![]() |
![]() |
নির্বাচিত পোস্ট | লগইন | রেজিস্ট্রেশন করুন | রিফ্রেস |
নূহ-উল-আলম লেনিন
জরুরি অবস্থা জারির পূর্বশর্ত এবং জরুরি আইনের বিধানাবলী সম্পর্কে উল্লিখিত বিবরণী বা ভাষ্যের কথা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে এতো দীর্ঘকাল জরুরি অবস্থা বহাল রাখা যে যুক্তিসঙ্গত নয়, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়েই যেখানে প্রশ্ন রয়েছে, সেখানে জরুরি অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন করলে, সেই নির্বাচনের বৈধতাও যে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে সরকারকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে। সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদ রহিত করলে অর্থাৎ জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে না বলে যে ধারণা প্রচার করা হয় তা বিভ্রান্তিকর।
সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষিত হয়েছে। সরকারের পরিকল্পনা ছিল অক্টোবরে উপজেলা নির্বাচন সম্পন্ন করার পর সংসদ নির্বাচন দেয়া। পক্ষান্তরে দেশের প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলের দাবি ছিল সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন নয়।
সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর দাবির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ১৮ ডিসেম্বর সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পাশাপাশি ২৪ ও ২৮ ডিসেম্বর উপজেলা নির্বাচনেরও তারিখ ঘোষণা করেছে।
রাজনৈতিক দলগুলো সর্বাগ্রে সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে স্বাগত জানালেও এতো স্বল্প সময়ের ব্যবধানে উপজেলা নির্বাচনের তারিখ ঘোষণাকে অবাস্তব ও অগ্রহণযোগ্য বলে তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক দলগুলোর এ বক্তব্যে সারবত্তা রয়েছে। অন্য কোনো মতলব হাসিল অথবা বিশেষ কোনো লক্ষ্য অর্জনের কৌশল না থাকলে নির্বাচন কমিশন ও সরকার সংসদ নির্বাচনের এক বা দেড় মাস পরে উপজেলা নির্বাচনের তারিখ ও তফসিল ঘোষণা করলে নির্বাচন নিয়ে কোনো সংশয় বা বিতর্কের অবকাশ থাকতো না।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো বড় রাজনৈতিক দলগুলোর আর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হচ্ছে, নির্বাচনের আগে জরুরি অবস্থা সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে নিতে হবে। প্রধান উপদেষ্টা জাতির উদ্দেশে ভাষণে অঙ্গীকার করেছেন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জরুরি অবস্থা ‘রহিত বা শিথিল করা হবে।’ এমনকি তার ভাষণে জরুরি অবস্থার মধ্যে অনুষ্ঠিত ৪টি সিটি করপোরেশন ও ৯টি পৌরসভার অবাধ নিরপেক্ষ সুষ্ঠু ও সাফল্যজনক নির্বাচনের কথাও উল্লেখ করেছেন। তবে রাজনৈতিক দলগুলো মনে করে জরুরি আইনের খ—গ ঝুলিয়ে রেখে ভয়-ভীতির পরিবেশে অবাধ-নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হবে না। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও জরুরি অবস্থার মধ্যে সংসদ নির্বাচনকে গ্রহণযোগ্য মনে করেন না। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলে দিয়েছে জরুরি অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন করলে নির্বাচন পর্যবেক্ষণে ইইউ তাদের প্রতিনিধি পাঠাবে না।
আসলে ১/১১-এর যে পরিস্থিতির পটভূমিতে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছিল, এখন আর সে পরিস্থিতি বিরাজ করে না। এতো দীর্ঘদিন জরুরি অবস্থা বহাল রাখার কোনো দৃষ্টান্তও আমাদের দেশে নেই। অতীতেও কখনো জরুরি অবস্থার মধ্যে সংসদ নির্বাচন হয়নি। এ অবস্থায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে হলে সরকারের উচিত হবে অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নেয়া। তবে জরুরি অবস্থার মধ্যে নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলের মধ্যে যে সংশয় সন্দেহ রয়েছে, সে বিষয়টিও পরিষ্কার হওয়া দরকার। অনেকেই আছেন জরুরি আইনের তাৎপর্য ভালোভাবে বোঝেন না। আমার মনে হয়েছে এ বিষয়টি আর একটু খোলাসা হওয়া দরকার। এ নিবন্ধে আমি চেষ্টা করবো আমাদের সংবিধানের আলোকে জরুরি অবস্থা সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষ্য তুলে ধরতে।
কোনো রাষ্ট্রে বা দেশে বহিরাক্রমণ, অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, গৃহযুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব অথবা জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপন্ন হলে অথবা বিপন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে সরকার দ্রুত পরস্থিতি সামাল দিতে যে আপদকালীন আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে, এক কথায় তাকেই ‘জরুরি অবস্থা’ বলা হয়।
জরুরি অবস্থা হতে পারে দুই ধরনের। যুদ্ধকালীন ও শান্তিকালীন। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থা বলতে বোঝায় কোনো দেশ অন্য এক বা একাধিক দেশের দ্বারা আক্রান্ত হয়ে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিকে। শান্তিকালীন জরুরি অবস্থা হতে পারে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত কারণে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া বিশ্বের প্রায় সকল দেশের সংবিধানেই জরুরি অবস্থার বিধান রয়েছে। সাধারণভাবে জরুরি অবস্থায় বেশিরভাগ দেশেই অধিকাংশ মৌলিক অধিকার রহিত বা সঙ্কুচিত করা হয়ে থাকে। তবে জার্মানি ও সিঙ্গাপুরের মতো কোনো কোনো অগ্রসর গণতান্ত্রিক দেশে জরুরি অবস্থায়ও মৌলিক অধিকার স্থগিত করার বিধান নেই। বৃটেনে অভ্যন্তরীণ গোলযোগের কারণে শান্তিকালীন জরুরি অবস্থায় (১৯২০ ও ১৯৬৪ সালের জরুরি আইন অনুযায়ী) কোনো নাগরিক অধিকার স্থগিত করা যায় না এবং এমনকি আদালতেও অধিকার বলবৎকরণের ব্যবস্থাকে সীমিত করা যায় না। ভারতে সংবিধানের ৪৪তম সংশোধনীর মাধ্যমে সংবিধানের ৩৫৯ নম্বর অনুচ্ছেদে বিধান করা হয়েছে যে, জরুরি অবস্থার সময় কোনো কারণেই সংবিধানের ২০ ও ২১ অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকার স্থগিত করা যাবে না।
১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে জরুরি অবস্থার কোনো বিধান ছিল না। ১৯৭৩ সালের ৯ সেপ্টেম্বর সংবিধান সংশোধন (দ্বিতীয় সংশোধনী) করে জরুরি অবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ সংশোধনীর ১৪১ক (১) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে : ‘যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ গোলযোগের দ্বারা বাংলাদেশ বা উহার যে কোনো অংশের নিরাপত্তা বা অর্থনৈতিক জীবন বিপদের সম্মুখীন’ হলে রাষ্ট্রপতি জরুরি অবস্থা ঘোষণা করতে পারবেন।
‘যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ’-এর বিষয়টির ব্যাখ্যা বা সংজ্ঞা আন্তর্জাতিক আইনে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত থাকলেও ‘অভ্যন্তরীণ গোলযোগ’ কথাটির কোনো সংজ্ঞা বা ব্যাখ্যা আমাদের সংবিধানে অথবা দেশের অন্য কোনো আইনেও দেয়া হয়নি। ফলে অভিধাটি অস্পষ্ট থেকে যায়। এর ফলে নির্বাহী কর্তৃপক্ষের ক্ষমতার অপব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হয়।
বাংলাদেশে মোট পাঁচবার জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়
প্রথমবার: ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বরÑ বঙ্গবন্ধু কর্তৃক, দুর্ভিক্ষাবস্থার পর, বাকশাল গঠনের প্রাককালে;
দ্বিতীয়বার: ১৯৮১ সালের ৩০ মেÑ বিচারপতি আবদুস সাত্তার কর্তৃক, জিয়াউর রহমানের হত্যাকা-ের পরিপ্রেক্ষিতে;
তৃতীয়বার: ১৯৮৭ সালের ২৬ নভেম্বরÑ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ কর্তৃক, ‘৮৬-এর নির্বাচিত সংসদ বাতিল;
চতুর্থবার: ১৯৯০ সালের ২৭ নভেম্বরÑ লেফটেন্যান্ট জেনারেল এরশাদ কর্তৃক আন্দোলন মোকাবেলা ও গদি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে;
পঞ্চমবার: ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারিÑ দৃশ্যত : রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন কর্তৃক হলেও কার্যত সেনাবাহিনী সমর্থিত ড. ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক। ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারি অনুষ্ঠেয় সংসদ নির্বাচন বাতিল এবং অন্যান্য পদক্ষেপ।
যখনই জরুরি অবস্থা ঘোষিত হবে, তখনই সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার সম্পর্কিত ২৩টি অনুচ্ছেদের মধ্যে ৩৬, ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ এবং ৪২ নম্বর অনুচ্ছেদে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলো আপনা আপনি স্থগিত হয়ে যাবে। অর্থাৎ চলাফেরা, সভা, সমাবেশ, সংগঠন রাজনৈতিক কর্মকা-, মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, ট্রেড ইউনিয়ন অধিকার, পেশা বা বৃত্তির স্বাধীনতা এবং সম্পত্তির অধিকার প্রভৃতি জরুরি আইনের আদেশ দ্বারা স্থগিত, সীমিত বা হরণ করা যাবে। জরুরি অবস্থা চলাকালে অপর ১২টি মৌলিক অধিকার সাধারণত বলবৎ থাকার কথা। কিন্তু সংবিধানের ১৪১(গ) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী ওই ১২টি অধিকারের যে কোনোটির বা সবগুলোর বলবৎকরণ রাষ্ট্রপতির আদেশে স্থগিত করার বিধান আছে। অভিজ্ঞতা হচ্ছে এ দেশে যতোবার জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে, ততোবারই ওই ১২টি অধিকারও স্থগিত করা হয়েছে। ফলে কার্যত জরুরি অবস্থাকালে ধর্মীয় স্বাধীনতা সম্পর্কিত ১৪ অনুচ্ছেদ ব্যতিরেকে সকল মৌলিক অধিকারই অকার্যকর ও অর্থহীন হয়ে পড়ে।
বাংলাদেশের সংবিধানে সংসদ বিদ্যমান থাকা অবস্থায় জরুরি অবস্থা জারির একশ কুড়িদিন অতিবাহিত হওয়ার আগে সংসদে তা অনুমোদন করতে হবে। সংসদ ভেঙে যাওয়া অবস্থায় জরুরি অবস্থা ঘোষিত হলে নতুন সংসদ নির্বাচিত হওয়ার ত্রিশদিন অতিবাহিত হওয়ার আগে ওই ঘোষণা অনুমোদন করতে হবে। জরুরি অবস্থা ঘোষণা উল্লিখিত সময়ে সংসদে প্রস্তাবাকারে অনুমোদন না হলে সেটার আপনা আপনি অবসান হয়ে যাবে।
জরুরি অবস্থা জারির পূর্বশর্ত এবং জরুরি আইনের বিধানাবলী সম্পর্কে উল্লিখিত বিবরণী বা ভাষ্যের কথা বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশে এতো দীর্ঘকাল জরুরি অবস্থা বহাল রাখা যে যুক্তিসঙ্গত নয়, তা আর ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বৈধতা নিয়েই যেখানে প্রশ্ন রয়েছে, সেখানে জরুরি অবস্থা বহাল রেখে নির্বাচন করলে, সেই নির্বাচনের বৈধতাও যে প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে সরকারকে তা বিবেচনায় রাখতে হবে।
সংবিধানের ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০ ও ৪২ অনুচ্ছেদ রহিত করলে অর্থাৎ জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করে নির্বাচন করলে সে নির্বাচন শান্তিপূর্ণ ও সুষ্ঠু হবে না বলে যে ধারণা প্রচার করা হয় তা বিভ্রান্তিকর। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের দুটি নির্বাচনই শান্তিপূর্ণ, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য হয়েছিল। বিতর্ক ছিল ২০০১ সালের কারচুপির নির্বাচন নিয়ে। বস্তুত সরকার ও নির্বাচন কমিশন যদি নিরপেক্ষ থেকে তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে, সর্বোপরি নির্বাচনি আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করে, তাহলে জরুরি অবস্থা রহিত করেও একটি গ্রহণযোগ্য শান্তিপূর্ণ অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব হতে পারে। অন্যথায় জরুরি আইনের আওতায় নির্বাচন করলে তা ভবিষ্যতের জন্যও একটি খারাপ দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
দেশবাসীর প্রত্যাশাÑ সরকার জরুরি আইন প্রত্যাহার, হাসিনা-খালেদাকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগসহ রাজনৈতিক নিপীড়নমুক্ত পরিবেশ এবং উপজেলা নির্বাচনের তারিখ অন্তত দেড়/দুই মাস পিছিয়ে দিয়ে গণতন্ত্র উত্তরণের পথ উন্মুক্ত করবে।
নূহ-উল-আলম লেনিন: রাজনীতিক ও কলাম লেখক।
[email protected]
©somewhere in net ltd.