভাবনা আর স্মৃতিকথা নয়, রীতিমত সাহিত্য আলোচনাও রয়েছে বইটাতে। আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, গজেন্দ্রকুমার মিত্র এবং যোগীন্দ্রনাথ সরকার এর সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনা। তাঁরা ছাড়াও আরও অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যাদের সাহচর্যে লেখিকা এসেছেন কিংবা আসতে পারেননি, তাঁদের প্রভাব কতখানি তাঁর জীবনে ছিল সে সম্বন্ধেও লিখেছেন। তাঁদের মধ্যে আছেন নরেন্দ্র দেব, কালিদাস রায়, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়, বনফুল, প্রেমেন্দ্র মিত্র, রাধারাণী দেবী, অনুরূপা দেবী, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, প্রমথনাথ বিশী, প্রভাবতী দেবী সরস্বতী, ডঃ রমা চৌধুরী, সৌম্যেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং আরও অনেকে। আর আছে সাহিত্য সম্পর্কিত তাঁর কয়েকটি ভাষণ। এমনিতে ভাষণ আমার খুবই অপ্রিয় জিনিসগুলোর ভিতর একটি। কিন্তু এই ভাষণগুলো খুব আগ্রহ নিয়ে পড়েছি। যাই হোক, এমনিতে লেখা অনেক বড় হয়ে গিয়েছে। এসব লিখতে গেলে আরও কয়েকগুন বড় হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে অসম্ভব ভালো লাগায় ভরিয়ে দেওয়ার মত একটি বই। পড়তে পড়তে কতগুলো লাইন যে মনে হয়েছে কোট করার মত তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। কিন্তু করা হয় নি সবগুলো। অল্প কয়েকটি করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাও সব মিলিয়ে একেবারে কম না। নন ফিকশন সাধারণত তেমন একটা পড়া হয় না। কিন্তু এখন এটা পড়ার পর থেকে মনে হচ্ছে এমন নন ফিকশন মাঝে মাঝেই পড়া উচিত। মনটাই ভালো হয়ে যায়।
ব্যক্তিগত রেটিং – ৫/৫
প্রিয় কিছু উক্তিঃ
১) “প্রায়শই আমরা অন্যমনষ্কতার মধ্যে বাস করে থাকি, তাই সৌভাগ্য যখন আসে তখন তাকে সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারি না। উপলব্ধিতে আসে তখন, যখন সেই সৌভাগ্যের ক্ষণটুকু হারিয়ে ফেলি।”
২) “সাহিত্য বিশ্বরহস্যের একটি পরম রহস্য। সাহিত্য শ্রদ্ধার বস্তু, সাহিত্য পবিত্রতার প্রতীক, সাহিত্য-চিরন্তনের বাহক। ‘কবিতা অমৃত, আর কবিরা অমর’।”
৩) “কথাশিল্পীকে এমন 'কথা' নিয়েই লিখতে হবে যাকে বর্তমানকালই নগদ বিদায় দিয়ে চুকিয়ে দেবে না, পরবর্তীকালও যার দেনা শোধ করবে।”
৪) “সাহিত্য চিরন্তন সত্যের বাহক, তার আবেদন ‘সত্তর’ আর ‘সতেরো’ দুজনের কাছেই সমান। একেই হয়তো ধ্রুপদী সাহিত্য বলা হয়।”
৫) “গল্পই তো কল্পনার জোগানদার। শোনা গল্প যদি অবাধ বিচরণের উন্মুক্ত প্রান্তর হয়, তো পড়া গল্প ফ্রেমে আঁটা নিসর্গ দৃশ্য।”
৬) “সাহিত্য বহন করে আসছে মানুষের অন্তরের শ্বাশত বাণী, আর সংস্কৃতি বহন করে আসছে তার চিরন্তন উন্নতির চেতনা।”
৭) “প্রকৃতির নিয়মানুসারে, প্রয়োজনের খাতিরেই সমাজে বিপ্লব আসে। যুগে যুগে কালে কালে সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্ত্তনের কাজ চলে। সাহিত্য তার কাজ কিছু এগিয়ে দেয়।”
৮) “রবীন্দ্রনাথের দান আমাদের জীবনে আলোবাতাসের মতোই সহজ। তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি ক’রে মুগ্ধ হওয়া যায়, সমালোচনা করা যায় না।”
৯) “জাতীয় সম্পদের প্রতি এই যে শ্রদ্ধার অভাব, এও এক প্রকার অপসংস্কৃতি।”
১০) “একজন সহকর্মীর বিয়োগ, জীবনের একটি পরম শিক্ষা।”
১১) “সাহিত্য কোনো একটি ‘অঞ্চলে’র পটভূমিকাতেই গড়ে ওঠে! তবু সে যখন সেই ‘অঞ্চলে’র আবেষ্টন কাটিয়ে বিশ্ব পরিক্রমায় বার হয়, সীমার মধ্যে অসীমের স্পর্শ এনে দেয়, তখনই সে সার্থক হয়ে ওঠে। দীর্ঘ, বলিষ্ঠ, ঋজু, সতেজ এই সাহিত্যে সেই অসীমের স্পর্শের স্বাদ আছে।”
১২) “আমরা বিরাটের কাছে মাথা নোয়াই, নোয়াতে ভালবাসি, কিন্তু যদি দেখি সেই বিরাটের মধ্যেও আমাদেরই মত সহজ স্বাভাবিক সুখদুঃখবোধ রয়েছে, তা’হলে খুশী না হয়ে পারিনা। এটুকু যে আমাদের প্রশ্রয় দিয়ে কাছে টানে।”
১৩) “চোখকে যদি মনের দর্পণ বলা হয়, তো চিঠিকে বলা যেতে পারে মনের ফটোগ্রাফ। মনের এক একটি মেজাজ, এক একটি অনুভবের মুহূর্ত, এক একটি অবস্থা ধরা পড়ে বন্দী হয়ে থাকে চিঠিপত্রের পৃষ্ঠায়। আর এই টুকরো মুহূর্তগুলিই তো মানুষের প্রকৃত রূপকে ফুটিয়ে তোলে।”
১৪) “সমাজ ও সাহিত্য একে অপরের পরিপূরক, কাজেই সাহিত্যিক যদি যথেচ্ছাচার করেন তবে অধিকার ভঙ্গ করা হয়। তাঁকে ভাবতে হয় তাঁর লেখার মূল্য আছে। এবং তাঁর দায়বদ্ধতা আছে সমাজের কাছে। সাহিত্যিকের কাজ উত্তরণের পথ দেখানো। শুধু বানিয়ে লেখা নয়। আসলে সাহিত্যিকের কাজ হচ্ছে নিজেকে প্রকাশ করা। প্রতিকারের চিন্তা করাও সাহিত্যিকের কাজ নয়। সে কাজ সমাজ সংস্কারকের। নিজেকে ঠিকমতো প্রকাশ করতে পারলে সন্তোষ, না পারলে যন্ত্রণা। নিজের কাছেই জবাবদিহি করতে হয়।”
১৫) “সাহিত্যকে যদি এক একটি কালের অথবা এক একটি ভাষার গণ্ডির মধ্যে খণ্ডমূর্তিতে দেখা হয়, সেটা ঠিক দেখা হবে না। তার সেই খণ্ড বিচ্ছিন্ন নানামূর্তির ঊর্দ্ধে আর এক অখণ্ড মূর্তি বিরাজিত, সে হচ্ছে যুগ যুগান্তর সঞ্চিত মানস চেতনার একটি অবিচ্ছিন্ন চিন্তাধারার আলোক। সেই আলোকধারা যুগের সঙ্গে যুগের সেতু নির্মাণ করে চলেছে অতীত থেকে ভবিষ্যতে।
এইখানেই সাহিত্যের অপরিহার্যতা, এইখানেই সাহিত্যের মূল্য। সাহিত্য অতীতকে রক্ষা করে, বর্তমানকে সমৃদ্ধ করে আর উত্তরকালের জন্য সঞ্চয় করে।”
১৬) “সাহিত্য চিরদিনই দুঃসাহসিক অভিযানের যাত্রী। প্রতি পদক্ষেপই তার নতুন পরীক্ষায় চঞ্চল। বন্ধুর পথকে জয় করতে পারায় তার উল্লাস। তাই অহরহই তার ভাঙা গড়ার খেলা। প্রতিনিয়তই সে পরীক্ষা নিরীক্ষায় অস্থির। এই অস্থিরতাই সাহিত্যের ধর্ম।
বিশেষ কোনো একটি মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছে, বিশেষ কোনো একটি দর্শনের সত্যকে আঁকড়ে ধরে, বাকী কালটা গুছিয়ে বসবে, এমন পাত্র সাহিত্য নয়। সাহিত্য নদীর সমগোত্রীয়, সরোবরের নয়।”
১৭) “মলাটের চেহারা কতোটা চিত্তাকর্ষক করতে পারলে বই কতোখানি চিত্তাকর্ষক হতে পারে, সেই চিন্তায় মাথা ঘামাচ্ছি আমরা।
অবশ্য সারা পৃথিবী জুড়ে তো এখন মলাটেরই যুগ চলছে।
মানুষ তো শুধু জিনিসের ওপরেই বাহারের মলাট দিচ্ছে না, জীবনের ওপরেও মলাট দিচ্ছে। যার যা মূল্য ধার্য হচ্ছে সে ওই মলাটের বাহার দেখে।”
১৮) “আপাতদৃষ্টিতে যাকে সুখী মনে হয় সে হয়তো আদৌ সুখী নয়, আবার যাকে নেহাৎ দুঃখী মনে হয় যে সত্যিকারের দুঃখী নয়। বাইরের চেহারা আর ভেতরের চেহারা দুটোর মধ্যে হয়তো আকাশ পাতাল তফাৎ।”
১৯) “নারী ছলনাময়ী, নারী জন্ম অভিনেত্রী। কিন্তু সে কি শুধু পুরুষজাতিকে মুগ্ধ করবার জন্যে? বিভ্রান্ত করবার জন্যে? বাঁচবার জন্যে নয়? আশ্রয় দেবার জন্যে নয়?”
২০) “কথা’ই তো ‘জীব’ জগৎ থেকে মানুষ জাতটাকে পৃথক করেছে, তাকে উত্তরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে, উন্মত্ত নিয়ে চলেছে। কথাই সভ্যতার বাহন, সংস্কৃতির বাহন। কথা আর তখন ‘কথা’ মাত্র না থেকে হয়ে উঠেছে ‘কথা শিল্প।’
কথাই ‘বাণী’, কথাই ‘ব্রহ্ম’। কথার মধ্যেই মানুষের অস্তিত্ব, কথার মধ্য দিয়েই মানব মনের মুক্তি। সে মুক্তি স্রষ্টারও, ভোক্তারও।”
২১) “সাহিত্য চিরদিনই দুঃসাহসিক পথের যাত্রী। তার প্রতিপদক্ষেপেই নতুন পরীক্ষায় চঞ্চল।
দুর্গমকে অতিক্রম করাতেই তার উল্লাস।
দুরূহকে নিয়ে খেলা করাতেই তার আনন্দ। অফুরন্ত রহস্যময় মানব চিত্তের জটিল ধাঁধার উপর আলো ফেলে ফেলে তার যাত্রা।
তাই প্রতি নিয়তই সে অস্থির।
এই অস্থিরতাই সাহিত্যের ধর্ম, এই অস্থিরতার মধ্যেই সাহিত্যের অস্তিত্ব।
বিশেষ কোনো একটি মহৎ লক্ষ্যে পৌঁছে, বিশেষ কোনো একটি সত্য’কে আঁকড়ে ধরে বসে বাকি কালটা গুছিয়ে বসে থাকবে, এমন পাত্র সাহিত্য নয়। সে নদীর মতো অহরহই ভাঙ্গন ধরাবে, পলি পড়াবে।
সাহিত্য তো জীবনেরই রূপায়ণ।
যে জীবন মুহূর্তে মুহূর্তে নতুন চেতনায় দুর্বার, নতুন উপলব্ধিতে উদ্ভাসিত, নতুন মূল্যবোধে উচ্চকিত, সাহিত্য কি সেই যুগজীবনকে অস্বীকার করবে?
যে যুগ অফুরন্ত সমস্যায় কণ্টকিত, অফুরন্ত যন্ত্রণায় দিশেহারা, দমবন্ধ বাতাসে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না, সেই যুগের সাহিত্যে স্নিগ্ধ প্রশান্তির আশা করা যায় না।”
২২) “হয়ত যাকে হিংস্র অত্যাচারী বলে মনে হয়, সে মূলতঃ হিংস্র নয়, অত্যাচারী নয়, অবোধ মাত্র। তার বোধহীনতাই অত্যাচারীর চেহারা নেয়। আবার এও দেখেছি মানুষ সবচেয়ে অসহায় নিজের কাছেই। তা সে নারী পুরুষ উভয়েই। সেই অসহায়তা থেকে তার উদ্ধার নেই। আবার হয়তো সে নিজের সবচেয়ে 'অচেনা'। তাই একদা যে জীবনটিকে পরম মুল্যবান ভেবে হৃদয় দিয়ে লালন করে এসেছে, এক মুহূর্তেই তা একান্তই মুল্যহীন হয়ে যেতে পারে।”
২৩) “জীব মাত্রেরই জীবন নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে একটা দুর্বার ভয়কে কেন্দ্র করে। সে ভয় মৃত্যুভয়। এ ভয়কে জয় করবার সাধনা কঠিন। তাই জীব এই ভয়কে চোখ বুজে অস্বীকার করতে চায়।...যা অলঙ্ঘ্য তাকেই লঙ্ঘন করবো। যা অপ্রতিরোধ্য তাকে কিছুতেই নিশ্চিত বলে ভাববোনা। এই হচ্ছে মানুষের চিত্তবৃত্তি!
তাই মৃত্যুকে আমরা কিছুতেই দিন রাত্রির মতোই সহজ বলে মেনে নিতে পারি না। তাই প্রিয়জনকে হারিয়ে ফেলে উন্মত্ত শোকে আত্মহারা হই।”
বিঃদ্রঃ – বইটি পড়ার পর গত বছর এই রিভিউটি গুডরীডসে লিখেছিলাম। বইয়ের কোটগুলোও সেখানে তখন অ্যাড করে দিয়েছিলাম।
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:৪৬
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: অনেক ধন্যবাদ
২| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৫:৪১
রাকু হাসান বলেছেন:
আট নম্বর টা ভীষণ ভালো লাগলো । সত্যি রবীন্দ্রনাথের সাহিত্যকর্ম এমনই । তাঁকে নিয়ে সমালোচনা করার মত মেধা ,মনন,জ্ঞানই বা ক’জনের আছে । অবাক লাগছে পোস্ট প্রথম পাতায় যাচ্ছে না কেন ! নাকি ইচ্ছাকৃত ভাবে দিচ্ছেন না ।
০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:৩০
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: ঠিক। বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ - উনবিংশ শতাব্দীতে জন্মগ্রহণ করা এসব সাহিত্যিকদের সাহিত্যকর্ম কোনদিন পুরানো হবার নয়। তাই এগুলো নিয়ে সমালোচনা করার দুঃসাহস করার আগে অমন লিখতে পারার ক্ষমতা অর্জন করা উচিত বলে আমি মনে করি।
আর আমি যতদূর জানি সেফ হলে লেখাগুলো প্রথম পাতায় যায়। যার জন্য অনেক বেশি পোস্ট আর মন্তব্য করতে হয়। কিন্তু ব্যস্ততার কারণে আমার এই দুটো করার সময় হয়ে উঠে না। সামুতে আসি অনেকদিন পর পর। কোন পোস্ট না পড়ে তো আর মন্তব্য করা যায় না।
পড়ার জন্য এবং মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।
৩| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১:২৬
রাকু হাসান বলেছেন:
আর আমি যতদূর জানি সেফ হলে লেখাগুলো প্রথম পাতায় যায়। যার জন্য অনেক বেশি পোস্ট আর মন্তব্য করতে হয়
তা ঠিক । এখন মডুরা অনেক উদার । কেউ কেউ এক দুইটা পোস্ট করেই সেফ হচ্ছে । সবার ক্ষেত্রে এটা হচ্ছে । সে ক্ষেত্রে আপনি কেন হবেন না ! কোনো কারণে হয়তো মডুরা আপনার নিক নজরে আসছে না । নোটিশ বোর্ড দেখতে পারেন । হয়তো সেফ করে দিয়েছে ,না হলে একটু অনুরোধ রাখতে পারেন । ভালো লেখে যদি প্রথম পাতায় লেখা না যায় ,খারাপ লাগে । আপনার মন্তব্যে একজন ভালো মানের পাঠকের ছাপ স্পষ্ট । সুন্দর প্রতি উত্তর ।
১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৩
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: কি জানি কেন হচ্ছে না। যদিও আমার লেখার আপাতত খুব বেশি সময় নেই। তারপরও সেফ হতে পারলে সবারই ভালো লাগবে।
ভালো মানের পাঠক কিনা জানি না। তবে পড়তে আমি খুব পছন্দ করি। আগে পড়া হত অনেক বই। কিন্তু কয়েক বছর ধরে আর তেমন একটা পড়া হয়ে উঠছে না। তারপরও একটু সময় পেলে অবসর কাটে হয় বই পড়ে আর না হয় মুভি দেখে।
আর ভালো লাগলো ভাইয়া আপনার কমেন্ট পেয়ে। ব্লগে আসার প্রথম থেকে যেভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন সেটার কোন তুলনা হয়না। ভাল থাকবেন সবসময়।
৪| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:০৭
মনিরা সুলতানা বলেছেন: চমৎকার রিভিউ ! দারুণ !!!
প্রিয় তে রাখলাম পোস্ট টা।
১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ২:৫৭
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: অনেক অনেক ধন্যবাদ আপু মন্তব্য এবং প্রিয়তে রাখার জন্য।
৫| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৮:২২
স্বপ্নীল ফিরোজ বলেছেন: সুন্দর।
১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪০
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: ধন্যবাদ
৬| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৪৫
অপু দ্যা গ্রেট বলেছেন:
আমার অনেক প্রিয় একজন লেখিকা । তার বই সংগ্রহ করে পড়েছিলাম । এখন নিজের সংগ্রহে নিয়ে আসব ।
শুভ কামনা ।
১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১০:৫০
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: আমারও অসম্ভব প্রিয় একজন লেখিকা। তাঁর লেখা যত বই পড়েছি তার ভিতর বেশিরভাগই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়া। তাঁর রচনাবলী কেনার ইচ্ছা আছে ভবিষ্যতে।
মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ।
৭| ১০ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৫১
আখেনাটেন বলেছেন: চমৎকার একজন লেখিকাকে নিয়ে লিখেছেন।
ছোটকালে উনার অনেক বই বাড়িতে দেখতাম। কয়েকটা মনে হয় পড়েওছিলাম। এখন আর মনে নেই। অাশাপূর্ণা দেবী ও মহাশ্বেতা দেবী বাংলা সাহিত্যের অমর দিকপাল হয়েই থাকবেন। শেষের জন তো নোবেলের জন্যও মনে হয় মনোনীত হয়েছিলেন বেশ কবার।
১১ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১২:০৭
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: তাই? এটা জানা ছিল না। মহাশ্বেতা দেবীর আমি মাত্র দুটো বই পড়েছি - হাজার চুরাশির মা ও অরণ্যের অধিকার। নিঃসন্দেহে তিনি ভালো লিখেন। তবে আশাপূর্ণা দেবীর লেখা আমার একটু বেশি প্রিয়। যদিও প্রতিটি সাহিত্যিক নিজ নিজ জায়গায় অনন্য। তাই তুলনা খাটে না।
আশাপূর্ণা দেবী শিশু সাহিত্যও লিখেছেন। হয়তো সেগুলো পড়ে থাকতে পারেন। আমি ছোটবেলায় তাঁর কিছু গল্প পড়েছিলাম। কিন্তু সেগুলো কি গল্প ছিল সেটা মনে নেই। ছোটবেলার বেশির ভাগ বইগুলো অনেকে নিয়ে আর ফেরত দেয়নি। আর বড় হওয়ার পর আমার আম্মু ছোট ছোট কাজিনদের আমার ছোটবেলার বেশিরভাগ বই দিয়ে দিয়েছে। বলাই বাহুল্য আমার প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও। সে যাই হোক, বড় হওয়ার পর বুঝতে পেরেছে কী অসাধারণ লেখনী তাঁর। প্রথম প্রতিশ্রুতি আর সুবর্ণলতা পড়ে তাঁর ফ্যান হয়েছিলাম। এরপরে আরও অনেক বই পড়েছি। কিন্তু এই দুটো আমার সব থেকে বেশি প্রিয়।
ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। ভালো লাগলো।
৮| ১২ ই নভেম্বর, ২০১৮ সন্ধ্যা ৭:০৫
ফারিহা হোসেন প্রভা বলেছেন: উক্তিগুলো ভালো লেগেছে অনেক অনেক......
১৩ ই নভেম্বর, ২০১৮ বিকাল ৩:৫৬
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: উক্তিগুলোই ভালো লাগার মত ছিল। ধন্যবাদ আপু মন্তব্যের জন্য।
৯| ১৬ ই নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৪০
সনেট কবি বলেছেন: সুন্দর
২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ১১:৫০
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: মন্তব্যর জন্য ধন্যবাদ। ভাল থাকবেন।
১০| ২২ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৩৯
রাজীব নুর বলেছেন: চমৎকার একটি পোষ্ট।
২২ শে জুলাই, ২০২০ বিকাল ৪:৪৯
স্বরচিতা স্বপ্নচারিণী বলেছেন: মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। ভালো থাকবেন।
©somewhere in net ltd.
১| ০৯ ই নভেম্বর, ২০১৮ দুপুর ১:২০
আর্কিওপটেরিক্স বলেছেন: মুগ্ধতার ছোঁয়া রেখে গেলাম